সুনামি মহাকালের ধ্বংসযজ্ঞ রচনার একটা নমুনা তৈরি করি আজ। এই রচনাটি আমাদের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।
Table of Contents
সুনামি মহাকালের ধ্বংসযজ্ঞ রচনা
ভূমিকা :
এমন অনেক প্রাকৃতিক পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি, যা মানবজীবনে নিয়ে আসে ধ্বংসলীলা, আর দুর্বিষহ মৃত্যু। বর্তমানে পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণে সমগ্র বিশ্ব নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি। নানা প্রকার ভূ-প্রক্রিয়া এর জন্য দায়ী। মাধ্যাকর্ষণ, ভূ-তাপীয় শক্তি, সৌরশক্তি প্রভৃতি ভূপৃষ্ঠের কোথাও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনে। আবার কখনো খুব দ্রুত পরিবর্তন সাধন করে। সাধারণভাবে বহিঃশক্তির সঙ্গে জড়িত ভূ-প্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠে ধীর পরিবর্তন আনে। অপরদিকে আন্তঃশক্তির সঙ্গে জড়িত ভূ-প্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠে দ্রুত পরিবর্তন সাধন করে।
ভূপৃষ্ঠে দ্রুত ও আকস্মিক পরিবর্তন সাধনকারী প্রক্রিয়ার মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগে মানুষ অনেক কিছুকে জয় করলেও ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, সুনামিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে আজও মানুষ অসহায়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্বাধিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী দুর্যোগটি সুনামি নামে পরিচিত।
সুনামি সম্পর্কিত ধারণা :
সুনামি শব্দটি জাপানি। এর ইংরেজি বানান Tsunami’, যার উচ্চারণ Soo nam-ce অর্থাৎ খুব লম্বা কল্পমান সমুদ্রের ঢেউ। যে কোনো কারণেই হোক সাগরের জলবাশির স্থিতাবস্থা ব্যাহত হলেই সৃষ্টি হয় এ প্রবল ঢেউয়ের। ঘূর্ণিঝড়ে সামুদ্রিক পানির স্রোতকে তীরের দিকে ঠেলে নিয়ে আসে বাতাসের ঝাপটা। সুনামির জলস্রোত শুধু উপকূলেই ধাক্কা মারে। সাগরের বাকি অংশ থাকে শান্ত। ফলে গভীর সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ বা জলযানের ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে।
বিভিন্ন কারণে সাগারে সুনামি সৃষ্টি হতে পারে। যেমন—জোরালো ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির উদ্দ্গীরণ কিংবা গ্রহাণু বা বড় ধরনের উল্কা আছড়ে পড়লে এই ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে। কম্পনজনিত এই আততায়ী ঢেউ কোনো রকম জানান দেয়া ছাড়াই উপকূলে আঘাত হানতে পারে। সুনামির এক একটি ঢেউয়ের গতি ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটারেরও বেশি। গভীর সমুদ্রে একটি ঢেউ থেকে আরেকটি ঢেউয়ের দূরত্ব থাকে কখনো কখনো কয়েক’শ কিলোমিটার। এ ঢেউয়ের আঘাত সমুদ্র তীরবর্তী লোকালয় বা তীরভূমিতে ধ্বংসযজ্ঞ বা বিপর্যয় ডেকে আনে। তীরভূমিতে সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা ২০ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত উঠতে পারে।
সুনামির চরিত্র :
আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে, গভীর সমুদ্রে কোনো ঢেউয়ের উচ্চতা যদি এক মিটার হয় তাহলে তা উপকূলে গিয়ে ২০ থেকে ৩০ মিটার উচ্চাতা ধারণ করতে পারে। সেই ঢেউ কয়েক হাজার টন শক্তি ধারণ করে ভূমির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ঐ পানির প্রাচীরের একটি অংশ তীরে আঘাত না করে গভীর সমুদ্রে ফিরে যায়। অনেক সময় ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে সেই জলরাশি ফের তীর ভূমির দিকে ফিরে এসে ছোবল হানে। প্রশান্ত মহাসাগরে যেখানে পানির গভীরতা ৪ হাজার মিটার সেখানে সুনামি ঘণ্টায় ৭০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারে। গত ২৬ ডিসেম্বর যে সুনামিটি এশিয়ায় আঘাত হেনেছিল তার গতি ছিল ঘণ্টায় ৫০০ কিলোমিটার।
সাধারণত সুনামির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য (একটি ঢেউয়ের থেকে আরেকটি ঢেউয়ের দূরত্ব) ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দুটি ঢেউয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১ ঘণ্টা। কোনো রকম শক্তি ক্ষয় না করে যখন সুনামি দূরন্ত গতিতে ছুটে অল্প গভীরতায় পৌঁছে যায় তখন সুনামিতে সাধারণ ঢেউয়ের মতোই আচরণ লক্ষ্য করা যায়। পার্থক্য শুধু এই ঢেউয়ে যে প্রচণ্ড শক্তি থাকে সাধারণ ঢেউয়ে তেমনটা থাকে না। অগভীর পানিতে এসে সুনামির গতি কমে যায়।
ফলে বাড়তে থাকে উচ্চতা। বিশাল পানির প্রাচীর হয়ে দিগন্তকে আড়াল করে প্রচণ্ড শক্তিতে সুনামি ঝাপিয়ে পড়ে তীরে। সুনামি সমুদ্র সৈকতের সব বালু ধুয়ে-মুছে নিয়ে যায়, গাছপালা উপড়ে ফেলে এমনকি মুহূর্তেই একটা শহরকে শ্মশানে পরিণত করতে পারে। কোনো কোনো সুনামির উচ্চতা ৩০ মিটার পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। সুনামির শক্তি এতটাই প্রচণ্ড যে, ২০ মেট্রিক টন ওজনের পাথরের ব্লককেও এই ঢেউ ১৮০ মিটার পর্যন্ত ভাসিয়ে নিতে যেতে পারে।
সুনামির কারণ :
বিভিন্ন কারণে সুনামি সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির উদ্গরণ কিংবা বড় ধরনের উল্কা আছড়ে পড়লে এ ঢেউয়ের সৃষ্টি হতে পারে। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪ ভারত মহাসাগরের তলদেশে ইন্ডিয়া প্লেটটি তিনবার পিছলে যায় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে । রিখটার স্কেলে এ ভূমিকম্পের মাত্রা দাঁড়ায় ৮.৯। সমুদ্রের তলদেশে ভূপ্লেটের আকস্মিক উঠানামার কারণে এ মারাত্মক ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। ভূবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন মেগা সুনামি। ভারত মহাসাগরের তলদেশে ভূপৃষ্ঠের একাংশ সুমাত্রার অন্য অংশকে সজোরে চাপ দেয়। এই প্রবল চাপে সমুদ্রতলের প্রায় ৬০০ মাইলব্যাপী এলাকায় ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ফলে স্থানচ্যুতি ঘটে বিপুল জলরাশির।
সুনামির ক্ষতিকর দিক :
মানবসমাজ ও সভ্যতার জন্য সুনামি বয়ে আনে মারাত্মক বিপর্যয়। এতে ধ্বংস হয় সভ্যতা, বিপন্ন হয় মানবতা। মানুষের পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্রই এর ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে মানুষ কেবল তার আপনজনকেই হারায় না বরং সহায়-সম্বল, সাজানো সংসার সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সুনামির ভয়াবহ ছোবল নিমিষেই নিঃশেষ করে দেয় হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস, শ্মশানে পরিণত হয় উপদ্রুত অঞ্চল। সুনামির ক্ষতিকর দিকের এই ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা যায় ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় সংঘটিত সাম্প্রতিক কালের সুনামির ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ।
বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া সুনামি :
পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে সুনামি সংঘটিত হয় প্রলয়ঙ্করী রূপ নিয়ে । সর্বপ্রথম সুনামি ১৮৯৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারার মেইন বুলেডারডের একটি অংশ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ঐ একই বছরের জুন মাসে মানাবিকু সুনামি কোনো সংকেত ছাড়াই আঘাত হানে জাপানে।
৭০ ফুট উঁচু ঐ জলোচ্ছ্বাস ধর্মীয় উৎসব পালনরত জনতার ওপর আছড়ে পড়ে, যাতে প্রায় ২৬ হাজার লোক নিহত হয় । এছাড়াও ১৮৮৩ সালে ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় জলোচ্ছ্বাসে জাভা ও সুমাত্রা উপকূল ভেসে যায় এবং নিহত হয় প্রায় ৩৬ হাজার লোক । ১৯০৬ সালের জানুয়ারি মাসে উপকূলীয় ভূমিকম্পে টুমাকো ও কলম্বিয়ার একটি অংশ ভেসে যায় এবং রিউভার্দে, ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার মিকেবেতে ৫০০ থেকে দেড় হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে ।
১ এপ্রিল ১৯৪৬ সালে আলাস্কার ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামি :
আলাস্কার ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে হিলো ও হাওয়াইয়ে ১৫৯ জনের মৃত্যু এবং কয়েক লাখ ডলারের ক্ষতি হয়।
১ নভেম্বর ১৯৫৫ সালে লিসবনে ভূমিকম্পের উঁচু জলোচ্ছ্বাস:
লিসবনে ভূমিকম্পের ফলে ২০০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস পর্তুগাল, স্পেন ও মরক্কোর উপকূলে আঘাত হানে ।
২২ মে ১৯৬০ সালে চিলিতে ৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস :
৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে চিলিতে এক হাজার লোক মারা যায় এবং হাওয়াইয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফিলিপাইন, ওকিনাওয়া ও জাপানে মারা যায় ৬১ জন । ২৮ মার্চ ১৯৬৪ ; গুড ফ্রাইডেতে ভূমিকম্পের পর জলোচ্ছ্বাসে আলাস্কা উপকূলের ৩টি গ্রাম বিষান্ত হয়। পশ্চিম উপকূল ভেসে গেলে ১০৭ জন আলাস্কা, ৪ জন ওবিনন ও ১১ জন ক্যালিফোর্নিয়ার অধিবাসী নিহত হয় ।
১৬ আগস্ট ১৯৭৬ সালে ফিলিপাইনের মোরো উপসারগীয় অঞ্চলে সুনামি :
ফিলিপাইনের মোরো উপসারগীয় অঞ্চলে সুনামিতে অন্তত ৫ হাজার লোক মারা যায়। ১৭ জুলাই ১৯৯৮ : উপকূলে ভূমিকম্পে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পাপুয়া নিউগিনির উত্তর উপকূলে ২ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে । কয়েক হাজার লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া সুনামি :
সাম্প্রতিককালে এশিয়ার বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে সংঘটিত সুনামি গত ৪০ বছরের মধ্যে প্রচণ্ডতম এবং এর ফলে সৃষ্ট দুর্যোগটি পৃথিবীর প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের তালিকায় তৃতীয় বৃহত্তম দুর্যোগ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৮.৯। যার উৎপত্তি হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে। বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টা ৫৮ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে সাগরের তলদেশে এ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এ সুনামি পৃথিবীর ১২টি দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে দফায় দফায় আঘাত হানে।
লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সেখানকার মানববসতি। এর ফলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, ভারত ও থাইল্যান্ডের উপকূলীয় ও দ্বীপাঞ্চলসমূহে। সুনামিতে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটি ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে হওয়ায় এখানে প্রাণহানি বেশি হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শ্রীলংকা। এর ফলে এখানে প্রায় ৩০ হাজার লোক মারা যায় এবং ৫ হাজার লোক নিখোঁজ হয়। এছাড়া ভারত, থাইল্যান্ডেও মৃতের সংখ্যা কম নয় । এই ভয়াবহ সুনামি আফ্রিকাকেও কাঁপিয়েছে। আফ্রিকার সোমালিয়া, সিসিলি, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ায় ভয়াবহ সুনামির ফলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। ধ্বংসলীলা সৃষ্টিকারী এই সুনামি শুধু মৃত্যুই নয়, ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিও সাধন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন শিল্প ও মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে এই সুনামি। সুনামির মানবিক আঘাত বেশি হলেও এর অর্থনৈতিক প্রভাব এখনে হিসাব করা সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান এ প্রসঙ্গে বলেন, সুনামির আঘাতে যে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে ১০ বছরেরও বেশি সময় দরকার হবে। ইতিহাসের এই ভয়াবহ ভূমিকম্প বদলে দিয়েছে এশিয়ার মানচিত্র। আর ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে পারিপার্শ্বিক ও আবহাওয়াগত অবস্থায়। সুনামির ফলে সুমাত্রার উপকূলবর্তী সমুদ্রতলে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার ফাটল দেখা দিয়েছে।

সুনামির ধ্বংসযজ্ঞ :
২৬ ডিসেম্বর ২০০৫-এর সুনামিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া ৷ দেশটির উপকূলবর্তী সব গ্রামই পানির তোড়ে ভেসে গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, শুধু আচেহ এবং উত্তর সুমাত্রায়ই মৃতের সংখ্যা ১,১০,২২৭ জন। সকরারি হিসাব অনুযায়ী শ্রীলঙ্কায় সুনামি-জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যু ঘটেছে ৩০, ১২০ জনের। আহত হয়েছে ১৬ হাজারেরও বেশি লোক এবং ২০ হাজারের বেশি লোক নিখোঁজ হয়েছে। ভারত সরকারের এক হিসাব অনুযায়ী, নিহত হয়েছে ১৫,৭৮২ জন। এছাড়াও নিখোঁজ হয়েছে ৫,৫১১ জন।
থাইল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়, সেখানে ২০৬১ থেকে ৪৯৯৩ জন বিদেশী এবং ২০০২ জন থাই-নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত অপর ৩০০ জনের পরিচয় জানা যায়নি। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী মিয়ানমারে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে।
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুম জানিয়েছেন, সেখানে অন্তত ৭৫ জন নিহত এবং পর্যটন এলাকা থেকে আরো ৪২ জন নিখোঁজ হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় ৬৮ জন নিহত হয়েছে। এদের অধিকাংশই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সময় পেনাংয়ে ছিলেন। বাংলাদেশে এক পর্যটন নৌকা প্রচণ্ড ঢেউয়ের মুখে পড়ে দুই ভাই মারা গেছে। ২৬ ডিসেম্বরের ভয়ঙ্কর সুনামি শুধু এশিয়াই নয়, আফ্রিকার পূর্ব উপকূলেও আঘাত হানে। এতে সোমালিয়ায় ১৭৬, তাঞ্জানিয়ায় ১০ এবং কেনিয়ায় একজন নিহত হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ :
সুনামির পরপরই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছিল রিলিফ সংগ্রহের কাজ। সুনামিতে লণ্ডভণ্ড দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তাদানে সাড়া দিতে গিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে আসে। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়। সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য আন্তর্জাতিক কিছু সাহায্য সংস্থা পুরোদমে কাজ করে। স্মরণকালের ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালানোর উদ্যোগ নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
সুনামির ফলে স্বাস্থ্যগত প্রভাব :
সুনামি শুধু বস্তুগত, আর্থিক ও প্রিয়জন হারানোর ক্ষতিই নয় বরং জীবিত থাকাদের জন্য মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থারও সৃষ্টি করেছে। জীবত মানুষদের স্মৃতিতে শুধু বেদনার স্মৃতিই যা তাদের মানসিক রোগের সৃষ্টি করছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এশিয়া এবং আফ্রিকার উপকূলবর্তী এলাকায় সুনামির প্রত্যক্ষদর্শী হাজার হাজার মানুষকে এমন দুঃসহ স্মৃতিই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আহতদের শারীরিক ক্ষত হয়তো খুব দ্রুতই সেরে যাবে কিন্তু মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে বেশ ক’বছর। ফুকেট সৈকতে সুনামি দুর্গতদের জন্য প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক সিজার ভার্গাস বলেন, সুনামিতে আক্রান্তদের ব্যাপক মানসিক পরিচর্যা প্রয়োজন ।
সুনামি সতর্কাবস্থা :
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সুনামির আগাম হুঁশিয়ারি ব্যবস্থা থাকলে হয়তো হাজার হাজার লোকের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ ধরনের ব্যবস্থা ইতিমেধ্যই চালু রয়েছে। এ ব্যবস্থায় গভীর সমুদ্রে ৬টি ভাসমান বয়া এবং অন্যান্য শনাক্তকারী যন্ত্রের সাহায্যে কানাডার পশ্চিম উপকূল এবং যুক্তরাষ্ট্র, হাওয়াই ছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরের ২৬টি দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা যায়।
২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারত মহাসাগরের জন্য আগাম সুনামি হুঁশিয়ারি ব্যবস্থা চালু করার কথা। মরিশাসে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকম্প ও সুনামির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নিয়ে আয়োজিত একটি সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়। সুনামি সতর্কীকরণ ব্যবস্থা নেই এমন অঞ্চলগুলোতে এবং প্রথমবারের মতো আটলান্টিক মহাসাগর, ক্যারিবিয়ান সাগর ও মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চলে ৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার ব্যয়ে নতুন সুনামি সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরাও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় দু কোটি ডলার ব্যয়ে সুনামি সতর্কতা ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা করেছেন । সম্প্রতি জাপানের কোবে শহরে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১৬০ দেশের ৩ হাজার বিশেষজ্ঞ ১৮ মাসের মধ্যে ২ থেকে ৩ কোটি ডলার ব্যয়ে ভারত মহাসাগরে একটি সুনামি সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে সুনামি :
মানব ইতিহাসে এমন দুর্যোগ এই প্রথম নয়। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশ একাই হারিয়েছিল তিন লাখ মানুষ। লক্ষাধিক মানুষ হারিয়েছিল ১৯৯১ সালের এপ্রিলে। এমন দুর্যোগ নানা দেশে নানাভাবে হয়েছে। কোথাও সেটি ঘূর্ণিঝড়, কোথাও ভূমিকম্প, কোথাও প্লাবন, জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি নামে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এত মৃত্যু ও এত ক্ষয়ক্ষতি মানুষের জন্য কি নির্দেশনা রেখে যায়? ইসলামের দৃষ্টিতে ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখনোই কোনো দৈবাৎ দুর্ঘটনা নয়, প্রকৃতির নিজস্ব সৃষ্টিও এটি নয়। সৃষ্টির সামর্থ্য প্রকৃতির নেই, কারণ সে নিজেই সৃষ্ট। বরং প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানে যা কিছু ঘটে তা মহান আল্লাহ তায়ালার সূক্ষ্ম পরিকল্পনারই অংশ মাত্র। রোগব্যাধি, দুর্যোগ-দুর্ঘটনা তার ইচ্ছারই দাস মাত্র।
তেমনি ভূমিকম্প বা সুনামি আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার অভিব্যক্তি। পবিত্র কুরআনে সেটিই বর্ণিত হয়েছে এভাবে ‘তিনি (আল্লাহ) মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন এ জন্য যে, তিনি পরীক্ষা করবেন তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে কে উত্তম’। (সূরা আল-মূলক, আয়াত ১)। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২১৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছ তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ তোমাদের পূর্ববর্তীদের মতো পরীক্ষা করা হবে না? অথচ তাদের ওপর বিপদ- মহিবত, ক্ষয়ক্ষতি ও ভূমিকম্প এমভাবে এসেছিল যে, এমনকি রাসূল ও তার ঈমানদার বান্দাগণ বলতেন, “আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? (বল) আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটবর্তী।
ধ্বংস ও বিপর্যয়ের বহু কাহিনী বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআনে। লক্ষণীয় হলো, কুরআনে বর্ণিত দুর্যোগগুলোকে নিছক দুর্যোগ বলা হয়নি। বলা হয়েছে শান্তিরূপে। দুর্যোগের এটিই হলো কুরআনি পরিভাষা। প্রতিটি মৃত্যু ও বিপদ থেকে একজন মুসলমান পায় আল্লাহতে আত্মসমর্পণের প্রেরণা, পায় জীবনের পুনর্মূল্যায়নের সম্বিত। পায় দিকনির্দেশনা। বিপদ-আপদ, মৃত্যু, রোগ-ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি এগুলো আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষারূপে। লক্ষণীয় হলো নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হলো মুসলমান। শুধু ইসলামে নয়, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ধর্মেই নগ্নতা ও ব্যাভিচার হলো মহাপাপ। ইসলাম এটি হত্যাযোগ্য অপরাধ। অথচ পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ব্যাভিচার পরিণত হয়েছে সংস্কৃতিতে।
বাণিজ্যরূপে ব্যাপ্তি পাচ্ছে মুসলিম দেশেও। অধিকাংশ মুসলিম দেশে জনগণের ট্যাক্সের অর্থে সাগর তীর এলাকায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন নাম করে হোটেল, ক্যাসিনো, বার ও টুরিস্ট সেন্টার খুলে সেখানে ব্যভিচারের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। শুধু থাইল্যান্ড, ভারত বা শ্রীলঙ্কাই নয়, একই পথ ধরেছে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, মরক্কো, কৃর আমিরাত, তিউনিসিয়া ইত্যাদি মুসলিম দেশও। কাজেই সাম্প্রতিক এ জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য এক সতর্কবাণী বলে মনে করে চিন্তাবিদগণ।
উপসংহার :
মানুষ প্রকৃতির কাছে অসহায়। প্রকৃতির মরণছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা সব সময়ই করে এসেছে মানুষ। পূর্ব থেকে সতর্ক হতে পারলে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সাহসের সাথে মোকাবিলা সহজ। ভয়াবহ এ সুনামিতে নিহতদের স্মরণে গভীর শোকই যথেষ্ট নয়, বরং বিপন্ন মানবতাকে রক্ষার জন্য আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যেতে হবে।