একটি বণভোজনের অভিজ্ঞতা | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

একটি বণভোজনের অভিজ্ঞতা | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা ,

একটি বণভোজনের অভিজ্ঞতা

বড়দের কাছে শুনেছিলাম— শীতের সময়ে বনভোজনের সুবিধা বেশি। আমি ছোট শহরে থাকি, কোনোদিন বাইরে যাইনি। বনভোজনের নাম শুনে অস্থির হয়ে উঠলাম। ভাবলাম- পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ আর সোজন বাদিয়ার ঘাট দেখতে পাবো। ভাগ্যে থাকলে, চাই কি রঙিলা নায়ের মাঝি ও হাঁসু নামের মেয়েটির দেখা পেয়ে যাবো। ভারি মজা হবে। ধানের ক্ষেতে বাতাস বয়ে যায়। পুকুর বিলে শান্ত জলে রোদ্র ঝিলমিল করে। পাটের ডগায় আদর সোহাগ কেমন করে জানি ফুটে থাকে। সব আমরা দেখতে পাব। আমাদের মহল্লা থেকে রব উঠলো- ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পালন করেই বনভোজনের পালা শুরু হবে।

 

একটি বণভোজনের অভিজ্ঞতা

 

ঠিক হলো— যাওয়া হবে মধুপুর গড়ের জাতীয় পার্কে। আমাদের প্রথম বর্ষ ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার ফল বের হলো। বিজয় দিবস পার হলো। সবাই মিটিং বসলো। স্থির হলো একটি বড় বাস এবং একটি ট্রাক ভাড়া করা হবে। মহিলারা সব শিশুদের নিয়ে বাসে যাবেন। বড়রা যাবেন ট্রাকে চড়ে। ডেকচি, বালতি, খড়ি ও খাবার নেয়া হবে বাসের ছাদে ট্রাকের মধ্যে। সালু কাপড়ে লেখা হলো ‘বনভোজন-২০১৫ মীরপুর ১ নং সেকশন’। আমরা বানালাম কাগজের ফুল, রঙিন কাপড়ে ব্যাজ এবং ফেস্টুন। শিখে নিলাম স্লোগান, নতুন ইয়েল। কৌতুকাভিনয়ের মহড়া চললো। গান, নাচ ও মুখোশ ইত্যাদি নিয়ে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম।

বনভোজনের দিনটি যতই নিকটবর্তী হলো আমাদের উত্তেজনা ততোই বেড়ে যেতে লাগলো। অবশেষে নির্ধারিত দিনে যাত্রা শুরু করলাম। বাসে আমাদের মাইক ছিল। সবাই মিলে সববেত কণ্ঠে রব তুললাম : ‘যাচ্ছি কোথা, যাচ্ছি কোথা? বনভোজনে বনভোজনে’, ‘চলো সবে বনভোজনে, আনন্দ করি মধুপুরে’, ‘মধুপুরের রসের হাড়ি, নিয়ে যাব সবার বাড়ি’ ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছালাম। চিৎকার-চেঁচামেচি আর হাসাহাসিতে সবাই বাঁধভাঙা আনন্দে ফেটে পড়ল। সকাল ছয়টায় আমাদের বাস-ট্রাক ছুটলো। হালকা কুয়াশা ভেদ করে সোনা রোদ উঁকি দিচ্ছে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

হাওয়ায় উড়ছে আমাদের ব্যানার নিশান, আমাদের চুল, জামা, আমাদের মন-প্রাণ ও পথে দু-ধারে মাঠ-প্রান্তর, খাল-বিল-নদী, বাড়ি-ঘর সবুজ বনানী। খোলামেলা নীলাকাশ দূরে যেন চিল উড়ে। একসময় টাঙ্গাইল পৌঁছলাম। তারপর সবুজ- শ্যামল সজল পল্লীর কোমল দৃশ্যাবলি। মধুপুর পৌঁছাতে সাড়ে নয়টা বাজলো। পনেরো মিনিটের মধ্যেই জাতীয় পার্কের চুনিয়া কটেজে গিয়ে নামলাম। বাস-ট্রাক থেকে ক্রমান্বয়ে সব জিনিসপত্র নামালাম। তারপর একটা পছন্দসই জায়গা দেখে সতরঞ্জি বিছিয়ে মহিলারা সব বসে পড়লেন। কাছেই ফুলিয়া কটেজ। শাল-সেগুনের বনের মধ্যে আরো অনেক বনভোজনার্থী দল এসেছে। চারদিকে মাইকের কোলাহল।

অচেনা লোকজন, ছেলেমেয়েদের আনাগোনা চারিদিকে। বাবুর্চি যখন আগুন জ্বেলে রান্না চড়ালো, আমরা তখন চারদিক ঘুরে বেড়াবার জন্য বায়না ধরলাম। নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা খেয়ালখুশি মতো এখানে-সেখানে না গিয়ে দলীয়ভাবে ঘুরবো এটা ছিল পূর্ব সিদ্ধান্ত। শেষে মিলি আপা আর নিতুন ভাইয়ের নেতৃত্বে বেড়িয়ে পড়লাম। বাবুর্চিকে সাহায্য করার জন্য অনেকেই থেকে গেলো। বয়স্করা বসে গেলো তাস পাশা, লুডো, দাবা ইত্যাদি নিয়ে। আমাদের মাইকে ঘোষণা হলো— নাচ, গান, আবৃতি ও হালকা গল্প শেষ হবে খাবারের আগে এবং অভিনয় হবে পরে। আমরা পথ হাঁটছি, মাইকের শব্দ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।

 

একটি বণভোজনের অভিজ্ঞতা

 

আমাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো গারোদের বাড়ি, ক্ষীর নদী, মিশন স্কুল, গাছে গাছে বানর-হনুমান। গারো নারী-পুরুষ ছেলে-মেয়েদের দেখলাম। ওরা গরীব; ওদের খালি গা ধূলো-বালি মাখা। আমাদের দেখে ওরা পালিয়ে গেলো। কোনো ছেলেমেয়ে কাছে এলা না। বড়দের দুই-একজন এসে কথা বললো। মিলি আপা ও নিতু ভাইয়ের সঙ্গে। শুনেছি ওদের নিজস্ব জীবনধারা আছে। ওরা সবাই মারাক এবং ধর্মে খ্রিস্টান। ওরা নিয়মিত গীর্জায় যায়। কিছু সময় পরে আমরা বনভোজনস্থলে ফিরে এলাম । গাছের নিচে ঢালু জায়গায় আমাদের অনুষ্ঠান বেশ জমে উঠেছিল। অচেনা লোকেরাও উপভোগ করেছে। নাচে- গানে-হাসি-গল্পে গোটা পরিবেশ আনন্দমুখর হয়েছিল।

হাততালি ও ইয়েল চলছিল। সেদিন মধুপুরে আমরাই সবার মনোযোগের কেন্দ্র ছিলাম। এরপর এলো ভোজন পর্ব। সারিবদ্ধভাবে আমরা সবাই বসে গেলে পোলাও-কোর্মা পরিবেশন করা হলো পেটে ছিল ক্ষিধে, মুখে ছিল হাসি। অল্পক্ষণেই খাওয়া শেষ। কৌতুকাভিনয়ের পালা তারপর। মাইকে ঘোষণা দিতেই চারদিক থেকে দর্শক এসে ভিড় জমালো। দেখেশুনে সবাই হাসতে হসতে গড়াগড়ি দিয়ে হাততালি দিলো। সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়লো তখন আমাদের ঘরে ফেরার পালা। সবাই ফিরে আসে ঘরে। আমরা ফিরে এলাম ঢাকা শহরে মীরপুর ১নং সেকশনে। ফেরার পথে তেমন হৈচৈ হলো না।

কিছুটা ক্লান্তি, কিছুটা এমন আনন্দঘন দিন ফেলে আসার কষ্ট— তাই সবাই একটু চুপচাপ। খুব অল্প সময়েই পথটুকু ফুরিয়ে গেল। বনভোজনের স্মৃতি রইলো তাজা। বনভোজনের সেই জায়গা, নাম না জানা পাহাড় আর অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যাবলি পড়ে রইলো পেছনে, স্মৃতিরা সঙ্গী হলো কেবল। সেদিনের আনন্দ ফূর্তিতে ভরা বনভোজনের অভিজ্ঞতা কোনোদিনই ভুলবার নয়।

আরও দেখুন:

Leave a Comment