Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : মানুষের ইতিহাসের শুরুতে সে শিক্ষা গ্রহণ করেছে প্রকৃতি থেকে। শিখেছে কিভাবে প্রতিনিয়ত মানুষ হয়ে উঠতে হয়। বিবর্তনের পথ পরিক্রমায় প্রাচীন মানুষ এক সময় হয়ে উঠেছে আধুনিক সভ্য মানুষ। সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে তার ভাষা, তার শিক্ষার আয়োজন। মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যমে সমাজের গুণগত পরিবর্তন সাধন করেছে শিক্ষা। মানুষ কোনো একক সত্তা নয়, তার ইতিহাস যুথবদ্ধতার, তার ইতিহাস সহমর্মিতার এ সত্য চৈতন্যে প্রোথিত করেছে শিক্ষা। জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বংশ পরম্পরায় হস্তান্তরের দায়িত্বও তার।

প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষা

শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো দেশের প্রতি দায়বদ্ধ, প্রয়োগমুখী, উৎপাদনক্ষম, সৃজনশীল, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তোলা। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দূরদৃষ্টি না থাকা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন এবং বৈদেশিক হস্তক্ষেপের কারণে যথার্থ বিজ্ঞানভিত্তিক এবং যুগোপযোগী হয়ে ওঠেনি। একটা জাতিকে ধ্বংস করতে তার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করাই যেমন যথেষ্ট তেমনি একটা জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। আর শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক স্তরই মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

 

তাই তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ এ স্তরেই একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথটা অনেকটা এগিয়ে যায়। সম্প্রতি বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে মাধ্যমিক স্তরে ‘একমুখী সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা’ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা এক বছরের জন্য স্থগিত রয়েছে। এই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা আলোচনার পূর্বে আমাদের একটু পেছনে ফিরে দেখতে হবে।

বর্তমান মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা : ১৯৬৩ সালের পূর্বে মাধ্যমিক স্তরে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল তাতে সব শিক্ষার্থীকে একই বিষয় পড়ে পরীক্ষা দিতে হতো। ঐ পরীক্ষার প্রচলিত নাম ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষা। ১৯৬৩ সালে এসএসসি (Secondary School Certificate)-এর কাঠামোতে নবম-দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ভাগ হয়ে যায়। বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত এরকম কিছু বিষয়ে সবাইকে পড়তে হতো।

তারপর নির্দিষ্ট বিভাগের জন্য কিছু নির্দিষ্ট বিষয়; যেমন- ‘বিজ্ঞান বিভাগের জন্য পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত; মানবিক বিভাগের জন্য ইতিহাস, অর্থনীতি, পৌরনীতি এবং বাণিজ্য বিভাগের জন্য হিসাববিজ্ঞান, হিসাবরক্ষণ ইত্যাদি অধ্যয়ন করতে হতো। পরবর্তীতে ৮০’র দশকে ধর্ম শিক্ষাকেও বাধ্যতামূলক করা হয়। এ শিক্ষাব্যবস্থানুযায়ী বাংলা (২০০), ইংরেজি (২০০), সাধারণ গণিত (১০০), ভূগোল (১০০) এবং ধর্ম শিক্ষা (১০০) মোট ৭০ নম্বর সবাইকে পড়তে হতো। ৩০০ নম্বর বিভাগ অনুযায়ী বিষয়গুলোর জন্য আর বাকি ১০০ ন ঐচ্ছিক বিষয়ের জন্য।

বর্তমান শিক্ষা সংস্কার : সম্প্রতি বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৬ সাল থেকে মাধ্যমিক স্তরে ‘একমুখী সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতঃপর ৫ ডিসেম্বর ২০০৫ সরকার এক বছরের জন্য একমুখী শিক্ষা স্থগিত করে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (শতকরা ৭০ ভাগ) ও বাংলাদেশ সরকার (শতকরা ৩০) যৌথভাবে ৪৯০ কোটি ২০ লাখ টাকার তহবিলে Secondary Education Sector Improvment Project (SESIP) গ্রহণ করে ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কাউন্সিল (NCCC)-এর অনুমোদনক্রমে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (NCTB) মূল দায়িত্ব পালন করছে। ৪টি ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য NCTB কাজ করছে। ক্ষেত্রসমূহ হলো-

১. একমুখী শিক্ষাক্রম,

২. পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা বেসরকারিকরণ,

৩. স্কুল ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি,

৪. পরীক্ষা সংস্কার কর্মসূচি।

একমুখী শিক্ষাক্রম : মাধ্যমিক স্তরে বর্তমান প্রচলিত মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান শাখার পরিবর্তে একীভূত ও সমন্বিত শিক্ষাক্রমের নামই একমুখী শিক্ষাক্রম। মাধ্যমিক শিক্ষান্তরের জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রথমে ২০০২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (NCCC) গঠন করে। সমন্বয় কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে SESIP-এর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরামর্শকবৃন্দ এবং NCTB-এর বিশেষজ্ঞগণ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে দেশব্যাপী দশটি জেলায় শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক এবং বিভিন্ন স্তরের মানুষের অভিমত গ্রহণ করে।

এছাড়া বিভিন্ন এশীয় এবং দূরপ্রাচ্যের ৯টি দেশের এবং ৫টি পাশ্চাত্য দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করে। এর প্রেক্ষিতে ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩ তারিখে অনুষ্ঠিত NCCC-এর সভায় এ দেশে প্রচলিত বহুমুখী শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে একমুখী শিক্ষাক্রম প্রবর্তনের বিষয়ে মত প্রকাশ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক স্তরে একমুখী শিক্ষাক্রম কাঠামো ও শিক্ষাক্রম নকশা করা হয়। শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাংলা (২০০), ইংরেজি (২০০), সাধারণ গণিত (১০০), ধর্ম শিক্ষা ( ১০০) আগের মতোই থাকবে। সবার জন্য একটি নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা হলো ব্যবসায় শিক্ষা ( ১০০ )। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর পরিবর্তে এসেছে সাধারণ বিজ্ঞান। এর প্রথম পত্রে (৭৫) আছে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন দ্বিতীয় পত্রে (৭৫) আছে উদ্ভিদ, প্রাণী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও জনসংখ্যা শিক্ষা।

সমাজবিজ্ঞানের প্রথম পত্রে (৭৫) আছে ইতিহাস ও ভূগোল । দ্বিতীয় পত্রে (৭৫) আছে অর্থনীতি, পৌরনীতি আর সমাজবিজ্ঞান। একটি আবশ্যিক নির্বাচনিক বিষয় আছে (১০০)। এর বিষয়গুলো হচ্ছে কৃষি শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। এই ১১০০ নম্বরের বাইরে আছে একটি ঐচ্ছিক বিষয় (১০০)। এর বিষয়গুলো হলো উচ্চতর গণিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বাণিজ্যিক ভূগোল, কর্মমুখী শিক্ষা, সংগীত, চারু ও কারুকলা, ‘স্বাস্থ্য এবং ক্রীড়া ও শারীরিক শিক্ষা। এ শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষার ভাষা হিসেবে যোগ হয়েছে মুসলমানদের জন্য আরবি, হিন্দুদের জন্য সংস্কৃত এবং বৌদ্ধদের জন্য পালি ভাষা।

বিদেশী কনসালট্যান্টদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে NCTB এবং SESIP-এর বিষয় বিশেষজ্ঞগণ এ শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছেন। ৬ মার্চ ২০০৫ তারিখে অনুষ্ঠিত NCCC-এর সভায় ১৩টি বিষয়ের শিক্ষাক্রম অনুমোদন করা হয়। 

পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা বেসরকারিকরণ: শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তুকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ এবং এ দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে তা পৌঁছে দেয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও একক কর্তৃত্ব ১৯৫৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫২ বছর যাবৎ পালন করে আসছে NCTB এ প্রক্রিয়ায় NCTB রচিত ও প্রকাশিত প্রতিটি বিষয়ের একটি করে বই শিক্ষার্থীগণ পড়তো। কিন্তু বর্তমান গৃহীত সরকারের শিক্ষা সংস্কার নীতির আলোকে ২০০৫ সাল থেকে নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণীর জন্য বেসরকারি খাতে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

স্কুল ভিত্তিক মূল্যায়ন (SBA) : শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মূল্যায়নে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্নিত করা হয়েছে-

১. সাধারণ (পাবলিক) পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন এবং ২. বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীর ধারাবাহিক মূল্যায়ন ।

লিখিত পরীক্ষা ব্যতিরেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য প্রতিটি বিষয়ের শতকরা ৩০ ভাগ নম্বর থাকবে শিক্ষকদের হাতে।

 পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার : এ ব্যবস্থায় প্রশ্নের দুটি অংশ থাকবে। কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নে ৬০ নম্বর থাকবে। এখানে ৯টি প্রশ্নের মধ্যে ৬টি উত্তর করতে হবে এবং সময় থাকবে ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট। আর বহু নির্বাচনী প্রশ্নে ৪০ নম্বর থাকবে। এখানে ৪০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এবং সময় থাকবে ৪০ মিনিট। এসএসসি পরীক্ষায় ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্র প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতেই হবে । অর্থাৎ রচনামূলক ও সংক্ষিপ্ত উত্তরের প্রশ্নে ৫০ নম্বর এবং বহুনির্বাচনী প্রশ্নে ৫০ নম্বর থাকবে।

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার সুবিধা : বস্তুত জাতীয় উন্নতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রধান মাধ্যম শিক্ষা। উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে দেশের জনসমষ্টিকে জনসম্পদে পরিণত করা যায়। সুতরাং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে একমুখীকরণ নিশ্চয়ই কিছু সুবিধা বয়ে আনবে এ বিশ্বাসেই এ সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত শিক্ষাক্রম সব শিক্ষার্থীর মধ্যে একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে। এ শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক স্তরে প্রতিটি শিক্ষার্থী সমভাবে জ্ঞানের নানাবিধ শাখায় জ্ঞানার্জনের সুযোগ পাবে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী, যে মানবিক বিভাগ নিয়ে পড়াশুনা করে, সে বিজ্ঞানের কোনো বিষয় সম্বন্ধে থাকে একেবারেই অন্ধ। একইভাবে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় থাকে দুর্বল।

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলনে এ অবস্থার কিছুটা হলেও অবসান হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদেরকে ১৩ বছর বয়সেই শিক্ষার বিশেষ শাখা বেছে নিতে হয়, যা তাদের বয়সের তুলনায় শক্তই বটে। আমাদের দেশে শিক্ষাক্রমের ধারা একবার বেছে নিলে শিক্ষার্থীরা অন্য ধারায় যেতে পারে না। যদিও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিক এবং বাণিজ্য শাখায় গিয়ে সামলে নিতে পারে কিন্তু মানবিক এবং বাণিজ্য শাখার শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে বিজ্ঞান শাখায় কখনোই কুলিয়ে উঠতে পারে না। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা একটি ব্যাপকভিত্তিক শিক্ষাক্রম সরবরাহ করে, যা সব শিক্ষার্থীর শেখা প্রয়োজন। তাছাড়া বর্তমান মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণের একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, যারা তুলনামূলকভাবে অধিক মেধাবী তারা

বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করে। এ ধারণাটি আমাদের ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে হীনমাতার সৃষ্টি করে। এ হীনম্ন্যতাবোধ তাদেরকে পাঠে অনুৎসাহিত করে। ফলে ভালো করার প্রবণতা হ্রাস পায়। একমুখী শিক্ষাক্রমে কমসংখ্যক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে ফলে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা বেসরকারিকরণের ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক বই পড়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারবে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থাকার ফলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বইয়ের মান উন্নত হবে এবং বইয়ের সংকট থাকবে না।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তাছাড়া একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা, নম্বর প্রদান, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সহজ হয়। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি সংখ্যায় A+ পায়। মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগ থেকে A+ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা। এক্ষেত্রে পরীক্ষার খাতায় নম্বর প্রদানের ব্যাপারটি বিশেষভাবে জড়িত। বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বর পায়, পক্ষান্তরে, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা সে অনুযায়ী নম্বর পায় না; অবশ্য কিছু যৌক্তিক কারণে।

কিন্তু কেউ একজন A+ ও B+ পাওয়া শিক্ষার্থীর ফলাফল শুনে তবে সে নির্দ্বিধায় A+ পাওয়া শিক্ষার্থীকে মেধাবীতর বলে বিবেচনা করবে। এক্ষেত্রে সে কোন বিভাগ থেকে পাস করেছে তা পরে দেখার বিষয়। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় অসম নম্বর বণ্টন প্রক্রিয়ার অবসান ঘটবে এবং প্রতিযোগিতামূলক লেখাপড়ায় শিক্ষার্থীরা উৎসাহিত হবে। তাছাড়া নিজ স্কুল শিক্ষকদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের ফলে শিক্ষার্থীর সঠিক মূল্যায়ন হবে এবং শিক্ষার্থী পাঠভারাক্রান্ত না হয়ে মননশীল হয়ে গড়ে উঠবে।

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার অসুবিধা : যে কোনো জিনিসই তা যতই ভালো উদ্দেশ্যেই প্রবর্তন করা হোক না কেন তাতে ভালোর উল্টো অর্থাৎ খারাপের অস্তিত্ব থাকতে বাধ্য। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায়ও কিছু খারাপ দিক লক্ষণীয়। মানুষ জন্মগতভাবেই সমান মেধাবী হয়ে জন্মে না। আবার অনেকে মেধাবী হলেও সব বিষয়ের প্রতি তার সমান আগ্রহ থাকে না। কারো কারো কাছে গণিত বা বিজ্ঞান আগ্রহের বিষয় কিন্তু, সাহিত্য বা সমাজবিজ্ঞানের শাখাগুলোর প্রতি তার কোনো আগ্রহ থাকে না। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থীর গণিত বা বিজ্ঞানের প্রতি প্রচণ্ড অনাগ্রহ এবং অনীহা।

আর কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট না হয় তবে সে ঐ বিষয়ে খারাপ করতে বাধ্য। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ওপর জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর নামে এক ধরনের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় জোর করে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহী বিষয়গুলোর প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অবশ্য এখানে একটি কথা বলা ভালো যে, শহরের ছেলে-মেয়েদের গপ্তাখানেক গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে অনাগ্রহী বিষয়গুলোতে ভালো করানোর চেষ্টা করা গেল, কিন্তু গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কি হবে? আর এটা তো জানা যে, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশ শহরে বাস করে।

বর্তমান যুগে কোনো জাতির উন্নতির মাপকাঠি হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি করলেই জাতি উন্নত হবে। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নয়নের মূল কথা হলো বিজ্ঞান শিক্ষা। আর আমাদের মতো দেশে এটি আরো বেশি দরকার। আমাদের বর্তমান প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষার পূর্বে বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী স্কুল এবং কলেজে চার বছর বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ পায়। তারপরও দেখা যায়, তারা ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, কৃষি, ফার্মেসি ইত্যাদি বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা নিতে গিয়ে হিমশিম খায়। সুতরাং চার বছর পড়ার পরও যদি তাদের হিমশিম খেতে হয় তাহলে দু’বছর

পড়ার পর কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। অথচ প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের জন্য আছে ৭৫ নম্বর, যেখানে আগে ছিল ২০০ নম্বর। আর উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, পরিবেশ বিজ্ঞান আর জনসংখ্যা মিলে ৭৫ নম্বর। একমুখী শিক্ষায় আক্ষরিক অর্থে বিজ্ঞান শিক্ষা ক্রসফায়ারের মুখোমুখি হয়েছে। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে কোনো ব্যবহারিক পরীক্ষা রাখা হয়নি। বিজ্ঞানে জোর কম দিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক, যুগোপযোগী শিক্ষা সম্ভব নয়। এতে জাতি আরো পঙ্গু হবে এবং আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হবে।

প্রস্তাবিত একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় পূর্বের মতো ধর্মবিষয় থাকলেও এবার তার সাথে একটি বিষয় যোগ হয়েছে তা হলো ধর্ম শিক্ষায় ভাষা হিসেবে মুসলমানদের জন্য আরবি, হিন্দুদের জন্য সংস্কৃত এবং বৌদ্ধদের জন্য পালি। এমনিতেই তাদের এক গাদা বিষয় মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এরপরও যদি ধর্মের ভাষা হিসেবে অন্য একটি ভাষা শিখতে হয় তবে তা মরার ওপর খড়ার ঘা’ ছাড়া আর কিছু নয়। আর এর শিক্ষক পাওয়াও কঠিন। তাছাড়া বিজ্ঞানে নম্বর কমিয়ে ধর্মকে আবশ্যিক রাখা কোনো যুক্তিযুক্ত কাজ নয়।

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিটি বিষয়ের শতকরা ৩০ ভাগ মার্কস থাকবে শিক্ষকদের হাতে। যদিও দিন দিন শিক্ষকদের নৈতিকতা এবং সততা হ্রাস প্রাপ্তির বিভিন্ন ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে তবুও আমরা মনে করি শিক্ষকরা সমাজের সর্বাপেক্ষা সম্মানিত। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিটি শিক্ষকের মধ্যে একজন স্বাভাবিক মানুষের বাস, যে কিনা সুযোগ পেলেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে। কোনো বিষয়ে পাস নম্বর ৩৩। কোনো শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীকে কৃপাবশত তার হাতের ৩০ নম্বর দিয়ে দেন তবে তাকে মাত্র ৩ নম্বর পেতে হবে, যা অনায়াসে সে পেতে পারে। আবার এর উল্টোটাও ঘটতে পারে। অর্থাৎ কোনো ছাত্র যদি কোনো শিক্ষকের কু-নজরে পড়ে এবং সে শিক্ষক যদি তার হাতের ৩০ নম্বর থেকে কোনো নম্বর প্রদান না করে তবে ঐ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় যত ভালোই করুক না কেন তার ফলাফল খারাপ হতে বাধ্য।

উপরন্তু আজকাল শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানোর বাণিজ্যে ব্যস্ত । তাদের ভাবটা এমন যেন ওটাই তাদের মূল পেশা, শিক্ষকতাটা খণ্ডকালীন। এসব শিক্ষক ঐ ৩০ নম্বরকে অস্ত্র বানিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে জিম্মি করে ফায়দা লুটতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে মনে সদিচ্ছা পোষণ করলেও এ নম্বর সুষ্ঠুভাবে প্রদান করতে পারবেন না। কেননা তারাও আবার সমাজের মাতব্বর, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ইত্যাদি শ্রেণীর নিকট জিম্মি। সমাজের এসব শ্রেণীর সুপারিশ বা ভয়ভীতি সহজেই শিক্ষকদের নীতিকে দুর্নীতিতে রূপান্তর করতে পারে। আবার যেহেতু প্রদত্ত ৩০ নম্বর ফলাফল নির্ধারণে যোগ হবে সেহেতু সকল শিক্ষকই চাইবেন তার বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো করতে এবং পাশের হার বাড়াতে। সুতরাং ‘নম্বর তো আর কিনে দিতে হয় না – এ তত্ত্বের ভিত্তিতে ইচ্ছামতো শিক্ষকগণ নিজ ছাত্রছাত্রীদের নম্বর প্রদান করতে পারেন, এতে প্রকৃত মেধাবী নির্বাচন করা কঠিন হবে।

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাপেক্ষা সমালোচিত তা হচ্ছে, ‘একমুখী শিক্ষা’ আসলে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা নয়। ‘একমুখী শিক্ষা’ কথাটি ছিল দেশের শিক্ষানুরাগী মানুষের একটি প্রিয় স্বপ্ন, যা দিয়ে বোঝানো হতো মাদ্রাসা, ইংরেজি মিডিয়াম, মাধ্যমিক ধারাকে একটি একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী পর্যন্ত একই ধারায় নিয়ে আসা। মাদ্রাসা এবং ইংরেজি মাধ্যমকে স্পর্শ না করে শুধু মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করে এটাকে ‘একমুখী শিক্ষা’ নাম দেয়া জাতির জন্য একটি বড় প্রতারণা।

একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সুপারিশ : একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরী মনে করেন এমন ব্যবস্থা, যেখানে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সবার জন্য একই পদ্ধতি কার্যকর হবে। এ পদ্ধতিতে কেউ ইংরেজি আর কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়বে তা হবে না। সবাইকে বাংলা মাধ্যমে পড়তে হবে । ইংরেজি তাকে ভিন্নভাবে আয়ত্ত করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে যদি রাখতেই হয় তাহলে সেটাকেও এই পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের জন্য ধর্মীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

তাই একমুখী বলতে দেশের সব শিক্ষাকে একটি কাঠামোর মধ্যে এনে বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক এবং সময়োপযোগী করতে হবে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী শুধু জ্ঞানার্জনই করে না, সে নিজের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ইতিহাস, দেশাত্মবোধ সম্পর্কে সজাগ হয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। মাদ্রাসা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষায় যা কম লক্ষণীয়। তাই তাদেরকে অবশ্যই একই কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে এবং দেশের শিক্ষাবিদ। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ- আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তাছাড়া আমাদের জানা উচিত যে শিক্ষা একটি ধারাবাহিক পদ্ধতি। এখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ইত্যাদি স্তর রয়েছে এবং একটি স্তর অপরটির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাথমিক শিক্ষার যে ভিত তৈরি হবে সে ভিতের ওপর নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা দাঁড়াবে। আবার নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর দাঁড়াবে মাধ্যমিক, মাধ্যমিকের ওপর উচ্চ মাধ্যমিক এবং তার ওপর দাঁড়াবে উচ্চ শিক্ষা। সুতরাং একটি স্তরের আগের এবং পরের স্তরকে পরিবর্তন না করে কোনোভাবেই মাঝখানের একটি স্তরকে পরিবর্তন করা উচিত নয়। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯২ সালে একাবার এ ধরনের একমুখী শিক্ষা চালু করে আবার আগের পদ্ধতিতে ফিরে আসতে হয়েছে ।

 

উপসংহার : আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, ১৪টি দেশ ঘুরে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে ‘একমুখী শিক্ষা’ নামে যা করার চেষ্টা চলছে তা পূর্ণাঙ্গ একমুখী শিক্ষা নয়। তাই দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ এবং সুধী সমাজের লোকজন এর বিরোধিতা করছেন। আমাদের দেশের জন্য আমাদের সবার পরামর্শের ভিত্তিতেই শিক্ষাব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। আর তাছাড়া উদ্দেশ্য যতই ভালো থাক ফল যদি খারাপ হয় তাহলে সে উদ্দেশ্য সৎ উদ্দেশ্য থাকে না। তাই শিক্ষা একমুখী হবে নাকি বহুমুখী হবে সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো প্রদত্ত শিক্ষা মাধ্যমে শিক্ষার উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা। অর্থাৎ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শিক্ষার্থী দেশ তথা জাতির কল্যাণে আসছে কিনা। যদি জাতির কল্যাণ বয়ে আনে তবে তা গ্রহণযোগ্য ।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version