অর্থালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার – বিষয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “ছন্দ ও অলঙ্কার” বিভাগের একটি পাঠ।
Table of Contents
অর্থালঙ্কার ছন্দ ও অলঙ্কার
অর্থের বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য-বিধায়ক অলঙ্কারকে বলা হয় অর্থালঙ্কার। ‘রূপ-সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ-রতন আশা করি’ কিংবা ‘চাঁদের মতো মুখখানি তার করছে ঢল ঢল’- বাক্য দুটির প্রথমটিতে ‘রূপের মধ্য দিয়ে অরূপের সন্ধান’ বোঝাতে প্রচলিত সাগর ও রত্নের সঙ্গে তাদের অভেদের সাহায্যে ব্যাপারটা স্পষ্টতর ও সহজবোধ্য করে তোলা হয়েছে, আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটিতে মুখের লাবণ্য বোঝাতে চাঁদের উপমা টেনে এনে তা স্ফুটতর করা হয়েছে।
শব্দালঙ্কারের আবেদন যেমন শ্রুতির কাছে, অর্থালঙ্কারের আবেদন তেমনি বুদ্ধির কাছে। শব্দটির প্রকৃত অর্থ বোধগম্য না হলে অলঙ্কার পরিস্ফুট হয় না। অর্থালঙ্কার সাধারণ লক্ষণ অনুসারে প্রধানত পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত হতে পারে। যেমন :
১. সাদৃশ্যমূলক
২. বিরোধমূলক
৩. শৃঙ্খলামূলক
৪. ন্যায়মূলক
৫. গূঢ়ার্থমূলক।
সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার :
দুই ভিন্ন জাতীয় পদার্থের অন্তর্নিহিত কোনো না-কোনো সাদৃশ্যের ওপর নির্ভর করে যে শ্রেণির অলঙ্কার রূপ লাভ করে তাকে সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার বলে। এই শ্রেণির উল্লেখযোগ্য অলঙ্কার হল : উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নুতি, সন্দেহ, নিশ্চয়, প্রতিবস্তুপমা, দৃষ্টান্ত, নিদর্শনা, ব্যতিরেক, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি এবং প্রতীপ।
উপমা :
একই বাক্যে সাধারণ ধর্মবিশিষ্ট দুই ভিন্ন জাতীয় পদার্থের মধ্যে সাদৃশ্য কল্পনা করা হলে তাকে উপমা বলে। যেমন : পদ্মের কলিকাসম / ক্ষুদ্র তর মুষ্টিখানি। উপমার চারটি অঙ্গ:
১. উপমেয় : যাকে তুলনা করা হয়। ২. উপমান : যার সঙ্গে তুলনা করা হয়। সাধারণ ধর্ম : যে বৈশিষ্ট্যের জন্য তুলনা দেওয়া হয়। সাদৃশ্যবাচক শব্দ : মত, সম, হেন, সদৃশ, প্রায় ইত্যাদি। 8. দৃষ্টান্ত : ‘পদ্মের কলিকাসম ক্ষুদ্র তব মুষ্টিখানি।’- এ বাক্যে উপমেয়—মুষ্টি; উপমান-পদ্মের কলিকা; সাধারণ কাম- ক্ষুদ্র,; সাদৃশ্যমূলক শব্দ-সম।
ধর্ম- উপমার শ্রেণিবিভাগ :
পূর্ণোপমা :
যেখানে উপমার চারটি অঙ্গ= উপমেয়, উপমান, সাধারণ ধর্ম ও সাদৃশ্যবাচক শব্দ প্রত্যক্ষভাবে বিদ্যমান থাকে তাকে পূর্ণোপমা বলে। যেমন : রাজ্য তব স্বপ্নসম / গেছে ছুটে।
লুপ্তোপমা :
উপমার চারটি অঙ্গের মধ্যে যে কোনো একটি বা দুটির উল্লেখ না থাকলে তা লুপ্তোপমা হয় । * যেমন : পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে / নাটোরের বনলতা সেন।
মালোপমা :
একটি উপমেয়ের একাধিক উপমান থাকলে তাকে মালোপমা বলে। যেমন : তোমার সে চুল / জড়ানো সূতার মত, নিশীথের মেঘের মতন।
রূপক :
উপমেয়ের সঙ্গে উপমানের অভেদ কল্পনা করা হলে তাকে রূপক অলঙ্কার বলে। যেমন : ওহে নাবিক কে জানে তোমার মহিমা। । নাম নৌকায় নিরবধি পার কর ভবনদী তিন জাতের তব আগে কি ছার যমুনা।
রূপক নিরঙ্গ রূপক :
যখন একটি উপমেয়ের সঙ্গে এক বা একাধিক উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয় তখন তা হয় নিরঙ্গ রূপক। যেমন : এমন মানব জমিন রইল পতিত / আবাদ করলে ফলত সোনা।
সাঙ্গ রূপক :
যেখানে বিভিন্ন অঙ্গসমেত উপমেয়ের সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গসমেত উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয় সেখানে সাঙ্গ রূপক হয়।
যেমন : ধারামঞ্জীরে নভ-অঙ্গনা সঙ্গত করে সে সঙ্গে / রিমি ঝিমি রিমিঝিমি পরম্পরিত রূপক : যদি একটি উপমেয়ের সঙ্গে একটি উপমানের অভেদ কল্পনা অন্য উপমেয়ের সঙ্গে অন্য উপমানের অভেদ কল্পনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে পরম্পরিত রূপক হয়। যেমন মরণের ফুল বড় হয়ে ফোটে / জীবনের উদ্যানে।
উৎপ্রেক্ষা :
নিকট-সাদৃশ্যের জন্যে উপমেয়কে উপমান বলে প্রবল সংশয় হলে উৎপ্রেক্ষা অলঙ্কার হয়। যেমন: হীরা মুক্তা মাণিক্যের ঘটা / যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক।
সন্দেহ :
যেখানে উপমেয় ও উপমান উভয়পক্ষে সমান সংশয় থাকে সেখানে সন্দেহ অলঙ্কার হয়। যেমন : স্বর্ণপাত্রে সুধারস, না সে বিষ? কে করে শোচনা । পান করি সুনির্ভয়ে, মুচকিয়া হাসে যবে ললিত লোচনা।
অপহ্নুতি :
যদি উপমেয়কে অস্বীকার করে উপমানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তবে তাকে অপহ্নুতি অলঙ্কার বলে।
নহ, কাব্য তুমি, তোমা ‘পরে কবির প্রসাদ / কবির কল্পনা মোহে চক্ষে তব ঘনায়েছে ঘোর। যেমন : নারী নহ, কাব্য তুমি, :
নিশ্চয় :
যদি উপমানকে নিষিদ্ধ করে উপমেয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাহলে তাকে নিশ্চয় অলঙ্কার বলে। যেমন : এ নহে মুখর বনমর্মর গুঞ্জিত । এ যে অজাগর গরজে সাগর ফুলিছে । এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত । ফেন-হিল্লোল কল–কল্লোলে দুলিছে।
চাক ভ্রান্তিমান :
অতি সাদৃশবশত উপমেয়ের সঙ্গে উপমানের প্রভেদ নির্ণয় করতে না পেরে যদি উপমেয়কে উপমান বলে ভুল করা হয়, তবে ভ্রান্তিমান অলঙ্কার হয়।
যেমন : তোমার সুখে গুনগুনিয়ে ভ্রমর এলো / কমল বলে ভুল করে সে স্পর্শ ছড়ালো, / আমার ঈর্ষা জাগালো।
অতিশয়োক্তি :
উপমেয় ও উপমানের অভেদ কল্পনার জন্যে উপমেয়ের একবারে উল্লেখ করে উপমানকেই উপমেয়রূপে নির্দেশ করলে অতিশয়োক্তি অলঙ্কার হয়। যেমন : আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা, / মিথ্যা হত কাননে ফুল ফোটা।
ব্যতিরেক :
উপমান অপেক্ষা উপমেয়ের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ সূচিত হলে ব্যতিরেক অলঙ্কার হয়। যেমন : কি ছার ইহার হে দানবপতি মিয়, প্রস্থে যারে সভা, স্বহস্তে গড়িলা তুমি তুষিতে কৌরবে।

প্রতীপ :
প্রসিদ্ধ উপমানকে উপমেয় রূপে বর্ণনা করলে প্রতীপ অলঙ্কার হয়। যেমন কফি নিবিড় কুন্তলসম মেঘ নামিয়াছে মম / দুইটি তীরে।
সমাসোক্তি :
অচেতন উপমেয়ে চেতন উপমানের কিংবা চেতন উপমেয়ে অচেতন উপমানের ব্যবহার করা হলে সমাসোক্তি অলঙ্কার হয়। যেমন : আরোপ শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই / আয় আয় কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
প্রতিবস্তুপমা :
যেখানে উপমেয় ও উপমান দুটি পৃথক বাক্যে থাকে, তাদের সাধারণ ধর্ম তাৎপর্যে এক হয়েও বিভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হয় এবং সাদৃশ্যবাচক শব্দের প্রয়োগ হয় না, সেখানে প্রতিবস্তুপমা অলঙ্কার হয়।
যেমন : কিন্তু নিশাকালে কবে ধূমপুঞ্জ পারে / আবরিতে অগ্নিশিখা? অগ্নিশিখা তেজে গ চলিলা প্রমীলা দেবী বামা- দল-বলে ।
দৃষ্টান্ত :
যেখানে উপমেয় ও উপমান দুটি পৃথক বাক্যে থাকে, তাদের সাধারণ ধর্ম তাৎপর্যে এক না হয়েও সদৃশ ব বলে প্রতীয়মান হয় এবং সাদৃশ্যবাচক শব্দের প্রয়োগ হয় না, সেখানে দৃষ্টান্ত অলঙ্কার হয়।
যেমন : পর্বত গৃহ ছাড়ি / বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে, কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
নিদর্শনা :
যেখানে দুটি বস্তুর অসম্ভব বা সম্ভব সম্বন্ধ ব্যঞ্জনা দ্বারা উপমেয় উপমান ভাব ফুটিয়ে তোলে, সেখানে নিদর্শনা অলঙ্কার হয়। যেমন : অমরবৃন্দ যার ভুজবলে । কাতর, সে ধনুর্ধরে রাঘব ভিখারী. বধিল সম্মুখ রণে? ফুলদল দিয়া / কাটিলা কি বিধাতা শালী তরুবরে?
আরও দেখুন: