চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ-ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী | ভাব-সম্প্রসারণ | ভাষা ও শিক্ষা , ভাব সম্প্রসারণ সাধারণত কবিতা বা যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একটি চলন এর মাধ্যমে তা ভাবে পূর্ণ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আর এই আলোচনায় ভাবনা লুকায়িত সকল মানব জীবনের আদর্শ এবং ব্যক্তিচরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা এবং বিচ্যুতি ফুটে উঠে।
চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ-ধনী তদপেক্ষা শতগুণে দোষী
চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন যে গর্হিত অপরাধ, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। অপরের ধন অপহরণ, অন্যের সম্পদে লোভ করা ইত্যাদি পাপ বলে চিহ্নিত। পাপ-পুণ্যের নিরিখে বিচার করলে তস্করমাত্রই শাস্তিযোগ্য। কারণ দোষীর শাস্তি না হলে সমাজে ন্যায়-নীতি বলে কিছু থাকে না। কিন্তু এটুকু বলেই যদি নিশ্চিত থাকা যেত, তাহলে জগতে এত অপরাধ সংঘটিত হাত না। একটি কথা সর্বাগ্রে বিবেচনার যোগ্য। জন্মমুহূর্তে একটি ক্ষুদ্র মানবশিশু নিশ্চয়ই চোর বা অপরাধী হয়ে আসে না।
জন্মসূত্রে অপরাধী বলে কাউকে ধরে নেওয়া সমাজবিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্রের পরিপন্থী। মানবসমাজের ললাটে আদিপাপ বা original sin এর কলঙ্ককালিমা লেপন করে দেওয়াটাই তো একটা পাপ। যে শিশু সরল হাসি এবং স্বর্গীয় সুষমা নিয়ে এ পৃথিবীতে চোখ মেললো, কৈশোরে বা যৌবনে হঠাৎ সে একদিন চোর, ডাকাত বা অন্যতর হানিকর দস্যুতে পরিণত হয় না। অবস্থার চাপে পড়ে, জীবনধারণের কঠোরতম প্রয়োজনের প্রবর্তনায় মানুষ অপরাধ জগতের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়। ধীরে ধীরে ঐ দুষ্টচক্র তাকে গ্রাস করে ফেলে। তখন সে দুর্ধর্ষ দস্যুতে পরিণত হয়।অপ্রিয় হলেও একথা নিদারুণ সত্য যে, দারিদ্র্যের জ্বালায় মানুষ চুরি করতে বাধ্য হয়। ধরা পড়লে আইনের ধারানুসারে তার শাস্তিও হয়।
কিন্তু এই দারিদ্র্যের মূলে যে কৃপণ ধনিক গোষ্ঠীর নিষ্ঠুরতা, তা অনেক সময় আমরা ভেবে দেখি না। শুধু ধনী হলেই কেউ নিষ্ঠুর হবে—একথাও সমর্থনযোগ্য নয়। নিষ্ঠুর হচ্ছে স্বার্থপর কৃপণ ধনী। অর্থশাস্ত্র একটা মুল তত্ত্বই হচ্ছে অর্থের ব্যবহারজনিত চলনশীলতা (circulation of money)। অর্থ যদি কোন সম্পদ সৃষ্টিতে সহায়তা না করে যখের ধনের মতো মাটির নিচে গুপ্ত থাকে, তবে তার আর কোন অর্থ নেই। কৃপণ ধনিক সমাজ অত্যন্ত সংকীর্ণ স্বার্থপরতার বশবর্তী হয়ে অপরকে প্রবঞ্চিত করে নিজের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে এবং তা দেশ বা জাতির কোন কল্যাণকর কাজে বিনিয়োগ করে না। অপরকে বঞ্চিত করে তারাই সমাজের অপরাধ প্রবণতার বীজ বপন করে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, চোরের অপরাধ প্রত্যক্ষাগোচর বলে শাস্তির আওতাভুক্ত; কিন্তু যে অপ্রত্যক্ষ এবং অধিকতর হানিকর পরস্বাপহারী ধনের গৌরবে সমাজের মাথায় চড়ে বসে রয়েছে, তার কোনো শাস্তি হয় না। ধনবৈষম্যের এই নিদারুণ চক্রতলে পিষ্ট হয়ে সমাজের কাঠামোতে যে অবক্ষয়ের বিষাক্ত বীজাণু দৃঢ়মূল হয়ে চলেছে, সে সম্পর্কে সকলের সচেতন হওয়া আশু প্রয়োজন।
আরও দেখুন: