সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : প্রত্যেক দেশেই জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শের প্রতিফলন ঘটে প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক শিক্ষা যে দেশে যত সুষ্ঠুভাবে দেয়া হয় সে দেশ তত বেশি উন্নত। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিভূমি দুর্বল হলে ব্যক্তির জীবনে তো বটেই, জাতীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপরও তার ক্ষতিকর প্রভাব অপরিসীম। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার।
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা
বাংলাদেশ সরকার এক যুগ আগে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছে। এজন্য সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যাসমূহ দূর করে এর মানোন্নয়ন করা জরুরি।
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা : আমাদের দেশে সর্বজনীন শিক্ষা বলতে মৌলিক শিক্ষাকে বোঝায়, যা প্রধানত প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে দেয়া হয়। প্রাথমিক’ শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম স্তর। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য দুটি : ১. মানসম্মত মৌলিক বা বুনিয়াদি শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, ২. শিক্ষাব্যবস্থার পরবর্তী স্তরে প্রবেশের জন্য যোগ্যতা অর্জন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানে দেশে সর্বজনীন শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এতে বলা হয় :
রাষ্ট্র : ক. একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দানের জন্য; খ. সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; গ. আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন ।
কোনো দেশে নিরক্ষরতার উৎসমূল হচ্ছে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির অনুপস্থিতি বা ব্যর্থতা। অর্থাৎ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী বয়সের সকল ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করা (enrollment), তাদের ধরে রাখা (retention) এবং প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করার (completion) কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন না হলে প্রতি বছর প্রাথমিক’ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুরা নিরক্ষর থেকে যায় এবং ক্রমাগত নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়। এভাবেই দেশে নিরক্ষরের সংখ্যা স্ফীত হতে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের পূর্বে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম গৃহীত না হওয়ায় এ দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী নিরক্ষর থেকে যায়।
নিরক্ষরতা দূর করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন নিরক্ষরতার উৎসমূল বন্ধ করা অর্থাৎ মানসম্মত সর্বজনীন প্রাথমিক’ শিক্ষা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। অবশ্য একই সাথে প্রয়োজন নিরক্ষর থেকে যাওয়া শিশু, কিশোর-কিশোরী ও বয়স্কদের জন্য ব্যবহারিক সাক্ষরতা কর্মসূচি ও অব্যাহত শিক্ষা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে ৬-১০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সর্বজনীন প্রাথমিক’ শিক্ষা কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৮০ সনে অর্থাৎ দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৮০-১৯৮৫) সূচনালগ্নে। এই কর্মসূচির বাস্তবায়ন দুই দশকের অধিক সময় ধরে চলে আসছে। কিন্তু গণদারিদ্র্য ও গণনিরক্ষরতার মতো সমস্যায় নিমজ্জিত বাংলাদেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন একটি দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ কাজ।
প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব : এ কথা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের জাতীয় জীবনের সকল সমস্যা, সংকট ও দুর্দশার মূল উৎস নিরক্ষরতা। এই অভিশাপ থেকে যদি আপামর জনসাধারণকে মুক্ত করা যেত তাহলে বর্তমানে জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্থাৎ কৃষি, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, সমাজসেবা, সমবায় ইত্যাদি জাতিগঠনমূলক সকল উন্নয়ন প্রচেষ্টাই সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠত। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের অধিকাংশ সমস্যা বা সংকট সাক্ষর বা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দ্বারাই সমাধান করা সম্ভব হতো।
রাশিয়া ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশসমূহে গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, একজন সাক্ষর ব্যক্তি একজন নিরক্ষর ব্যক্তি অপেক্ষা শিল্প ও কলকারখানায় বেশি উৎপাদনক্ষম, স্বাস্থ্যের সাধারণ নিয়মাবলী পালনে বেশি সজাগ, পরিকল্পিত পরিবার গঠনে বেশি আগ্রহী, বাণিজ্যিক লেনদেনে বেশি দক্ষ এবং নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকারসহ অন্যান্য অধিকার আদায়ে বেশি সচেতন ও সক্ষম।
তাই সকল সমস্যা ও সংকটের মূল উৎস নিরক্ষরতাকে দূরীভূত না করে আমাদের দেশে অন্যান্য ক্ষেত্রে সমস্যা দূরীকরণ বা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের যে উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা তা গাছের গোড়া কেটে উপরিভাগে পানি দেয়া বা তলাবিহীন পাত্রে পানি ঢেলে সেটিকে পানি দ্বারা ভর্তি করার ব্যর্থ প্রচেষ্টার শামিল। জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যর্থতা দ্বারাই তা প্রমাণিত হয় ।
শিক্ষা মানুষের একটি জন্মগত অধিকার। মানুষের পূর্ণরূপে মানুষ হয়ে ওঠার একটি প্রধান অবলম্বন হলো শিক্ষা। কাজেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষালাভের সুযোগ প্রতিটি শিশুকেই দিতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে সর্বজনীন প্রাথমিক’ শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ শুরু হয়। বিশ্বে আজ যারা উন্নত জাতি হিসেবে পরিগণিত, তারা শিক্ষা বিশেষ করে প্রাথমিক’ শিক্ষাকে অবৈতনিক, সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করেই তাদের গৌরবময় আসন দখল করেছেন ।
দারিদ্র্য, বেকারত্ব, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক মূল্যবোধ, নিরক্ষরতা প্রভৃতি নানাবিধ সমস্যায় বাংলাদেশ জর্জরিত। এই পরিস্থিতি মোরুাবিলা করার জন্য এবং জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে প্রাথমিক- শিক্ষাব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দীর্ঘদিনের অবহেলায় বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা আজ শোচনীয়। সরকার স্বাধীনতার পর থেকেই প্রাথমিক’ শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার যতই আন্তরিক হোক না কেন দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের সমস্যাসমূহ দূরীভূত করা তার একার পক্ষে সহজসাধ্য নয়।
প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করার পূর্বশর্ত হিসেবে দেশের অন্যান্য মৌলিক সমস্যা সমাধানের আশু প্রয়োজন । একটি অনুকূল পরিবেশ ব্যতীত ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া সম্ভব নয়। তাই ধীরে ধীরে এবং ক্রমাগতভাবে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং এ কাজে শুধু সরকার নয় দেশের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগিতা : সাম্প্রতিককালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, প্রাথমিক শিক্ষা শুধু প্রতিটি শিশুর মানবিক গুণাবলী অর্জনের জন্যই প্রয়োজন নয়, প্রাথমিক’ শিক্ষা একটি দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্যও আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। প্রাথমিক’ শিক্ষা শুধু মানুষকে সাক্ষরতা এবং ভাষা ও গণিতের দক্ষতা দেয় না, সেই সঙ্গে তার বিচারবুদ্ধির বিকাশ ঘটায়, মাঠে-ময়দানে, কল-কারখানায় কর্মীদের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, মানুষকে উদ্যমশীল করে এবং জীবনের নানা মৌলিক চাহিদা যথা পুষ্টি, আশ্রয়, পোশাক, স্বাস্থ্য এসব মেটাবার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় পাওয়া যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তির তায়, প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন এমন একজন ব্যক্তির তুলনায় ৫২.৬ শতাংশ বেশি। তেমনিভাবে মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তির আয় একই স্তরের শিক্ষায় শিক্ষিত নন এমন ব্যক্তির চেয়ে ৭.২ শতাংশ বেশি। আর একজন স্নাতক ডিগ্রিধারীর আয় বেড়ে যায় ১৬.২ শতাংশ। এ ছাড়া প্রাথমিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন নারীর আয় বৃদ্ধির পরিমাণ ৯২.২৫ শতাংশ। কাজেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগিতা সবচেয়ে বেশি।
প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : গতিশীল সামাজিক জীবনের চাহিদা এবং সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক’ শিক্ষার লক্ষ্য ও সাধারণ উদ্দেশ্যসমূহ নির্ধারণ করা হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, প্রশাসক, বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তি এতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই অঞ্চলের অন্যান্য কয়েকটি দেশের প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলী এবং এ দেশের শিক্ষা কমিশনসমূহের রিপোর্ট পর্যালোচনা করেন। অতঃপর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পটভূমির প্রেক্ষিতে নিচে বর্ণিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ প্রাথমিক’ শিক্ষার জন্য চিহ্নিত করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও উন্নয়ন সাধনই হচ্ছে প্রাথমিক’ শিক্ষার মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য প্রাথমিক শিক্ষার মাঝে নিম্নলিখিত সাধারণ উদ্দেশ্যসমূহ রাখা হয়েছে :
১. শিক্ষার্থীর মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার প্রতি অটল আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে তোলা যেন এই বিশ্বাস তার সমগ্র চিন্তা ও কর্মে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। ২. সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলা। ৩. পারস্পরিক সমঝোতা এবং সকলের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব সৃষ্টি করা। ৪. কায়িক শ্রমের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করা। ৫. পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীকে তার অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।
৬. সুনাগরিক হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়/প্রতিষ্ঠানে কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীকে অধিকার অর্জনে এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পাদনে প্রশিক্ষণ দেয়া। ৭. দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলা। ৮. জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি লাভ করা এবং এগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তোলা । ৯. শিক্ষার্থীর শারীরিক বিকাশে সহায়তা করা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস ও মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করা। ১০. ভাষা, সংখ্যাজ্ঞান ও হিসাব সম্পর্কিত মৌলিক দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা। ১১. শিখন দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা।
১২. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনে সমস্যা সমাধানের অভ্যাস গঠন এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সহায়তা করা। ১৩. শিক্ষার্থীর নিজ পরিবেশকে জানতে ও বুঝতে সহায়তা করা। ১৪. জীবনযাত্রার মানেদ্রয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্ব বোঝা এবং প্রয়োগে আগ্রহী করা। ১৫. শিক্ষার্থীর মনে সৌন্দর্যবোধ জাগিয়ে তোলা এবং পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করা। ১৬. শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা করা। ১৭. বাঞ্ছিত সামাজিক আচরণ অর্জনে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করা। ১৮. শিক্ষার্থীদের মনে বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিকতাবোধ জাগিয়ে তোলা। ১৯. বিদেশী ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন এবং ব্যবহারে সহায়তা করা।
প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবিষয় : প্রাথমিক শিক্ষার উপরোক্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য যেসব বিষয়াবলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলো হলো : মাতৃভাষা (বাংলা), গণিত, পরিবেশ পরিচিতি (সমাজ ও বিজ্ঞান), ধর্ম (ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান), শরীরচর্চা, চারু ও কারুকলা, সঙ্গীত এবং ইংরেজি। শিক্ষার্থীরা যারা যে ধর্মাবলম্বী তারা সেই ধর্ম বিষয়ে অধ্যয়ন করবে।
বিবর্তনের ধারায় প্রাথমিক শিক্ষা : বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষা ব্যবস্থারই ধারাবাহিকতা মাত্র। ব্রিটিশ শাসকদের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্যের আলোকেই এ দেশে প্রাথমিক’ শিক্ষাব্যবস্থা কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এ দেশে প্রাথমিক’ শিক্ষা বিস্তারের প্রথম সংগঠিত উদ্যোগ দেখা যায় ১৯১৯ সালে ‘বেঙ্গল প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট’ প্রবর্তনের মাধ্যমে। এতে দেশের পৌর এলাকাগুলোতে ৬-১১ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার আয়োজনের জন্য শিক্ষা সেল এবং পরিদর্শন ব্যবস্থা চালু হয়। তবে সে সময় দেশে পৌর এলাকার পরিধি অত্যন্ত সীমিত থাকায় সমগ্র দেশে এই আইনের প্রভাব হয় খুবই সামান্য ।
এরপর ১৯৩০ সালে প্রবর্তিত হয় ‘বেঙ্গল (রুরাল) প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট’। এই আইনের মাধ্যমে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে ৬-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত হয় । পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে সারা দেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের সংকল্প ঘোষণা করা হয়। সে সময় প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয় নব প্রতিষ্ঠিত ‘জেলা স্কুল বোর্ডের হাতে, তাদের সাথে পরামর্শক্রমে নির্দিষ্ট এলাকায় বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের বিধান রাখা হয়। কিন্তু শিক্ষা সেল-এর মাধ্যমে সংগৃহীত, অর্থের অপ্রতুলতা এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
পাকিস্তান আমলে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা : ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও নানাভাবে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের কথা বলা হয়েছে। ১৯৫১ সালে প্রাদেশিক পরিষদে ‘বেঙ্গল (রুরাল) প্রাইমারি এডুকেশন (ইস্ট বেঙ্গল অ্যামেন্ডমেন্ড) অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে আবার দশ বছরের মেয়াদে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য দশ বছরের একটি “বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প হাতে নিয়ে ১৯৫১ সালের ১৬ আগস্ট তার সাড়ম্বর উদ্বোধন করা হয়।
দেশে সে সময় ৪০৯টি থানা এবং প্রতি থানায় ১০টি ইউনিয়ন ছিল। স্থির হয় যে, প্রতি বছর প্রতি থানায় একটি করে ইউনিয়ন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নেয়া হবে। সেসব এলাকার স্কুলগুলো জেলা স্কুল বোর্ডের আওতা থেকে সরাসরি সরকারি তত্ত্বাবধানে আসবে। এভাবে ১৯৫১ সালে ৪০২টি এবং ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে আরো ৩৯০টি ইউনিয়নকে এই প্রকল্পের আওতায় নেয়া হয় । এভাবে দু বছরে প্রায় ৫,০০০ স্কুল এবং ১৫,০০০ শিক্ষক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আসে। এজন্য চারটি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু মাত্র দু বছর পর এই বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প কার্যত পরিত্যক্ত হয়।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট যে একুশ দফার জনপ্রিয় দাবি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তার মধ্যে একটি দাবি ছিল বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন। কিন্তু তারা এই শিক্ষা প্রবর্তন করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ হলো অর্থনৈতিক। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে যে অর্থ বরাদ্দের প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যেমন— বিদ্যালয় গৃহ, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদির অপ্রতুলতা, প্রতি স্কুলে পাঁচটি শ্রেণীর জন্য মাত্র তিনজন শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিদর্শনের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের প্রস্তুতির অভাব ।
১৯৫৭ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে দ্য ইস্ট বেঙ্গল (রুরাল) প্রাইমারি এডুকেশন (সাপ্লিমেন্টারি প্রভিশনস) অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে জেলা স্কুল বোর্ড তুলে দিয়ে প্রাথমিক স্কুলগুলোকে সরকারি তত্ত্বাবধানে নেয়া হয় । বাধ্যতামূলক এলাকার প্রাথমিক স্কুলগুলোকে পরিণত করা হয় ‘মডেল’ স্কুলে, অন্য স্কুলগুলো হলো ‘নন-মডেল’ স্কুল। কিন্তু এ ব্যবস্থায়ও প্রাথমিক’ শিক্ষাক্ষেত্রে দ্বৈত প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং বৈষম্যমূলক আচরণের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে সমগ্র প্রাথমিক’ শিক্ষা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে শুরু করে।
বিদ্যালয়ের নাম মডেল হতে পারে, কিন্তু বিদ্যালয়ের নামের পূর্বে ‘নন-মডেল’ নামটি সংযোজন কোনোমতেই শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা বা পরিদর্শকদের নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় বাধ্য হয়ে সরকার ১৯৬৫ সালে সকল মডেল ও নন-মডেল স্কুলকে একীভূত করে ম্যানেজড ফ্রি প্রাইমারি বা এমএফপি স্কুল হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের উদ্যোগ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রাথমিক’ শিক্ষা অগ্রাধিকার পায়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতির আলোকে শিক্ষাকে ঢেলে সাজাবার পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক’ শিক্ষাকে জাতীয়করণ করা হয়। ২৬ অক্টোবর ১৯৭৩ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার বিপুলসংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। পরে এটি বিল আকারে ‘প্রাথমিক স্কুল বিল ১৯৭৪’ নামে সংসদে উত্থাপন করা হয় এবং একই বছর ২৫ জানুয়ারি সংসদে পাস হয়।
এই আইনের মাধ্যমে সরকার দেশের তখনকার সব প্রাথমিক স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এসব স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরিও সরকারিকরণ করা হয়। ফলে হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুনর্গঠন, প্রশাসন এবং ব্যবস্থাপনার এক বিশাল দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। স্থানীয় স্কুল ম্যানেজিং কমিটি অকেজো হয়ে পড়ে। স্কুল শিক্ষক হয় সরকারি কর্মচারী। স্থানীয় কমিটির কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। তবুও প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক।
শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ : ১৯৭২ সালে যে প্রথম ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন’ গঠিত হয়, সেই বুদরাত-ই-খুদা কমিশন তাদের ১৯৭৪ সালের পেশকৃত রিপোর্টে সুপারিশ করেন যে, ‘প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষারূপে পরিগণিত করে তাকে সর্বজনীন করতে হবে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রচলিত অবৈতনিক শিক্ষা ১৯৮০ সালের মধ্যে বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে। এজন্য যেসব আনুষঙ্গিক কর্মসূচির প্রস্তাব করা হয় তার মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট শিক্ষক, পাঠ্যবই ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, দশ হাজার নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পনের হাজার স্কুলে দ্বিতীয় শিফট প্রবর্তন,
দশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নয়ন, দুই হাজার মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শিফট প্রবর্তন, স্কুলে মেয়েদের সংখ্যা বাড়াবার জন্য মহিলা শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য ক্র্যাশ প্রোগ্রাম এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাক্ষরতা কর্মসূচির ব্যবস্থা করা। পরবর্তীকালে দেশে যেসব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হয় তার ফলে এ সকল প্রস্তাব বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। এরপরে ১৯৮৩ সালের মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৮ সালের মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশনসহ ১৯৭৯ সালের জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কাউন্সিলও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীন করার সুপারিশ রাখে, কিন্তু কোনো শিক্ষা কমিশনের সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি : বাংলাদেশ সরকার – প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) জোরের সঙ্গে উল্লেখ করে যে, শিক্ষা হবে ‘গণমুখী ও সর্বজনীন’। সব ছেলেমেয়ের জন্য অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় আইনে নির্ধারিত হবে। সমাজের প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রেখে সুশিক্ষিত এবং কর্মোদীপ্ত নাগরিক প্রস্তুত করার জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার উন্নয়ন পরিকল্পনায় জাতীয় উন্নয়নে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন করার লক্ষ্যে সরকার প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাপ্রকল্প-এক গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তখন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি ।
আশির দশকের গোড়া থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে বাংলাদেশ সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের লক্ষ্যে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট বেশ বড় আকারের কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ সকল উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৯৮১ সালে পৃথক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৮১ সালে একটি প্রাথমিক শিক্ষা আইন এবং ১৯৮৩ সালে সংশোধিত প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রবর্তিত হয়। এসব আইনের ধারায় ৪৮২টি উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং প্রতি উপজেলায় ৬- ৮ জন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের পদ প্রবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষা কমিটি (৮-১০ জন মনোনীত সদস্য) এবং প্রতিটি প্রাথমিক স্কুলে নির্বাহী কমিটির (১১ জন মনোনীত ও নির্বাচিত সদস্য) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই সময়ে প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহেরও ব্যবস্থা করা হয়।
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প : দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮০-৮৫) বাস্তবায়নকালে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প-দুই। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল :
১. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি বাড়ানো। ২. ঝরে পড়ার কারণে সৃষ্ট অপচয় কমানো। ৩. শিক্ষার মান বাড়ানো। ৪. নতুন বিদ্যালয় গৃহ তৈরি ও লেখাপড়ার অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। ৫. সমাজ ও স্কুলের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ বাড়ানো। ৬. স্থানীয় পর্যায়ে স্কুল ব্যবস্থাপনা ও পরিদর্শন জোরদার করা।
১৯৮৫ সালে প্রকল্প শেষে দেখা যায় যে, মোট বরাদ্দের ৪১.৪% খরচ করতে সক্ষম হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ১৯৮০ সালে প্রাথমিক শিক্ষার বয়স উপযোগী শিশুর ভর্তি ১২.৬৩% থেকে বাড়িয়ে ১৯৮৫ সালে ৯১% ভাগে উন্নীত করা। কিন্তু পাঁচ বছর শেষে ১৯৮৫ সালে দেখা যায়, শিক্ষার্থী ভর্তির হার মাত্র ৬১%-এ দাঁড়ায় যা লক্ষ্য থেকে অনেক পেছনে ।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রাথমিক শিক্ষা : তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০) বাস্তবায়নকালে দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। এটি ছিল সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে একমাত্র সরকারি প্রকল্প যা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পরিচালনা করে। উপজেলা পরিষদের সহযোগিতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল :
ক. ৬-১০ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের ভর্তি ১৯৮৫ সালে ৬০% থেকে ১৯৯০ সাল নাগাদ ৭০%-এ উন্নীত করা । খ. ১৯৮৫ সালে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশকে ৫ বছরের প্রাথমিক শিক্ষাচক্র শেষ করানো। গ. উন্নত স্কুল ব্যবস্থাপনা, কার্যকর পরিদর্শন এবং উন্নত পাঠদানের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ দক্ষতা বাড়ানো।
চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রাথমিক শিক্ষা : চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯০-৯৫) প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ নামে একটি নতুন বিভাগ গঠিত হয়। ১৯৯০ সালে প্রাথমিক’ শিক্ষাকে সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক করার জন্য আইন পাস করা হয় এবং ১৯৯২ সাল থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৯৯০ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং ইউনিট গঠিত হয় প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি বৃদ্ধি, সম অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষার সঠিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে Genera Education Project (GEP) নামে একটি বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্প যেসব কাজ করেছে সেগুলো হলো :
ক. স্কুল তৈরি এবং সংস্কার করা। খ. জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস প্রতিষ্ঠা করা। গ. স্যাটেলাইট স্কুল পাইলট প্রোগ্রাম প্রবর্তন ঘ. অনানুষ্ঠানিক এবং বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষা প্রোগ্রাম চালু। ড. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দান। চ. পাঠ্যক্রম উন্নয়ন এবং পাঠ্যবই প্রণয়ন। ড. বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান প্রক্রিয়ার উন্নয়ন। এছাড়া সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আরো অনেক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন কার্যক্রম (১৯৯৬-২০০২): ১৯৯৬-২০০২ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ২৩টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে এবং সম্প্রসারণে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষ বাড়ানো, স্কুল পুনঃনির্মাণ, মেরামত, রেজিস্টার্ড বেসরকারি স্কুলের উন্নয়ন, স্যাটেলাইট স্কুল নির্মাণ, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু রাখা এবং উপজেলা রিসোর্স সেন্টার নামে নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করা। এ সময় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন সংস্থা যেমন ADB, World Bank, DFID, GTZ, NORAD, UNICEF, IDA, SIDA, USAID এবং IDB সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম : প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০০২ সালে ADBর আর্থিক সহায়তায় পরবর্তী ছয় বছরের জন্য এক নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এই পরিকল্পনা ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-২’ (PEDP-II) নামে পরিচিত। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ৪, ৯৩৩.৮০ কোটি টাকা। PEDP II-
এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের শিক্ষানীতি, সবার জন্য শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী ভর্তি, পাঁচ বছর শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে থাকা, প্রাথমিক’ শিক্ষাচক্র সম্পন্ন করা এবং শিক্ষার হার ও শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়তা করা। এই কর্মসূচিতে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয় কার্যক্রমকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন—
১. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং তাদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো ।
২. বিদ্যালয় এবং শ্রেণীকক্ষের ভৌত এবং শিখন-শিক্ষণ পরিবেশের মান উন্নয়ন। ৩. অবকাঠাमে
উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন। ৪. স্কুলে ভর্তির সম অধিকার এবং সুযোগ বৃদ্ধি করে শিক্ষার মানোন্নয়ন । ৫. শিক্ষাব্যবস্থাপনা, পরিদর্শন এবং মূল্যায়নের ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন । প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে Programme Approach ভিত্তিক ছয় বছর মেয়াদি একটি নতুন কর্মসূচি গ্রহণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ১১টি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এই কর্মসূচির জন্য ৬১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা দেবে। এই কর্মসূচিতে দেশের নিজস্ব সম্পদ থেকে ১২৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ যোগান দেয়া হবে ।
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে গত দু বছরে প্রায় ছয় হাজার সরকারি এবং রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। অচিরেই পনেরো হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩৯৭টি উপজেলায় “উপজেলা রিসোর্স সেন্টার’ নির্মাণ করা হবে। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে বই ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করছে। শ্রমজীবী মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য শিশুকল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শূন্যপদে ৬০ শতাংশ শিক্ষিকা নিয়োগের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প চালু : শিক্ষার্থীদের ভর্তির হার বৃদ্ধি, তাদের বিদ্যালয়ে ধরে রাখা এবং পাঁচ বছরের প্রাথমিক’ শিক্ষা সমাপ্ত করতে উৎসাহিত করা, ঝরে পড়ার হার হ্রাস করা এবং তাদের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সরকার প্রাথমিক’ শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করেছে। ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকগণ এক সন্তানের জন্য মাসিক ১০০ টাকা এবং একাধিক সন্তানের জন্য ১২৫ টাকা হারে বৃত্তি পাবেন। তবে শর্ত হচ্ছে, স্কুল দিবসের শতকরা ৮৫ দিন উপস্থিত থাকতে হবে এবং পরীক্ষায় অন্তত শতকরা ৪০ নম্বর পেতে হবে। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৬৩ কোটি টাকা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন : সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, তৃণমূল পর্যন্ত শিক্ষার বিস্তার এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষার ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বারোপ করার লক্ষ্যে সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগকে ২০০৩ সালের ২ জানুয়ারি পূর্ণ মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরিত করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষায় জাতীয় সম্পদের যোগান ও ব্যবহার : মানবসম্পদ উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার পরিমাণগত সম্প্রসারণ এবং গুণগত মানোন্নয়ন অর্থের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক এ প্রেক্ষিতেই শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বিনিয়োগ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদ এবং অর্থনীতিবিদের গবেষণাকর্মে দেখা গেছে, শিক্ষা বিশেষ করে প্রাথমিক’ শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ থেকে সর্বাধিক ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রত্যর্পণ (return) বা ফল পাওয়া যায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষা খাতে অর্থসংস্থান সর্বদাই অপর্যাপ্ত, এর ব্যবস্থাপনাও সমস্যাসংকুল । আশির দশকে শিক্ষায় গড় সরকারি ব্যয় ছিল জাতীয় আয়ের ১.৩ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষার পেছনে সরকারি ব্যয় জাতীয় আয়ের কমবেশি শতকরা ২.১৭ ভাগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় আয়ের অন্যূন ৫.৫ শতাংশ শিক্ষার পেছনে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সার্কভুক্ত দেশগুলোর চেয়েও অনেক কম অর্থ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। তবে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পেছনে সরকারি ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রস্তাবিত ব্যয়ের সঙ্গে সংশোধিত বায় সঙ্গতিও বেড়েছে আশানুরূপভাবে। কিন্তু বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগই শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন যোগাতেই ব্যয় হয়ে যায়। শিক্ষক প্রশিক্ষণ, গবেষণা, পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ খুবই সামান্য। ফলে সঙ্গত কারণেই প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানের চেয়ে সংখ্যা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রাধান্য পেয়েছে।
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান অবস্থা ও সাফল্য : বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে সর্বজনীন প্রাথমিক’ শিক্ষা বিস্তারের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। প্রাথমিক- শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়েছে, ঝরে পড়ার হার কমেছে এবং পাঁচ বছরের প্রাথমিক’ শিক্ষা সমাপ্তকারীর হারও অনেক বেড়েছে। নিচে প্রাথমিক’ শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যাবলী সারণী আকারে উপস্থাপন করা হলো :
সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সুষম বিস্তার ও গুণগত মানোন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ : প্রাথমিক’ শিক্ষায় সর্বাধিক বাজেট বরাদ্দ, ছাত্র উপবৃত্তি প্রকল্প চালু, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের প্রবর্তন, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক’ শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিট প্রতিষ্ঠা, প্রাথমিক’ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে দেশব্যাপী সর্বজনীন প্রাথমিক’ শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এসবের ফলে শিক্ষার হার ও সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট অগ্রগতি পরিলক্ষিত হলেও এখনো অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়নি । নিচে প্রতিবন্ধকতাগুলোর একটি চিত্র তুলে ধরা হলো :
শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষক অপ্রতুলতা কাটেনি, ফলে অধিকাংশ স্কুলে তথাকথিত স্ট্যাগারিং পদ্ধতি চলছে। শহর ও গ্রামে শিক্ষার মান ও সুযোগ-সুবিধা সমান নয়। এ ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছেই । ছাত্র হাজিরা অসন্তোষজনক। গড় উপস্থিতি মাত্র ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ।
ঝরে পড়ার হার এখনো অবাঞ্ছিত রকমের। বর্তমানে সরকারি হিসেবেই ৩০ শতাংশ
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার আগেই করে পড়ে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অত্যন্ত বেশি। বর্তমানে ১ : ৬৩। ফলে শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। পাঠদানের নির্ধারিত সময় অত্যন্ত কম, বছরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৪৪৪ ঘণ্টা এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে ৭৩৪ ঘণ্টা।
মূল্যায়ন পদ্ধতি যুগোপযোগী নয়। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। শৈশবকালীন শিশুদের পরিচর্যা ও উন্নয়ন এবং প্রাক-প্রাথমিক’ শিক্ষা বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। অনেক স্কুলে অনানুষ্ঠানিকভাবে শিশু শ্রেণী চালু থাকলেও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে বাড়ির স্বচ্ছন্দ পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে অপরিচিত স্কুল পরিবেশে এসে শিশু শিক্ষার্থীরা যে অস্বস্তি বোধ করে তা নিরসনের কোনো উপায় নেই। অথচ ঝরে পড়ার এটাও একটি অন্যতম কারণ। শিক্ষকদের ইন সার্ভিস ট্রেনিং বলতে কিছু নেই। একদিনের সাব ব্লাস্টার ট্রেনিং থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। স্কুল ম্যানেজিং কমিটি এবং শিক্ষক অভিভাবক সমিতির অধিকাংশেরই শিক্ষার প্রতি কোনো
অঙ্গীকার নেই। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় সমাজ সম্পৃক্তকরণ ফলপ্রসু নয়। শিক্ষকরা পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিস্পৃহ, মূলত ট্রেড ইউনিয়ন ও অন্যান্য কাজে বেশি লিপ্ত। বেসরকারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ ত্রুটিপূর্ণ, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগ করা হয় না। ফলে দুর্বল শিক্ষক নিয়োগ পায়। পরিণামে মানসম্মত শিক্ষাদান সম্ভব হয় না। প্রধান শিক্ষকের কর্তৃত্বের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে স্কুল ব্যবস্থাপনা অকার্যকর। তাদের ক্ষমতায়ন প্রয়োজন।
স্কুল প্রতিষ্ঠায় কোনো সমতা রক্ষা করা হয় না। উদ্যোক্তারা পছন্দমতো জায়গায় স্কুল নির্মাণ করেন। ফলে স্কুলের স্থানানুগ চাহিদা অনেক সময় অপূর্ণ থাকে। এর ফলে দেখা যায় চরাঞ্চল, পার্বত্য এলাকা এবং গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়ের ঘনত্ব শহুরে অঞ্চলের তুলনায় যথেষ্ট কম।
শিক্ষকদের পারফরমেন্স পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। তদারকি ও পরিবীক্ষণে শিখন-শিক্ষণ গুরুত্ব পায় না। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন সাব সেক্টর, শিক্ষা স্তর সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার অভাব শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক সিস্টেম লসের অন্যতম কারণ। অধিকাংশ পরিদর্শক ও তত্ত্ববধায়কের পেশাগত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্ম অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকৃত অর্থে একাডেমিক সুপারভিশন হয় না। নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে গৃহীত পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবধর্মী হয় না। তথ্যের বিভিন্ন উৎস ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই এর প্রধান কারণ । শিক্ষা সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের বাস্তবায়নে নমনীয়তা এবং জবাবদিহিতার অভাব প্রাথমিক’ শিক্ষাক্ষেত্রে সিস্টেম লস ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
স্বল্প সংখ্যক শিক্ষক দিয়েই শিশু জরিপ, পাঠ পারিকল্পনা তৈরি, শ্রেণী পঠন-পাঠন, উপবৃত্তি সংক্রান্ত কাজ সম্পাদন, নিয়মিত তথ্য ছক পূরণ ছাড়াও অফিস সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ করতে হয়। এতে শ্রেণীতে পাঠদানের কাজ ব্যাহত হয়। এছাড়া শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থা, পদোন্নতি সমস্যা, ভৌত সুবিধার অপ্রতুলতা, দপ্তরি সমস্যা, শিশু জীবনের সঙ্গে শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতার অভাব, পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের অভাব, অভিভাবকদের দারিদ্র্য ও অসচেতনতা এবং রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যাপক ঘুষ ও দুর্নীতি, উচ্চপদে বিভাগবহির্ভূত লোকের পদয়ন ইত্যাদি নানাবিধ কারণে সর্বজনীন প্রাথমিক ‘শিক্ষার সুষম বিস্তার ও গুণগত মানোন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় : প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান এসব সমস্যা সমাধানের জন্য ইতিপূর্বে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার অনেকগুলোই যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ বিনিয়োগের অভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিককালে সাধারণভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে এবং বিশেষভাবে প্রাথমিক’ শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু এখনো তা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শুধু নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় হারের চেয়েও অনেক কম।
মূলত এই বিনিয়োগের দৈন্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রীহীন দশা এবং অনাকর্ষণীয় পরিবেশের জন্য দায়ী। কাজেই সর্বামে শিক্ষা খাতে এবং প্রাথমিক’ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ অন্তত দ্বিগুণ করতে হবে। এছাড়া সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেগুলো হলো :
১. জরিপের মাধ্যমে দু কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সব শিশুর জন্য পাঁচ বা ছয় কক্ষবিশিষ্ট বিদ্যালয় স্থাপন নিশ্চিত করা। ২. বিদ্যালয়গুলোর ভৌত পরিবেশ উন্নত করে তাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থীর বসার ব্যবস্থা ও যথেষ্ট পরিমাণ পাঠ্যপুস্তক, বোর্ড, চক প্রভৃতি শিক্ষা উপকরণের সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৩. শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উপযুক্ত মানের শিক্ষক সরবরাহ করা এবং তাদের পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৪. আকর্ষণীয় শিক্ষাক্রম প্রবর্তন এবং তাতে শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিফলন, পরিবেশের ওপর গুরুত্ব দান ও আনন্দের উপকরণ সংযোজন করা।
৫. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং উচ্চতর বেতন স্কেল প্রদান করা। ৬. শিক্ষকদের কাজের ব্যাপকতা হ্রাস করা। ৭. প্রতিটি বিদ্যালয়ে দপ্তরি, অফিস সহকারী (করণিক) নিয়োগ করা। ৮. পিটিআই ও উপজেলা রিসোর্স সেন্টারকে আধুনিকীকরণের মাধ্যমে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৯. ঘুষ, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করা।
উপসংহার : সর্বজনীন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে জাতীয় অঙ্গীকার, স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টা এবং সার্বিক গুণগত ব্যবস্থাপনা থাকা। সার্বিক গুণগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব, অনুপ্রাণিত জনশক্তি, অনুকূল পরিবেশ ও সহমর্মিতা, সংশোধনমূলক তদারকি এবং অধিকতর সামাজিক সম্পৃক্ততা অর্জন করা সম্ভব। আমরা যদি শিক্ষার জন্য একটা শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করতে চাই তাহলে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনীমূলক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুকূলে অবকাঠামো ও পরিবেশ ছাড়াও উন্নত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রশিক্ষক এবং মানসম্মত শিখন-শিক্ষাসামগ্রী যোগানের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
এসবের জন্য গোটা প্রাথমিক’ শিক্ষাব্যবস্থায় দায়দায়িত্ব পুনঃসংজ্ঞায়িতকরণসহ ‘স্টাফ প্রোফাইল’ পুনঃনির্ধারণ ও স্টাফ অডিট’-এর প্রচলন করতে হবে, যাতে কর্মরত প্রতিটি লোক অনুধাবন করতে পারে, মানসম্মত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে তাকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে নতুনত্ব বা সৃজনশীলতার নামে প্রাথমিক শিক্ষার যে কোনো ধরনের বিচ্যুতিও নিরুৎসাহিত করতে হবে।
আরও দেখুন:
- ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম | কৃষি-কৃষক ও পল্লী উন্নয়ন | বাংলা রচনা সম্ভার
- অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার
- অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পুষ্টিঘাটতি পূরণে মৎস্য | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার
- জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার