পত্র কী ও এর আবশ্যকতা | পত্র বা চিঠি | ভাষা ও শিক্ষা ,কোনো বিশেষ উদ্দেশে মানবমনের কোনো ভাব, সংবাদ, তথ্য, আবেদন ইত্যাদি অপরের কাছে লিখিতভাবে জানানো হলে, তাকে সাধারণভাবে বলে।যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হল ‘চিঠি’। চিঠি শুধু যোগাযোগেরই সহজ মাধ্যম নয়, বরং স্বল্প ব্যয়ে যোগাযোগ স্থাপনে চিঠির কোনো বিকল্প নেই। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন ও সমাজের দায়িত্বশীল পদাধিকারী মানুষের কাছে নানা প্রয়োজনে চিঠি লিখতে হয়। যদিও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, অয়্যারলেস, টেলেক্স, ফ্যাক্স, মোবাইল, ইন্টারনেট, ই-মেইল ইত্যাদির মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে প্রয়োজনীয় খবরাখবর অপরের কাছে খুব সহজেই পৌঁছানো যায়, তদুপরি সুপ্রাচীন মাধ্যম এই চিঠির গুরুত্ব এতটুকু কমে নি।
পত্র কী ও এর আবশ্যকতা | পত্র বা চিঠি | ভাষা ও শিক্ষা
এর মূলে যে কারণ, তা হল- ‘চিঠি’– এই কথাটি শুনলেই পাঠকের মন হঠাৎ কেমন চনমন করে ওঠে। অর্থাৎ, ‘চিঠি’ যে ভাব বিনিময় করে তা আরঅন্য কোন কিছু দিয়ে সম্ভব নয় বলে চিঠির গুরুত্ব সর্বজনীন। লেখক চিঠিতে নিজেকে উজাড় করে উপস্থাপন করেআর পাঠক তা অনুভব করে।হৃদয়ের এমন কিছু কথা থাকে, যা শুধু চিঠিতে লিখেই জানানো সম্ভব, আবার এমন কিছু কথা থাকে যা পাঠক সরাসরি শুনতে যতটা না স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তার থেকে সে-কথাগুলো যদি চিঠির মাধ্যমে জানে তাহলে অনেক বেশি আনন্দ অনুভব করে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক – ‘আমরা অনেকসময়ই প্রিয়জনের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে গিয়ে এমন দু-একটি কথা বলি যার অর্থ শ্রোতাকে (প্রিয়জনকে) বের করে নিতে হয়; যেমন- “আমি যে তোমাকে কীরকম ভালোবাসি তা ঠিক বোঝাতে পারছি না, আমার এমন কোনো ভাষা নেই যা দিয়ে তা বোঝানো যায়। ‘
—এখানে বক্তা তার ভাষার অভাবে যা বোঝাতে পারল না শ্রোতার কিন্তু সে-ভাষাটি বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না- এইউভয়ের না বলা অংশটুকু যে কী, তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কেননা তা কখনো কথা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, শুধুহৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। – ‘চিঠি’র ব্যাপারটাও ঠিক তদ্রূপ, চিঠি পাওয়ার মাঝে এবং চিঠি পড়ার মধ্যে হৃদয়ে যেরস, যে ভাব, আনন্দ, অনুভূতি জাগে- তা যে কী, তা বলা যায় না, ব্যাখ্যা করা যায় না, তা শুধু অনুভব করা যায়।
আমরা প্রয়োজনীয় একটি খবর সরাসরি বা টেলিফোনে যেভাবে বলি, চিঠির মাধ্যমে তা বলতে গেলে সেই একই কথার রূপ যায় পাল্টে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে, তখন কেবলমাত্র অর্থকে প্রকাশ করে। কিন্তু, কথাকে যখন তির্যক ভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায়, তখন সে আপন অর্থের চেয়ে আরো কিছু বেশি প্রকাশ করে। সেই বেশিটুকু যে কী, তা বলা শক্ত। কেননা, তা কথার অতীত; সুতরাং অনির্বচনীয়। যা আমরা দেখছি শুনছি জানছি তার সঙ্গে যখন অনির্বচনীয় যোগ হয়, তখন তাকেই আমরা বলি ‘রস’। অর্থাৎ, সে জিনিসটাকে অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না।’
‘চিঠি’ শুধু ভাবেরই মাধ্যম নয় চিঠি সাহিত্যেরও অংশ। অন্যান্য সাহিত্যের মতো পত্র-সাহিত্যও পাঠকের কাছে বেশ সমাদৃত। চিঠির মধ্যে লেখককে যেভাবে আবিষ্কার করা যায়, অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছিন্নপত্রাবলী’র একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘ওর মধ্যে যা-কিছু আমার ব্যক্তিগত জীবন-সংক্রান্ত সেটা তেমন বহুমূল্য নয়— কিন্তু যেটাকে আমি বাইরে থেকে সঞ্চয় করে এনেছি, যেটা এক একটা দুর্লভ সৌন্দর্য, দুর্মূল্য সম্ভোগের সামগ্রী, যেগুলো আমার জীবনের অসামান্য উপার্জন— যা হয়ত আমি ছাড়া আর কেউ দেখে নি, যা কেবল আমার সেই চিঠির পাতার মধ্যে রয়েছে, জগতের আর কোথাও নেই- তার মর্যাদা আমি যেমন বুঝব এমন বোধ হয় আর কেউ বুঝবে না।”
তিনি আরো লিখেছেন, ‘বিশ্বজগতের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ আত্মীয়তার কথা আমার অন্য কোন লেখায় তেমন সত্যভাবে নেই, যেমন আমার চিঠির মধ্যে আছে— সেই অংশগুলো যদি পাই তা হলে আমার জীবন অনেকটা বৃহত্তর হয়ে ওঠে।’ – রবীন্দ্রনাথের এ লেখা থেকে চিঠির গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। একইভাবে কবিতায়ও চিঠিকে অনেক কবিই বেশ মর্মগ্রাহী করে বর্ণনা করেছেন।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতাটির কথাই ধরা যাক, তাঁর এই কবিতায় অন্তর্লীন হয়ে আছে একটি জীবনদর্শন; অপরদিকে কবিতাটিতে ফুটে উঠেছে দুঃখ-দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট অথচ কর্তব্যপরায়ণ এক রানারের বেদনাঘন করুণ জীবনকাহিনি। রানার ছুটে চলেছে চিঠির বোঝা নিয়ে, যে চিঠিতে রয়েছে জানা-অজানার খবর। কিন্তু ‘রাত্রির খামে’ রানারের দুঃখ-দারিদ্র্যের কথা ঢাকা পড়ে আছে বলে, কহি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন)-সহ বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত বলেছেন যে, ‘বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার দেশি, বিদেশি, সংস্কৃত— যে ভাষা থেকেই আসুক না কেন, এগুলো বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ।
এগুলো বাংলা ভাষার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে, বাংলা থেকে আলাদা করে এদের কথা চিন্তা করা যায় না।’ কাজেই বাংলা চিঠি বা পত্রও একান্ত বাংলা ভাষারই নিজস্ব সম্পদ এবং তা বাংলাভাষীদের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে বাংলা পত্র বা চিঠি একান্তই বাংলারীতি অনুযায়ী হওয়া উচিত।ব্যক্তিগত সামাজিক পত্রসমূহের গঠন-কাঠামোতে কোনোরূপ পরিবর্তন করা হয় নি (বাংলারীতি অনুযায়ী গড়ে ওঠা পত্রের আদর্শ রেখে দেওয়া হল)। কিন্তু আবেদন পত্র বা ব্যবহারিক পত্রে বর্তমান প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে।।
সাধারণত একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে নিম্নলিখিত অংশগুলো বিদ্যমান। যেমন :
১. চিঠির ওপরের মঙ্গলসূচক শব্দ। [আজকাল ব্যক্তিগত চিঠিতে মঙ্গলসূচক শব্দের ব্যবহার কেউ করেন না ।
২. চিঠির ওপরের ডান কোণে স্থান ও তারিখ।
৩. চিঠির ওপরের অংশের বাঁ দিকে প্রাপকের উদ্দেশে সম্বোধন বা সম্ভাষণ ।
৪. চিঠির বক্তব্য বিষয় বা পত্রগর্ভ। পত্রগর্ভে— প্রাক্-ভাষণ বা ভূমিকা, পত্রসার, বিদায় ভাষণ অন্তর্গত।
৫. নিবেদন এবং স্বাক্ষর।
৬. চিঠির শিরোনাম। খামের উপর পরিষ্কারভাবে ঠিকানা লিখতে হবে (বিদেশি চিঠিতে ঠিকানা হবে ইংরেজি ভাষায়)।
উল্লিখিত বিষয়গুলো ব্যবহার করে নিচে একটি ব্যক্তিগত চিঠির নমুনা দেখানো হলো :
ব্যক্তিগত পত্রের সম্ভাষণ-রীতি
চিঠির বাম দিকে পত্র-প্রাপককে সম্বোধন বা সম্ভাষণ করা হয়। পত্র-প্রাপকের সঙ্গে পত্র প্রেরকের সম্পর্ক অন্য জনেই সম্ভাষণ হয়ে থাকে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে একটি পত্রে দুবার সম্ভাষণ ব্যবহৃত হয়; একটি প্রথমেই কাছে চিঠি লেখা হয় তাকে উদ্দেশ্য করে সম্ভাষণ এবং অপরটি চিঠি শেষে বিদায় সম্ভাষণ। নিচে উভয়
আরও দেখুন: