সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অমার্জনীয় শীর্ষক আলোচনা সভার ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা ,
সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অমার্জনীয় শীর্ষক আলোচনা সভার ভাষণ রচনা
‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অমার্জনীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আজ অত্যন্ত একটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনায় অংশ নিচ্ছি। সময়োপযোগী এ-বিষয়ে আজকের মহতী সভায় কিছু বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এজন্য সভার আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অমার্জনীয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য সুধীবৃন্দ, আজ নবযুগের নবীন প্রভাতে দিকে দিকে বিশ্বমানবতার জয়গান বিঘোষিত হচ্ছে।
অথচ খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক যে, সাম্প্রতিককালে সমাজ ও দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বেড়ে চলেছে। এটা কোনো সভ্য জাতির জন্যেই মঙ্গলজনক নয়। আপনারা জানেন যে, সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল- সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। একথা ঠিক যে সমাজবদ্ধ মানুষ নানা ধর্ম সম্প্রদায়ে বিভক্ত। কিন্তু ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। সকল ধর্মের মূলকথা- প্রেম, মৈত্রী, শান্তি ও সম্প্রীতি। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার মূল কথা অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ থেকেই জন্ম নেয় অন্য সম্প্রদায়ের ক্ষতি করার জন্যে পাশবিক উল্লাস। সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে সামাজিক শান্তি, মানবিক মূল্যবোধ এবং জাতিগত সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। এজেন্যই ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অমার্জনীয়’। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব— ‘আশরাফুল মাখলুকাত’।
স্রষ্টার সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষই কেবল সচেতনতায়, বুদ্ধিমত্তায় স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ। তবে এ শ্রেষ্ঠত্বকে বজায় রাখতে হলে মানুষকে অবশ্যই বিবেকবান এবং মানবতাবাদী হতে হবে। আর এ জন্যেই কবির দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা— ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ এ মানবতাকে মূল্য দিতে হলে সমাজে সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। সুধীবৃন্দ, সত্যদ্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলামের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছে সর্বকালের এক বরণীয় মানবতার অমোঘ বাণী ।
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন কাণ্ডারী!
বলো, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
জগতে সকলের পরিচয় হউক মানুষ হিসেবে– মানুষ এবং মানুষ; ‘মানুষ’-এর আগে-পরে কোনো বিশেষণ (যেমন- . হিন্দু মানুষ, মুসলমান মানুষ, বৌদ্ধ মানুষ, খ্রিস্টান মানুষ এরকম বিশেষণ) যুক্ত না করে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে- সামাজিক প্রাণী হিসেবে মানুষ নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত; নানা পথে ও মতে বিশ্বাসী। তাতে কোনো সমস্যা নেই এবং সমস্যা হওয়ারও কথা নয়। কিন্তু এক সম্প্রদায় যখন অন্য সম্প্রদায় থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, তখনই তার মধ্যে জন্ম নেয় এক হীন, অনুদার জাত্যভিমান। তখনই তার মনের জমিতে বোনা হয় বিষবৃক্ষের বীজ। কালে কালে ফলে তারই বিষময় পরিণাম। অসহিষ্ণুতার মধ্যেই থাকে বিদ্বেষ।
অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়ার মধ্যেই প্রকাশ পায় পাশবিক-শক্তির উল্লাস। দেখা দেয় অনিবার্য বিরোধ, সংঘর্ষ। এরই নাম সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতা তাই মানুষের যুগ-যুগান্তরের এক অভিশাপ ও অমার্জনীয় অপরাধ । সুধী, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে সমাজ প্রগতির পথকে রুদ্ধ করে দেয়। অথচ কোনো ধৰ্ম, কোনো আদর্শই পৃথিবীতে এ সর্বনাশা ভেদবুদ্ধিকে সমর্থন করে নি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘ধর্মের কোনো জবরদস্তি নেই।’ এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্বের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমরা আজ উন্নয়নমুখী।
আমাদের জাতীয় জীবনে গঠনমূলক কাজের উৎকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। চাষি, ব্যাপারে জেলে, কামার, কুমার, মুচি, ডোম সকলকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেই জাতির উন্নয়নের জন্য গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা আমাদের জন্যে অপরিহার্য। আমরা যতই উন্নয়ন পরিকল্পনা আর অর্থনৈতিক উন্নতির ঘোষণা দেই না কেন, জাতীয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের মত উন্নয়নকামী দেশের উন্নতির চাবিকাঠি। বিশ্বজনীন সামাজিক সম্প্রীতি তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করেই পৃথিবীতে শান্তি ও প্রগতি স্থাপন সম্ভব।

এই সম্প্রীতিই কেবল শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও উন্নতিতে গ্যারান্টি দিতে পারে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সকলের কাম্য হওয়া উচিত । ভেদ-বৈষম্যকে দূরে ঠেলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে বর্জন করি, সমস্বরে বলি-ধর্ম যার যার পৃথিবী সবার। প্রাজ্ঞ সুধীবৃন্দ, আপনারা অবশ্যই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে – সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই এ-দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক। খেতে-খামারে, কলে-কারখানায়, অফিস-আদালতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নানা সম্প্রদায় কাজ করছে। একে অন্যের দুঃখে-আনন্দে শরিক হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে গভীর সংহতি ও ঐক্য জাতীয় ইতিহাসে গৌরবময় ঐতিহ্য ও ইতিহাস হয়ে আছে। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধ তারই স্বাক্ষর। ১৯৭১ সালে এদেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষিত হয়। আমরা তাই গৌরবান্বিত। জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এ সম্প্রীতি সংরক্ষণের পরিস্থিতিটি খুবই উপযোগী। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশ একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহান মন্ত্রে দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল।
জাতীয়তাবোধের দৃঢ়বন্ধনে তারা আবদ্ধ। সাম্প্রদায়িকতা এক দুরারোগ্য ব্যাধি। এই ব্যাধির জীবাণু জাতির জীবনের গভীরে প্রোথিত। শুধু আইন-শৃঙ্খলার কঠোরতার মধ্যেই এর সমাধান সূত্র নেই। তরুণ শিক্ষার্থীরাই হল দেশের সবচেয়ে আদর্শপ্রবণ, ভাবপ্রবণ অংশ। ছাত্র- সমাজই দেশের ভবিষ্যৎ, জাতির কাণ্ডারি। তাদের মধ্যে আছে অফুরান প্রাণশক্তি। পারস্পরিক শ্রদ্ধার মনোভাব, আন্তরিক মেলামেশা, ভাবের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় হবে এক নতুন প্রজন্মের। এরই মধ্য দিয়ে ছাত্ররা নতুন করে অনুভব করবে মানবতার উদার মহিমা।
শুনবে সেই মহামিলনের মন্ত্র। ছাত্রাবস্থায়ই সাম্প্রদায়িকতার রাহু মুক্তির শপথ নিতে হবে। সম্প্রীতির মহাব্রত অনুষ্ঠানের তারাই হবে প্রধান পুরোহিত। শুধু পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া নয়, সুকুমার বৃত্তিগুলো যথাযথ বিকশিত হলেই তাদের শিক্ষার পূর্ণতা, সার্থকতা। মনুষ্যত্বের অধিকার অর্জনই হবে তাদের শিক্ষানুশীলনের পরম প্রাপ্তি। শিক্ষার নিবেদিত প্রাঙ্গণে তারা নতুন করে উপলব্ধি করবে সবার ওপরে মানুষই সত্য। মানুষে মানুষে প্রীতি-বন্ধনই হবে তার শেষ কথা। আমাদের কবি বলেছেন-
হে চিরকালের মানুষ, হে সকল মানুষের মানুষ / পরিত্রাণ করো
ভেদচিহ্নের তিলক পরা / সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে। ধন্যবাদ সবাইকে।
আরও দেখুন :