অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পুষ্টিঘাটতি পূরণে মৎস্য | অর্থনীতি, উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড়, উন্মুক্ত জলাশয় এবং প্লাবন ভূমি এ দেশকে মৎস্যচাষ ও আহরণের পাদভূমিতে পরিণত করেছে। এক সময় বলা হতো ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম দিক।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পুষ্টিঘাটতি পূরণে মৎস্য | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পুষ্টিঘাটতি পূরণে মৎস্য
পূর্বে এ দেশে অল্প শ্রম ও পুঁজিতে অতি সহজেই মৎস্য আহরণ করা যেত। তাছাড়া তখন মুক্ত জলাশয় এবং বদ্ধ জলাশয় উভয় ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকভাবে প্রচুর পরিমাণ মৎস্য উৎপাদিত হতো। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অবকাঠামোগত পরিবর্তন ইত্যাদির ফলে বাংলাদেশে অনেক জাতের মাছই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে চাহিদার তুলনায় মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে।
তবে মাছের মাথাপিছু উৎপাদন হ্রাসের জন্য জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধিও দায়ী। তাই মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরকেও বিজ্ঞানভিত্তিক উৎপাদন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। তাছাড়া মৎস্যচাষ আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধান ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং জনগণের প্রোটিনের ঘাটতি মেটাতে মৎস্যসম্পদের গুরুত্ব অনেক
বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ : বাংলাদেশে সাধারণত চার ধরনের ক্ষেত্র থেকে মৎস্য আহরণ ও চাষ করা হয়। যেমন—
ক. বদ্ধ জলাশয় : বাংলাদেশে চাষ উপযোগী প্রায় ২০ লক্ষ পুকুর ও দীঘি রয়েছে, যার আয়তন প্রায় ২.৭২ লক্ষ হেক্টর। তাছাড়া প্রায় ৬০০০ হেক্টর বাওড় রয়েছে। এছাড়া অসংখ্য মৌসুমী জলাশয়, রাস্তা পার্শ্বস্থ ডোবা, জলাধার, পাহাড়ি ক্রিক ইত্যাদি জলাভূমির আয়তন প্রায় ৫.৭ লক্ষ হেক্টর। পুকুরের বর্তমান হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ২.৫ মেট্রিক টন, যা যথাযথ কৌশল ও আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ৪ মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব। তাছাড়া দেশে চাষযোগ্য পোল্ডার/একক্লোজার, বিল, ধানী জমি, উপকূলীয় ঘের এবং মিঠাপানির বদ্ধ জলাভূমির পরিমাণ ১৪.৫১ লক্ষ হেক্টর । এসব জলাভূমির বর্তমান হেক্টর প্রতি উৎপাদন ৫০৫ কেজি।
খ. মুক্ত জলাশয় ; নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, সুন্দরবন ও মোহনা অঞ্চল, কাপ্তাই হ্রদ ও প্লাবনভূমি মিলে দেশে প্রায় ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর মুক্ত জলাশয় রয়েছে, যেখান থেকে বাৎসরিক প্রায় ৭.১৬ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদিত হয়।
গ. উপকূলীয় জলাভূমি : এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জলাভূমি চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনার জন্য খুবই উপযোগী । প্রাথমিক পর্যায়ে সনাতনী পদ্ধতিতে চাষ হলেও পরবর্তী পর্যায়ে উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারিত হয়। উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষভুক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ১.৪১ লাখ হেক্টর। এ সকল জলাভূমিতে চিংড়ি উৎপাদনের বর্তমান গড় হার প্রায় ৩,০০,৪০০ কেজি। এখানে গলদা এবং বাগদা উভয় জাতের চিংড়িই চাষ হয়। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কক্সবাজার, ভোলা প্রভৃতি জেলায় চিংড়ির চাষ হয়।
ঘ. সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ : বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ১,৪০,৯১৫ বর্ণ কিলোমিটার। এছাড়া মোহনা অঞ্চল, সুন্দরবনের রক্ষিত জলাভূমি, বেইজলাইন জলাভূমি ও আন্তঃদেশীয় অঞ্চলের জলাভূমি মিলে রয়েছে সর্বমোট প্রায় ২.৬৩ লাখ বর্গ কিলোমিটার জলাশয়। দেশে সামুদ্রিক জলাশয়ের আয়তন সাধুপানির এলাকার চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও সামুদ্রিক উৎ থেকে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ২১.৩১ ভাগ আহরিত হয়।
সর্বোপরি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৫-এর হিসাব অনুযায়ী দেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত ও বন্ধ জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৪.৪ লাখ হেক্টর। ২০০৩-২০০৪ অর্থবছরে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২১.০২ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্যসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন—
ক. মৎস্য আমাদের একটি অতীব মূল্যবান ও সম্ভাবনাময় দেশীয় সম্পদ। দেশে যে পরিমাণ মৎস্য চাষোপযোগী জলাশয় রয়েছে এগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে মৎস্যচাষের ব্যবস্থা করতে পারলে তা দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা অল্প পুঁজি, ন্যূনতম প্রশিক্ষণ ও সহজতর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে একটি দরিদ্র পরিবারও সরকারি- বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাবলম্বী হতে পারে। এজন্য আমাদেরকে বিদেশী ঋণের বোঝা কিংবা এনজিওর খপ্পর—কোনোটিই বরণ করতে হবে না। প্রয়োজন কেবল দক্ষ ব্যবস্থাপনা, জনসচেতনতা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ।
খ, বাংলাদেশে বর্তমানে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী বেকার রয়েছে। বিশেষ করে যুব বেকারদের কর্মস্পৃহা ও সামর্থ্য সত্ত্বেও তারা জাতির জন্য বোঝা হয়ে আছে। এখচ মৎস্যখাতের উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক যুবক তাদের সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে। দেশে যে প্রায় ৪৫ লাখ হেক্টর জলাশয় রয়েছে, এর অধিকাংশতেই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করা হচ্ছে না। তাই স্বল্প প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পুঁজি সরবরাহের মাধ্যমে দেশের যুবসমাজকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৎস্যচাষে উৎসাহিত করতে পারলে তারা প্রচলিত দাপ্তরিক চাকরির মোহ থেকে অবশ্যই মুক্তি পাবে। এভাবে দেশের একটা বিরাট সম্ভাবনাময় অংশ আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পাবে।
গ. দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্যখাতের ওপর নির্ভরশীল। ১৩ লাখ লোক সরাসরি মৎস্যচাষ ও আহরণের কাজে নিয়োজিত। কিন্তু মৎস্যখাতের দুরবস্থা তথা বিভিন্ন জাতের মাছের বিলুপ্তি ও খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওড়ে মাছের আকাল দেশের এ বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবনে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে দেশের জেলে পল্লীগুলোর দিকে তাকালেই এ বিপর্যয়ের ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়। তাই পরিকল্পিত উপায়ে
দেশের মৎস্যসম্পদের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে মৎস্য চাষ ও আহরণের সাথে সম্পৃক্ত একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। অথচ অব্যাহত সরকারি প্রচেষ্টা এবং যথাযথ কলাকৌশল প্রয়োগ করে করে উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছ সংরক্ষণ, বদ্ধ জলাশয়ের পরিকল্পিত মৎস্য উৎপাদন এবং সামুদ্রিক ও উপকূলীয় এলাকায় অবাধে মৎস্যনিধন রোধ করা যায়। এতে দেশে সার্বিকভাবে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর আয়-রোজগার বাড়ার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঘ. রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও মৎস্যসম্পদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের রপ্তানি আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ (প্রায় ৬ ভাগ) আসে মৎস্যখাত থেকে। প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার হিমায়িত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। এমনকি আমাদের ৭১১ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখা বরাবর ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত প্রায় পৌনে ২ লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে যে সামুদ্রিক জলসম্পদ রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের মৎস্য রপ্তানির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করতে পারি।
কেননা কক্সবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা, ভোলা, নোয়াখালী প্রভৃতি জেলায় উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষকে আরো সম্প্রসারিত করা সম্ভব। এতে একদিকে যেমন আমাদের বাণিজ্যিক ভারসাম্য অবস্থার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পাশাপাশি অত্যন্ত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। এমনকি এর পুরোটাই দেশীয় সম্পদ হওয়ায় তা উন্নত প্রযুক্তি আমদানি ও বিকাশ এবং এর মাধ্যমে শিল্পায়নকে ত্বরান্বিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ঙ. দেশের প্রায় ১৩ কোটি লোকের প্রোটিনের যে বিশাল চাহিদা তা পূরণেও মৎস্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এক হিসাব মতে, এ দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ ভাগ আসে মৎস্য থেকে। এ প্রেক্ষিতে দেখা যায়, দেশে মোট মৎস্যের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩২ লাখ মেট্রিক টন। অথচ উৎপাদিত হয় মাত্র ২১ লাখ মেট্রিক টন। তাই দেশে এখনো প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন। মৎস্য ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে দেশের জনগোষ্ঠীর প্রেটিনেরও প্রচুর অভাব রয়েছে। এমনকি মৎস্য উৎপাদন ব্যাহত ও হ্রাস পাওয়ায় জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’–এ প্রবাদটি আজ কেবলই কল্পনা। তাই প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুস্থ সবল জাতি গঠনে মৎস্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চ. সর্বোপরি জনগণের জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি আনয়নে মৎস্যচাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা আমাদের দেশে যে সীমিত পরিমাণ কৃষিজমি তাতে, গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করে জীবনের পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব নয়। তাই কৃষি বহুমুখীকরণের নীতির ভিত্তিতে চাষাবাদযোগ্য জমিতে পরিকল্পিত উপায়ে ধান চাষের পাশাপাশি মাছ চাষ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে ।
বাংলাদেশের মৎস্যখাতের বিদ্যমান সমস্যাবলী ও এর কারণ : অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর- বাওড়, সামুদ্রিক জলসম্পদ আর বিরাট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও এ দেশের মৎস্যখাত আজ গভীর সংকটে নিপতিত। মৎস্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে অজস্র সমস্যা। এ সকল সমস্যার ফলে কেবল মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়াসই ব্যাহত হচ্ছে না বরং বিদ্যমান বিপুল পরিমাণ মৎস্যসম্পদ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ অবস্থা অবশ্য একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বরং দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা ও অব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক পরিণতিতে আজকের এ নাজুক অবস্থা । তবে এ অবস্থার জন্য দায়ী কারণগুলোর অন্যতম হলো :
১. রাজস্বভিত্তিক ইজারা ব্যবস্থাপনায় ইজারাগ্রহীতারা অধিক লাভের আশায় জলমহাল থেকে নির্বিচারে মৎস্য আহরণ করছে। তাছাড়া ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জলাগুলোকেও সেচে সম্পূর্ণরূপে মৎস্য আহরণ করা হচ্ছে। ফলে পরবর্তী বছর মৎস্য প্রজননের প্রয়োজনীয় মাছ জলাশয়গুলোতে থাকছে না। এ অবস্থায় জলমহালগুলোতে মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রও সংরক্ষণ করা হচ্ছে না । ২. দেশে যৎসামান্য ডিমওয়ালা ও পোনামাছ যা আছে তাও নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারি বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না ।
৩. বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম যেমন- কৃষি কাজে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মাছের স্বাভাবিক জীবন প্রণালী ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং সড়ক ও রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রাক্কালে যথাযথভাবে ফিস পাস (Fish Pass) নির্মাণ না করায় মাছের বিচরণ, প্রজনন ও শুষ্ক মৌসুমে প্লাবন ভূমি থেকে মুক্ত জলাশয়ে যাতায়াত ব্যাহত হচ্ছে।
৪ . কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, নগর ও বন্দরের বর্জ্যপদার্থ দ্বারা জলাশয় দূষণের ফলে মাছের প্রজননক্ষেত্র বিনষ্টসহ মাছের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবেশগত বিপর্যয়ে মুক্ত জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
৫. বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচ প্রকল্পের প্রয়োজনে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মনুষ্যসৃষ্ট বিবিধ প্রতিকূল পরিবেশ, প্রতিবেশী দেশের উজানে বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি কারণে জলমহালে অতিরিক্ত পলি পড়ে মাছের আবাসস্থলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। তাছাড়া মাছের উৎপাদন ও প্রজনন চালু রাখতে প্রয়োজনীয় অভয়াশ্রমও রাখা হচ্ছে না ।
৬. মৎস্য বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ মাছ ধরা হয় তার শতকরা ২৫ ভাগই হচ্ছে কারেন্ট জালের মাধ্যমে। কারেন্ট জালের মাধ্যমে প্রতি বছর কেবল জাটকা অর্থাৎ ইলিশের বাচ্চাই নিধন করা হয় ২০ হাজার মেট্রিক টন। ডিমওয়ালা ইলিশ এবং এ ২০ হাজার মেট্রিক টন জাটকার অন্তত শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগও যদি নিধন বন্ধ করা সম্ভব হয় তাহলে বছরে অতিরিক্ত আড়াই লাখ টন ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
৭. আমাদের ‘হোয়াইট গোল্ড’ বলে পরিচিত চিংড়ির চাষও নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় গড়ে ওঠা ঘেরগুলোর যেমন কোনো সামঞ্জস্য নেই, তেমনি এগুলো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অনুপযুক্ত স্থানে অপরিকল্পিত উপায়ে। এর কারণ লাগসই প্রযুক্তিনির্ভর কারিগরি জ্ঞানের অভাব। এ খাতের অন্যান্য সমস্যাগুলোর অন্যতম হলো উপযুক্ত/মৌসুমী সময়ে চিংড়ি পোনার অপর্যাপ্ত সরবরাহ, চিংড়ির রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ে প্রয়োজনীয় গবেষণগার/স্বাস্থ্য পরীক্ষাগার না থাকা ও অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ প্রভৃতি। এ সকল সমস্যার যথাযথ সমাধান করতে পারলে দেশের রূপালী বিপ্লবকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
মৎস্য সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কলাকৌশল এবং করণীয় : দেশে বর্তমানে ১৪ লাখ মেট্রিক টন মাছের যে বিপুল ঘাটতি তা পূরণ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য মৎস্য উৎপাদন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং আমাদের মৎস্যখাতের বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে এ খাতের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি আশু দৃষ্টি দেয়া দরকার : প্রথমত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষিকাজের প্রয়োজনে সেচ প্রকল্পভুক্ত এলাকায় বাঁধ ও রাস্তাঘাট নির্মাণের
প্রাক্কালে মৎস্যসম্পদের বিকল্প জলাধার সৃষ্টি ও ফিস পাস নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেতরের এলাকাসহ সুবিধাজনক যে কোনো ধান চাষ এলাকায় বাড়তি ফসল হিসেবে মাছ উৎপাদনের জন্য ধানক্ষেতে মাছ চাষের কার্যক্রম চালু করতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রজননক্ষম মাছের মজুদ বৃদ্ধি এবং বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির রক্ষার্থে রুই, পাঙ্গাস, ইলিশজাতীয় মাছসহ অন্যান্য মাছ জলমহালের যে অংশে প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন করে সে অংশ/ স্থানকে চিহ্নিত করে সুফলভোগী জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপনে উদ্যোগী হতে হবে।
চতুর্থত, সুফলভোগীদের অংশীদারিত্বমূলক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পোনামাছ অবমুক্তকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ।
পঞ্চমত, আহরণ চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য মৎস্য আহরণের ব্যবহৃত জাল ও সুফলভোগীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কারেন্ট জালের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণে কার্যকরী ব্যবস্থাগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও তার বাস্তবায়ন দেখার জন্য জাতি অপেক্ষমান।।
ষষ্ঠত, অতিরিক্ত পলি পড়ে যে সকল মুক্ত জলমহালে মাছের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে মাছের স্বাভাবিক জীবন প্রণালীর ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলছে, সে সকল জলমহাল সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নেয়া আবশ্যক।
সপ্তমত, জৈবিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় উৎপাদন পরিকল্পনার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি জলমহাল ইজারা প্রদান ও উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে জলমহালের ভৌতিক ও পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে ইজারা মূল্য নির্ধারণ করা উচিত।
অষ্টমত, ইলিশ মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য জৈবিক কার্যক্রম গ্রহণ করা আবশ্যক।
নবমত, উপকূলীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা প্রণয়ন করে ভূমির শ্রেণীবিন্যাস করে উক্ত ভূমিতে স্থানীয় সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ সহনীয় লাগসই চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ আবশ্যক।
দশমত, উপযুক্ত সময়ে সুস্থ, সবল চিংড়ি পোনা সরবরাহ, চিংড়ি পোনার মৃত্যুহার হ্রাসের জন্য বিমান এবং অন্যান্য উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি আবশ্যক ।
একাদশত, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের পরিমাণ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি আহরণোত্তর মজুদ পুনঃনিরূপণ এবং সহনশীল মাত্রায় আহরণযোগ্য ফলন ধরার পরিমাণ নির্ণয়ে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কার্যক্রম গ্রহণ আবশ্যক।
উপসংহার : সর্বোপরি বাংলাদেশে মৎস্যসম্পদের যে বিপুল সম্ভাবনা একে কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া মৎস্যসম্পদের গুরুত্বকে সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে তুলে ধরতে না পারলে কোনো কার্যক্রমই সফল হবে না ।
আরও দেখুন: