একাত্তরের দিনলিপি | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

“একাত্তরের দিনলিপি” শুধু একটি ব্যক্তিগত দিনলিপি নয়, বরং একটি জাতির সংগ্রাম, স্বপ্ন ও আত্মত্যাগের অন্তরঙ্গ দলিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, হতাশা, সাহস, ভয় ও প্রত্যাশার নিখুঁত বর্ণনা এতে ফুটে উঠেছে গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। ভাষার গঠন ও বর্ণনার সরলতা এটিকে একটি প্রামাণ্য সাহিত্যিক দলিলের মর্যাদা দিয়েছে। বাংলা গুরুকুল-এর “ভাষা ও শিক্ষা” বিভাগের “নির্মিতি” অংশে এই রচনাটি ইতিহাস, সাহিত্য ও আত্মজৈবনিক ধারার এক অনন্য সংমিশ্রণ হিসেবে পাঠকের সামনে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানসিক ও সামাজিক জগতকে জীবন্ত করে তোলে।

একাত্তরের দিনলিপি

১ মার্চ, সোমবার, রাত ১০টা, ১৯৭১

বিক্ষুব্ধ বাংলা। ভুট্টো সাহেব পরিষদে যোগ দিবেন না সিদ্ধান্তে। পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবী রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। আজ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে মেয়েরা শহীদ মিনার উদ্বোধন করার জন্য আমাকে নিয়ে গেল, কিন্তু গোলমালে সবই বন্ধ হয়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, আরও অনেক নেতাদের এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কাল ঢাকায় হরতাল, পরশু সারাদিন প্রদেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করা হল।

৭ মার্চ, রবিবার, রাত ৯টা, ১৯৭১

সকাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে (ঘোড়দৌড় ময়দানের নাম বর্তমানে এটি) লোকজন জমা হচ্ছে। ১টার সময় তাড়াহুড়া করে আমরাও রিকশা করে গিয়ে পৌঁছালাম। মঞ্চের সামনেই স্থান পেলাম। মেয়ে স্বেচ্ছাসেবিকারা বলল, বসুন, আপনি আমাদের নিজের লোক, মনের মানুষ, কাছের মানুষ। এম.এন.এরা গিয়ে দূরে চেয়ারে বসুন। অন্তরটা জুড়িয়ে গেল শুনে।

আমি দেশের মানুষের মনের মানুষ। একী ভাগ্যের কথা। ৩টা ২০ মিনিটে মুজিব এলেন বিমর্ষ মলিন মুখে। সৈন্যবাহিনী সামরিক আইন প্রত্যাহার না করলে তিনি অধিবেশনে যোগ দিবেন না। রেডিওতে তার বক্তৃতা রিলে করতে দেওয়া হল না। তিনিও অফিস আদালত স্কুল কলেজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ রাখতে বললেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ করলেন ।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

২৬ মার্চ, শুক্রবার, রাত ১০টা, ১৯৭১

গতকাল রাত পৌনে বারটায় হঠাৎ করে চট্টগ্রাম থেকে ফোন এল, ঢাকায় কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে কিনা। ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা শান্ত। ফোনটা রাখা মাত্র পুলের উপর ‘মা’ বলে একটি আর্তনাদ শুনা গেল, পরপর মেশিনগানের শব্দ ও জয়বাংলা শব্দের পর অবিরাম রাইফেল বোমা স্টেনগান মেশিনগান এর শব্দ, সাত মসজিদ, ই.পি. আর এর দিক থেকে গোলা কামানের শব্দ, জয় বাংলা, আল্লাহ আকবার এর আওয়াজ ২টা পর্যন্ত হল, তার পর থেকে শুধু কামান- গোলা-গুলির শব্দ, রাত সাড়ে ৩টায় মিলিটারি ভ্যান বাড়ির সামনে দিয়ে এসে আবার চলে গেল। কাল থেকে কারফিউ জারি। শোনা যাচ্ছে মুজিব বন্দি।

ওদিক থেকে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। আজ রাত ১০টা পর্যন্ত। রেডিওতে ইয়াহিয়া ৮টায় ভাষণ দিল। আওয়ামী লীগ বন্ধ। মুজিব শর্তে আসেননি, সামরিক শাসন অমান্য করেছেন বলা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মেশিনগানের শব্দ আসছে। মানুষের শব্দ কোথাও নেই, ঘর থেকে বের হতে পারছি না।

 

১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭১

আজ ১২টায় বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে এসে আবার সোচ্চার হল ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণে। আল্লাহর কাছে শোকর। বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। সুখ দুঃখের অনুভূতি কমে গেছে যেন, তবুও একি শিহরণ। আল্লাহ । তোমার দানের অন্ত নেই। ইন্দিরা গান্ধী শতায়ু হোন। শতবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েও তার ঋণ শোধ হবে না। জয়যুক্ত হোক সোভিয়েত রিপাবলিক। আমার বাবা আমার কাহহার আজ বেঁচে নেই। আজ ২৯ দিন হল, সে শুয়ে আছে মাটির কোলে। আর আজ কি শোকাবহ ঘটনা। জয় মিছিল দেখতে গিয়ে হাতেম আলীর শালীর মেয়ে জলির বড়বোন ডলি ১৮নং রাস্তায় গিয়ে মিলিটারির উন্মত্ততার দরুন গুলিতে মারা গেল। আহা! মা বেঁচে আছে যে। এ যে কি করুণ দৃশ্য!

Leave a Comment