Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

উন্নয়নের জন্য শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

উন্নয়নের জন্য শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : সৃষ্টির আদিতে মানবজাতি মূলত ছিল প্রকৃতি নির্ভর। কালের আবর্তে নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে আধুনিক সভ্য মানুষের সৃষ্টি। মানবজাতির উন্নয়নের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো যখনই শিক্ষার প্রসার ঘটেছে তখনই উন্নয়ন দ্রুত বেগবান হয়েছে। কাজেই ইতিহাসের আলোকে আমরা বলতে পারি শিক্ষা উন্নয়নের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

উন্নয়নের জন্য শিক্ষা | শিক্ষাবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

উন্নয়নের জন্য শিক্ষা

আধুনিক যুগে উন্নয়নের ধারণা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। আর প্রবৃদ্ধির ধারণা শিল্প উৎপাদন ও আধুনিক সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই নিঃসন্দেহে এ প্রক্রিয়ায় পুঁজির অংশগ্রহণ অত্যন্ত উঁচু। এ পুঁজির মধ্যে শুধু বৈষয়িক পুঁজিই নয় বরং মানবিক পুঁজিও (জনগণের জ্ঞান ও তার ব্যবহারের জন্য প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা) রয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই শুধুমাত্র উন্নয়ন নিশ্চিত করে না । তাই আমাদের এ স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া চাই, যা দেশের সামাজিক মূল্যবোধ, ঐতিহাসিক অর্জন, সংস্কৃতি ও নৈতিকতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

 

উন্নয়ন ও শিক্ষা : বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে কোনো দেশের উন্নয়ন বলতে মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বোঝায়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো দেশের বা অঞ্চলের জনগণ প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে মাথাপিছু দ্রব্য ও সেবাকার্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রয়াসী হয়। এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় হলো ব্যাপক শিক্ষা বিস্তার। দেশে ব্যাপকভাবে শিক্ষার বিস্তার না হলে লোকের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয় না।

সংস্কৃত ‘শিষ’ শব্দ থেকে শিক্ষা কথাটি এসেছে। এর অর্থ হলো শাসন বা শৃঙ্খলা বা নির্দেশনা। ইংরেজি ‘Education’ শব্দটি ‘Educated’ থেকে এসেছে। যার অর্থ হলো প্রতিপালন বা পরিচর্যা করা। শিক্ষাকে দুটি অর্থে ব্যবহার করা হয়। ১. সংকীর্ণ অর্থে ও ২. ব্যাপক অর্থে ।

সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে দক্ষতা অর্জনকে বোঝানো হয়ে থাকে, যা মূলত পাঠ্যপুস্তক নির্ভর। অন্যদিকে ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হলো মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন। যার মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুদা তার ‘শিক্ষা’ নামক প্রবন্ধে ব্যাপক অর্থে শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ শিক্ষা মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশের মাধ্যমে একজন মানুষকে পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। যার ফলে মানুষ সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি তরান্বিত করে। তাই উন্নয়ন ও শিক্ষা একে অন্যের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।

উন্নয়নে শিক্ষার গরুত্ব : উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা তথা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা, জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন তথা আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। তাই এ শিক্ষা হতে হবে সহজলভ্য । আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে যে দৈন্যদশা তা ১০০ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলেন, ‘আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ বলে ঠিক সাড়ে তিন হাত গৃহ নির্মাণ করলে চলে  না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান থাকা প্রয়োজন, না হলে আমাদের স্বাস্থ্য ও আনন্দের ব্যাঘাত ঘটে।’ শিক্ষা সম্বন্ধেও এ কথা খাটে।

যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা, অর্থাৎ অত্যাবশ্যক তার মধ্যে শিশুদেরকে আটকে রাখলে কখনও তাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়তে পারে না। আবশ্যিক শিক্ষার সাথে স্বাধীন পাঠ না মেশালে ছেলে ভালো করে মানুষ হতে পারে না- বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও বৃদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে সে অনেকটা শিশু থেকে যায়। এ উদ্ধৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারি পরিপূর্ণ মানুষ তথা বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মানুষ বা মানবসম্পদ হিসেবে পরিগণিত হতে হলে ব্যাপক অর্থে শিক্ষার গুরুত্ব অপরীসীম। কারণ দক্ষ মানবসম্পদই উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

মানুষের কার্যকর স্বাধীনতা প্রদানের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের মানবিকীকরণে শিক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার মতো সামাজিক অধিকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণের অধিকারকে সহজে লভ্য করে তোলে। অর্থাৎ শিক্ষা নিজে প্রত্যক্ষভাবে নয় বরং অনগ্রসর মানবসমাজকে (তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত) দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমেই কেবল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দিকে চালিত করে।

উন্নয়ন নিজে নিজে সাধিত হয় না। সকল প্রকার উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মানুষ। আর মানুষকে এ উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত হতে হলে, অর্থাৎ উন্নয়নযজ্ঞে শামিল হতে হলে তাকে দক্ষতা অর্জন করতে হবে অর্থাৎ মানবসম্পদে রূপান্তরিত হতে হবে। এ কাজটিই করে থাকে শিক্ষা। অতএব দেশে যত রকমের সম্পদ এবং সম্ভাবনা তা আহরণ ও ব্যবহার উপযোগী করে তোলার কাজ করে থাকে দক্ষ মানবসম্পদ। তাই দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মানবসম্পদের নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।

বর্তমান সময়ে যে কোনো দেশের জনগোষ্ঠীই সে দেশের প্রধান সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামগ্রিক উন্নয়ন যে জনগণের দক্ষতা, পরিশ্রম ও উদ্যোগের ওপর নির্ভর করে তা সীমিত ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে। তাই বলাই যায়, উন্নয়ন প্রকৃতপক্ষে দক্ষ মানবসম্পদের দ্বারাই সম্ভব। প্রাকৃতিক সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ তবে তা যথেষ্ট নয়। আবার সম্পদের অপ্রতুলতাও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা নয় । একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে মূলত দেশটির মানব সম্পদের উন্নয়ন তথা শিক্ষাব্যবস্থার সফল প্রয়োগের ওপর ।

উন্নয়নের উপায় : উন্নয়ন ও শিক্ষা একে অপরের সাথে উদ্দেশ্য ও উপায় সম্পর্কে সম্পর্কিত। এখানে উদ্দেশ্য হলো উন্নয়ন এবং সেক্ষেত্রে শিক্ষাকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ উপায় ছাড়া উদ্দেশ্য বা অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয় ।

সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, উচ্চ হারের মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সুনির্বাচিত উচ্চ শিক্ষা যে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে সে শিক্ষা আমরা পাই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে। মানব সম্পদ গঠনের এ প্রক্রিয়া ঐ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে যে অবদান রেখেছে, সে বিষয়ে প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই একমত। তবে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ, অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়েও মানব সম্পদের উন্নয়নের গতিকে আরো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

হার্বিসন এবং মায়ার্স মানবসম্পদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাঁচটি উপায়ের উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো :

১. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা : প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাঠামোর মাধ্যমিক শিক্ষা এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে বোঝানো হয়েছে।

২. কর্মকালীন প্রশিক্ষণ : ধারাবাহিক বা উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা।

৩. আত্মউন্নয়ন : আত্মউন্নয়ন বলতে ব্যক্তির জ্ঞান, দক্ষতা ও সামর্থ্যের উন্নয়নকে বোঝায়। যা ব্যক্তি তার নিজের চেষ্টায় আনুষ্ঠানিক উপায়ে বা দূরশিক্ষণের মাধ্যমে অনুষ্ঠানিক উপায়ে অন্যের কাছ থেকে শিখে নিজের আগ্রহ ও কৌতূহল অনুযায়ী ব্যাপক গুণমান, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে।

৪. স্বাস্থ্য উন্নয়ন : উন্নতমানের চিকিৎসাব্যবস্থা এবং গণস্বাস্থ্য কার্যক্রমের মাধ্যমে কর্মরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য উন্নয়ন ঘটে। ৫. পুষ্টি উন্নয়ন : পুষ্টি মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে মানুষ অধিক সময় ধরে কাজ করতে পারে এবং তার কর্মজীবন দীর্ঘ হয়।

উন্নয়নে শিক্ষার অবদান : শিক্ষা যে উন্নয়নের প্রত্যক্ষ সহায়ক তার প্রমাণ মেলে পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের দিকে দৃষ্টি দিলে। শিক্ষার প্রতি প্রাধান্য যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তরান্বিত করেছে তাই নয়; এর মাধ্যমে সামাজিক সাম্য, মানুষের জীবনযাত্রার মানেরও উন্নয়ন ঘটেছে। আয়ের বৈষম্য, শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, বেড়েছে স্বাস্থ্যসুবিধা এবং গড় আয়ু। শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও মানবসম্পদ তৈরির প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে রাষ্ট্রসমূহ যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে।

পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে বর্তমানে শিক্ষাখাতে বেশকিছু কার্যকরী পরিকল্পনা নেয়ার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। গুণগত মানের দিকেও রয়েছে সতর্ক দৃষ্টি। তাছাড়া এ অঞ্চলের দেশসমূহে শিক্ষার প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর পরবর্তী শিক্ষাকে সময়োপযোগী তথা শ্রম বাজারের চাহিদা অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়েছে। তবে তাদের সনাতনী শিক্ষাব্যবস্থাকেও যে অবহেলা করা হচ্ছে তা নয়। সময়োপযোগী উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে যা তাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে জনসম্পদকে মানবসম্পদে রূপান্তরের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা পালন করে । যেমন-

১. পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি : শিক্ষা মানুষকে তার নিজ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করে। ফলে সে তার অবস্থানের পরিবর্তন কামনা করে এবং পরিবর্তনে উৎসাহী হয়।

২. জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করে : শিক্ষা ছাড়া একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভরশীল। আর তাই সে বিভিন্নভাবে প্রতারণার স্বীকার হয়। কিন্তু এ ব্যক্তিই শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের ও পরিবারের উন্নয়ন এবং দেশের উন্নয়নমূলক কাজে অবদান রাখতে পারে। কারণ শিক্ষা জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করে।

৩. মানুষের চিন্তা ও বিচারশক্তির বিকাশ সাধন : শিক্ষা মানুষের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন সাধন করে, যার ফলে মানুষ তার চিন্তা ও বিচারশক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত ও আর্থসামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ করে সঠিক কর্মপন্থা উদ্ভাবন ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা প্রণয়নে সচেষ্ট হয় । ফলে তারা সামাজিক ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে অবদান রাখে।

৪. সমাজ সচেতনতা ও ঐক্যবোধ জাগ্রত করে : শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উদার করে। চেতনার উন্মেষ ঘটায়। তারা ব্যক্তির জীবনে সমাজের প্রভাব এবং সমাজের প্রতি তার যে কর্তব্য তা অনুধাবন করতে শেখায়। তারা সমাজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমাজসেবী সংগঠন, সমিতি ও অন্যান্য সংগঠন গড়তে উদ্যোগী হয়।

৫. নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ববোধের উন্মেষ : শিক্ষা মানুষকে তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে। ফলে তারা অধিকার প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। এছাড়াও তারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তাদের মতামত পেশ করতে পারে।

৬. কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি দক্ষতা শব্দটি শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট। শিক্ষার মাধ্যমেই কর্মে মানুষের দক্ষতা বাড়ে। একজন নিরক্ষর কর্মীর তুলনায় একজন সাক্ষরকর্মী অধিক দক্ষ। কারণ সে নিজের বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ যথাৰ্থভাবে করতে সক্ষম। দক্ষতা বৃদ্ধি আয় বৃদ্ধির সাথে এবং আয় বৃদ্ধির সাথে কাজের আনন্দ জড়িত। কাজের আনন্দ কাজের স্পৃহা বাড়ায় ।

৭. শিক্ষা সুষম সমাজ গঠনে সহায়ক : সর্বজনীন শিক্ষা সুষম সমাজ গঠনে সহায়ক, কারণ শিক্ষা শুধু আয় বৃদ্ধিতে নয় বরং শিক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষেরা শিশু মৃত্যুর হার কমানো, স্বাস্থ্য সুবিধা গ্রহণ ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যান্য সুযোগ- সুবিধাও পেয়ে থাকে। ফলে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে।

৮. স্বাস্থ্যবিধি ও পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন শিক্ষা সচেতনতা বৃদ্ধি করে। তাই শিক্ষিত ব্যক্তি স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু নিরক্ষর ব্যক্তি স্বাস্থ্যরক্ষা সম্পর্কে জ্ঞন না থাকায় সে কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে স্বাস্থ্য এবং কর্মক্ষমতা দুই হারায় । তাছাড়াও পরিবার পরিকল্পনার জ্ঞান না থাকায় পরিবারের সদস্য সংখ্যা অপরিকল্পিতভাবে বাড়তে থাকে। ফলে পারিবারিক জীবনে সংকট দেখা যায়।

৯. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন : শিক্ষা মানুষকে আত্মসচেতন করে তোলে এবং সুন্দর জীবনযাপনের প্রেরণা জোগায়। জ্ঞানের মাধ্যমে অন্যের অবস্থান জেনে সে নিজেকে তুলনা করে এবং নিজের অবস্থানের উন্নয়নে প্রয়াসী হয়। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিত পরিবারের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণে ব্যক্তি সচেষ্ট হয়। অন্যদিকে নিরক্ষর ব্যক্তি সব কিছুর জন্য কেবলমাত্র ভাগ্যকে দোষারোপ করে এবং সমাজে মানবেতর জীবনযাপনে অভ্যস্থ হয়।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষানীতি গ্রহণে ব্যর্থতা : শিক্ষাকে যেখানে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে দেখানো হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রেও অনগ্রসরতার ছাপ স্পষ্ট। সেই ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো শিক্ষানীতি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমে শিক্ষা উদারীকরণের যে পরিকল্পনা তা পরিকল্পনাই রয়ে গেছে; বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাই উন্নত বিশ্বে শিক্ষা যেখানে উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করছে, আমাদের দেশে সেখানে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বৃদ্ধি করে চলেছে।

বাস্তবে যা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা। তবে আমার কথা এই যে, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নমুখী শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। বৃত্তিমূলক ও কারিগরী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ব ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে মেডিক্যাল ও প্রকৌশল শিক্ষার ওপরও জোর দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। স্বশাসিত এ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে শিক্ষার চাহিদা নিরূপণ এবং এর

উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তবে শিক্ষাকে আমাদের দেশের উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ; যেমন- দুর্নীতি, সহিংসতা ও অস্থিরতা দূর করে স্থিতিশীল শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা বাঞ্ছনীয় । এক্ষেত্রের একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতির অভাব স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়।

 উন্নয়নের জন্য যে ধরনের শিক্ষা দরকার : বাংলাদেশের জন্মলগ্নে শিক্ষা সম্পর্কিত অনেক আশাবাদী উচ্চারণ সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক চিত্র আশানুরূপ নয় ।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগে অপারগ। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে প্রাথমিক শিক্ষা পেশা পরিবর্তনে সামান্য সাহায্য করলেও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। তাই শিক্ষার উৎকর্ষী বৃদ্ধি এবং শিক্ষাকে উন্নয়নে ব্যবহারের জন্য যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে তা হলো :  

 মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে যতবেশি প্রযুক্তিনির্ভর করা যায় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে পরীক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্থ করার পারদর্শীতা যাচাইয়ের চেয়ে সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চলমান সমস্যাসমূহ দূর করে শিক্ষাকে আরো বেশি প্রযুক্তি নির্ভর করতে হবে। একটি সৃজনশীল উচ্চশিক্ষিত কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার জন্য Learning to think, and thinking to learn’ এ ধারার ওপর গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। মানব উন্নয়ন সূচকের ইতিবাচক প্রবণতা দেখে অনুমান করা যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃত্ব মানুষের জন্য উন্নয়নের নীতিতে বিশ্বাস করে যে বিনিয়োগ করেছিল তা আখেরে ভালো ফল দিয়েছে। এ নীতির প্রধান দিক ছিল শিক্ষায় বিনিয়োগ। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের যে ভূমিকা ছিল তা এমন :

– সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ; শিক্ষা সম্বন্ধে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার;

-মৌলিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ; শিক্ষার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি;

-কারিগরী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব প্রদান;

– ভালো মানে শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকদের মানসিক প্রস্তুতি; ভারসাম্য রক্ষামূলক শিক্ষা বিস্তার;

-হাতে-কলমে শিক্ষাদান;

-শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে তৎপরতা বৃদ্ধি;

– শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্যভাব বজায় রাখা;

– শিক্ষার ভিত্তি উন্নয়নে নিরন্তর কর্ম পরিকল্পনা এবং

-শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা গ্রহণ ।

এ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে এ অঞ্চলে জ্ঞানকর্মীর যে বিকাশ ঘটেছে তাতেইঅর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে।

 

উপসংহার : শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার, যা বাংলাদেশের সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে এ শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য, দুর্নীতি ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট দুর্বল ভূমিকা রাখছে। এ জারাহাত ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিহীন শিক্ষাকে ঢেলে প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে না পারলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তিগত খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হতে হবে। বাস্তবতার আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়নের এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তার সফল প্রয়োগ সম্ভব হলে শিক্ষা তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। দেশেও উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version