সমিতির সভাপতির অভিভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা , ঢাকায় ১৩৩৫ সনে মুসলিম সাহিত্যসমাজের ৩য় বার্ষিক অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণ ।
সমিতির সভাপতির অভিভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
সভাপতির ভাষণ : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ [সংকলিত ও সংক্ষেপিত]
আজ দেশের মধ্যে মুক্তির ডাক এসেছে। কিন্তু সে ডাক অতি ক্ষীণ। দূরের বাঁশির সুরের মত কখনও কানে এসে লাগে কি, না লাগে, আসল ভীরু কাপুরুষ আমরা, তার উপর তন্দ্রা-ঘোর ডোর। চাই আমাদের জন্য তুড়ি ভেরীর তীক্ষ্ণ বিকট নিখাদনা। তা না হলে জীবনের রাঙা পতাকার নিচে দলে দলে মুক্তি ফৌজ এসে জমবে না; তা না হলে মুক্তির লড়াই আমাদের চলবে না; তা না হলে মুক্তি আমাদের মিলবে না।
তাই চাই আমাদের বীর্যবন্ত সাহিত্য। মাত্র একখানি পুস্তক আরবের বহু যুগের কালঘুম ভেঙে দিয়ে সমস্ত দুনিয়া তোলপাড় করে এক নতুন প্রাণ গড়ে তুলেছে। মাত্র একটি গীত প্রাচীন ফরাসির শিরায় শিরায় আগুনের শিখা জ্বালিয়ে যত পুরানকে ছাই করে এক নতুন ভাবজগতে জাগিয়ে দিয়েছে।
কলম ও কলমের বাণী ও লেখনীর এমনই অপূর্ব ক্ষমতা! তাই কোরআন তার দৈবী ভাষায় ঘোষণা করছে— ‘নূন্ ওয়া-ল কলম, ওয়া মা য়সরুন’ ‘(লক্ষ কর) দোয়াত, কলম এবং যা তারা লেখে’ (সূরা : কলম)। সাহিত্য যদি সত্যিকার সাহিত্য হয় সে মুক্তি দিবেই- দেহের মুক্তি, মনের মুক্তি, আত্মার মুক্তি। এই তিনটি নিয়েই মানুষ। একটি ছেড়ে অন্যের মুক্তিতে মুক্তি নেই। সাহিত্যের সকল উদ্দেশ্যই ঘুরে ফিরে এসে দাঁড়ায় এখানে। এই মুক্তিকেই মাঝের বিন্দু করে সাহিত্য চারদিকে ঘুরবে। আলঙ্কারিক মম্মট ভট্ট কাব্যের ফল সম্বন্ধে বলেছেন—
কাব্যং যশসেহর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবেতর ক্ষতয়ৈ।
সদ্যঃ পরনিবৃতয়ে কান্তাসম্মিততয়োপদেশযুজে ॥
“কাব্য যশের জন্য, টাকাকড়ির জন্য, আচার ব্যবহার জানবার জন্য, অমঙ্গল দূর করবার জন্য, সদ্য সদ্য পরম শান্তি লাভের জন্য, প্রেয়সীর ন্যায় উপদেশ দিবার জন্য।’ সে সাহিত্য বিফল, ষোল আনাই বিফল, যা মুক্তির সন্ধান দেয় না। আজ সাহিত্যের মার্কা নিয়ে একটা জিনিস বাজারে চলছে। শুনি তার কাটতিও কম নয়, বিশেষ করে যুবক মহলে। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তরুণ-তরুণীদের একটা অপূর্ণ দুর্দান্ত ইচ্ছাকে রক্তমাংসময় কল্পনা দিয়ে পূর্ণ করা।
রহমানে শয়তানে যে তফাত, আঙুরে ও শরাবে যে তফাত, মুক্তি ও বন্ধনে যে তফাত, আসল সাহিত্য ও এই সকল সাহিত্যে সেই তফাত। হায়! অবোধ পাঠক জানে না সাইরেনের বাঁশরীর সুরের ন্যায় এই অসাহিত্য তাকে ধ্বংসের দিকে পলে পলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। জাতির সমস্ত যৌব-শক্তি এই সাহিত্য জোঁকের মতো নিঃসাড়ে চুষে নিচ্ছে। সাহিত্যের হাটে যে কেবল এই কামাগ্নিসন্দীপনী বটিকাই বিক্রি হচ্ছে তা নয়।
এর চেয়েও ভয়ানক ভয়ানক জিনিস— একেবারে সাক্ষাৎ বিষ— নানা মনোহর নামে ও রূপে কাটতি হচ্ছে। পরখ করলেই অনায়াসে দেখা যাবে সেগুলির ভিতর আছে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, জাতীয় বিদ্বেষ প্রভৃতি। এ সমস্ত জাতির আত্মা ও মনকে বিষাক্ত করে দেশে কি অশান্তিই না ঘটাচ্ছে।
আমি অরসিক নই; আর্ট বুঝি। কিন্তু আর্টের নামে কি গণিকার উলঙ্গ অঙ্গ-ভঙ্গিকেও প্রশ্রয় দিতে হবে? তারিফ করতে হবে? আমি সাহিত্যের স্বাধীনতা বুঝি কিন্তু তাই বলে কি সাহিত্যের পবিত্র তীর্থক্ষেত্রে অমৃতের নামে বিষ কিংবা রসের নামে প্রস্রাব বিক্রিরও লাইসেন্স দিতে হবে? আমাদের এক জিহাদ ঘোষণা করতে হবে এই অপসাহিত্যের বিরুদ্ধে। আজ সমস্ত বঙ্গ অনিমেষে চেয়ে আছে তার খিযরের জন্য যে তাকে পরাণ ভরে এই সত্যিকার সাহিত্যের ‘আবে হায়াতের’ পরিচয় করে দেবে। প্যারীচাঁদ, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ভাষার অনেকটা সংস্কার হয়েছে।
কিন্তু বাংলার বানান-বিভীষিকা এখনও ঘোচে নি। সেখানে মস্ত বড় একটা সংস্কারের দরকার। সংস্কৃতের দুটো ব বাংলায় একাকার হয়ে বানান-সংস্কারের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে; তিনটে শ ষ স দুটো ণ ন, দুটো জ য, এদেরও একাকারের দরকার আছে। বানান সংস্কারের নজির পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশে পাওয়া যাবে। কিন্তু কারও সাহসে কুলায় না। ব্রহ্মশাপের ভয়ে নাকি? খালি বানানে নয়, অক্ষরেও তার সংস্কারের দরকার আছে।
যুক্তাক্ষরগুলি অনেক স্থলেই রাসায়নিক মিশ্রণের মত হয়ে আছে। এতে যে খুঁট-আখুরে ছেলেমেয়ের প্রাণান্ত হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলা যখন ইংরেজি ফরাসি আদি ভাষার মতন পৃথিবীর একটা গণ্যমান্য ভাষা হয়ে উঠবে, তখন হয়ত ল্যাটিন হরফ চালাতে হবে।
আপাতত যুক্তাক্ষরের একটা ব্যবস্থা হওয়া উচিত। শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির মতটা সকলে মেনে নিলেই গোলমাল ঢুকে যায়। কিন্তু আমরা এমনই প্রাচীন পন্থার দাস যে এই সংস্কারটুকুও বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নই। আমরা অনেকবার বলেছি মুসলিম সাহিত্য। কেউ হয় তো বলতে পারেন “কি গোঁড়ামি। সাহিত্যেও আবার জাত বিচার! তাই একটু খোলাসা করে বলা দরকার- মুসলিম সাহিত্য বলতে কী বুঝি। আমাদের ঘর ও পর, আমাদের সুখ ও দুঃখ, আমাদের আশা ও ভরসা, লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে যে সাহিত্য, তাই আমাদের সাহিত্য। কেবল লেখক মুসলমান হলেই মুসলমান সাহিত্য হয় না।
হিন্দুর সাহিত্য অনুপ্রেরণা পাচ্ছে বেদান্ত ও গীতা, হিন্দু ইতিহাস ও হিন্দু জীবনী থেকে। আমাদের সাহিত্য অনুপ্রেরণা পাবে কোরআন ও হাদীস, মুসলিম-ইতিহাস ও মুসলিম-জীবনী থেকে। হিন্দুর সাহিত্য রস সংগ্রহ করে হিন্দুসমাজ থেকে, আমাদের সাহিত্য করবে মুসলিমসমাজ থেকে। এই সাহিত্যের ভিতর দিয়েই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের চেনা-পরিচয় হবে। চেনা হলেই ভাব হবে।
To know is to love. এই সেদিন দীনেশ বাবু বলেছেন, ‘যদি মুসলমানগণ তাঁহাদের সমাজের উন্নত চরিত্রগুলি সুন্দর মহিমান্বিত বর্ণে চিত্রিত করিয়া বাংলা সাহিত্যে উপস্থিত করেন, তবে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে তাঁহাদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইবেন।’ আমরা একেই বাংলার মুসলিম সাহিত্য বলি।
হিন্দু সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্য হিন্দুর মন্দির ও মুসলমানের মসজিদের মতো এক সম্প্রদায়ের একচেটে জিনিস নয়। সুহৃদয় সত্যেন্দ্র দত্ত, ভক্তিভাজন গিরিশচন্দ্র সেন, মাননীয় শ্রীকৃষ্ণকুমার মিত্র, শ্রদ্ধেয় শ্রীজলধর সেন, মান্যবর অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রভৃতি হিন্দু লেখকও অনেক মুসলমান সাহিত্য রচনা করেছেন। বাস্তবিক বাংলা সাহিত্য বাংলার হিন্দু-মুসলমানের অক্ষয় মিলন-মন্দির হবে। হিন্দু সাহিত্য ও মুসলিম সাহিত্য হবে তার দুই কুঠরি।
সর্বত্রই সকলের অবাধ প্রবেশ অধিকার। যে পর্যন্ত মুসলিম সাহিত্য না গড়ে উঠেছে সে পর্যন্ত মিলন মন্দির পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে না। তবে, এস হিন্দু ও মুসলমান! এস সাহিত্যিক ও সাহিত্য-ভক্ত! এস কবি ও গায়ক! এস ঐতিহাসিক ও দার্শনিক, আমরা এই মিলন মন্দির গড়ে তুলি। এস কিশোর-কিশোরী, এস তরুণ-তরুণী এস জরৎ-জরতী, এই মিলন-মন্দিরে এক মন প্রাণ হয়ে মুক্তি সাধনা করি।
আরও দেখুন: