মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একদিন | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা ,
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একদিন
পাঠ্যপুস্তকের পাতায় গল্প-রচনা, ভাষণ-প্রতিবেদন, চিঠি ইত্যদিতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বহুবার পড়েছি। যতবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়েছি ততোবারই চেতনায় জাগ্রত হয়েছি, দ্রোহ-বিদ্রোহে জ্বলে ওঠেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দু-একটি গল্প-কবিতাও লিখে ফেলেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবু মুক্তিযুদ্ধ আমাকে আলোড়িত করে, রক্তে জাগায় শিহরণ। যখন মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা শুনি কিংবা পড়ি ততোবারই মনে হয়েছে আমি নিজেই যেনো একজন মুক্তিযুদ্ধা। তাই মুক্তযুদ্ধ জাদুঘরে যাবার সংকল্প আমার দীর্ঘ দিনের। আজ ষোলই ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস।
আজই আমার দীর্ঘদিনের সে ইচ্ছেটুকু পূরণ করবো বলে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম— মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্দেশ্যে। আগেই জানা ছিল জাদুঘরটির অবস্থান জাতীয় প্রেসক্লাবের ঠিক বিপরীত দিকের পথে। কাছে যেতেই চোখে পড়ল— হলুদ সাইনবোর্ডে লাল হরফে লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। যথানিয়মে টিকিট কিনে জাদুঘরে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই চোখে পড়ল, ‘শিখা চির অম্লান’। তারকাকৃতি একটা বেদির ওপর জ্বলছে অনির্বাণ শিখা। পেছনে পাথরের বুকে খোদাই করা বাণী সাক্ষী বাংলার রক্তভেজা মাটি সাক্ষী আকাশের চন্দ্রতারা ভুলি নাই শহীদের কোন স্মৃতি ভুলব না কিছুই আমরা।
পঙক্তিগুলো বার বার আবৃতি করতে করতে প্রবেশ করলাম মূল কক্ষে । মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর বলতেই মনে হয় এখানে সংরক্ষিত থাকবে মুক্তিযুদ্ধের নানা তথ্য ও নিদর্শন। কিন্তু এখানে যা দেখছি তা আমার ভাবনা ও কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বের হলো— ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি’। আমি বুঝতে পারলাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম কেবল মার্চ মাসে শুরু হয় নি, এর সূচনা আরও আগে। সেই ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন থেকেই শুরু হয়েছিল এ দেশের মানুষের মুক্তির লড়াই।
তাই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও ১৮৫৭ সাল থেকে শুরু হওয়া মুক্তি সংগ্রামের নিদর্শনগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজানো হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে বাংলার প্রাচীন ও ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান ও বিভিন্ন নিদর্শন। কারণ যে বাঙালি জাতি লড়াই করেছিল একাত্তরে সে জাতি হাজার বছরের পুরনো সভ্যতায় গরীয়ান। শিখা চির অম্লানের বাঁ দিকের প্রথম গ্যালারিতে ঢুকে দেখলাম, এখানে দুটি ভাগে নিদর্শনগুলো বিন্যস্ত। প্রথম পর্বে রয়েছে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং দ্বিতীয় পর্বে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের বিভিন্ন নিদর্শন। বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পর্বে রয়েছে সিলেট অঞ্চলে প্রাপ্ত ফসিল, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারের মডেল, ভুটান থেকে পাওয়া অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান-এর মূর্তি, ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদের মডেল। বিভিন্ন মন্দিরের পোড়ামাটির কারুকাজ ও মসজিদের টালির নিদর্শন।
এসবের পাশাপাশি নানা সময়ের মুদ্রা, তালপাতার লিপি, তুলট কাগজে মনসামঙ্গল কাব্যের অংশবিশেষ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম— এই তিন ধর্মের সমন্বয়ে সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতির একটা পরিচয় পাওয়া যায় এখানে ৷ দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে আমি কৌতূহলী হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যেখানে পরাজিত হয়েছিল সেই পলাশীর আম্রকাননে নকশাটা খুঁটিয়ে দেখলাম। এর সঙ্গেই সাজানো টিপু সুলতান, তিতুমির, রামমোহন রায়-এর প্রতিকৃতি, ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকীসহ অনেকের স্থির চিত্র ফটোগ্রাফ বারবার আমাকে সেই সুদুর অতীতে টেনে নিয়ে গেল। এরপর আমি গ্যালারি দুইয়ে প্রবেশ করলাম ।

গ্যালারি দুই থেকেই শুরু হয়েছে পাকিস্তান আমলের ইতিহাস। একে একে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর সাধারণ নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল, ছবি ও স্মারক দেখতে পেলাম। গ্যালারি তিন সাজানো হয়েছে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতার ছবি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, প্রাথমিক প্রতিরোধ, প্রবাসী সরকার ও সেক্টর কমাণ্ডারদের তৎপরতার তথ্য।
গ্যালারি চার ও পাঁচ-এ দেখলাম প্রতিরোধের লড়াই, গেরিলাযুদ্ধ, নৌ-কমান্ডো, বিমানবাহিনী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন, পাকবাহিনীর দালাল রাজাকারদের ভূমিকা, বীরশ্রেষ্ঠ, শহীদ বুদ্ধিজীবী, চূড়ান্ত লড়াই এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্মারক, বিবরণ ও ছবি। সবশেষে চমৎকার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে চত্বরে নেমে এলাম।
এখানে রয়েছে চমৎকার রুচিসম্পন্ন একটি জলখাবারের দোকান। রইপত্র ও স্মারক সামগ্রীর একটি বিপনীবিতানও আছে। জাদুঘরের সামনে রয়েছে ১০০ আসন বিশিষ্ট একটি চমৎকার অডিটোরিয়াম। সেখানে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য ভিডিও প্রদর্শনের ব্যবস্থা আছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখে এক অদ্ভূত অনুভূতিতে মন ভরে ওঠল। সত্যি কী বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে, কী অনন্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। সেই আত্মদান, সেই গৌরবের ইতিহাসকে ধরে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। স্বচক্ষে তা দেখতে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে হলো। বার বার এ গৌরবগাঁথা দেখার ইচ্ছা পোষণ করে বাসার উদ্দেশ্যে পা ফেললাম। সঙ্গে রইল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, মুক্তিসংগ্রামের গৌরবগাঁথার বিরল অভিজ্ঞতা।
আরও দেখুন: