সংসদীয় রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দল – নিয়ে আজ রচনার একটি নমুনা তৈরি করবো আমরা। এই নমুনাটি আপনাদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লেখবার জন্য নয়। এই রচনাটি পড়ে আপনারা ধারণা নেবেন। এরপর পরীক্ষার খাতায় নিজেদের মতো করে লিখবেন।
Table of Contents
সংসদীয় রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দল রচনা
ভূমিকা :
পুঁজিবাদ আর বিশ্বায়নের বিশ্বে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আধুনিক এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান এবং আবশ্যকীয় উপাদান হলো রাজনৈতিক দল। প্রতিষ্ঠিত এবং কার্যকর রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি ব্যতীত কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই টিকে থাকতে পারে না।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল কেন্দ্রবিন্দু সংসদকে কার্যকর করার জন্য সরকারি দল এবং বিরোধী দলের পাশাপাশি অবস্থান জরুরি। কেননা সরকারি দল ক্ষমতার আতিশয্যে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, যেখানে বিরোধী দল কার্যকর ও গঠনমূলক বিরোধিতার মাধ্যমে সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একদিকে সরকারি দলকে যেমন বিরোধী দলের যৌক্তিক মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, অন্যদিকে বিরোধী দলকেও তার বিরোধিতার যথার্থতা সম্পর্কে সজাগ থাকবে হবে।
সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভূমিকার কতিপয় মূলনীতি:
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারি দল ও বিরোধী দলের পরস্পরিক সম্পর্ক ও কার্যক্রম কতিপয় মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ সকল মূলনীতি যথাযথভাবে অনুসৃত না হলে সংসদীয় ব্যবস্থা তার মৌলিকত্ব হারাতে বাধ্য ।
প্রথমত,
পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। গণতন্ত্র গণমানুষের বিক্ষিপ্ত মত ও পথকে একটি ব্যবস্থার আওতায় এনে সামগ্রিক কল্যাণের পথ খুঁজে বের করে। এক্ষেত্রে সকলের মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা অত্যাবশ্যক। তাই সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দল ও বিরোধী দলকে অবশ্যই পরস্পরের মতের মূল্যায়ন করতে হবে । বিরোধী দলকে তার মতামত প্রদানের সময় মনে রাখতে হবে কেবল সরকারকে ঘায়েল করার জন্য নয়, বরং মতামত হবে যৌক্তিক ও জনগণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে। অপরদিকে সরকারি দলকে মনে রাখতে হবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধী দলের সকল মতামত উপক্ষো করা অনুচিত এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিরোধী ।
দ্বিতীয়ত,
বিরোধী দলের বিরোধিতা সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। বিরোধী দলের কার্যকর বিরোধিতা সরকারি দলের স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার নিয়ন্ত্রন হিসেবে কাজ করে। তাই সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধীদের দমন-পীড়নের পরিবর্তে তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের সুযোগ দান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করার অন্যতম পূর্বশর্ত। অন্যদিকে বিরোধী দলের বিরোধিতা যখন কেবলই বিরোধিতার জন্য হয় তখন তা গণতন্ত্রকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে।
তৃতীয়ত,
প্রতিযোগিতা গণতন্ত্রের মৌলিক স্পৃহা থেকে উৎসারিত। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য নিয়মতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা গণতান্ত্রিক রাজনীতিরই অংশ। কিন্তু এ প্রতিযোগিতা যখন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে না হয়ে প্রতিহিংসায় রূপ নেয় তখন তা পুরো রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
চতুর্থত,
সংসদীয় গণতন্ত্রের আরেকটি মূলমন্ত্র হলো আলোচনা, সংঘর্ষ নয়। এখানে সকল প্রকার রাজনৈতিক মতবিরোধকে সংসদে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও যৌক্তিক আচরণ করতে হবে এবং সংসদে আলোচনার পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
পঞ্চমত,
নির্বাচন যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ, তাই নির্বাচনকালে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও উপদলের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করাটাই স্বাভাবিক। তাই নির্বাচনের পর বিজয়ী সরকারি দলের সমর্থকদের প্রতি বিশেষ সুদৃষ্টি দেয়ার ব্যাপারটিও স্বাভাবিক। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে এই নীতি পরিহার করা আবশ্যক। বরং নির্বাচনে সমর্থনের বিষয়টি বাদ দিয়ে দল-মত নির্বিশেষে সকলের প্রতি সমান আচরণ করাই গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে জনগণের দাবি।
ষষ্ঠত,
রাজনীতিতে প্রত্যেক দলেরই কোনো না কোনোভাবে অবদান থাকতে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে এ সত্যটি স্বীকার করে নিয়ে একে অপরের ভূমিকার স্বীকৃতিদানের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে ।
সপ্তমত,
সরকারের গণবিরোধী ও অযৌক্তিক কার্যকলাপের বিরোধিতা করার জন্য বিরোধী দলকে গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য মনে করা হয়। তাই বলে বিরোধী দলের ভূমিকা কেবল বিরোধিতার মাঝেই সীমিত থাকবে এমন নয়। বরং গঠনমূলক বিরোধিতার পাশাপাশি সরকারি ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দানও বিরোধী দলের ভূমিকাকে আরো ভাস্বর করতে পারে।
অষ্টমত,
সংসদীয় রাজনীতির আরেকটি মূলমন্ত্র হলো সকল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে সংসদ। সংসদকে বাদ দিয়ে তথ্য প্রষ্ঠিানিক রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে অপ্রতিষ্ঠানিক রাজনীতির অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়লে সংসদীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা বিনষ্ট হতে বাধ্য ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভূমিকা :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পরই বাংলাদেশে প্রথম সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। তারপর দীর্ঘ প্রায় পনের বছর যাবৎ সামরিক রাজনীতির যাঁতাকলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা তার মৌলিকত্ব হারাতে বসেছিল । কিন্তু ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়।
তারপর ১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসে এবং সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করে। তারপর ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়। এবং ২০০১ সালে মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোটের সরকার ক্ষমতায় আসে। রাজনীতির এ পালাবদলের মাঝে একট বিষয় সুস্পষ্ট ছিল—কোনো দলই সংসদীয় রাজনীতির মৌলিক চেতনা ও রীতিনীতির প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিল না এবং বর্তমানে এক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছে বলে মনে হয় না।
১. বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনীতির আলোকে দেখা গেছে, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের কোনোটাই পরস্পরের যৌক্তিক ও গণমুখী দাবিকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেনি। বরং রাজনৈতিক একগুয়েমি ও জেদের বশে একে অপরের যে কোনো মত ও নীতির যেনতেনভাবে বিরোধিতা করার হীনম্মন্যতা ছিল তাদের রাজনীতির মূল চরিত্র। তাই দেখা যায় সরকারি দল জোরে যেমন বিরোধী দলের উত্থাপিত কোনো যৌক্তিক দাবিকেও অস্বীকার করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একটার পর একটা বিল পাস করে, তেমনি বিরোধী দলও সংসদে সরকারি দলের যে কোনো বিল ও প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
এর অন্যতম উদাহরণ হলো সংসদে যখন বাজেট উত্থাপিত হয় এবং পাস হয় তখন বিরোধী দলের হরতাল আহ্বান একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে জননিরাপত্তা আইনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ আইন কিংবা পার্বত্য শান্তিচুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকার বিরোধীদের মতামত গ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করেনি। অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপিও যে এ ব্যাপারে খুব বেশি আন্তরিক ছিল তা-ও বলা যাবে না ।
২. আমাদের রাজনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো আপোষহীনতা। আমাদের সংগ্রাম চলবেই – ব্রিটিশ ও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সময়কার এ জনপ্রিয় স্লোগানটি আমাদের রাজনীতিবিদদের চেতনাকে ভালোভাবেই গ্রাস করেছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশের সরকার আর একটি পরাধীন, উপনিবেশের রাজনীতির যে ভিন্ন চরিত্র তা এখনো আমাদের রাজনীতিবিদর সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় তাদের মাঝে আপোষকামিতার যে গণতান্ত্রিক বোধ তা অনুপস্থিত।
অথচ গণতন্ত্রের দাবি হলো—সমাজ ও রাজনীতিতে সক্রিয় প্রতিটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মতামতই বিবেচনার দাবি রাখে। তাই বিবদমান দলগুলোর পারস্পরিক আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমেই ভিন্ন ভিন্ন মত ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় সাধন করতে হবে। অথচ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় বসতেই নারাজ। এরা কেউই নিজেদের অবস্থান থেকে নড়তে নারাজ। এক্ষেত্রে অবশ্য এক ধরনের হীনম্মন্যতাও কাজ করে । কেননা তারা মনে করে কোনো রকম ছাড় দেয়া তাদের অসামর্থ্যের প্রমাণবহ এবং এটা তাদের জন্য অপমানকর।
৩. প্রতিযোগিতা নয়, প্রতিহিংসাই আমাদের রাজনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় তখন বিরোধীদের দমন, পীড়ন এবং হয়রানিই যেন তাদের মূল কাজে পরিণত হয়। মিথ্যা মামলা, পুলিশি হয়রানি, চাকরিচ্যুতি থেকে শুরু করে নামবদল, ছবিবদল, পরিকল্প বদল ও স্থগিতকরণসহ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার যতরকম পদ্ধতি রয়েছে সবই সরকার করে থাকে। অন্যদিকে সরকারকে হেনস্থা করা ও বেকায়দায় ফেলার জন্য যত রকমের অপকৌশল রয়েছে তার সবগুলোই বিরোধী দল করে থাকে।
৪. আমাদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের আরেকটা প্রবণতা হলো, এরা কখনোই একে অপরের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার উদারতা দেখাতে চায় না। সরকারি দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যত ভালোই করুক না কেন বিরোধী দল তার স্বীকৃতি দেয় না বরং যত ধরনের খুঁত রয়েছে তা খুঁজে খুঁজে বের করে।
অনেক ক্ষেত্রে নামবদল, সংস্কার বা ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা ঘেঁটে এর কৃতিত্ব নিজেরা নেয়ার অপচেষ্টাও করে। তাই একই সম্মেলন কেন্দ্র, সেতু কিংবা ছাত্রাবাসের দু-তিন বার উদ্বোধন ও নামবদলের ঘটনাও ঘটতে দেখা যায় । তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অপবাদ, মিথ্যাচার ও কুৎসা রটনার মতো অপকর্মগুলো সংসদে দাঁড়িয়েই করে থাকেন । এভাবে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলো কেউই একে অপরের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। ফলে সংসদে ঘন্টার পর ঘণ্টা কেবলই এ সকল বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয় কিন্তু এ বিতর্কের ফল পাড়ায় শূন্য।
৫. বাংলাদেশের রাজনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো রাজনীতিতে পোষক-পোষিতের সম্পর্কের উপস্থিতি। এ জাতীয় প্রবণতা রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যেহেতু নির্বাচন, জনগণের অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক দলব্যবস্থা প্রভৃতি বিদ্যমান, তাই সকল নাগরিক একই রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করবে এটা ভাবা ঠিক নয়। বরং বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী যখন তাদের পছন্দমতো দলকে সমর্থন। করার সুযোগ পাবে তখনই গণতন্ত্র অর্থবহ হবে। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ দেখলে মনে হয় যে, তাদেরকে সমর্থন করা যেন অত্যাবশ্যক। তাই কোনো দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন তাকে যে দল বা গোষ্ঠী সমর্থন দিয়েছিল তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান অপরিহার্য বিবেচনা করে।
পক্ষান্তরে যে সকল দল বা গোষ্ঠী সমর্থন করেনি বলে ধারণা করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণও অপরিহার্য বিবেচনা করে। অথচ একটা গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের উচিত দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে সমান চোখে দেখা । কেননা ভিন্নমত পোষণ করার অধিকার প্রত্যেকেরই আছে। এ অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো সরকারের অবশ্য করণীয়। আবার আমাদের দেশে অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ সুবিধা প্রদানের রীতিও সুবিদিত। বিশেষ করে যে এলাকায় যত শক্তিধর মন্ত্রী, সে এলাকায় তত উন্নয়ন—এ প্রবণতা সুষম উন্নয়ন বানচাল করে দিয়ে অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য বৃদ্ধি করছে ।
৬. আমাদের বিরোধী নেতারা সবসময় সরকারের সকল কিছুর বিরোধিতা করাকেই তাদের প্রধান কাজ বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, সরকারের সকল কাজের বিরোধিতা করতে না পারলে তাদের মান যাবে। অথচ এ জাতীয় ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বরং সরকারি দলের ভালো কাজে সমর্থন যুগিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজনীতি করলে বিরোধীদলীয় প্রধানের মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কমে না। অন্যদিকে সরকারি দলের প্রধানও বিরোধীদলীয় প্রধানের রাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব স্বীকার করতে চান না।
তিনি সরকারি ক্ষমতার বলে জনগণের একটা বিরাট অংশের সমর্থনপুষ্ট বিরোধী দলকেও তোয়াক্কা করতে চান না। তখন অনেক সময় বাধ্য হয়েই বিরোধী দলকে সংসদ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসতে হয়। এ অবস্থার জন্য কোনো পক্ষকেই এককভাবে দায়ী করা যায় না। কেননা এমনও দেখা যায় যে, কেবল একগুঁয়েমি এবং হীনম্মন্যতার কারণেও বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে থাকে। এমনটি আমরা যেমন বিএনপির ক্ষেত্রে দেখেছি, তেমনি ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও দেখছি।
৭. আমাদের রাজনীতিবিদদের আচরণ দেখলে মনে হয় যে, তারা তাদের নিজেদের অবস্থান সম্পর্কেই যেন সচেতন নন ৷ তাই তারা একে অপরকে সম্মান করার যে ন্যূনতম সৌজন্যবোধ সেটাও দেখাতে পারেন না। অথচ আত্মসম্মানবোধ, আত্মোপলব্ধি এবং একে অপরকে সম্মান করার মৌলিক নীতির ওপরই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্ভরশীল। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের নেতা-নেত্রীদের সংসদে দাঁড়িয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, এমনকি কুৎসিত মন্তব্য করতেও শোনা যায়।
৮. রাজনৈতিক ব্যবস্থা যা-ই হোক না কেন, রাজনীতিবিদদের অবশ্যই সকল কিছুর ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা আর যাই হোক দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হতে পারে না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দল, নেতা-নেত্রীরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে আঁতাত করার জন্য আমরা মীরজাফরকে দোষ দিয়ে থাকি, কিন্তু আজকের অনেক মীরজাফরকেই আমরা চিনি না। বিশেষ করে জাতীয় বিষয়কে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তুলে নিয়ে গিয়ে বিদেশীদের কাছে ধর্না দেয়ার ঘৃণ্য মানসিকতা আমাদের রাজনীতিবিদদের বহু দিনের ।
৯. নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন, সংসদ ও সংবিধানের প্রতি আস্থা রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে—এটাই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি। অথচ আমাদের দেশের রাজনীতির দিকে তাকালেই বোঝা যাবে এখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের এ দাবিগুলো কতটা পূরণ হচ্ছে।
![সংসদীয় রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দল রচনা [ ২০০০ + শব্দ ] 3 আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news-300x225.jpg)
জনগণ যাদের ভোট দিয়ে সংসদে তাদের জন্য কথা বলতে পাঠায় তারা সংসদে না গিয়ে দলীয় রাজনীতির নোংরা খেলায় মেতে থেকে সংসদ বর্জনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতির কারণে সংসদে প্রায়ই কোরাম সংকট দেখা দেয় । নানা ছুতোয় সংসদ বর্জন আমাদের সংসদের একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিরোধী দলকে হেয় করা, কথা বলতে না দেয়া এবং যে কোনো যুক্তি ও দাবি কেবল বিরোধী দলের বলে অগ্রাহ্য করার সংস্কৃতিও আমাদের সংসদে চালু হয়েছে।
আমাদের রাজনীতির আরেকটি দিক হলো, যে বিষয়, নীতি বা সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থের অনুকূল বলে মনে করবে কেবল সেটাকেই তারা মেনে নেবে, নতুবা সব অগ্নণতান্ত্রিক, অস্বচ্ছ বা গণবিরোধী বলে চালিয়ে দেবে। যেমন কোনো নির্বাচনে যে দল হেরে যায়, তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হলেও সে দল এখানে কারচুপির অভিযোগ কোনো না কোনো ভাষায় উত্থাপন করবেই ।
সুতরাং এ দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে যদি কার্যকর করতে হয় তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা, পারস্পরিক সম্মানবোধ ও সংসদীয় সংস্কৃতির চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাকে যদি কার্যকর করতে দরকার:
প্রথমত,
সরকারি এবং বিরোধী দল উভয়কেই একে অপরের যৌক্তিক ও গণমুখী দাবিকে সমর্থনের সৎসাহস দেখাতে হবে।
দ্বিতীয়ত,
সরকারি দল এবং বিরোধী দল উভয়কেই সংসদকে সকল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য নানা ছুতোয় যেমন সংসদ বর্জন করা যাবে না, তেমনি সংসদে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টিতেও সরকারি দলকে সহনশীল ও যৌক্তিক হতে হবে।
তৃতীয়ত,
বিরোধী দলকে যেমন বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার মানসিকতা পরিহার করতে হবে, তেমনি সরকারি দলকেও যৌক্তিক ক্ষেত্রে বিরোধী দলের দাবি মেনে নিতে হবে। আপোষ করার মানসিক প্রস্তুতি উভয় দলেরই থাকতে হবে।
চতুর্থত,
রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক অবদানের স্বীকৃতি প্রদানের মতো উন্নততর মানসিকতা পোষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে একে অপরকে স্বীকৃতি না দিলে কারো অবদানের মহিমাই উজ্জ্বল হয় না।
পঞ্চমত,
পরস্পরকে বিশ্বাস করার যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তার চর্চা করতে হবে। রাজনীতিতে প্রতিহিংসা পরিহার করে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। তাহলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিবর্তে উন্নয়ন হবে, গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটবে।
ষষ্ঠত,
সর্বোপরি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে থাকবে জাতীয় স্বার্থ। তাই গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে ঐকমতো পৌঁছতে হবে। নতুবা কোনো জাতীয় সমস্যারই সমাধান হবে না।
উপসংহার:
সুতরাং যতদিন না আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সংসদীয় রাজনীতির এ সকল মৌলিক বিষয়ের চর্চা করবে, ততদিন পর্যন্ত সংসদীয় গণতন্ত্র যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই থেকে যাবে।
আরও দেখুন: