শব্দের অর্থ পরিবর্তন | শব্দের অর্থ পরিবর্তনের কারন | ভাষা ও শিক্ষা , শব্দ বস্তু বা ভাবের দ্যোতক। শব্দের দ্বারা আমরা পরিচিত বস্তুকে বোঝাতে কিংবা অন্তরসস্থ ভাবকে প্রকাশ করতে চাই। আমাদের পরিচিত বস্তু ও ভাবজগতের পরিধি যত বৃদ্ধি পায়, একই শব্দকে ততই আমরা একাধিক বস্তু বা ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করি।
শব্দের অর্থ পরিবর্তন | শব্দের অর্থ পরিবর্তনের কারন | ভাষা ও শিক্ষা
শব্দের অর্থ পরিবর্তন
কালের বিবর্তনে তথা ভৌগোলিক পরিবেশ, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন ইত্যাদি নানা কারণে শব্দের যে অর্থ-পরিবর্তন ঘটে তাকে শব্দের অর্থ-পরিবর্তন বলে।
কোনো ভাষার কোনো শব্দ চিরকাল একই অর্থ বহন করে না। যে শব্দের যখন উৎপত্তি হয়, তখন তার একটা নিজস্ব নির্দিষ্ট অর্থ থাকে। শব্দটি তখন বিশেষ বস্তু বা ভাবপ্রকাশের কাজে নিয়োজিত থাকে। কিন্তু পরে দেখা যায়, সেই শব্দ প্রথমদিকে নির্দিষ্ট একটি অর্থ ধারণ করলেও যুগ পরিবর্তনের নানা ঠোকর খেয়ে অবশেষে এক বা একাধিক অর্থ বুকে নিয়ে বসে আছে। কখনো এমন হয় যে, শব্দটি নতুন এক অর্থের কথা বলছে। ব্যাপারটা সব ভাষার বেলাতেই ঘটে। মোটকথা- শব্দের অর্থ বা মতিগতি কখনোই ঠিক থাকে না। যেমন, উদ্ভট শব্দের অর্থ অদ্ভুত, আজগুবি, উৎকট।
সংস্কৃত উদ্ভট শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে এক উদ্ভট রূপ ধারণ করে বসে আছে। শব্দটির উদ্ভট আচরণে স্ততি না হয়ে উপায় নেই। কারণ সংস্কৃত ভাষায় উদ্ভট শব্দটির অর্থ হল— মহাশয়, মহাত্মা, উদার, পুর্নন, দুর্ধর্ষ, শ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্ট ইত্যাদি। অথচ বাংলা ভাষায় উদ্ভটের মানে হল অদ্ভুত, আজগুবি, অসম্ভব যেগুলোর সঙ্গে সংস্কৃত উত্তটের কোনো মিলই নেই।
ভাষা বহতা নদীর মতো প্রবহমান। গতির টানে শুধু শব্দ ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে না, শব্দের মূল অর্থ দূরতর হয়ে কালক্রমে পরিবর্তন স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। নানা কারণে এই পরিবর্তন ঘটতে পারে। শব্দার্থ পরিবর্তনের পেছনে ভৌগোলিক পরিবেশ, সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনের নানান ইতিবৃত্ত ও তাদের বিচিত্র কাহিনি নিহিত আছে। ফারসি শব্দ ‘দরিয়া’-র অর্থ নদী পরিবর্তিত ভৌগোলিক পরিবেশে বাংলায় হয়েছে ‘সমুদ্র’।
“বিবাহ” শব্দের প্রাচীন অর্থ ছিল বহন বা অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া তখনকার দিনে বিবাহের জন্যে কন্যা অপহৃতা হত এই ছিল সামাজিক প্রথা। পরে পরিবর্তিত অর্ধ- ‘শুভ পরিণয়’। ‘ঝি’ শব্দের অর্থ কন্যা, তবে ‘দাসী’ অর্থেওপ্রচলিত। এই অর্থ-পরিবর্তনের পেছনে হীন কাজকে শোভনতা দানের উদ্দেশ্যে মনস্তাত্ত্বিক কারণ কাজ করেছে। ‘গবাক্ষ’ শব্দের অর্থ “গোরুর চোখ। বর্তমান অর্থ “বাতায়ন’ হলেও তার আকৃতি গোরুর চোখের তুল্য। অবশ্য এখন চৌকাকার। তাহলেও গবাক্ষ’ শব্দের গভীরে লুকিয়ে আছে উপমা অলংকারের চমৎকার ব্যাঞ্জনা ।
শব্দের অর্থ পরিবর্তনের কারন
পণ্ডিতের চোখে “শব্দের অর্থ পরিবর্তনের কাহিনি বিচিত্র ও মনোরম” এবং এ কাহিনি “আমাদের অফুরন্ত খনি।” শব্দের অর্থ পরিবর্তনের ইতিহাসের মধ্যে ‘মানব মনের চিন্তাধারার বিচিত্র ও বিবিধ বিসর্পণের নির্দেশ পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই ইতিহাসের মধ্যে জাতি বা ভাষাসম্প্রদায়ের অতীত ইতিহাসের ও চিন্তাধারার আভাস ইঙ্গিত লুকানো থাকে।’ ভাষাবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী শব্দের অর্থ পরিবর্তনের বহুবিধ কারণ লক্ষ করা যায়। মোটকথা দেশ, কাল, পাত্র এবং পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন অবস্থা মানব-মনের ওপর যেভাবে প্রভাব ফেলে, শব্দের অর্থও সেভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই কারণগুলো চার ভাগে বিভক্ত হতে পারে। যেমন,
১। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণ : ইতিহাসের ধারায় সমাজবিধি ও সংস্কৃতির রূপের পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে শব্দের অর্থের পরিবর্তন দেখা যায়। ভৌগোলিক পরিবেশের কারণেও একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রয়োগপ্রযুক্তিও শব্দের পরিবর্তন না ঘটিয়ে অর্থের পরিবর্তন ঘটায়।
২। ভাষিক কারণ : ধ্বনিসাদৃশ্য, ভাষানুষঙ্গের বিমিশ্রণ বা স্পর্শসংক্রমণ, লোক-নিরুক্তি শব্দের সঙ্করীকরণ, সমধ্বনিযুক্ত শব্দ থেকে জাত শব্দবিভ্রম, বর্ণচোরা শব্দের প্রভাব এবং বিভিন্নরূপ ধ্বনি পরিবর্তনের প্রভাবে শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়।
৩। সামাজিক কারণ : সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঋণ, বিদেশি কৃতঋণ শব্দ নিয়ে জটিলতা বা রসিকতা, শব্দ ব্যবহারকারীদের আর্থ-সামাজিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তনও শব্দের অর্থের ওপর প্রভাব ফেলে এবং তার ফলে শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হয়।
৪। মনস্তাত্ত্বিক কারণ : মানুষের বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার, টাবু ও সুভাষণ, আবেগ, শৈথিল্য ও আরামপ্রিয়তা, রসবোধ ও ব্যঙ্গপ্রবণতার দরুন মানুষের মধ্যে শব্দের রূপক ও আলংকরিক প্রয়োগপ্রবণতা দেখা দেয়। শব্দের অর্থ পরিবর্তনের এটাই সবচেয়ে বড় কারণ।
আরও দেখুন:
- যতি চিহ্ন বা বিরাম চিহ্ন কী | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে পরিবর্তন | ভাববাচ্য থেকে কর্তৃবাচ্যে পরিবর্তন | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- বাচ্য পরিবর্তন | কর্মবাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে পরিবর্তন | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- বাচ্যের প্রকারভেদ | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- যদি জানতেম আমার কিসের , প্রেম ৪৬ | Jodi jantem amar kisher