একটি দিনের দিনলিপি | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

একটি দিনের দিনলিপি | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা ,

একটি দিনের দিনলিপি

আজ ২ মার্চ।  আমার জীবনে আরও একটি সম্ভাবনাময় দিনের সূত্রপাত হল। প্রতিটি দিনই আমার কাছে নতুন, সম্ভাবনাময় এবং জীবন গঠনের নতুন প্রত্যয়ে জেগে ওঠার আহ্বান। জীবনের ছোট ছোট ভুলগুলোকে শুধরে নিয়ে দিনলিপির বিকশিত হওয়া, সকল বাধা অতিক্রম করে দীপ্ত শপথে এগিয়ে যাওয়া। এক একটি সূর্যোদয়ে কত অসীম সম্ভেবানা লুকানো থাকে, অথচ আমরা তার খণ্ড-ক্ষুদ্র অংশই কাজে লাগাতে পারি ।

সূচনা দু চারটে কাজ করতে না করতেই কখন যেন প্রদীপ্ত সূর্য নিস্তেজ হয়ে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ে। অস্তগামী সূর্যটি যেন নীরবে-নিঃশব্দে বার বার সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে— ‘সংক্ষিপ্ত রে কর্ম-জীবন, পাবে না আর এমন জনম, গঠন কর সোনার জীবন।’ আমি আমার জীবনকে গঠন করতে চাই; একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে চাই। আমার দিনলিপি তো আমার কর্মময় জীবনকে অর্থাৎ আমাকেই প্রকাশ করছে। আমার প্রকাশ তো অসুন্দর হতে পারে না। আমার দিনলিপি— ভাবে বোধে বোধিতে, শ্রমে-ঘামে- অধ্যাবসায়ে, সততা-নিষ্ঠা-নৈতিকতায় ও সদাচরণের হাজারো সুন্দর-সম্ভাবনাময় সফলতার কথায় ভরে উঠুক মনুষ্যত্বের সাধনায়।

 

একটি দিনের দিনলিপি

 

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দিনলিপিটি আমার হোক (এই প্রত্যাশায় আজকের দিনলিপি লিখতে শুরু করলাম)। প্রতিদিনের মতো আজও সকাল ছটায় ঘুম থেকে উঠেছি। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো সকালে হাঁটতে বেরুতে পারিনি। ঝটপট হাতমুখ ধুয়েই পড়ার টেবিলে বসতে হয়েছে। পদার্থ ও রসায়ন— দুটো বিষয়ের ওপর আজ শ্রেণি- দিনের পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। শুধু রাসায়নিক সমীকরণটি পারছিলাম না। বন্ধু লিমন ক্লাস সূচনা শেষে সমীকরণটি আমাকে বুঝিয়ে দিল। লিমনের মতো এমন বন্ধু আর আমার দ্বিতীয়টি নেই। আমাদের শ্রেণিতে লিমন সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। শুধু লেখাপড়াতেই নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তার তুলনা হয় না।

আগামী দিন সাপ্তাহিক ছুটি। আমরা দুজনে মিলে সাভার স্মৃতিসৌধে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের এ সিদ্ধান্তের কথা বাবা-মাকে জানাতে হবে বলে দ্রুত বাসায় ফিরে এলাম। দিনের মধ্যভাগ বাসায় এসে দেখি মা আমার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আমি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। ছোটমাছের তরকারি।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মা তড়িঘড়ি করে ডালটা গরম করে নিয়ে এলেন। মুখে হাসি নিয়ে বললেন— ‘ঠাণ্ডা ভাত আর গরম ডাল একসঙ্গে নিয়ে নে, দেখবি সবই গরম লাগবে’। মার কথা শুনে আমি হো-হো করে হেসে উঠম। মা বললেন- ‘ডিমভাজা খাবি?” ভাইবোনদের মধ্যে মা আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসেন। বাবা এখনো অফিস থেকে ফেরেন নি। বাবার কথা মুখে আনতে-না-আনতেই বাবা এসে হাজির।

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন— ‘খিদেয় পেট পুড়ে যাচ্ছে, জরুরি মিটিং ছিল, দুপুরে খাওয়ার সময় পাইনি’। কিছু সময়ের মধ্যেই বাবা এসে বসলেন আমার পাশে। এই সুযোগে কাল সাভারে ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টি বাবাকে বললাম। বাবা-মা দু জনেই খুশি হয়ে লিমনের বাবা-মাকেও আমাদের সঙ্গে যাওয়ার কথা বলিস।

দিনের খুশিতে আমি ছুটলাম খেলার মাঠে। লিমনের সঙ্গে সেখানে আমার দেখা হবে। জানালাম লিমনকে। লিমন আগে থেকেই তার বাবা-মাকে জানিয়েই রেখেছিল। সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে নেওয়ার কথা যেন ভুলে না যাই— মনে করিয়েয়ে দিস, এবং আরও অনেক গল্প শেষে বাসায় ফিরে এলাম। শেষ—ভাগ সন্ধ্যার সময় হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসলাম। একটানা তিন ঘণ্টা লেখাপড়া করলাম। তারপর রাতে খাওয়ার জন্য সবাই এক সঙ্গে টেবিলে বসলাম। আগামী দিন সাভার ভ্রমণ বিষয়ক নানা কথার মধ্য দিয়ে খাবার পর্ব শেষ হলো। এর কিছুক্ষণ পরই বাবা ডাকলেন টেলিভিশনে খবর শোনার জন্যে।

 

একটি দিনের দিনলিপি

 

প্রথমেই শর্ত জুড়ে দিলেন— যদি নাটক দেখ তবে খবরের শিরোনাম শুনে আবার গিয়ে পড়তে বস। খবরের শিরোনাম শোনার পর কি আর পড়াতে কারও মনোযোগ আসে? আমার বাবা খুব সহজ-সরল। হয়তোবা প্রত্যেকের কাছেই বাবা খুব সহজ-সরলই হয়। কিন্তু আমার বাবার সরলতা একটু ভিন্ন রকমের।

আমি যখন পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করি তখন বাবা আমাকে রাতের প্রথম জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। বাবার এই কান্না আমি সহ্য করতে পারি না। বাবা শুধু একবারই প্রহর কেঁদেছিলেন— ক্লাস সিক্সে ইংরেজিতে ফেল করেছিলাম বলে। তার পর থেকে আজ অবধি আর কাঁদতে হয় নি। আমাকে নিয়ে বাবার খুব উচ্চ আশা। বড় হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবো- এমন কথা বাবা কখনোই আমাকে বলেন নি। ঘুরেফিরে বাবার মুখে ওই একই কথা— ‘একজন ভালো মানুষ হতে হবে— সুন্দর মানুষ, যথার্থ মানুষ’। সদাচারী হও, কাজে-কর্মে যে সুন্দর সে-ই যথার্থ সুন্দর মানুষ। জগতে যাঁরা বড় হয়েছে, সবাই সদাচারী, সুন্দর মানুষ ছিলেন।

খাবার টেবিলে বসে স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য ত্যাগের কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গত তিনি আজও সেই কথাগুলোই বললেন। বাবার, হিতোপদেশগুলো আমি কখনোই ভুলি না। মা-এর স্নেহ-ভালোবাসা ভোলার সাধ্য আমার নেই। ক্লাসের শিক্ষকগণও আমাকে ভালোবাসেন। সবার এই অফুরান ভালোবাসা আমাকে দায়িত্বশীল হতে শিখিয়েছে। মহৎ জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। সংকল্প, ধৈর্য, অধ্যবসায় সহকারে জীবনের লক্ষ্য অর্জনে প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তকে রাতের কীভাবে কাজে লাগাতে হবে তা শিখিয়েছেন।

জীবন-জয়ের হাতিয়ার আমার নিজের হাতেই- এ দ্বি-প্রহরের আগে কথা আমি উপলব্ধি করতে শিখেছি। আরও অনেক কথা এসে মনের কোণে ভিড় করছে। দিনের আরও অনেক ছোটখাটো কর্মের কথা বাদ থেকে গেল। থাক না সে-সব কথা, সবচেয়ে বড় কথা জীবনের লক্ষ্য অর্জনে আমি যেন বিচ্যূত না হই। আমি যেন সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন গঠন করতে পারি— সেটাই আসল কথা। আরও একটি সুন্দর সকালের অপেক্ষায় আজকের মতো বিদায়। কাল আরও একটি নতুন দিন আসবে। ঘটবে আরও নতুন ঘটনা। আরও কিছু নতুন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। সেগুলোও লেখা হবে আমার দিনপঞ্জির খাতায়। শুরু হবে নতুন দিনলিপি ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment