এইডস তৃতীয় বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের এক মারাত্মক হুমকি | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : একুশ শতকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের মাঝেও বিশ্বব্যাপী এইডস জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে এটি এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি। সামগ্রিকভাবে বিশ্বে ঘাতকব্যাধি হিসেবে এর অবস্থান চতুর্থ। তবে সামগ্রিক বিচারে এটি সবচেয়ে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যাধি। এ রোগ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে তার সর্বনাশের মহাডংজ্ঞা বাজিয়ে চলেছে। বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এ রোগের প্রকোপ দেখে বিশ্ব সম্প্রদায় আজ মহাশঙ্কায়।
এইডস তৃতীয় বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের এক মারাত্মক হুমকি | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার
এইডস তৃতীয় বিশ্বের জনস্বাস্থ্যের এক মারাত্মক হুমকি
সবচেয়ে মারাত্মক বিষয় হলো, এ রোগে আক্রান্তদের অনেকেই জানে না যে সে এ রোগের ভাইরাস বহন করছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, নিজের অজান্তেই সে তার আপন জনের মাঝেই এর বিস্তার ঘটিয়ে চলছে। আর এতে অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণ, কোটি কোটি পরিবার তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে, দারিদ্র্য আর মানব বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে দেশের পর দেশ, অঞ্চলের পর অঞ্চল । শেষ পর্যন্ত এ ঘাতকব্যাধি মানব সম্প্রদায়কে কোন তিমিরে নিয়ে যাবে তাও কেউই বলতে পারবে না। অবশ্য বিশ্ববাসী ইতিমধ্যেই এ মহাঘাতকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছে।
এইডস কি : AIDS-এর পূর্ণরূপ হলো Acquired Immune Deficiency Syndrome বা স্ব- উপার্জিত অনাক্রম্যতার অভাবের লক্ষণাবলী। এটি একটি ধ্বংসাত্মক ব্যাধি, যা ভাইরাস সংক্রমণের মাধ্যমে রোগীর দেহে বাসা বাঁধে। এর ভাইবাসের নাম HIV (Human Immuno Deficiency Virus)। এটি মানবদেহে প্রবেশ করে তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এমনভাবে বিনষ্ট করে দেয় যে সাধারণ রোগের জীবাণু তখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে শরীরকে কুরে কুরে অকাল মৃত্যু নিশ্চিত করে। এইচআইভি ভাইরাস অন্যসব ভাইরাসের মতোই।
তবে এর কার্যপদ্ধতি ভিন্ন ধরনের। এ ভাইরাসের কেন্দ্রসমূহের RNA-এর চতুর্দিকে প্রোটিনের দুটি স্তর ও চর্বিযুক্ত পর্দা দ্বারা শক্তভাবে আটকানো থাকে। উপকরণাদির সাথে নানা প্রকার জারকরস বা এনজাইম থাকে যার মধ্যে reverse transcriptase প্রধান। নিজের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ভাইরাস এ এনজাইম ব্যবহার করে। কিছু RNA, কিছু প্রোটিন, গ্লাইকোপ্রোটিন এবং চর্বিঝিরি মিলে এ ভাইরাস গঠিত হয়। নির্দিষ্ট প্রকার দেহকোষের ওপর সঠিক গ্রাহক বা রণডণর্যমর থাকলে সে ধরনের কোষের সঙ্গে ভাইরাস সংযুক্ত হতে পারে।
HIV-এর আক্রমণের জন্য এ ধরনের আমাদের শরীরের কোষ হচ্ছে লিম্ফোসাইট (T4 Lymphocyte)। HIV- এর আক্রমণের ফলে T4 Lymphocyte দ্বারা শরীরের যে অনাক্রম্য ব্যবস্থা (Immuno system) তৈরি হওয়ার কথা, সে ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সুযোগ সন্ধানী ভাইরাস ও রোগজীবাণু দ্বারা শরীর সহজেই আক্রান্ত হয়। এমতাবস্থায় রোগীকে যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, বিকলাঙ্গতা, স্নায়বিক বৈকল্য, ক্যান্সার ইত্যাদিতে ভুগতে দেখা যায় ।
এইডসের ইতিহাস : ১৯৫৯ সালে প্রথম ব্রিটেনের এক ব্যক্তির রক্তে এইডসের ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায় । ১৯৭০-এর দশকে আফ্রিকায় এইডস ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮১ সাল থেকে এইডসকে একটি মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ বছরই এইডস রোগের কারণ চিহ্নিত করা হয়। মূলত ১৯৭৭-৭৮ সালে আমেরিকা, হাইতি ও আফ্রিকায় এইডস রোগ পরিলক্ষিত হয়। ১৯৮৫ সালে হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা হাডসন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বব্যাপী আতন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালে মানুষের রক্তে এইডসের ভাইরাস আছে কিনা তার পরীক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এভাবে বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তেই এইডস তার মরণবার্তা নিয়ে একের পর এক হাজির হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এইভসের বিস্তৃতি UNAIDS-এর ২০০৬ সালের তথ্যানুযায়ী বিশ্বজুড়ে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৪ কোটি। কেবল ২০০৫ সালে এইডস আক্রান্ত হয়েছে ৫০ লাখ এবং এ পর্যন্ত এইডসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে আড়াই কোটি লোক। তবে পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলে এইডস অত্যন্ত দ্রুতহারে বিস্তার লাভ করেছে। ২০০৫ সালে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলে ২ লাখ ৫০ হাজার লোক নতুন করে এইচআইভি বা এইডসে আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখের ওপরে। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৭০ লাখ লোক এইডসে আক্রান্ত। এ অঞ্চলে ২০০৫ সালেই ৪ লাখ ৩৫ হাজার লোক এতে আক্রান্ত হয়।
অন্যদিকে ২০০৫ সালেই সাব সাহারান আফ্রিকায় প্রায় ২৫ লাখ লোক এইডস রোগে মারা গেছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিগত এক বছরে ৩০ লাখ ৪০ হাজার লোক নতুনভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে এ অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটির কাছাকাছি। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে এইডস আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার।
উচ্চ আয়ের দেশসমূহে ২০০১ সালে ৭৫ হাজার লোক এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত হয়েছে এবং আক্রান্তদের সংখ্যা ১৫ লাখে উন্নীত হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার। ক্যারিবীয় অঞ্চল আক্রান্তের দিক থেকে দ্বিতীয়। দেশ হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি এইডস রোগী রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। অন্যদিকে সবেচেয়ে বেশি এইডস আক্রান্তের হার সোয়াজিল্যান্ডে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগ লোক এইডসে আক্রান্ত।
এইডসের কারণ ও বিস্তার : এইডস মূলত এর ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। তাই এটি একটি সংক্রামক রোগ হিসেবেই চিহ্নিত। এটি রোগীর শরীরে অবস্থান করে এবং এ ভাইরাস নানা প্রক্রিয়ায় অন্যের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত, বীর্য, যৌনরস, মূত্র, চোখের পানি, গুঘু এবং মায়ের দুধে এইচআইভি অবস্থান করে।
তবে চোখের পানি, গুথু ও মূত্রের মধ্যে ভাইরাসের ঘনত্ব কম থাকায় এগুলোতে এইডস সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ না হলেও এইচআইভি ভাইরাস নানা প্রক্রিয়ায় বিস্তার লাভ করতে পারে। যেমন- ক. এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যৌনমিলনের মাধ্যমে, খ, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে, গ. এইডস জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত সুচ, সার্জিকেল যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে, এইডস আক্রান্ত মায়ের গর্ভধারণের মাধ্যমে সন্তান জন্মলাভ করলে। সুতরাং বিশ্বব্যাপী এইডসের ব্যাপক বিস্তারের পিছনে যেসব কারণ দায়ী সেগুলো আলোচনা করা হলো :
১. অবাধ যৌনাচার : বিশ্বব্যাপী অবাধ যৌনাচার এইডসের ব্যাপক বিস্তারের জন্য মূলত দায়ী কেননা এইডস আক্রান্ত রোগীর সাথে যৌনমিলনের মাধ্যমে এইডসের ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে এইডসের বিস্তার ঘটায়। বিশেষত, অনুন্নত দেশগুলোতে কোনো প্রকার সাবধানতা অবলম্বন না করে এইডস আক্রান্ত নারী-পুরুষের অবাধ যৌনাচার চলছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সাবধানতা এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্বহীনতার অভাবও এ প্রবণতাকে আরো উসকে দিচ্ছে। ফ্রি সেক্সের নামে বিশ্বব্যাপী যে সর্বনাশা খেলা চলছে তা-ই মানবজাতিকে আজকের এ সংকটময় অবস্থার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে।
২. সমকামিতা : সমকামিতা পশ্চিমা দেশগুলোতে এইডস বিস্তারে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এর মাধ্যমে এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে মেলামেশার ফলে আক্রান্ত হচ্ছে সুস্থ মানুষ ।
৩. মাদকাসক্তি : মাদকাসক্তির ব্যাপক বিস্তারও এইডসের বিস্তারের ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কেননা মাদকাসক্তির ফলে দেখা যায় এরা অনেক সময় এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করে এইডসে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া এরা এক-একটি সিরিঞ্জ ও সুচ দিয়ে কয়েকজনে মাদক সেবন করে। ফলে এদের মধ্যে কেউ এইডস আক্রান্ত থাকলে বাকিরা সবাই আক্রান্ত হয়। অনেক সময় দেখা যায়, আসক্তির ফলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এরা নিজের অজান্তেই এ মহামারীর কবলে পড়ে যায়।
৪. রক্ত সঞ্চালন : এইডস ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম মাধ্যম রক্ত সঞ্চালন। যে কোনো প্রকারেই হোক এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত যদি সুস্থ ব্যক্তির দেহের রক্তের সাথে মিশ্রিত হয় তাহলে সে নিশ্চিতভাবে এইডসে আক্রান্ত হবে। বিশেষত, ইনজেকশন, উভয়ের কাটা, ফোঁড়া, ঘা ইত্যাদির মাধ্যমে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির শেভিং, রেজার, ব্লেড, দন্ত চিকিৎসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও নাক-কান ফোঁড়ায় সুচ ইত্যাদি জীবাণু অবস্থায় ব্যবহারের ফলে এইচআইভি ছড়াতে পারে। সুতরাং রক্তদান, রক্তবাহণ ও রক্ত সঞ্চালন এইচআইভি/এইডস সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এইডস ও বিশ্বস্বাস্থ্য : যুগে যুগে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কলেরা, বসন্ত, ডেঙ্গুসহ অনেক ধরনের রোগই পৃথিবীজুড়ে ব্যাপকহারে জনগণের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এইডসের যে বিস্তার তা সর্বকালের সকল মহামারীকে ছাড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ চরম উৎকর্ষের যুগেও এইডস বিশ্ব মানবসমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনে মানবপ্রজন্মের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশে এ রোগের যে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে এ মহাদেশে মানব অস্তিত্বের কি দশা হবে তা ভাবলে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়।
এইডসের একটি বিশেষ দিক হলো এইডসে আক্রান্ত রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুবই কম। তাই একবার এইডস আক্রান্ত হলে মৃত্যু অনেকটা নিশ্চিত বলা যায়। কারণ এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর সকল প্রকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং এর ফলে একের পর এক নতুন নতুন উপসর্গ তার শরীরে দৃষ্ট হতে থাকে ।
তাছাড়া এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি তার পরিবার ও সমাজের জন্য এক ধরনের বোঝা। কেননা আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের অন্য সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকায় তাকে ঘরে রাখা যেমন বিপজ্জনক, তেমনি আলাদা করে সরিয়ে রাখাও বেদনাদায়ক। তাই পরিবারের লোকজন অজান্তে কিংবা জেনে শুনে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে মেলামেশার কারণে অন্যরাও আক্রান্ত হয়। ফলে পুরো পরিবারে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতা পাওয়া গেলেও এইডস আক্রান্ত পরিবারগুলো প্রায়ই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এইডস আক্রমণের আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো এ রোগের নির্মম শিকার হচ্ছে শিশুরা। কেননা এইডস আক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্মলাভের ফলে তারা অবধারিতভাবে এ রোগের শিকার হয়ে জীবন দিচ্ছে। ফলে এইডস আক্রান্ত দেশে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। বাহামায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর ৬০%-এর মৃত্যুর কারণ এইডস। জাম্বিয়ায় এ হার ৭০%। তাছাড়া শিশুরা মায়ের সংশ্রবে থাকার ফলে মা এইডস আক্রান্ত হলে সেও নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে নিষ্পাপ শিশুটিকে কেবল তার জন্মধাত্রী মায়ের কারণেই অকাল মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে।
এইডস সংক্রমণের চিকিৎসার দিকটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ পর্যন্ত এইডস রোগের তেমন নির্ভরযোগ্য কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। আর যা আছে তাও বেশ ব্যয়সাধ্য। ফলে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকার মতো অঞ্চলগুলোতে এ রোগটির বিস্তারের অর্থই হলো বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ। ফলে দেখা যায় পরিবারের কেউ এইডসে আক্রান্ত হলে সে পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবে দুদিক থেকে সমস্যায় পড়ে। একদিকে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অসুস্থতার ফলে উপার্জন বন্ধ হয়ে পড়ে, অন্যদিকে তার ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার বহন করতে গিয়ে পরিবারের অন্যরাও চরম দারিদ্র্যের কবলে নিপতিত হয়।
ফলে এইডস আক্রান্ত দেশগুলোর জাতীয় ও মাথাপিছু আয় হ্রাস পায়। কেননা বয়স্ক ব্যক্তিরা এইডসে আক্রান্ত হলে তাদের উৎপাদন থেকে জাতি বঞ্চিত হয়। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী আফ্রিকার সাব সাহারান অঞ্চলে এইডসের কারণে দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। ২০১০ সালের মধ্যে সর্বাধিক এইডস আক্রান্ত দেশে মাথাপিছু জিডিপি ৮% হ্রাস পাবে। এইডস দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থাকেও নানাভাবে প্রভাবিত করে। একদিকে এইডসের ব্যাপক আক্রমণের ফলে অর্থনৈতিক সুরবস্থা শিক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সামর্থ্য ও সরকারি বরাদ্দ উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দেয়। তা ছাড়া আতঙ্কিত জনগণের মধ্যে স্কুল গমনাগমনের হারও কমে যায়। সোয়াজিল্যান্ডে এইডসের কারণে মেয়েদের স্কুল গমনের হার ৩৬% হ্রাস পেয়েছে।
আফ্রিকার সাব সাহারান অঞ্চলে এইডসের কারণে ৮ লাখ ৬০ হাজার ছেলেমেয়ে তাদের শিক্ষক হারিয়েছে। ২০০০ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ৩০০ শিক্ষকের মধ্যে ৮৫% এইডসের কারণে মারা যায়। আবার আক্রান্ত দেশগুলোর গড় আয়ু এইডসের কারণে মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সাব সাহারান এলাকার চারটি দেশ যেমন বতসোয়ানা, মালাবি, মোজাম্বিক ও সোয়াজিল্যান্ডে গড় আয়ু ৪০ বছরের নিচে নেমে এসেছে।
২০০০ সালের শেষে ১ কোটি ২১ লাখ ছেলেমেয়ে কোথাও তাদের মা বা বাবা আবার কোথাও তাদের মা-বাবা উভয়কে হারিয়ে এতিম হয়েছে। এসব এতিম শিশুর অনেকেই এইডস আক্রান্ত। মা-বাবা হারা শিশুর সংখ্যার এ ব্যাপকতা আক্রান্ত দেশগুলোতে ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সুতরাং সব দিক বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধ কিংবা দারিদ্র্য নয়, এইডসই নতুন শতাব্দীতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এইডস প্রতিরোধে করণীয় : মরণব্যাধি এইডস প্রতিরোধ করতে হলে এখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত, বিশ্বব্যাপী অবাধ যৌনাচার ও ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে আইনগত ও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নর-নারীর যৌন সম্পর্ক মানব বংশবিস্তারের একমাত্র কৌশল হিসেবে এটির প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল ও সতর্ক থাকার ব্যাপারে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম দায়িত্ব পরিবার ও সমাজের। তারপর ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতার ব্যাপক বিস্তার হলে অযাচিত যৌনাচার অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, মাদকাসক্তির বিরুদ্ধেও সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নৈতিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে । এ ব্যাপারে প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
তৃতীয়ত, এইডস বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে। সেজন্য যৌনশিক্ষা ও প্রয়োজনীয় সাবধানতা বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে হবে। তাছাড়া এইডস বিস্তারের নানা মাধ্যম ও এগুলো থেকে দূরে থাকার বিষয়ে জনগণকে সতর্ক করা খুবই জরুরি। সেজন্য জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সরকারি ও বেসরকারি সব প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক সতর্কতামূলক প্রচার অব্যাহত রাখতে হবে।
চতুর্থত, এইডস প্রতিরোধ কার্যক্রমে জাতিসংঘ ও অঙ্গ সংগঠনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। কেননা এইডস এখন আর কোনো একক দেশের সমস্যা নয়, বরং এটি মানবজাতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত দেশগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রতিরোধ কার্যক্রমে অংশগ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে।
পঞ্চমত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতিটি ব্যক্তিকেই এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। বিশেষত রক্তদান, রক্তগ্রহণ, রক্তসঞ্চালন, সুচ, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজের ব্যবহার এবং যৌন মেলামেশার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ষষ্ঠত, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমাজের কর্তব্য বিষয়েও সচেতন হতে হবে। কেননা এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যাপারে সামাজিক উদাসীনতা সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
উপসংহার : সর্বোপরি এইডসের চিকিৎসা এখনো পর্যন্ত নয়। সুতরাং আক্রান্ত দেশগুলোতে পর্যাপ্ত : চিকিৎসা সহায়তা প্রদান খুবই জরুরি। তাছাড়া এসব দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও দারিদ্র্য বিমোচনের ব্যাপারেও সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান আবশ্যক ।
আরও দেখুন: