সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই — এই চরণের মূল গভীর ভাবকে বুঝে তার প্রসার ঘটানোকে ভাব-সম্প্রসারণ বলা হয়। ভাব-সম্প্রসারণের সময় মূল বাক্যের অর্থ তুলে ধরে প্রয়োজনীয় যুক্তি, বিশ্লেষণ, উপমা এবং উদাহরণ ব্যবহার করে বক্তব্যকে সুস্পষ্ট ও বিস্তৃত করা হয়। যখন কবি বা লেখক তার ভাব প্রকাশে সরাসরি না বলে ইঙ্গিত বা বর্ণনামূলক ভাষা ব্যবহার করেন, তখন সেই ইঙ্গিতসমূহকে আলোকস্বরূপ ব্যাখ্যা করে ভাব সম্প্রসারণ করা হয়। এর মাধ্যমে পাঠকের জন্য ভাবের গভীরতা ও অর্থ আরও স্পষ্ট ও বোধগম্য হয়।
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই
মানুষের কোনো জাতিভেদ নেই, মানুষের কোনো জাতিভেদ থাকতে পারে না। পৃথিবীর যে কোনো দেশের অধিবাসী হোক, মানুষের একমাত্র পরিচয় হলো – সে মানুষ। সে বাঙালি, ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান, রাশিয়ান, চিনা, আমেরিকান যা-কিছুই হোক— সাদা কালো— যে রঙেরই হোক তার গায়ের বর্ণ, তার সত্য পরিচয় হল— সে মানুষ । সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হল মানুষ। তাঁর সৃষ্টিতে নেই কোনো ভেদাভেদ, নেই কোনো ভেদ-বৈষম্যের পার্থক্যরেখা। কিন্তু মানুষ রচনা করেছে মানুষে মানুষে কৃত্রিম ভেদাভেদ, সৃষ্টি করেছে ঘৃণ্য জাতিভেদ। ভেদবুদ্ধি-প্রণোদিত স্বার্থপর মানুষ সৃষ্টি করেছে মানুষে মানুষে বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর; এবং জগতের যত দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যত কলঙ্কময় রক্তপাত, তার মূলে আছে এই অবাঞ্ছিত মানসিক ভেদ-বৈষম্য।
পৃথিবীতে মানুষে মানুষে এই সংঘাত ও রক্তপাতের শুরু অতি প্রাচীনকাল থেকেই। ভৌগোলিক সীমাবেষ্টনীর মধ্যে ভূমিষ্ঠ মানবগোষ্ঠী ক্রমে অপর স্থানের মানবগোষ্ঠীকে ঘৃণা করতে শিখেছে। ফলে গঠিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের। কিন্তু ক্রমেই রাষ্ট্রীয় ভেদ-বিদ্বেষ এবং ধর্মীয় সীমা-পার্থক্য মুছে ফেলে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করেছে। স্রষ্টা মানুষকে অন্তশক্তিতে বলীয়ান করে তার মধ্যে মেধা ও বুদ্ধির সমন্বয় ঘটিয়ে অন্যান্য জীব থেকে শ্রেষ্ঠ করেছেন। ফলে, মানুষ তার মেধা ও বুদ্ধিবলে জলে-স্থলে- অন্তরীক্ষে আধিপত্য বিস্তার করে তার শ্রেষ্ঠত্বের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছে।

সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ এ প্রকৃতির ওপর ক্রমেই আধিপত্য বিস্তার করেছে। গড়ে তুলেছে গ্রাম, নগরসভ্যতা। সে তার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে অণু থেকে অট্টালিকা, সাগর থেকে মহাসাগর পর্যন্ত জয় করে নিয়েছে। মানুষের আরাম-আয়েসের জন্যে উদ্ভাবন করেছে নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী। সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সে সৃষ্টি করেছে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন। এভাবে আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছে। তবে মানুষ তার শক্তির দম্ভে যদি ব্যথিত, পীড়িত, পার্থিব দুঃখ-দুর্দশার রাহুগ্রাসে নিপতিত এবং ভাগ্যাহত মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তাহলে সে দাম্ভিকের ওপর স্রষ্টার অভিশাপ নেমে আসে; তার শ্রেষ্ঠত্বের পরাজয় ও অপমৃত্যু ঘটে। বস্তুত দুঃখী ও অবহেলিত মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালনের মধ্যেই তার শ্রেষ্ঠত্ব ও কৃতিত্ব নিহিত।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ বলেই এ পৃথিবীতে তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। মানুষ তার নিরলস শ্রম-সাধনায় বিপুল অবদানের মাধ্যমে এ-পৃথিবীর কল্যাণ সাধন করে। মানবকল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করার মধ্য দিয়েই মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় রেখে যায়। আর তখনই ঘোষিত হয়— সবার ওপরে মানুষ সত্য, তার ওপরে কেউ নেই।