ব্যঞ্জনাতত্ত্ব ভাষা ও শিক্ষা, অর্থের সংজ্ঞার্থ : বক্তা ভাষার ধ্বনি, রূপমূল, শব্দ, পদবন্ধ, বাক্যকল্প, বাক্য, স্বর ও শারীরিক ইঙ্গিত এবং প্রতীকী সংকেতের মধ্য দিয়ে যে বার্তা/ধারণা তথ্য/সংবাদ শ্রোতার কাছে প্রেরণ করতে চায় সেই বার্তা/ধারণা তথ্য/সংবাদই বক্তার অভিপ্রেত অর্থ।
ব্যঞ্জনাতত্ত্ব ভাষা ও শিক্ষা
ব্যঞ্জনাতত্ত্ব
অর্থকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষিক সংগঠনের আশ্রয়ে বিভিন্নভাবে দেখা সম্ভব। ধ্বনি বা রূপমূলের অর্থ, শব্দের অর্থ, পদবন্ধের ও বাক্যকল্পের অর্থ, বাক্যের অর্থ। বাগর্থবিজ্ঞান মূলত শব্দ এবং বাক্যের মধ্যে গ্রন্থিত শব্দের অর্থ নিয়ে বিবেচনা করে। উপরের আলোচনায় আমরা শব্দের আক্ষরিক অর্থ ও তার নানা রকম পরিবর্তনের ধারা নিয়ে আলোচনা করেছি।
কিন্তু পুরো বাক্যটি যখন আক্ষরিক অর্থকে ছাপিয়ে কোনো তির্যক অর্থ প্রকাশ করে তখন ভাবের ও অর্থের যে ব্যঞ্জনা লাভ করে তা-ই এখন আলাচনা করব। অর্থাৎ ভাষা একই সঙ্গে বাক্যের মাধ্যমে নানা অর্থ প্রকাশ যেমন করে, তেমনই বাক্যের অতিরিক্ত নানা ব্যঞ্জনাও প্রকাশ করে। ভাষার এই অর্থ প্রকাশকে আমরা দু ভাগে ভাগ করে নিতে পারি : (ক) অভিধা বা সরল অর্থ এবং (খ) ব্যঞ্জনা বা তির্যক অর্থ।
(ক) অভিধা বা সরল অর্থ : বাক্যের মধ্যে গ্রন্থিত শব্দের আক্ষরিক অর্থাৎ মূলত শব্দে ও বাক্যে আশ্রিত। স্বাভাবিক অর্থই হল অভিধা (primary meaning)। অর্থ প্রকাশ বা বাগর্থ প্রকাশ কিছুটা আক্ষরিক কাজ, তাতে বাক্যের শব্দ ও পদবন্ধগুলোর অর্থের একটা ভূমিকা থাকে। অভিধার কাজ হল সরল অর্থ প্রকাশ, অর্থাৎ যা বলা হচ্ছে মোটামুটি তাই বোঝানো হচ্ছে।
যেমন- গরুটির জন্যে ঘাস কেটে আন। উক্তিটির সরল অর্থ হল- গরুটির জন্যে ঘাস কেটে আনতে হবে। কিন্তু বক্তা যদি এরকম বলে যে– পরীক্ষার পর অবসর দু মাস বসে বসে আমি ঘাস কাটব না’। এ-উক্তিটি যে খুব একটা সরল নয়, তির্যক কোনো উক্তি তা আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না। উক্তিটিতে বক্তা, নিশ্চয়ই ‘ঘাস কাটার’ কথা বলছেন না। বাক্যের এই তির্যক অর্থ প্রকাশক ক্ষমতাকেই বলে ব্যঞ্জনা।
(খ) ব্যঞ্জনা বা তির্যক অর্থ : বাক্যের শব্দ বা শব্দগুলো যখন সরল অর্থ প্রকাশ না করে তির্যক কোনো অর্ধ প্রকাশ করে, তখন তাকে বলে ব্যঞ্জনা। অর্থাৎ তির্যক অর্থ-প্রকাশ, যা বলা হচ্ছে আক্ষরিকভাবে তা বোঝাতে না চেয়ে অন্য কিছু বোঝায়। গ্যাজডার (Gazdar, 1979) ব্যঞ্জনাতত্ত্বকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন : ব্যাকরণে বাক্যের সত্য-মিথ্যা নির্ধারণে বাক্যের বাগর্থটি নিষ্কাষিত করে নিলে যে-অর্থটুকু বাকি থাকে তা-ই তার বাজনা। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক :
উক্তি :
১. এই সময়টায় আমার ভীষণ চায়ের তেষ্টা পায়। তোমাদের পায় না?
উদ্দিষ্ট অর্থ : একটু চায়ের ব্যবস্থা হলে ভালো হয়।
২. মাত্র একশো টাকার জন্যে হাত নোংরা করব না দাদা।
উদ্দিষ্ট অর্থ : বেশি টাকা পেলে করতে পারি।
৩. তুই ও মেয়েকে বিয়ে করলে আমার মরা মুখ দেখবি।
উদ্দিষ্ট অর্থ : ও মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না।
৪. যাও না, গিয়েই দ্যাখো না মজাটা।”
উদ্দিষ্ট অর্থ : গেলে শাস্তি পেতে হবে।
৫. বাপরে কী বীর। এক চড়ে পাঁচটা মশা মেরেছে।
উদ্দিষ্ট অর্থ উপহাস করা হয়েছে।
প্রাত্যহিক জীবনে কথা বলার সময় এ-রকম অনেক ব্যঞ্জনা-অন্য বাক্যই আমরা ব্যবহার করি। আমাদের ব্যবহৃত বাক্যে প্রতি মুহূর্তে নানা ধরনের অলংকারও জেগে ওঠে। ব্যঙ্গে, বিদ্রূপে, সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে, নিষেধে, অনুজ্ঞায় আমরা যা বলি অনেক সময় তা সোজাসুজি বোঝাতে চাই না, অন্য কিছু বোঝাতে চাই। ভাষার এই অবারিত সম্ভাবনা সৃষ্টিশীল মানুষকে প্রতিক্ষণে নিত্যনতুন ভাব ও বোধে জাগিয়ে তোলে, এবং এগিয়ে নিয়ে যায় সৃজনশীলতার জ্ঞানরাজ্যে, আবিষ্কার করে নতুন থেকে নতুনতর কোনো জ্ঞান, অভিনব ভাব-রূপের কোনো বিষয়বস্তু।

আরও দেখুন: