শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : শিশুরাই আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন। অনাগত দিনের নতুন ইতিহাস। এদের মধ্যেই সুপ্ত আছে ভাবীকালের কত কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, কত সত্যসন্ধ বিজ্ঞানী, কত দুঃসাহসী অভিযাত্রী, কত আলোকতীর্থের অভিসারী যুগাবতার ধর্মগুরু, ইতিহাসের কত খ্যাত-কীর্তি পুরুষ। আজ মর্ত্যের প্রাঙ্গণে যার অপটু, ভীরু-চরণধ্বনি, উত্তরকালে তারই দৃপ্ত পদচারণা।
Table of Contents
শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার
শিশু-পরিচর্যার প্রয়োজন :
যে শিশুরা ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার, যাদের কর্মসাধনা ও সিদ্ধির ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির গৌরব-ইতিহাস, যারা আগামী দিনের স্বপ্ন ও সার্থকতা, তাদের জীবনে উপেক্ষা আর অশ্রুসিক বেদনার কত করুণ কাহিনী। দুঃখ, দারিদ্র্য, লাঞ্ছনার কত অভিশাপ। জন্মমুহূর্তেই কত নবজাতক আমাদের অবহেলায়, নিষ্ফল আর হতাশের দলে।
পূর্ণ প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই পথপ্রান্তে কত শিশু-পুষ্প নিঃশব্দে অকালে ঝরে যায় । ওদের জীবনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য চাই যথার্থ পরিবেশ রচনা, চাই উদার, সহৃদয় মানসিকতা, চাই প্রীতিপ্রেমের পরিচর্যা । পিতামাতা এবং সমাজই তাকে পরিকল্পিত রূপ দেয়ার কারিগর। পৃথিবীতে ওরা নবীন অতিথি। চোখে ওদের ভীরু, অসহায় দৃষ্টি। পায়ে নেই চলার স্বচ্ছন্দ গতি। তাই পৃথিবীর মানুষের কাছে ওদের স্নেহ-ভালোবাসার বুভুক্ষু হৃদয়ের প্রসারিত আহ্বান ।
শিশু অধিকার সনদ :
শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের দলিল এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার প্রতিফলক। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্বের শিশুদের মৌলিক মানবাধিকার, মর্যাদা রক্ষা, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, কল্যাণ এবং তাদের বিকাশের স্বার্থে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সনদটি গৃহীত হয়। ১৯৯০-এর ৩ আগস্ট বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২২টি দেশ শিশু অধিকার সনদ অনুসমর্থন করে। বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম এশীয় দেশ যে এই সনদকে অনুসমর্থন জানিয়েছিল। ১৯৯১-এর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে সনদটি কার্যকর হয়।
শিশুদের কল্যাণে যথাসম্ভব উদ্যোগ ও সহযোগিতা প্রদানে বাংলাদেশ সরকার দেশের জনগণ এবং জাতিসংঘের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই সনদে তিনটি পর্বে মোট ৫৪টি নীতিমালা বা ধারা প্রণীত হয়েছে। এই ৫৪টি নীতিমালা বা ধারাকে পাঁচটি খাতে চিহ্নিত করে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। যথা : শিশুদের জীবনের নিশ্চয়তা বা বেঁচে থাকার অধিকার, শিশুদের বিকাশ বা উন্নয়নের অধিকার, শিশুদের সুরক্ষা বা নিরাপত্তা অধিকার, শিশুদের অংশগ্রহণের অধিকার, শিশুদের সমাবেশিকরণ অধিকার। এ সনদে আছে শিশুদের মৌলিক ও মানবিক ১০টি অধিকার। এ অধিকারগুলো হলো-
১. জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে এ অধিকার ভোগ করবে।
২. স্বাধীন, মুক্ত ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু এবং স্বাভাবিক বিকাশে প্রতিটি শিশু অবাধ সুযোগ ভোগ করবে।
৩. শিশুর একটি নাম ও জাতীয়তা থাকবে।
৪. প্রচুর পুষ্টি ও আবাসিক সুবিধা পাবে। বিনোদন ও স্বাস্থ্য পরিচর্যাসহ সামাজিক সুবিধা ভোগ করবে।
৫. পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের শুশ্রূষা, শিক্ষা ও পরিচর্যা নিশ্চিত করা।
৬. সমঝোতা, নিরাপত্তা বিধানসহ স্নেহময় পরিবেশে শিশুর থাকার ব্যবস্থা করা।
৭. বিনা খরচে শিক্ষাদান ও শিশু শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৮. দুর্যোগের সময় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পর্যাপ্ত ত্রাণ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
৯. অবজ্ঞা, নিষ্ঠুরতা এবং শোষণের হাত থেকে রক্ষা করা ।
১০. বর্ণ, ধর্মসহ যে কোনো ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ করা।
জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদের মূল কথা হচ্ছে- শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য চাই নিরাপদ পরিবেশ, চাই তার সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা, তার চাই খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, চাই পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও সেবা, চাই উপযুক্ত শিক্ষা । এক কথায় শিশুকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চাই অভাবমুক্ত ও অনুকূল জীবন ও পরিবেশ।
বর্তমান সমাজে শিশুদের অবস্থা:
আজও এদের বৃহদাংশের জীবনে অশিক্ষার অন্ধকার, সমাজের নির্মম অবহেলা। আজও তাদের জন্য নেই যোগ্য সমাদরের আসন। এখনও বিশ্বের অজস্র শিশুর জীবনে অর্থনৈতিক অভিশাপ, সমাজের নিষ্ঠুর ঔদাসীন্য। আজও কত শিশু গৃহ পরিত্যক্ত, অনাথ। বহু শিশু এখনও ক্ষুধার তাড়নায় সমাজবিরোধীদের সহজ শিকার। ভবিষ্যতের অনপনেয় কলঙ্কের গ্লানি, অখ্যাতি আর অবজ্ঞায় জীবনের ঋণশোধ করে যেতে হয় আজও কত শিশুকে।
কত শিশু আজও অপুষ্টি, অনাহারে নীরবে নিভৃতে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কেউ তার হিসাব রাখে না। আজও ওরা বাস করে আলো বাতাসহীন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, ভোগ করে দুঃসহ নরকযন্ত্রণা । আজও কত শিশুর পরনে বস্ত্র নেই, রোগে ওষুধ নেই, ক্ষুধায় অন্ন নেই। কত দুরারোগ্য ব্যাধি তাদের জন্মসঙ্গী । এখনও বহু শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে পথে পথে ভিক্ষা বৃত্তি করে । এখনও অনেক বালকভৃত্য নিতান্তই কষ্টে-ক্লিষ্টে প্রাণধারণের তাগিদে অন্যের গৃহে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে, কলে-কারখানার কাজ করে। শিক্ষা-অঙ্গনে এখনও কোটি কোটি শিশুর প্রবেশের নেই ছাড়পত্র। এ চিত্র বাংলাদেশেও।
বাংলাদেশের শিশু-বর্তমান প্রেক্ষাপট :
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে ‘শিশু অধিকার দিবস’, ‘বিশ্ব শিশু দিবস’ এবং ‘শিশুদের জন্য হ্যাঁ বলুন’ কর্মসূচি। শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলো নিয়ে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ’ প্রণয়ন এখন একটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছে। এ সনদ তৈরি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে শিশুদের অধিকারসমূহকে দেয়া হয়েছে স্বীকৃতি। এ সনদের ধারাগুলো বাস্তবায়নের জন্য আইনি সাহায্যের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা মন্ত্রণালয়, রয়েছে শিশু একাডেমী, রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ছয় বছর বয়সের পর প্রতিটি শিশুর শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বড়দের মতো সমঅধিকারে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এদেশের শিশুরা জায়গা করে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিশুমেলা। অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। টেলিভিশন ও বেতারে নাচ, গান, নাটকের পাশাপাশি শিশুরা আসর বসিয়েছে খবর পাঠের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে। অবাধে এদেশের শিশুরা পারদর্শী হয়ে উঠেছে কম্পিউটার প্রযুক্তি বিষয়ে। শিশু অধিকার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর নিদর্শন হিসেবে সরকার ২০০৪ সালকে শিশু সাহিত্য বর্ষ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশে শিশুর সুযোগ :
বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ। তাই এদেশের শিশুরা বহু অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ দেশে রচিত হয়নি। অধিকাংশ শিশুই দারিদ্য ও অপুষ্টির শিকার। দারিদ্রোর কারণে বিপুল সংখ্যক শিশুকে জীবিকার তাড়নায় শ্রমদাসে পরিণত হতে হয়। তারা শিক্ষার সুযোগ পায় না। নির্মল আনন্দের সুযোগ থেকে হয় বঞ্চিত। যদিও শিশু প্রতিভার আবিষ্কারে কত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার আয়োজন! শিশুদের বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, ছবি আকার প্রতিযোগিতার আজও বিরাম নেই। কোথাও দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করা হয়েছে। ওদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও কিছু কিছু উদ্যোগ-আয়োজন হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি সামান্য ।
শিশু অধিকার রক্ষায় আমাদের করণীয় :
শিশু অধিকার বিষয়টি বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক বিষয় । শিশুদের অধিকার বাস্তবায়ন না হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে (আইনগতভাবে) রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হয়। কারণ শিশু অধিকার সনদের ভাষায়, রাষ্ট্র হলো এক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব বাহক। রাষ্ট্রের এ দায়িত্ব পরোক্ষভাবে অভিভাবক, প্রতিবেশী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ওপরেই বর্তায়। শিশুদের অধিকার সংরক্ষণে প্রয়োজন-
১. জাতীয় পর্যায়ে শিশুদের মানসম্মত শিক্ষাদান
২. শিশুদের প্রভাবিত করে এমন ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করা
৩. প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বাভাবিক শিশুর সমান সুযোগ দান করা
৪. নিয়মিত টিকাদান
৫. সর্বস্তরে শিশুদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা
৫. বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশনের পর্যাপ্ত সুবিধা পান
৭. স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ
৮. সময়োচিত মেধা বিকাশে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা
৯. বস্তিবাসী শিশুদের পুনর্বাসিত করা
১০. শিক্ষার পরিবেশে বৈষম্য দূর করা
১১. বাধ্যতামূলক শিশুশ্রম বন্ধ ঘোষণা
১২. শিশুশ্রম উদ্যোগী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া
১৩. শিশু পাচারে লিপ্ত অপরাধীচক্র চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা
১৪. ঠিকানাবিহীন শিশুদের তালিকা প্রণয়ন এবং তালিকাভুক্ত শিশুদের পুনর্বাসিত করা
১৫. মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বাসস্থান ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করা
শিশুরা দু’বেলা অন্ন সংস্থানের দাবি জানিয়ে সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা চায়। তারা অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে চায় না। চার নিরাপন ও সুরক্ষিত পরিবেশ। শিশুদের এ সু-ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, এনজিও ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

উপসংহার :
শিশু অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সীমাহীন দারিদ্র্য্য প্রধান বাধা হয়ে রয়েছে। তাই বাস্তব পদক্ষেপ ছাড়া এক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতি অর্জিত হবে না। শুধু প্রতিবছর শিশুবর্ষ পালনের মহাউৎসব পালন করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, এ আলোকোজ্জ্বল উৎসব প্রাঙ্গণের বাইরে যে কত শিশু আছে ক্ষুধায় ক্লান্ত, পীড়িত, কত শিশু নগ্ন, কত শিশু অকালে বিদায় নেয়, তার খবর কেউ রাখে না। জীবনধারণের সামান্যতম উপকরণও তাদের ভাগ্যে পায় না। বরং ওরা পায় সমাজের নিদারুণ ঔদাসীন্য । ওদের কাছে মিথ্যে হয়ে যায় আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষ । তাই এ বর্গ উদ্যাপনের মধ্যেই যেন আমাদের সব উদ্যম, দায়িত্ব বিশেষিত না হয়।
আরও দেখুন: