শিশুকল্যাণে সামাজিক আইন | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

শিশুকল্যাণে সামাজিক আইন | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু বড় হয়ে আগামী দিনের কর্ণধার হবে। শিশুরাই পুরাতন ও জরাজীর্ণকে ভেঙে সবকিছুকে নতুন ও মজবুত করে গড়ে তুলবে। কিন্তু শিশুরা যদি উপযুক্তভাবে বিকশিত না হয়, তাহলে তাদের দ্বারা মহৎ কোনো কাজই সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে শিশুদের বাস্তব অবস্থা অত্যন্ত করুণ। সকল প্রকার মৌল মানবিক চাহিদা থেকে আমাদের দেশের শিশুরা বঞ্চিত। এসব মৌল মানবিক চাহিদা অপূরণের ফলে আমাদের দেশে শিশু ও কিশোর অপরাধের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শিশুকল্যাণে সামাজিক আইন | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলাদেশ সরকার শিশুদের এ বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে শিশুকল্যাণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। তবে তা চাহিদা ও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য। সরকারি কার্যক্রম ব্যতীত আন্তর্জাতিক ও স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমেও আমাদের দেশে শিশুকল্যাণ কার্যক্রম চলছে । এখন আমরা শিশুকল্যাণের স্বরূপ ও বাস্তব অবস্থা নিয়ে আলোচনা করব।

শিশুকল্যাণে সামাজিক আইন | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

শিশুকল্যাণ বিষয়ক ধারণা :

শিশুদের সার্বিক বিকাশ ও কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাকেই সাধারণ অর্থে শিশুকল্যাণ বলা যায়। আধুনিক যুগে শিশুকল্যাণ ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। শিশুর জন্মের পূর্ব থেকে শিশুকল্যাণ শুরু হয় এবং তা কৈশোর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ শিশু যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন থেকে বা তার পূর্ব থেকেই মায়ের বিশেষ পরিচর্যা করা হয়, যাতে শিশু সুস্থ ও সবল হয়ে জন্মাতে পারে এবং জন্মের পর শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তির সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় ।

শিশুকল্যাণের ধারণা খুবই ব্যাপক। কারণ এই পরিধি খুবই বিস্তৃত। পরিবারের সকল সদস্য, পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ, বিদ্যালয়, আত্মীয়স্বজন সবই শিশুকল্যাণের সাথে জড়িত। কাজেই এসব প্রতিটি পর্যায়ে সুস্থ ও বাঞ্ছিত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যাতে শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধিতে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয় ।

হ্যাজেল ফ্রেডারিকসেন (Hazel Fredricksen )-এর মতে, শিশুকল্যাণ বলতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিশুদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির সার্বিক বিকাশ ও উন্নতির জন্য যেসব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও দৈহিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় সেসব কার্যক্রমকে বোঝায়।’ (W. A. Friedlander Introduction to Social Welfare, P-334) আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, “শিশুকল্যাণ বলতে ঐ সব কর্মসূচিকে বুঝায় যা শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনে নিয়োজিত এবং এটি শিশুর জন্মের পূর্ব থেকে শুরু করে কৈশোর পর্যন্ত শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে ।’

সামাজিক আইন :

সমাজে প্রচলিত কিছু অবাঞ্ছিত ও অযৌক্তিক প্রথা বা কার্যকলাপ যা জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায় এবং সামাজিকভাবেই বিশেষ ব্যক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করে। এভাবে শোষিত, বঞ্চিত ও অসহায় দরিদ্র বা সমস্যায় নিপীড়িত জনসমষ্টিকে রক্ষার তাগিদে সামাজিক আইন প্রণীত ও গৃহীত হয়ে থাকে। সামাজিক আইন সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষী যেসব মতামত ব্যক্ত করেছেন তা নিচে উপস্থাপন করা হলো :

১. সমাজ বিজ্ঞানী Earke Fusje Young সম্পাদিত Dictionary of Social Welfare’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘শারীরিক পঙ্গুত্ব, দারিদ্র্য কিংবা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা কম থাকার জন্য যারা উন্নত জীবন লাভে অক্ষম এমন পণমানুষের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর জন্য সেবা লাভ নিশ্চিতকরণ এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণকালে প্রবর্তিত আইনই সামাজিক আইন

২. V. V. Sastri তার ‘Social Legislation in India’ গ্রন্থে বলেন, ‘যথাযথ আইনসিদ্ধ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গৃহীত সামাজিক প্রথার সংশোধনকে সামাজিক আইন বলা যেতে পারে। এ ধরনের প্রথার কাজ হলো সাধারণত কোনো সমাজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের ব্যবস্থা করা।

৩. Sir Henry Main এর মতে, ‘কেবল সার্বভৌম শক্তির অনুশাসনই আইন হয়, দেশের প্রচলিত আচার-প্রথাও আইন বলে স্বীকৃত। যদিও এগুলো কোনো সার্বভৌমের আদেশে সৃষ্টি হয়নি।’

উপর্যুক্ত সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে সংক্ষেপে বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম প্রণীত যেসব বিধি-বিধান বা নিয়মকানুন সমাজজীবন হতে অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা দূর করে অথবা প্রতিরোধ করে সুন্দর, সুষ্ঠু ও প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে প্রয়াস পায় সেগুলোই সামাজিক আইন নামে স্বীকৃত। সার্বিকভাবে সমাজের কল্যাণ সাধিত হয় বলেই মানুষ এসব আইন মেনে চলে।

শিশুকল্যাণ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত আইনসমূহ :

শিশু কল্যাণ প্রত্যয়টি অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। বর্তমানে এটি দুঃস্থ, অবহেলিত, বিকলাঙ্গ, পরিত্যক্ত, অসুস্থ, সামঞ্জসাহীন ও অপরাধ প্রবণ শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণের নামে সীমাবদ্ধ নয়। সমাজের সব শ্রেণীর শিশুই শিশু কল্যাণের আওতাভুক্ত। বর্তমানে শিশুদের পৃথক সত্তার পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়ে তাদের কল্যাণে এবং সুষ্ঠু বিকাশে প্রতিটি সমাজ ও দেশ সচেতন । এরূপ সচেতনতার ফলশ্রুতিই হচ্ছে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত শিশু কল্যাণ কার্যক্রম বাংলাদেশে শিশু কল্যাণ ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনগুলো নিচে আলোচনা করা হলো :

ক. ১৯২২ সালের বঙ্গীয় শিশু আইন :

শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাই তাদের কল্যাণ অগ্রাধিকারযোগ্য। শিশুদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য অবিভক্ত ভারতে ‘বঙ্গীয় শিশু আইন-১৯২২’ প্রণয়ন করা হয়। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে কিশোর অপরাধীদের সংশোধন, কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে যেসব আইন প্রণীত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাস্তবমুখী আইন হচ্ছে বঙ্গীয় শিশু আইন। জাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ সম্পদ শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা ও কল্যাণকে এ আইনে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ১৮৯৭ সালের রিফরমেটরি অ্যাক্ট-এর অসম্পূর্ণতা ও দুর্বলতার প্রেক্ষিতে এটি প্রণীত হয়। এ আইনের উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ নিম্নরূপ :

১. এ আইনের ধারা অনুযায়ী যুক্ত বাংলায় ১৪ বছরের কম বয়স্কদের শিশু এবং ১৪-১৬ বছর বয়স্কদের তরুণ ও কিশোর হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

২. কিশোর অপরাধীদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের জন্য কিশোর আদালত, শিল্প বিদ্যালয় এবং আটক নিবাস (Juvenile court, Industrial school and Remand Home) স্থাপনের ব্যবস্থা করা। এ আইনে ১৬ বছরের কম বয়স্ক যুবকদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ থাকলে কিশোর আদালত কর্তৃক তাদের পিতা বা অভিভাবকদের আদালতে ডাকতে বা ঐ যুবকদের আদালতে হাজির করার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিধান রাখা হয় ।

৩. যদি কোনো শিশু ভিক্ষা করে, মাতৃ-পিতৃহীন হয়, অক্ষম পিতামাতা বা অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে থাকে, নির্দয় ব্যবহারের শিকার হয় অথবা দুর্বৃত্ত বা বেশ্যার দলে থাকলে আদালত সেসব শিশুকে মুক্তি দিতে বা দায়িত্ববান কোনো অভিভাবকের তত্ত্ববধানে অথবা কোনো কারিগরি বা শিল্প বিদ্যালয়ে প্রেরণের ব্যবস্থা করতে পারবে।

৪. এ আইনের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে, কোনো শিশুর প্রতি নির্দয় ব্যবহার বা নির্যাতন করলে বা কোনো কিশোরীকে বেশ্যাবৃত্তিতে প্ররোচিত ও নিয়োজিত করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দু বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়।

৫. কোনো শিশু-কিশোরকে বন্ধক রাখলে বা বন্ধক হিসেবে ব্যবহার করলে, তার জন্য জরিমানা আদায়ের বিধান রাখা হয়।

সমালোচনা :

১৯২২ সালের বঙ্গীয় শিশু আইন শিশুদের কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য প্রণয়ন করা হলেও এ আইন সার্বিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্বলতার কারণে এ আইন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও শিশুদের কিছুটা কল্যাণ করতে পেরেছিল। উপর্যুক্ত কল্যাণমূলক ধারা ও বিধানগুলো সংযোজিত হওয়ায় এটি অন্যতম শিশু কল্যাণ ও নিরাপত্তামূলক আইন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশে বর্তমানে এ আইনটি কার্যকরি না হলেও উক্ত আইনের অনুরূপ ১৯৭৪ সালের শিশু আইন কার্যকর রয়েছে।

শিশুকল্যাণে সামাজিক আইন | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

খ. ১৮৫০ সালের শিক্ষানবিশ আইন :

এতিম, অসহায়, অপরাধী ও অবহেলিত শিশু-কিশোররা সমাজের চোখে সাধারণত অপাংক্তেয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত হয়। সেজন্যই তারা সমাজ থেকে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি ও সাহায্য পায় না। ফলে তারা বঞ্চনার শিকার হয়ে বিপথে পরিচালিত হয় এবং সমাজে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এতে তারা নানারূপ অপরাধ প্রবণ কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত এবং সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে।

এ অবস্থা কখনো কোনো সমাজে কাম্য নয়। এর প্রেক্ষিতেই এদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়। এসব আইনের মধ্যে ১৮৫০ সালে প্রণীত “শিক্ষানবিশ আইন ১৮৫০’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ আইনের ধারা অনুযায়ী এতিম, অসহায়, অপরাধী ও অবহেলিত শিশু-কিশোরদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও তাদের নিয়োগদানের ব্যবস্থা করা হয় যাতে তারা অনুকূল পরিবেশে উপর্যুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকারী এবং দায়িত্বশীল ও স্বাবলম্বী নাগরিক হয় গড়ে উঠতে পারে ।

সমালোচনা :

তবে এ আইন কাগজে থাকলেও বাস্তবে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ লক্ষ করা যায় না । কারণ এর কার্যকারিতার জন্য যে সামাজিক সচেতনতা, উপযুক্ত সংগঠন কাঠামো এবং বৈষয়িক সমর্থন দরকার তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সেজন্যই আজও এদেশের শিশু-কিশোরদের প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়ে সমাজে বোঝা হিসেবে পরিগণিত হতে হয়। বর্তমানে শিশু কিশোরদের স্বার্থে এ আইনের পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয়তা দু-ই রয়েছে।

গ. শ্রম আইন :

যে শিশুর বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি, তাকে কারখানায় কাজ দেয়া যাবে না। তবে ১৪ বছর পূর্ণ হয়েছে কিন্তু ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি এমন তরুণদের শর্তসাপেক্ষে নিয়োগ করা যায়। যেমন— ৭০ ধারায় শিশুদের কাজের সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৯৬৫ সালের কারখানা আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী শিশুদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ। তরুণ শ্রমিকদের দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে তাদের কাজ দিতে হবে। এর আগে বা পরে তরুণ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না।

এদের দিয়ে একটি শিফটেই কাজ করানো যাবে। চিফ ইন্সপেক্টরের অনুমতি ছাড়া ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে একবারের বেশি শিফট বদল করা যাবে না। কোনো তরুণকে যন্ত্রের কোনো অংশ চালু থাকা অবস্থায় সেখানে পরিষ্কার করা, তেল লাগনো বা বিন্যস্ত করা বা সংযোজনের কাজ করতে দেয়া যাবে না বা চলমান যন্ত্রের আশেপাশে কাজ করতে দেয়া যাবে না। যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত বিপদাপদ এবং তা থেকে সতর্কতা অবলম্বন সম্পর্কিত সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ না দেয়া পর্যন্ত কোনো তরুণ শ্রমিককে যন্ত্রের কাজ দেয়া যাবে না । কোনো কারখানার যে অংশে তুলা সংকোচন করে বস্তাবন্দি করা এবং সুতা কাটার যন্ত্র চালু আছে সেখানে তরুণকে কাজ করতে দেয়া যাবে না। তরুণদের কাজে নিয়োজিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট সার্টিফিকেট দানকারী সার্জনের নিকট থেকে দৈহিক সক্ষমতা সার্টিফিকেট নিতে হবে।

সমালোচনা :

প্রবাদে আছে, প্রয়োজন আইন মানে না। এ প্রবাদের সম্পূর্ণ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় এই শ্রম আইনের প্রেক্ষাপটে। অতি দারিদ্র্য শিক্ষার অভাব, শিল্প মালিকদের স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি কারণে তৃতীয় বিশ্বে দেশগুলোতে এ আইনের বাস্তব প্রয়োগ দেয়া যায় না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশের শিল্প কারখানাতেই বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। ফলে তারা অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হয় তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায় শিশুকাল পেরুতেই। তাই শিশুদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে কাগজে- কলমে নয় বাস্তবে এ আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ এখন সকলের কাম্য।

ঘ. ১৯৭৪ সালের শিশু আইন:

শিশুদের রক্ষণ, হেফাজত, তাদের সাথে ব্যবহার এবং কিশোর অপরাধের বিচার ও শাস্তি সম্পর্কিত আইন একীভূত এবং সংশোধন করার জন্য ‘১৯৭৪ সালের শিশু আইন’ প্রণয়ন করা হয়। এ আইন বলবৎ হওয়ার পর ১৯২২ সালের বঙ্গীয় শিশু আইন এবং ১৯২২ সালের রিফরমেটরি স্কুল আইন রহিত করা হয়। শিশু আইনে মোট ৭৮টি ধারা রয়েছে। এ আইনের উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ নিম্নরূপ :

১. এ আইনে কিশোর অপরাধীদের জন্য কিশোর আদালত স্থাপনের বিধান রাখা হয়েছে। কিশোর আদালতের যে ক্ষমতা সে ক্ষমতা অন্য আরও কয়েকটি আদালতকে দেয়া হয়েছে। এসব আদালত হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী দায়রা জজ, অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং দায়রা জজের আদালত। কিশোর আদালত যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানে এসব আদালত শিশু কিশোরদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার করবেন।

২. শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের পৃথক বিচার ব্যবস্থা থাকবে। এদের একত্রে, একই আদালতে একই সময়ে বিচার করা আইনানুগ নয় ।

৩. উক্ত আইনে গৃহহীন দুঃস্থ প্রমুখ শিশুদের লালন-পালন ও তত্ত্বাবধানের জন্য পরিবার আত্মীয় কিংবা দায়িত্ব গ্রহণে উপযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ।

৪. এ আইনে শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তি বা ক্ষতিকর আচরণে জড়িত করার মতো কার্যকে দণ্ড বিধানের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খলতাপ্রবণ সন্ততিদের সংশোধন করার জন্য তাদের পিতামাতা কিশোর আদালতের সাহায্য গ্রহণ করতে পারে ।

৫. এ আইনের বিধান মোতাবেক যদি শিশুর ওপর ক্ষতিকর কোনো উৎপীড়ন বা অবহেলা প্রদর্শন করে তবে তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধী বলে গণ্য হবে।

৬. গৃহহীন, জীবন ধারণের উপায়হীন, অভিভাবকহীন, ভিক্ষারত, পরিত্যক্ত এবং সঙ্গদোষে দুষ্ট শিশুদের আদালতে হাজির করার বিধান রয়েছে। কিশোর আদালত এসব শিশুদের সার্বিক দিক বিবেচনা করে রিমান্ড হোমে পাঠাতে অথবা কোনো আত্মীয়’র হেফাজতে রাখতে পারেন।

সমালোচনা :

আলোচিত শিশু আইনের কয়েকটি প্রশংসনীয় দিক উল্লেখ থাকলেও এর মুখ্য সীমাবদ্ধতা হলো এর ব্যাপক সুফল জনগণের দোরগোড়ায় এখনও পৌঁছায়নি। এ আইন কার্যকরী করতে পেশাগত যোগ্যতা সম্পন্ন ও দক্ষ কর্মীর নিয়োগ নেই বলে তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। থানা পর্যায়ে শিশু আইন কার্যকরীভাবে প্রয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত কিশোর অপরাধ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

শিশুকল্যাণে সামাজিক আইন | শিশুবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার :

শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার প্রবাদে আছে, Child is the father of the future. অর্থাৎ শিশুরা হচ্ছে ভবিষ্যতের পিতা। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নতির জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে থাকে। শিশুদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই সব দেশে শিশুকল্যাণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। শিশুদের সার্বিক বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য পিতা-মাতা ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় তাকেই শিশুকল্যাণ বলা হয়। কিন্তু  আমাদের দেশে শিশুরা তাদের অধিকার ভোগের সুযোগ পাচ্ছে না, শিশুদের সার্বিক বিকাশ প্রক্রিয়ার সঠিকতার জন্য বিভিন্ন সময়ের আইনসমূহ কার্যকর প্রভাব রাখতে পারছে না। এসব আইনসমূহের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে এর উপযোগিতা বৃদ্ধি করা উচিত।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment