সবার জন্য স্বাস্থ্য | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : আধুনিক বিশ্বে স্বাস্থ্যখাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত। কারণ একটি স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ জাতিই সুষ্ঠু সুশৃঙ্খলভাবে উৎপাদনমুখী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে দেশকে উন্নয়নের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি, অবকাঠামোগত অনুন্নয়নের ফলে স্বাস্থ্যখাত তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সবার জন্য স্বাস্থ্য | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার
সবার জন্য স্বাস্থ্য
এ স্বাস্থ্যহীনতা পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা হতে উত্তোরণের লক্ষ্যে সরকার নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখাতে বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি স্বাস্থ্য খাতের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। কাজেই এ সমস্যার কারণ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্যসেবার বিরাজমান সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একটি সুন্দর, সাবলীল ও আত্মপ্রত্যয়ী সমাজগঠন করা জরুরি।
স্বাস্থ্যকাঠামো চিত্র : স্বাস্থ্য মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। মানুষ জীবদ্দশায় কতটা সাহায্য করতে পারে তা নির্ভর করে সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকার উপর। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের স্বাস্থ্য কাঠামো মোটেই গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪৫ ভাগ জনসংখ্যা স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশগম্য। এক্ষেত্রে অবশ্য বয়স, শিক্ষা, ধর্ম, আদর্শ, মূল্যবোধ দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদিসহ অন্যান্য সামাজিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ১২ ভাগ লোক চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে যায়।
বাকি লোকগুলো প্রথাবদ্ধ চিকিৎসার জন্য কবিরাজ, ফকির, সন্ন্যাসী, দরবেশ, মাজার, খাঁজা, আওলিয়া ইত্যাদির কাছে যায়। গতানুগতিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিভিন্ন চিকিৎসক বিভিন্ন কৌশলে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে ধর্মের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব রয়েছে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের মানত যেমন মিলাত পড়ানো, মাজারে দুধ, শিন্নি, ভাব ও বাতাসা দেয়া, গরু কুরবানি করা ইত্যাদি মানত করে রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন কোনো গতানুগতিক প্রথাই কাজে লাগেনা, তখন বাধ্য হয়ে তারা হাসপাতালে যায়।
হাসপাতালে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার এক্ষেত্রেও রয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্য। Good, ১৯৮৭ সালে দেখিয়েছেন— কেনিয়ায় ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত যেখানে শহরে ১ ঃ ৯০ সেখানে গ্রামীণ এলাকায় ১:৭,০০০০, Zaidi-এর এক হিসাব মতে— পাকিস্তানে ৭৮ ভাগ হাসপাতাল এবং ৯০ ভাগ হাসপাতাল বেড রয়েছে শহরে। আমাদের দেশেও এ দৃষ্টান্ত বিরল নয়। আমাদের দেশের গ্রামীণ লোকজন স্বাস্থ্যসেবা হতে বঞ্চিতই বলা যায়। আধুনিক চিকিৎসা সুবিধার সমুদয় ব্যবস্থাই শহরে। আবার শহরে এ আধুনিক হাসপাতালের সুযোগগুলো এলিটদের হাতে বন্দি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বয়স, শিক্ষা, পরিবার, আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, জাতিগত প্রবণতা এবং টাবু (Taboo) মানুষের স্বাস্থ্যসেবাকে প্রভাবিত করছে।
স্বাস্থ্যসেবায় সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব : স্বাস্থ্যসেবা মূলত দু ধরনের হতে পারে— একটি হলো প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা (Preventive health care), অপরটি নিরাময়মূলক স্বাস্থ্যসেবা (Curative health care)। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যচিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এখানে দু ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রচলিত ও বিদ্যমান। তবে নিরাময়মূলক বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এক্ষেত্রে বেশ জরুরি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) দেয়া সংজ্ঞাটি এখানে প্রণিধানযোগ্য।
‘Health is a state of physical, mental and social wellbeing not merely. The absence of disease or infirmity.’
তবে এক্ষেত্রে সংস্কৃতি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে । সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস, আচার- ব্যবহার, ভাষা, নৈতিকতা মূল্যবোধ, প্রথা, পদ্ধতি ইত্যাদির জটিল সমাবেশ। এদিকে খেয়াল রেখে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অপরদিকে, পরিবার থেকে একজন মানুষ স্বাস্থ্যসেবার নানা বিষয়াদি শিখে থাকে। পরিবার মানুষের আদর্শ, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, লোকাচার, লোকরীতি ইত্যাদির ভিত্তিতে তার খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, কাজ, প্রার্থনা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির ভিত্তি গড়ে ওঠে। এ কারণেই Litmas পরিবারকে ‘স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক ইউনিট’ বলেছেন।
একটি পারিবারিক সংস্কৃতি তথা সমাজই একটি মেয়েকে শিক্ষা দেয় ‘মহিলা গাইনি’ এবং পুরুষ পাইনির মধ্যে কোনো পার্থক্য নির্ধারণ করার প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো কে ভালো ডাক্তার এবং তার কাছেই যাওয়া প্রয়োজন। এ ধ্যানধারণায় আলোকিত হয়ে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেরই বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে। তাছাড়া ডাক্তার, নার্সসহ, হাসপাতাল কর্মরত লোকদের ব্যবহার এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে রোগীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এজন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনুকূল গঠনমূলক পরিবেশ তৈরি একান্ত কামা। এক্ষেত্রে Behavioural Change Communication গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সামাজিক ব্যবস্থাপনার ভূমিকা : চিকিৎসা সেবাকে দুটো স্তরে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করা যায়— একটি হলো থানা এবং তার নিম্নস্তর, অন্যটি জেলা এবং তার উপরের স্তর। থানা পর্যায়ের হাসপাতালে বেড বা শয্যা খালি থাকে । আর জেলা ও তার উপরের দিকে শয্যার ব্যাপক সংকট। এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান জরুরি। এছাড়া হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদেরকে সামাজিক, নৈতিক এবং মানসিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে এবং সাথে সাথে ডাক্তার নামসহ সবাইকে একটি কাঠামোর মধ্যে এনে পরিচালনা করা প্রয়োজন, যেখানে সবার জবাবদিহিতা থাকবে। এক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধিদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার সমন্বয়সাধন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অপরিহার্য। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনাই আলোর মুখ দেখতে পারে না। স্বাস্থ্য খাতও যে কলুষমুক্ত নয়। ফলে আমাদের দেশের জনগণ স্বাস্থ্যসেবার সময়মতো ও সঠিক ফল ভোগ করতে পারে না। এর ফলে সরকারের দেয়া বরাদ্দের টাকা স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহৃত না হয়ে কতিপয় আমলা, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পকেটস্থ হয়। বিষয়টি বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার নানা নিদর্শনের মধ্যে একটি। দেশে ডাক্তার, নার্স ও কনসালটেন্টের সমন্বয়হীনতা ও স্বাস্থ্যহীনতার প্রধান কারণ বলে বিবেচিত ও আলোচিত। কেননা, যেখানে ডাক্তার প্রয়োজন, যেখানে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে কনসালটেন্ট অব সার্জারি অথবা কনসালটেন্ট অব মেডিসিন।
অর্থাৎ একটা পদের বিপরীতে অন্য ডিসিপ্লিনের লোক নিয়োগ দেয়া হয়, যেটা সাধারণত তথ্য সমন্বয়হীনতার কারণ হতে পারে। তাছাড়া হাসপাতালের পরিবেশ রোগীর অনুকূলে রাখাই শ্রেয়। রোগী যে বেডে থাকবে তার বেডশিট, বালিশের কভার বা তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, যে নার্স তার সেবা করছে তার পোশাক পরিচ্ছদ এবং মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সার্বিক পরিবেশ রোগীর অনুকূলে রাখা আবশ্যক।
উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের সাথে স্বাস্থ্যখাতের সম্পর্ক : চিকিৎসা পদ্ধতিকে (System) তিনস্তরে দেখা যায়; যথা : মৃত্যু প্রতিরোধ, অসুস্থতা কমানো এবং স্বাস্থ্যের গুণগত উন্নয়ন। চিকিৎসা পদ্ধতির এ তিনটি স্তরের মধ্যে হাসপাতাল হলো ‘Life Saving Treatment’. মানুষ তখনই হাসপাতালে যায় যখন তার আর কোনো উপায় থাকে না।
কিন্তু বর্তমান অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে সেই ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা অনেক সময় দেয়া সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার প্রায় দশহাজার মানুষের জন্য একজন নার্স এবং প্রায় তিন হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালে একটি বেড রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সাধারণ রোগীর জন্য প্রতি দুটো বেডের বিপরীতে একজন নার্স। ইনটেনসিভ কেয়ারে একটি বেডের জন্য একজন নার্স এবং প্রতি একজন ডাক্তারের জন্য তিনজন নার্স প্রয়োজন ।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে একটি বড় ধরনের অনুন্নয়নের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতাসহ অন্যান্য কারণও এ অনুন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী King কিছু সমস্যার কথা বলেছেন যেগুলো অনুন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি করে। যেমন- সম্পদের স্বল্পতা, পর্যাপ্ত জনশক্তির অভাব, যন্ত্রপাতি, শিক্ষা, বাসস্থান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের স্বল্পতা, অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ত্রুটিযুক্ত বিতরণব্যবস্থা ইত্যাদি স্বাস্থ্যসেবাকে বাধাগ্রস্ত করে। ইপিআই-এর ব্যাপক সাফল্য বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে। মহিলাদের Reproductive Age-এর আগে যেখানে গড়ে সাতজন সন্তান জন্ম দিত, এখন সেটি ৩.৪-এ পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১৯৬০ সালে যেখানে পাঁচ বছরের নিচে ২৪৭ জন শিশু মারা যেত, সেখানে ১৯৯৬ সালে মারা যায় ১১২ জন। ইরিংগা এবং তানজানিয়াতে ও কমিউনিটি প্রোগ্রাম এবং এবং নিউট্রিশন-এর ব্যাপক সাফল্য দেখতে পাওয়া যায়, যাকে আন্তর্জাতিক মডেলের মর্যাদা দিয়েছে। এতদসত্ত্বেও শিশুমৃত্যুর হার এবং অপুষ্টির হার উন্নত বিশ্বের সথে তুলনা করলে অনুন্নত দেশগুলোতে ভয়াবহ চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে অসুস্থতা এবং অপুষ্টির কারণ হিসেবে সামাজিক অসমতা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক নির্যাতনকে দায়ী করা হয়। উন্নত বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ আমেরিকা যেখানে তার খাদ্যমান থেকে পুষ্টির পরিমাণ কমানোর জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে সেখানে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো (যেমন- বাংলাদেশ) পুষ্টিহীনতার সম্মুখীন হয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
যার ফলে দেশগুলো কর্মোদ্যমী জনসংখ্যা হারিয়ে আরো অনুন্নয়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ডায়রিয়ায় প্রতি বছর বাংলাদেশে হাজার হাজার শিশু মারা যায়। পাঁচ বছরের নিচে যত শিশু মারা যায় তার শতকরা ১৫ ভাগ মারা যায় এ ডায়রিয়ায়। Nabumichi Kobayashi এর মতানুসারে আন্ত্রিক পীড়া বা ডায়রিয়াল ডিজিজ এমন একটি বড় ধরনের ব্যাধি, যার দ্বারা উন্নয়নশীল বিশ্বে পাঁচ মিলিয়ন শিশু মারা যায়। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলো গ্রামীণ এলাকায় শতকরা ৬৩ ভাগ লোকের চমৎকার পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা রয়েছে।
বাংলদেশে এ আন্ত্রিক রোগ সমস্যা সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো গড়ে তুলতে না পারলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব আরো বাড়তে পারে। এজন্য প্রয়োজন কমিউনিটি অংশগ্রহণ, যার মাধ্যমে হাসপাতালের ওপর চাপ কমিয়ে নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা পালন করলে অনেক রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যেমন- ডায়রিয়ার জন্য প্রয়োজন খাবার স্যালাইন। বাংলাদেশ সরকারের পাঁচটি ইউনিট আছে খাবার স্যালাইন তৈরির জন্য । কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী পাঁচ বছরের নিচের শিশুর জন্যই দরকার ২৯ কোটি প্যাকেট স্যালাইন, যা সরবরাহ করা উক্ত ইউনিটগুলোর পক্ষে সব নয় ।
এ কারণে প্রতিটি পরিবার যদি স্যালাইন বানাতে শেখে ও ডায়রিয়ামুক্ত থাকার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে তাহলে সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগের ওপর চাপ কমবে। মোরলে এবং অন্যান্যদের মতে কমিউনিটি অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব, যার মাধ্যমে সমস্যা নির্ধারণ করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারে। এভাবে কোনো সম্প্রদায় জ্ঞান, দক্ষতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং সর্বেচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে। এতে সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আরো ভালো পাওয়া সম্ভব।
এভাবে কমিউনিটি অংশগ্রহণের প্রচলিত পেশাগত বা Formal Professional স্বাস্থ্য কাঠামো এবং স্থানীয় জনগণের জ্ঞান ও সম্পদ ব্যবহার করে উত্তম স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব। অবশ্য আরো কিছু নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, যেগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা প্রয়োজন, যাতে এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। স্মরণাতীতকাল থেকে আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব পৃথিবীতে লক্ষ করা যায়। উত্তরবঙ্গে ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে আর্সেনিক ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৯৭ সালে উত্তরবঙ্গে ১২টি জেলা আর্সেনিকে আক্রান্ত হয় এবং শতকরা ৮২ ভাগ নলকূপের পানিতে আর্সেনিক দূষণ পাওয়া যায়।
এ অবস্থার উন্নয়ন এবং জনগণকে আর্সেনিকের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন সংস্থা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পৃথিবীর আরেকটি বিপজ্জনক রোগ যেটি বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি AIDS নামে পরিচিত। Edward-এর মতে এ রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য পরিবার পরিকল্পনা এবং গর্ভনিরোধক সিদ্ধান্ত ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। PIB রিপোর্ট অনুসারে ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যে পৃথিবীতে ২১.৮ মিলিয়ন লোক HIV/AIDS আক্রান্ত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে, যার মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দা।
বাংলাদেশে AIDS ভাইরাসে আক্রান্ত লোকসংখ্যা কম হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে WHO-এর তথ্যানুযায়ী তিন-পাঁচ লক্ষ লোক আক্রান্ত, যার বৃদ্ধির গতি দিন দিন বাড়ছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের যেহেতু অবাধ যাতায়াত রয়েছে সেহেতু এ রোগ ভারত থেকে ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। তাই AIDS থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনগণকে সচেতন করে তোলা আবশ্যক । সামাজিক আন্দোলনকে সফল করতে পারলে তার সুফল পাওয়া সম্ভব ।
গ্রামে একজন লোক হঠাৎ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রাম্য-চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করা সম্ভব। নয় বলে তাকে হাসপাতালে নেয়া জরুরি। কিন্তু দ্রুতগতিসম্পন্ন কোনো যানবাহন কোনো কোনো এলাকায় থাকা তো দূরের কথা দুর্গম এলাকার কারণে অন্যত্র থেকেও আনা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় রোগী নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ তত্ত্বাবধানে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নেয়া সম্ভব হলেও ডাক্তার অনুপস্থিত থাকার কারণে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়।
যাই হোক, হাসপাতালের নার্স, এক্স-রে মেশিন, অপারেটর, মেডিক্যাল অ্যাটেনডেন্ট সবাইকে ম্যানেজ করে এবং মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ঠিক করে মৃতপ্রায় রোগীকে যখন ডাক্তারের টেবিলে নিয়ে যাওয়া যায় তখন তার অবস্থা শেষ। এ অবস্থার একজন রোগীকে কীভাবে নিরাময় করা সম্ভব সে সম্পর্কে চিন্তা- ভাবনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। এ প্রসঙ্গে WHO-এর মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সেক্টর যেমন- কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি, শিক্ষা এবং তথ্য পরিবেশসহ অন্যান্য অবকাঠামো ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব ।
স্বাস্থ্যহীনতার কারণ : স্বাস্থ্যহীনতা বাংলাদেশের একটি মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশে এ খাতে নানা সমস্যার জাল বিস্তার হয়ে আছে। একক ও সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যা এর জন্য দায়ী নয় বরং নানা প্রপঞ্চ এখানে ক্রিয়াশীল। নিচে স্বাস্থ্যহীনতার প্রধান কারণগুলো উল্লেখ ও আলোচনা করা হলো :
১. অতিরিক্ত জনসংখ্যা : আমাদের দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। অধিক জনসংখ্যা আধ্যুষিত দেশে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ দেশের শতকরা প্রায় ৬৫ জন লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, যাদের মাথাপিছু আয় মাত্র বছরে ১০০ মার্কিন ডলার। নিম্নআয় ও দারিদ্র্যের কারণে তাদের অনেকেই নিত্যদিনের মৌল মানবিক চাহিদাগুলোও যথাযথভাবে পূরণ করতে পারে না। ফলে ভগ্নস্বাস্থ্য রোগব্যাধি, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে।
২. মাদকাসক্তি : বাংলাদেশে দিনের পর দিন হেরোইন, কোকেন, গাজা, আফিম, মারিজুয়ানা প্রভৃতি মারাত্মক মাদকের ছোবলে অনেক তাজা প্রাণ অকালে বিনষ্ট হচ্ছে । মাদকাসক্তি স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে তাই একটি বড় ধরনের অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত।
৩. পুষ্টিহীনতা : পুষ্টিহীনতা বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৯৪% স্বাস্থাহীনতায় ভোগে।
৪. স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক জ্ঞানের অভাব : বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই অজ্ঞ ও নিরক্ষর। অজ্ঞতার কারণে পুষ্টিকর খাদ্য ও পুষ্টির মান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকার কারণে পুষ্টিজনিত নানা সমস্যায় তারা অবতীর্ণ ।
৫. কুসংস্কার : কুসংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস, গোঁড়ামির ফলে দেশের জনগণ বিশেষণ গ্রামীণ জনপথে স্বাস্থ্যহীনতার শিকার।
৬. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ : বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন সংক্রমিক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তাদের জীবনধারণ করতে হয়। এর ফলে তাদের স্বাস্থ্য নানা সমস্যায় জর্জরিত।
৭. ঔষধ ও খাদ্যে ভেজাল : খাদ্যে ভেজাল বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
৮. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রতি বছর ব্যাপক পরিমাণে স্বাস্থ্যহীনতা বৃদ্ধি পায়। বন্যা, খরা, মহামারি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেকাংশে স্বাস্থাহীনতার জন্য দায়ী।
৯. প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের অভাব : শরীরকে সুস্থ্য ও সবল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণেঝার ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে দৈনিক যেখানে ন্যূনতম মাথাপিছু ২৫ আউন্সের খাদ্য প্রয়োজন, সেখানে মাথাপিছু দৈনিক গড়ে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ১৫ আউন্স । অতএব, এতে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণের অভাবের কারণে স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে ।
১০. ধর্মীয় গোঁড়ামি ও বাল্যবিবাহ : ধর্মীয় গোঁড়ামিও বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী। তাছাড়া প্রতি বছর বাল্যবিবাহ ও ঘন ঘন সন্তান গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে বহুসংখ্যক নরনারী স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে গৃহীত কর্মসূচি : স্বাস্থ্যসেবা ব্যতীত কোনো জাতিই একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও সাবলীল জনশক্তি গড়ে তুলতে পারে না। স্বাস্থ্যহীনতা মানুষের কর্মদক্ষতা হ্রাস করে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন তথা জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব প্রভাব থেকে মানবজীবনকে উদ্ধার করতে হলে সর্বাগ্রে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এ সমস্যা হতে উত্তরণের জন্য স্বাস্থ্যসেবায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন ।
ক. স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি : দেশের অধিবাসীদের কল্যাণের জন্য স্বাস্থ্যখাতে এ পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তাতে জনগণের চিকিৎসা সুবিধা পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে, প্রতি থানায় থানায় স্বাস্থ্য কর্মপ্লেক্স স্থাপনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। দেশে চিকিৎসক তৈরির জন্য মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এ অবস্থা জোরদার করার প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা তেরটি এবং বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা চারটি।
তবে স্বাস্থ্যবিষয়ক এ পরিসংখ্যান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগ এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে, যা কিছু অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে তা দেশের বিপুল জনসংখ্যার জন্য অপ্রতুল বলে সরকারি পর্যায়ে এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সার্বিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বাংলাদেশ ও স্বাস্থ্যসেবায় জাতিসংঘের ঘোষিত পদক্ষেপ অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। সবার জন্য স্বাস্থ্য কর্মসূচি পালনের অঙ্গীকার তাই বর্তমান সরকার দৃঢ়তার সাথেই ঘোষণা করছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সব মানুষের দ্বারে চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে ।
খ. দারিদ্র্য দূরীকরণ : মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। আমাদের দেশে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সফল হচ্ছে না। ফলে দেশের মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে। এ দারিদ্র্যই আমাদের সফল উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। স্বাস্থ্য খাতেও এ বিরূপ প্রভাব আমাদেরকে অসহায় করে তুলেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি সম্ভব হলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মানও উন্নত হবে এ বিশ্বাসটি পোষণ করেই সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
গ. জনগণের আয় ও উপার্জন বৃদ্ধি : জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে তাদের আয় ও উপার্জন বৃদ্ধি করা জরুরি। কৃষি উন্নয়নের ব্যবস্থা করে চাষযোগ্য ভূমিতে একাধিক ও বহুমুখী ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়া হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনসহ বিভিন্ন শকসবজির বাগান তৈরি করে জনগণের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার দেশে বিরাজমান স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
ঘ. স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি : জনগণকে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত জ্ঞানদানের মাধ্যমে সরকার এ অবস্থা নিরসনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ও গ্রামীণ পর্যায়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
ঙ. কৃত্রিম পুষ্টি উৎপাদন : পুষ্টি সমস্যার সমাধানকল্পে স্থানীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত গাছপালা, ফলমূল, থেকে কৃত্রিম আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য প্রস্তুতপ্রণালী সম্পর্কে ধারাবাহিক গবেষণা করে কৃত্রিম পুষ্টি উদ্ভাবনের কাজ সরকারি পর্যায়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
চ. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান : স্বাস্থ্য সমস্যার ফলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ ব্যাপারে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে।
ছ. গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা : আধুনিক ও প্রচলিত সুযোগ-সুবিধা গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে গণমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গ্রাম এলাকায় শতকরা ৮৫ জন লোক বসবাস করে। এসব বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা চলছে।
জ. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : অতিরিক্ত জনসংখ্যা আমাদের দেশের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠেছে। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা কার্যক্রমকে জোরদার করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যহীনতা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
ঝ. বহুমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন : বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে কোনো স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়িত হয়নি। তাই বিরাজিত স্বাস্থ্যসমস্যা সমাধানের জন্য বহুমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নের জোর চেষ্টা চলছে।
ঞ. কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরীকরণ: ধর্মীয় গোঁড়ামি বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী। এ কুসংস্কার দূর করার জন্য জনগণকে সচেতন করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
ট. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেবাদান কার্যক্রম : স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সেবাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ঠ. প্রতিষেধক কার্যক্রম জোরদার : সংক্রামক ব্যাধি ও অন্যান্য মহামারি প্রতিরোধকল্পে ইউনিয়ন ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্তব্যরত সব কর্মচারীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষেধক কার্যক্রম জোরদারের প্রয়াস চালানো হয়েছে।
ড. মাতৃকল্যাণ ও শিশু স্বাস্থ্যকর্মসূচি চালু : স্বাস্থ্যসেবার মানউন্নয়নের জন্য গ্রাম ও শহর পর্যায়ে মাতৃকল্যাণ ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি চালু ও সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এ ব্যাপারে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানদানসহ সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
ঢ. পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধশিল্প স্থাপন : বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় উৎপন্ন ওষুধ ও ওষুধ শিল্পের পরিমাণ খুবই কম। ফলে সব লোকের চিকিৎসা চাহিদা সীমিত সংখ্যক শিল্পে উৎপন্ন ওষুধ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে সরকারি, বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৭. ধূমপানে অনুৎসাহ দান : বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতায় ধূমপান প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নগরে প্রায় ৩৭% এবং গ্রামে প্রায় ৬০% লোক ধূমপানে অভ্যস্ত। ধূমপানের কারণে যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার প্রভৃতি মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, যা বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসমস্যার মূল কারণ বলে বিবেচিত। সরকার রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে ধূমপানের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সোচ্চার। তাছাড়া সরকার ধূমপান নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছে।
ত. ওষুধ ও খাদ্যে ভেজাল দূরীকরণ : স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে খাদ্য ও ওষুধপত্রের দাম ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এক শ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ী খাদ্য ও ওষুধপত্রে ভেজাল মিশিয়ে ওষুধ ও খাদ্যের মানকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। ওষুধের ভেজাল দূর করার জন্য সরকারিভাবে নানা সিন্ডিকেট গঠন করা হয়েছে; আর খাদ্যের ভেজাল দূরীকরণে একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা দিয়ে তার মাধ্যমে অভিযান চালানো হচ্ছে।
খ. মূল্যায়ন : উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রতীমান হয় যে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন মহলের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি এ পর্যায়ে একটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প ।
শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা যথাযথ বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যৎ জীবনে স্বাস্থ্যসমস্যা অনেক কমে যাবে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য এ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি যথেষ্ট সাফল্য প্রদর্শন করেছে। পোলিও, যক্ষ্মা, হাম ইত্যাদি মারাত্মক রোগ থেকে শিশুদের রক্ষায় এ কর্মসূচি ইতোমধ্যে বেশ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। সারা দেশে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে শিশুমৃত্যুর হার ইতোমধ্যে হ্রাস পেয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে জনস্বাস্থ্যের মান আশানুরূপ সফলতা পেয়েছে। শিশুদের পুষ্টির অভাব দূর করার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
অপুষ্টি দূর করার জন্য ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল বিতরণ করা হচ্ছে এবং শিশুদের অন্ধত্বের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য রাতকানা রোগের প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশুদের সঙ্গে সঙ্গে মায়েদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্য সংরক্ষণে উপযোগী ব্যবস্থা গৃহীত হলে তা জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে সাহায্য করবে। সবার জন্য স্বাস্থ্য বিধানের লক্ষ্যে দেশে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধির বৈচিত্র্যধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশে প্রতি বছর বিসিএস-এর মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য হারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডাক্তার নেয়া হচ্ছে। ডাক্তারদের সেবার মান উন্নতকরণের লক্ষ্যে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে ।
উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে হাসপাতালগুলোকে বহুশয্যায় উন্নীত করা হচ্ছে। তাছাড়া আরো নতুন নতুন হাসপাতাল ও কমিউনিটি হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প, যা বিশ্বব্যাংক এবং ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে, এর ফলাফল মোটামুটি ভালো। এখানে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহযোগিতা দেয় এবং পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত তাদের সম্পৃক্ত করে। আবার ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেখানে EPI- এর কেন্দ্রগুলো, স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং সামাজিক পুষ্টি কেন্দ্রগুলো একই জায়গায় হচ্ছে।
এর ফলে জনগণ একই জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের সেবা নিতে পারছে। এজন্য জনগণকে আরো সুশৃঙ্খল এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য Bangladesh Medical Research Centre (BMRC) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। BMRC গত ১০ বছরে ৩৯টি প্রকল্প গ্রহণ করে, যার মধ্যে ২২টি বাতিল হয় এবং ১২টি ফলাফলসহ ফেরৎ আসে। এ হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। তাছাড়া বাংলাদেশের রেফারেন্স সিস্টেম খুবই দুর্বল বা নেই বললেই চলে । এজন্য দেখা যায়, জেলা ও থানা হাসপাতাল বেড খালি থাকে। অথচ ঢাকা মেডিক্যালসহ অন্যান্য হাসপাতালে বেডে ভর্তি হওয়ার জায়গা না পেয়ে বারান্দায় বা মেঝেতেও রোগী থাকে।
এজন্য একটি সমন্বিত রেফারেন্স সিস্টেম প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করার জন্য গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্রিত করে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। গ্রামের মানুষদের কথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চিন্তা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে অন্যান্য খাতের মতোই উৎপাদনশীল একটি খাত তা সবাইকে বোঝাতে হবে। আবার সরকারি অনুদান দিলেই যে স্বাস্থ্যখাত উন্নত হবে এ বিষয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এজন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা একান্তভাবেই জরুরি উন্নয়ন বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যাবে স্বাস্থ্য খাতের চেয়ে পরিবার পরিকল্পনা খাতে অনেক বেশি খরচ হয়।
অথচ স্বাস্থ্য খাত হলো সমগ্র জনসাধারণের আর পরিকল্পনা সমগ্র জনসাধারণের ২০ ভাগের জন্য । এজন্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসাসেবার আদর্শের ভিত্তিতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করা আবশ্যক। জাতিসংঘ এ নির্দেশিকার জন্য স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার সমন্বয় সাধন করে উন্নয়নের কথা বলেছে। তাছাড়া শিক্ষা, বাসস্থান, সরকারি কর্মচারি এবং সাথে সাথে Community Reproductive Health Information এবং স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সেবার কথা উল্লেখ করেছে, যা ২০১৫ সালের মধ্যে পূরণ করতে হবে।
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন- ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে পুষ্টির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সম্ভব। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে; যেমন- বাংলাদেশের পুষ্টি সমস্যা উন্নয়নের জন্য Bangladesh Nutrition Food Policy করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করার লক্ষ্যে এসব আরো কর্মসূচির প্রায়োগিকতা আবশ্যক ।
উপসংহার : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনুন্নয়নের ব্যাপক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে তা উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকেই দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে স্বাস্থ্যসেবাকে সুনিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ উন্নত বিশ্ব অনুন্নত বিশ্বকে সহায়তা করা প্রয়োজন । মোটকথা, স্বাস্থ্যসেবা তখনই কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। যখন মানুষ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করবে, যার ফলে একটি স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে দেশ তথা পৃথিবীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে।
আরও দেখুন: