সেই মানুষটি যে ফসল ফলিয়েছিল, কবিতাটি “আন্তোরিও হাসিন্টে”র মূল রচনার অনুবাদ। কবিতা অনুবাদ করেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(ইংরেজি: Birendra Chattopadhyay) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা কবি। তার কবিতায় ভাষিত হয়েছে সমগ্র দুনিয়ার প্রতারিত মানুষের বেদনা, মানবতা-বিরোধী ঘটনার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ তীব্র-প্রতিবাদ। অন্যদিকে রোমান্টিকের মতো সমাজ জীবনের সুন্দর স্বপ্নকে শেষমুহুর্ত পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন। কবির জন্ম ২ সেপ্টেম্বর, ১৯২০। ১১ জুলাই, ১৯৮৫ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সেই মানুষটি যে ফসল ফলিয়েছিল..
সেই বিরাট খামারটাতে কখনো বৃষ্টি হয় না
আমারই কপালের ঘাম দিয়ে গাছগুলোকে
তৃষ্ণা মেটাতে হয়
সেখানে যে কফি ফলে, আর চেরি গাছে
যে টুকটুকে লাল রঙের বাহার ধরে
তা আমারই ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, যা জমে কঠিন হয়েছে
কফিগুলোকে ভাজা হবে, রোদে শুকোতে হবে,
তারপর গুড়ো করতে হবে
যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের গায়ের রঙ হবে
আফ্রিকার কুলির গায়ের রঙের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ
আফ্রিকার কুলির জমাট রক্তে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ
কে ভোর না হতেই ওঠে?
কে তখন থেকেই খেটে মরে?
কে লাঙ্গল কাঁধে দীর্ঘ রাস্তা কুঁজো হয়ে হাঁটে?
আর কেই বা শস্যের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত হয়?
কে বীজ বপন করে?
আর তার বিনিময়ে যা পায়, তা হ’লো
ঘৃণা, বাসি রুটি, পঁচা মাছের টুকরো,
শতচ্ছিন্ন নোংরা পোশাক, কয়েকটা নয়া পয়সা?
আর এরপরেও তাকে পুরস্কৃত করা হয়
চাবুক আর বুটের ঠোক্কর দিয়ে
কে সেই মানুষ?
কে ক্ষেতগুলোতে গম আর ভূট্টা ফলায়?
আর সারি বাধা কমলা গাছগুলোতে
ফুলের উৎসব আনে?
কে সেই মানুষ?
কে উপর ওয়ালাকে গাড়ি, যন্ত্রপাতি,
মেয়ে মানুষ কেনার টাকা আর
মোটরের নিচে চাপা পড়ার জন্য
নিগ্রদের মুন্ডুগলি যোগান দেয়?
কে সাদা আদমিকে বড়লোক তৈরি করে
তাকে রাতারাতি ফাঁপিয়ে তোলে
পকেটে টাকা যোগায়?
-কে সেই মানুষ?
তাদের জিজ্ঞাসা করো
যে পাখিরা গান গায়
যে ঝর্ণারা নিশ্চিত মনে
এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে
যে বাতাস এই মহাদেশের মধ্যকার মানচিত্র থেকে মর্মরিত হচ্ছে
তারা সকলেই উত্তর দেবে
ঐ কালো রঙের মানুষটা-
যে দিনরাত গাধার খাটুনি খাটছে।
আহা!
আমাকে অন্তত ঐ তালগাছটার চূড়োয় উঠতে দাও
সেখানে বসে আমি মদ খাবো
তালগাছ থেকে যে মদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে;
আর মাতলামোর মধ্যে আমি নিশ্চয়ই ভুলে যাব
আমি একজন কালো রঙের মানুষ
আমার জন্যেই এই সব।
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যের জগত – প্রেম, প্রকৃতি, চারপাশের মানুষ, তুচ্ছ ছোট ঘটনা, সমাজ আন্দোলন, পৃথিবীর নানা স্পন্দন – ঘিরে। আর কাব্যকে ঘিরে আছে তার সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা। কেননা তার নিজের জীবনকেও নিয়ন্ত্রিত করেছে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মনন। এই বিশ্বাসেই রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, কারাবাস করেছেন। তার ‘রাজা আসে যায়’ কবিতা বাংলায় এক প্রবাদ-বাক্যের স্থান করে নিয়েছে।
এছাড়া ‘উলুখড়ের কবিতা’, ‘লখিন্দর’,’জাতক’,’সভা ভেঙ্গে গেলে’,’রাস্তায় যে হেঁটে যায়’,’মানুষ খেকো বাঘেরা বড় লাফায়’, এই জন্ম জন্মভূমি’,’পৃথিবী ঘুরছে’,’ভিয়েতনাম ভারতবর্ষ’,’শীত বসন্তের গল্প’,’বেঁচে থাকার কবিতা’,আমার কবিতা’,’আর এক আরম্ভের গল্প’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার বহু কবিতায় সুর সংযোজন করে পরিবেশন করেছেন- হেমাঙ্গ বিশ্বাস, প্রতুল মুখোপাধ্যায়,অজিত পাণ্ডে, হাবুল দাস, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় চক্রবর্তী, বিপুল চক্রবর্তী, অনুপ মুখোপাধ্যায়, অসীম ভট্টাচার্য,অমিত রায় প্রমুখ বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পীরা। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা বিপুল যদিও গ্রন্থগুলির বেশির ভাগই ক্ষীণকায়।
আরও পড়ুন: