সঞ্চয়ের অভ্যাস সম্পর্কে ভাষণ রচনার একটি খসড়া তৈরি করে দেয়া হলো শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের, “ভাষণ” বিভাগের একটি পাঠ|
সঞ্চয়ের অভ্যাস সম্পর্কে ভাষণ রচনা
সম্মানিত সভাপতি ও উপস্থিত সুধীমণ্ডলী, আসসালামুআলাইকুম ।
ক্ষুদ্র থেকেই বৃহতের সৃষ্টি। বিন্দু বিন্দু জল মিলিয়ে যেমন সাগর হয়ে যায়, তদ্রূপ এক টাকা দুটাকা করে সঞ্চয় করলে একসময় তা লাখ টাকায় পরিণত হয়। তার বাস্তব উদাহরণ আপনাদের এই সমবায় সমিতি। মাত্র তিন বছর আগে আপনারা মাত্র দুই শত টাকা নিয়ে গঠন করেছিলেন এই সমবায় সমিতি, আজ আপনারা প্রায় বিশ লক্ষ টাকার সম্পত্তির অধিকারী। আজ আর আপনাদের দু মুঠো ভাতের জন্যে চিন্তা করতে হয় না। কোনো বিপদে-আপদে কারও কাছে মাথা নত করতে হয় না, হাত পাততে হয় না। তাই প্রত্যেকের মধ্যেই সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
সুধীবৃন্দ, সঞ্চয় মানুষকে দুঃখ-দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়। আমাদের চারপাশের যা কিছু আছে, বিশেষভাবে প্রকৃতির দিকে তাকালেই সঞ্চয়ের তাৎপর্য আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন। আপনাদের যে ফল গাছটি আজ ছোট— দিন দিন তাকে যত্ন দিয়ে বড় করে তোলেন, আপনার হাজার দিনের শ্রম তার মধ্যে সঞ্চিত হতে থাকে, ফলে সে একসময় আপনাকে ফলে-ফুলে ভরে দেয়। একক সঞ্চয় থেকে শুরু হয় বৃহৎ সঞ্চয়। আর তার নাম হল ‘সমবায়’। সমবায়ের উপকারিতা অপরিহার্য। কথায় বলে, ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’- সাধারণত যেখানে একক প্রচেষ্টায় কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন সম্ভবপর হয় না, সেক্ষেত্রে সমবেত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
সুধী, সকলে সম্মিলিতভাবে যে কাজটি যত সহজে সম্পাদন করা সম্ভব, পৃথক পৃথকভাবে তা বাস্তবায়িত করা তত সহজ নয়। সকলে মিলে কাজ করলে তাতে সাফল্য অনিবার্য। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সমবায়নীতি-১’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মানুষ খাঁটো হয় কোথায় যেখানে সে দশ জনের সঙ্গে ভাল করে মিলতে পারে না। পরস্পরের মিলে যে মানুষ সে মানুষই পুরা, একলা মানুষ টুকরা মাত্র। এটা তো দেখা গেছে, ছেলেবেলায় একলা পড়লে ভূতের ভয় হতো। বস্তুত এ-ভূতের ভয়টা একলা মানুষের নিজের দুর্বলতাকেই ভয়। .. দারিদ্র্যের ভয় আসলে ভূতের ভয়। ছাড়া ছাড়া থাকার জন্যই মানুষের এই ভয়।

দলবেঁধে থাকা দলবেঁধে কাজ করাই মানুষের ধর্ম। এ ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলেই মানুষ লোভ ক্রোধ মোহের মতো রিপুর শিকারে পরিণত হয়। ‘ সমবেত সুধীবৃন্দ, আপনারা হয়ত জানেন যে, ইউরোপের ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে এবং এ-দিকে জাপানে সমবায়ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান। ডেনমার্কে যে দুধ উৎপাদন করা হয়, তার বেশির ভাগই আসে সমবায় খামার থেকে। খুচরো দোকানও রয়েছে অনেক সমবায় ভিত্তিক, যুক্তরাষ্ট্রেও আছে সমবায়ভিত্তিক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান । আপনাদের এই সমবায় প্রতিষ্ঠানও একদিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আসলে সমবায় এমন একটি মিলিত প্রচেষ্টা যেখানে সদস্যদের মানসিকতা একটা বড় ফ্যাক্টর। পারস্পরিক আস্থা এবং ঐক্য সমবায়ে সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, দুর্নীতি এবং দুর্নীতির মানসিকতা যেখানে আছে, সেখানে সমবায় সফল হতে পারে না। তাই এ বিষয়গুলো আমাদের সবসময় স্মরণ রাখতে হবে। সমবায়ী বন্ধুরা, আমাদের মতো দারিদ্র্য-পীড়িত দেশে কোটি কোটি দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনে পরস্পরের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার কৃষিব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট উন্নত নয়।
আধুনিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নের যে প্রচেষ্টা বর্তমানে চলছে তাতে সমবায় ব্যবস্থা যথেষ্ট সাফল্য আনতে পারে। শিল্পক্ষেত্রেও সমবায়ের প্রয়োগের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। মোটকথা, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নয়নে সমবায় আন্দোলনের উপযোগিতা রয়েছে। তবে এর সাফল্যের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। আশার কথা যে, বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন কুটির শিল্পে ও পরিবহন ক্ষেত্রে সমবায়ের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় জীবনে সামাজিক ন্যায়- বিচারভিত্তিক জীবন-চেতনা আরও জাগ্রত হলে সমবায় আন্দোলন উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা লাভ করবে। সবার জন্যে প্রাণঢালা অভিনন্দন রইল, আপনাদের অগ্রযাত্রা কামনা করে বিদায় নিচ্ছি।
আরও দেখুন: