সংবাদপত্রের স্বাধীনতা | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : একটি সমাজের যে কোনো উন্নয়ন এবং পরিবর্তনে তথ্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ তথ্যের নাগাল পেতে বর্তমান সময়ে মানুষকে নানা ধরনের গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হতে হয়। “The Media is the message’ এ বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে মার্শাল ম্যাকলুহান (১৯৬৫) গণমাধ্যমের শক্তিশালী প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরেন। মার্শাল ম্যাকলুহানের কথা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমাজে গণমাধ্যমের প্রভাব কতটা । গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ হিসেবে সংবাদপত্র অনন্য ।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা | গণমাধ্যম | বাংলা রচনা সম্ভার
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
মাধ্যমেই গোটা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। নেপোলিয়নের এ সম্বন্ধে একটি কথা আছে। তিনি ইতিহাস দেখতে হলে বলতেন, ‘Bring many liar’. সংবাদপত্রকে বলা যায় Current history বা ইতিহাস চলন্তিকা। আর নেপোলিয়ন কেন, এ যুগের ক্ষুদ্রতম পাঠকটিও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন এই মিথ্যার ঝুড়ির মধ্যে সংবাদপত্রে কতটা আধুনিক সত্যের ধ্রুব সত্য লুকায়িত থাকে।
রবীন্দ্রনাথের মতে, “মনের চলাচল যতখানি, মানুষ ততখানি বড়। মানুষকে শক্তি দিতে হলে মানুষকে বিস্তৃত করা চাই।” সংবাদপত্র আধুনিক জীবনের অনিবার্য সঙ্গী । অজানাকে জানানো বা অজানা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দেয় সংবাদপত্র। সংবাদপত্র বর্তমান সভ্যতার একটি প্রধান অঙ্গ, দেশ-বিদেশের সংবাদ ব্যতীত আমাদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয় না।
নানা দেশের বিচিত্র সংবাদ, নানারকম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আলোড়ন এবং উন্নয়ন প্রভৃতির সংবাদ যেমন আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে পাই, তেমনি পাই নিজের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের খবর। তাই সংবাদপত্র আমাদের বর্তমান জীবনের এক অপরিহার্য সঙ্গী; এক পরমাত্মীয়।
ঐতিহাসিক পটভূমি : সংবাদপত্র ঠিক করে কোন দেশে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তা সুস্পষ্টভাবে বলা মুশকিল। তবে এ কথা সত্য যে, এ সংবাদপত্র একদিনে উদ্ভব হয়নি। সর্বপ্রথম ভেনিসে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল বলে। জানা যায় । একাদশ শতাব্দীতে চীন দেশে এক প্রকার সংবাদপত্র মুদ্রিত হয়। ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় এ কথা সর্বজন স্বীকৃত। উপমহাদেশে আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম বাংলা সংবাদপত্র চালু হয়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ মিশনারিরা শ্রীরামপুরে সর্বপ্রথম বাংলা সংবাদপত্র চালু করেন। ‘সমাচার দর্পণ’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে এ পত্রিকাটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।
১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সালের কোনো এক সময় ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম মুদ্রিত ইংরেজি সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান গেজেট” প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘আজাদ’। বর্তমান কালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির ফলে সংবাদপত্রের ইতিহাসেও আধুনিক জীবনের প্রাণবন্যা দেখা দিয়েছে। সংবাদ পরিবেশনের বৈচিত্র্য, সংবাদের বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। মুদ্রণ যন্ত্রের মাধ্যমে আধুনিকতম মুদ্রণ ব্যবস্থার দ্বারা সজ্জিত হয়ে সংবাদপত্র আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
সে সঙ্গে হয়ে উঠেছে আমাদের বর্তমান সভ্যতার অপরিহার্য উপকরণ। পূর্বে সংবাদপত্র হাতে হাতে লিখে কিংবা লিখো করে প্রচার করা হতো। এখন উন্নত ধরনের মুদ্রণ যন্ত্রে, বিশেষত রোটারি অফসেটে হাজার হাজার সংবাদপত্র অতি অল্প সময়ে ছাপানো সম্ভব হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রকার সংবাদপত্র : News মানে নতুন কিছু (Something new) । আমাদের চারপাশের প্রতিদিনে ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই সংবাদের উপাদান রয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত সংবাদ মানুষের সামনে উপস্থাপনের জন্য কাজ করে সে প্রতিষ্ঠানকে বলে সংবাদপত্র। আর সংবাদ সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য যারা কাজ করেন তাদের বলা হয় সাংবাদিক।
সংবাদপত্র বিভিন্ন রকমের হতে পারে। বর্তমান পৃথিবীর সভ্য দেশগুলোতে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, বার্ষিক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের পত্রিকা পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে প্রকাশিত হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে, সাংবাদপত্র আর সাহিত্যপত্র এক নয়। সংবাদপত্রের মূল কাজ সংবাদ পরিবেশন, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের ঘটনাবলী তুলে ধরাই সংবাদপত্রের বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে মুখ্য স্থান গ্রহণ করে রাজনীতি আর অর্থনীতি। নিছক সংবাদপত্র ছাড়াও আছে সচিত্র সিনেমা পত্রিকা, বিজ্ঞান পত্রিকা ও ধর্মপ্রচারমূলক পত্রিকা। এসব পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশনের সাথে কিছু সাহিত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, যুদ্ধবিগ্রহ, খেলাধুলা, সিনেমা, থিয়েটার, বেতার বার্তা, বাজারদর, শেয়ার মার্কেট প্রভৃতি নানা শ্রেণীর সংবাদ ও তথ্যাদি স্থান পায় ।
সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা : পৃথিবীতে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিস্তারের যতগুলো পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সংবাদপত্রের আসন সর্বশ্রেষ্ঠ। সংবাদপত্র পাঠ না করলে কারো জ্ঞান পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয় না। সংবাদপত্রকে বলা হয় জীবনযাত্রার চলমান অভিধান। এটি বর্তমান সভ্যতার অন্যতম স্তম্ভ। সংবাদপত্রের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের সংবাদ আমাদের কাছে পৌছাতে পারে। বর্তমান যুগে মানুষের জীবনে যতই জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে, সংবাদপত্রের প্রয়োজন ও গুরুত্ব তত তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে। কারণ সমস্যাসঙ্কুল জীবনের সমস্যা সমাধানেও সংবাদপত্র পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করতে পারে। সংবাদপত্রের বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, সকল শ্রেণীর মানুষের জীবনেই এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
সকল রুচিসম্পন্ন মানুষ যেমন এর মধ্যে মনের প্রশ্নের উত্তর পান, তেমনি সাধারণ মানুষ অনেক জ্ঞাতব্য তথ্য আহরণ করে সেগুলোর দ্বারা নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন। আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সচেতনতা গড়ে ভুলতে পারি। এছাড়া দেশের অর্থনীতি, শিল্প ক্ষেত্রের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জনসাধারণের পক্ষে সচেতন হয়ে ওঠা সম্ভব হয়। সংবাদপত্র আমাদের নানা রকমের কৌতূহল নিবৃত্ত করে । সংবাদপত্রের মাধ্যমেই আমরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পেয়ে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হই।
সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য : প্রেস বলতে সকল গণমাধ্যম অর্থাৎ মুদ্রণ মাধ্যম ছাড়াও রেডিও, টেলিভিশনসহ সব সংবাদ মাধ্যমকেই বোঝায়। তাই সংবাদপত্রের উদ্দেশ্য বলতে সকল গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করার ইঙ্গিত করে। সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের কাজ মূলত চারটি : তথ্য সরবরাহ করা (to inform), শিক্ষিত করা (to educate), প্রভাব বিস্তার করা (to persuade) এবং বিনোদন দেয়া (to entertain)। আলোচিত এ চারটি মূল কাজ ছাড়াও সংবাদপত্রসহ অন্যান্য গণমাধ্যম আরও কিছু কাজ করে। যেমন- কোনো কিছু সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করা (to interpret), কোনো বিষয় সম্পর্কে পথনির্দেশ বা পরামর্শ দেয়া (to guide) প্রভৃতি ।
পৃথিবীতে সংবাদপত্র প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই মানবজীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সাংবাদিকতা শক্তিশালী প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। Eternal vigilance price of the liberty- অর্থাৎ সদা জামাত মনোভাব স্বাধীনতা রক্ষার উপায়। সংবাদপত্র অতন্ত্র প্রহরীর মতো চারদিকে চোখ, কান, খোলা রেখে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার কোথায় কোন ভালো কাজটি সংঘটিত হচ্ছে এবং কোথায় এর ব্যতিক্রম ঘটছে সে লক্ষ্যে সংবাদপত্র তৎপর। বই, বেতার, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি কার্টুন ও কথামালা এবং টিভিতে অনুষ্ঠিত সব তাৎক্ষণিক এবং উপভোগ্য সংবাদ বুলেটিন মানব মনকে নিজের দিকে টেনে আনতে সচেষ্ট হয়েছে।
কোনো বিষয় সম্পর্কে মানুষের মনকে প্রভাবিত করার জন্য গণমাধ্যমগুলো তাদের সর্বপ্রকার যুক্তিতর্ক, ফন্দিফিকির উপস্থাপন করে। সংবাদপত্র বা প্রেস কখনও মিথ্য বলে না। মানুষের এ সুগভীর বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই গণমাধ্যমগুলো জনগণের ওপর কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায় । তবে সব গণমাধ্যমই যে জনগণকে সমানভাবে প্রভাবিত করতে পারে এমন নয়। কারণ গণমাধ্যমে প্রচারিত কোনো বার্তা সমাজের এক শ্রেণীকে প্রভাবিত করলেও আরেকটি শ্রেণী সমভাবে প্রভাবিত নাও হতে পারে।
তবে সংবাদপত্রের প্রচারণাতেই তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। তার নজির ইতিহাসেও রয়েছে। নিউইয়র্ক জার্নালের প্রকাশক র্যাডলফ হার্স্ট বিকৃত সংবাদ পরিবেশন করে আমেরিকা ও স্পেনের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন। ভলতেয়ারের বই পড়ে ফ্রান্সের জনগণ তাদের দেশে বিপ্লব ঘটানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র ও অন্যান্য অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দারুণ অনুপ্রেরণা জোগাত।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের প্রযুক্তি সম্ভাবনা বনাম সম্পাদনার মান : বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পের জগৎ আজ অনেক বড়। ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হয়, তখন পূর্ব বাংলা থেকে একটিও দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল ১০।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩-এ। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১০/১২ গুণ বেশি। দিনের পর দিন এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দৃশ্যত সংবাদপত্রের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যতই দেশের মানুষ সচেতন হচ্ছে, বাইরের জগৎ ও দেশকে জানার আগ্রহ ততই বাড়ছে। দেশ ও সমাজের বিভিন্ন কর্মতৎপরতায় নিজের কথা বলা বা নিজের মত প্রকাশ করায় অংশগ্রহণের আগ্রহ যত হচ্ছে ততই সংবাদপত্রের চাহিদা বাড়ছে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে সচেতনতা বাড়বে। আর এ সচেনতার প্রকাশ ঘটবে সংবাদপত্রের পাতায়।
বাংলাদেশে আজ পত্র-পত্রিকার সংখ্যা যা দাঁড়িয়েছে তা যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য গৌরবজনক । তবে সত্যের খাতিরে স্বীকার করা উচিত, এ গৌরবে সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটে না- না সার্কুলেশন, না মান। সংবাদপত্রের শিল্প কোনো সুস্পষ্ট জাতীয় নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে না বলে আজ সংবাদপত্র শিল্প খুবই এলোমেলোভাবে গড়ে উঠেছে। যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এ শিল্প পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজন ছিল তা অনুপস্থিত। ফলে দেশে প্রচুনা পত্রিকা প্রকাশিত হলেও বেশির ভাগ পত্রিকারই কোনো প্রভাব পাঠকদের ওপর লক্ষ্য করা যায় না।
সাংবাদিকতা নীতিমালাও লঙ্ঘিত হচ্ছে নিদারুণভাবে। অথচ নিয়মানুযায়ী সব পত্রিকাই কম-বেশি সরকারি সাহায্য পাচ্ছে নানাভাবে । সংবাদপত্র শিল্প কিভাবে গড়ে উঠেছে, কিভাবে চলছে এবং শিল্প বিকাশের জন্য কি নীতি অনুসৃত হওয়া উচিত এ সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয়। অথচ এ অস্পষ্টতার সুযোগে আজ সংবাদপত্র শিল্প বিকশিত হয়েও যথাযথ রূপ লাভ করতে পারছে না। সাংবাদিক ইউনিয়ন সংবাদপত্র শিল্প সম্পর্কে সরকারি নীতি ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। এ নীতি নির্ধারণ করা যেতে পারে কেবল মাত্র শিল্পের সমস্ত খুঁটিনাটি জানার পরে। আর তার জন্য দরকার প্রেস কমিশন। কেবলমাত্র প্রেস কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই সংবাদপত্র শিল্প সম্পর্কে সরকার একটা নীতি নির্ধারণ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর গত কয়েক বছরে সংবাদপত্রে সংবাদ, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রায় একই মানের রয়ে গেছে, শুধু কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। লক্ষ্য করার বিষয়, নিউজ প্রিন্টের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক খরচ বাড়ছে এ অজুহাতে বিভিন্ন সংবাদপত্র তার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছাঁটাই করেছে। বেসরকারি পত্রিকা ও সরকারি ব্যবস্থাধীন পত্রিকায় সম্পাদকীয় মন্তব্য স্পষ্টত দু ধরনের। বেসরকারি পত্রিকাগুলো স্বাধীনভাবে নানা বিষয়ে মতামত প্রকাশ করছে। অপরদিকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেসব কাগজ রয়েছে সেগুলো প্রধানত সামাজিক সমস্যা নিয়েই তাদের সমালোচনা ও মতামত সীমাবদ্ধ রাখছে। অবশ্য দু একজন ব্যতিক্রমী কলামিস্টও রয়েছেন। ইংরেজি কাগজগুলোর সুবিধা হলো, বিদেশী পত্রিকা থেকে নানা নিবন্ধ সরাসরি পুনর্মুদ্রণ।
রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিয়মিত দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যদিও ঢাকার বাইরে পত্রিকা প্রকাশনা নানাভাবে সমস্যায় আক্রান্ত, তবু প্রকাশকদের ও সাংবাদিকদের অদম্য আগ্রহের ফলে এসব পত্রিকা ক্ষুদ্র কলেবরে হলেও প্রকাশিত হচ্ছে। এসব পত্রিকায় কারিগরি সুযোগ সুবিধা এখনও প্রাচীন আমলের। আধুনিক মুদ্রণের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত এ পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যাও খুব বেশি নয় । শুধু ছাপার পদ্ধতিই নয়, পেশাদার সাংবাদিকের অভাবও এসব পত্রিকার একটা বড় সমস্যা।
ঢাকার বাইরে আস্তে আস্তে দৈনিক পত্রিকার একটা জগৎ গড়ে উঠছে। পুরনো পত্রিকাগুলো আধুনিক পদ্ধতির ছাপাখানা করার উদ্যোগ নিচ্ছে। সাংবাদিকতা পেশার প্রতি শিক্ষিত তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। প্রেস ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বিভিন্ন জেলায় প্রশিক্ষণ কোর্সও হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় সাংবাদিকরা তাদের ইউনিয়নের মাধ্যমেও সংঘবদ্ধ । এসবই সংবাদপত্র বিকাশে ও সংবাদপত্রের গুণগত মানোন্নয়নে সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সে সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার স্বরূপটিও প্রকাশিত হবে বলে সকলের প্রত্যাশা।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রেক্ষিত বাংলাদেশ সংবাদপত্র জনমত গঠন ও রাষ্ট্রশাসন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কেননা একটা দেশের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, রাষ্ট্রশাসন সংক্রান্ত নানা তথ্য সংবাদপত্রে পরিবেশন করা হয়। কখনো কখনো বিভিন্ন ধরনের সমস্যার ইঙ্গিত ও তা সমাধানের উপায় নির্দেশ করা হয় সংবাদপত্রে। এতে জনগণ একদিকে দেশ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। এজন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংবাদপত্র সঠিক সংবাদকে যাতে প্রকাশ করতে পারে তার ব্যবস্থা থাকা দরকার ।
অবশ্য সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষত সাংবাদিককে স্মরণ রাখতে হবে যে তার স্বাধীনতা আছে বলেই তিনি সর্বদা সব সত্য তুলে ধরতে পারেন না। কিংবা নিজের খেয়াল খুশিমত কোনো সংবাদ পরিবেশন করতে পারেন না। সংবাদ বা প্রতিবেদন রচনার ক্ষেত্রেও কিছু নিয়মবিধি আছে ৷ এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে সংবাদপত্রের চরিত্র ভ্রষ্ট হয়। এ ধরনের সাংবাদিকতাকে সাম্প্রতিককালে হলুদ সাংবাদিকতা (yellow journalism) নামে অভিহিত করা হচ্ছে। সংবাদপত্র হচ্ছে লোক শিক্ষক। জনকল্যাণের জন্য তা যেন সঠিকভাবে কাজ করে সেদিকে সংবাদপত্র মালিক, সাংবাদিক সবাইকে আন্তরিক হতে হবে । তাহলে সাংবাদপত্র তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
সংবাদপত্রে যেমন আছে সৎ, নির্ভীক সাংবাদিক, তেমনি আছেন অসৎ সাংবাদিক। অথচ নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনই সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকের কর্তব্য। সংবাদপত্র দেশের রাজনীতি তথা সামগ্রিক ক্ষেত্রে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যই একে বলা হয় চতুর্থ শক্তি (The fourth estate)। সংবাদপত্রের শক্তির প্রাচুর্য ও জনমানসে তার প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবেই দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো এর সুযোগ গ্রহণ করতে চায় এবং দলের কাজে ব্যবহার করতে চায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিককালের সংবাদপত্রগুলো প্রায়ই কোনো না কোনো দলের মুখপত্র হয়ে উঠেছে।
অথবা পরোক্ষ কোনো বিশেষ দল বা নীতির প্রতি সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। তাই বর্তমানে সংবাদপত্রের মাধ্যমে খাঁটি ও পক্ষপাতহীন সংবাদ পরিবেশন খুব কম ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়। আবার নির্ভীক, সৎ সংবাদ পরিবেশনের জন্য নির্ভীক সাংবাদিকের অপমৃত্যু ঘটে মুষ্টিমেয় ক্ষমতালোভী স্বার্থানেষী মানুষের হাতে। এ বিষয়টি নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে বিশাল বাধা। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব আমাদের। একজন সাংবাদিক আমাদেরই লোক এ ধ্রুব সত্যটি সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। সাংবাদিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য জনসাধারণকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে সত্যের পথে পরিচালিত করা, ব্যক্তিবোধের উল্লেখ ঘটানো এবং ব্যক্তির শুভবুদ্ধিকে উদ্দীপ্ত করা।
নিজেদের ব্যক্তিগত কিংবা দলগত স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে সংবাদ পরিবেশন করতে গেলে জনসাধারণের প্রতি অবিচার করা হয়, সাংবাদিককে সত্যনিষ্ঠ, নিরাসক্ত, কঠোর সমালোচক হতে হবে। এক বিচারে, সাংবাদিক প্রকৃতপক্ষে জাতির শিক্ষক, জাতিকে যথার্থপথে পরিচালনার দায়িত্ব তারই । সংবাদপত্রকে কেন্দ্র করে নানাভাবে মত বিনিময়ের সুযোগ থাকতে পারে- মত পার্থক্য সত্ত্বেও সত্যের অবিচল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়; এই সত্য প্রতিষ্ঠাই প্রকৃত সাংবাদিকতার লক্ষ্য। সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিনিময়ের বা দৃষ্টিভঙ্গির সত্যতা প্রকাশের সুযোগ থাকে বলে অনেকে সংবাদপত্রকে ‘Second Parliament of the nation’ বলে অভিহিত করে থাকেন ।
সাংবাদিকতার নীতিমালা : গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদপত্রে যেসব নীতি মেনে চলা হয়, সাংবাদিকতার নীতিমালা বলতে আমরা তাই বুঝি। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার আলোকে ক্রমানয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে এই নীতিমালা সৃষ্টি হয়েছে। নীতিমালা মূলত উপলব্ধির ব্যাপার। বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকগণ উপলব্ধি করেছেন যে, জনস্বার্থে, সংবাদপত্রের স্বার্থে এবং সাংবাদিকদের নিজেদের স্বার্থেও কিছু নীতি মেনে চলতে হবে। নৈতিক কারণেই তা মেনে চলা জরুরি। জনসাধারণের যা জানার অধিকার আছে তাদেরকে তা জানাতে হবে।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সংশ্লিষ্ট যেসব বিষয় তাদেরকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে, সে বিষয়গুলো তাদেরকে অবহিত করতে হবে। তাছাড়া জনগণকে নির্ভুল ও বস্তুনিষ্ঠ বিষয়গুলো জানাতে হবে। কাজেই যেসব সংবাদ পরিবেশন করা হবে তা শুধু নির্ভুল, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ হলেই চলবে না। তা সম্পূর্ণ সভ্য হতে হবে, তাতে ভারসাম্য থাকতে হবে, তা এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে যেন জনগণ তা সঠিক অর্থে গ্রহণ করেন এবং তা সঠিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরতে হবে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, কোনো ঘটনা, কোনো বক্তব্য অথবা কোনো পরিস্থিতিকে পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে দেখতে না পারলে পরিবেশিত সংবাদে এই গুণগুলো রক্ষা করা যাবে না। পরিবেশিত সংবাদটিতে….
১. যদি কোনো সাংবাদিকের নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত কিছু যুক্ত না হয়ে থাকে ।
২. তথ্য যদি উপযুক্ত সূত্র থেকে পাওয়া গিয়ে থাকে।
৩. সেসব যদি যথাযথভাবে যাচাই করা হয়ে থাকে ।
৪. পূর্ববর্তী ঘটনাবলী এবং বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে তা যদি বিচ্ছিন্ন করে না দেখানো হয়ে থাকে এবং
৫. বিষয়টি বিতর্কিত হলে যদি সব দিক তুলে ধরা হয়ে থাকে তাহলে পরিবেশিত সংবাদটিতে উপরে উল্লেখিত গুণাবলী থাকবে বলে আশা করা যায়।
নৈতিক কারণে সংবাদপত্রের যেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে তা নিম্নরূপ :
ক. রাষ্ট্রবিরোধী কিছু লেখা যাবে না ও এ রকম কাজে উৎসাহ দেয়া যাবে না।
খ. আদালত অবমাননা করা যাবে না ।
গ. আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না।
ঘ. কারো মানহানি করা চলবে না।
ঙ. কোনো সম্প্রদায় অথবা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো চলবে না।
চ. কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা চলবে না।
ছ. কোনো গুজব ছড়ানো চলবে না।
জ. সংবাদপত্রে কোনো কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না।
ঝ. জীবনের কোনো দিকই উপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই । কিন্তু অশ্লীলতাকে বর্জন করতে হবে।
ঞ. কারো ব্যক্তিগত জীবনের কোনো গোপন দিক যা জনগণের জানার অধিকার নেই তা ফাঁস করে তাকে বিব্রত করা চলবে না। অর্থাৎ কারো প্রাইভেসিতে হানা দেয়া চলবে না ।
ট. কারো দেশপ্রেমের প্রতি কটাক্ষ করা চলবে না। কোনো প্রমাণ ছাড়া কাউকে বিদেশী এজেন্ট
বা এ জাতীয় বিশেষণে ভূষিত করা যাবে না। ঠ. কোনো বিজ্ঞাপনকে সংবাদের ছদ্মবেশ দেয়া যাবে না ইত্যাদি ।
দেখা যায়, সমাজে যদি প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, রাজনৈতিক অঙ্গনে যদি একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করেন, ‘মারি আর পারি যে কৌশলে’ নীতি প্রাধান্য পায় এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী যদি একে অপরকে ঘায়েল করার কাজে সংবাদপত্রকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেন, তাহলে সংবাদপত্রের পক্ষে তার নিজস্ব সত্তা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে নীতিমালার সুষ্ঠু প্রতিফলন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কারণ সংবাদপত্রের চেহারা কি দাঁড়াবে তা কেবল সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করে না। মালিক, সাংবাদিক, প্রশাসন, রাজনীতিক, সমাজপতি, বিজ্ঞাপনদাতা, সংবাদপত্র সকলের কর্মকাণ্ডের মিলিত ফসলই সংবাদপত্র।
সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের দায়বদ্ধতা : সাংবাদিকতার অর্থ হচ্ছে একজন প্রত্যক্ষদর্শী, প্রত্যক্ষসাক্ষী। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা এবং সাংবাদিকেরা দেশের সম্পদ। এই কারণেই যে কোনো পরিস্থিতিতে তাদের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা প্রয়োজন। সাংবাদিকদের প্রধান ও একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের সংরক্ষণ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিকরা বলেন, সাংবাদিকদের কলমের ক্ষমতা তরবারির চেয়ে ধারালো ও শক্তিশালী। সহজেই অনুমেয় যে, কলম এমন একটি অস্ত্র যা সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের চেয়েও মারাত্মক।
এই কলমের সামান্যতম দু ফোটা কালি পৃথিবীর সমস্ত ধন-সম্পদের চেয়েও বেশি মূল্যবান। সেই কলম যখন কোনো সাংবাদিকের হাতের অস্ত্র হয় তখন তার ক্ষমতাও বেড়ে যায় অন্তহীনভাবে। সাংবাদিকগণ সমাজের ও দেশের ভীষণ প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় শ্রেণী। সব পেশার একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি আছে, আছে সংরক্ষিত সীমানা। কিন্তু একজন সাংবাদিকের পেশার নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডি নেই। অন্তহীন তার বিচরণের ক্ষেত্র। তারা ত্রিভুবনের যে কোনো বিষয় লেখার অধিকার রাখে। যারা এ পেশায় এসে কলম হাতে নেন সে মুহুর্তে নিজের অজান্তেই সমাজ ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই কাজ করছেন বলে বিবেচিত হবে ।
সাংবাদিকরা পরিচয়পত্র অর্থাৎ অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বহন করেন। এ কারণে তারা যে কোনো স্থানে প্রবেশাধিকার রাখেন । এমন কি বিশেষ সংরক্ষিত এবং নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় প্রবেশাধিকার থাকতে পারে, যা সমাজের অনেক গণমান্য ব্যক্তিদের থাকে না। তারা দেশের বাইরেও যে কোনো স্থানে বিশেষ ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে পরিচিত হন এবং সম্মানিত হয়ে থাকেন। দেশের এবং দেশের বাইরে কোথায় কি ঘটছে জনগণ তা জানার জন্য তৃষ্ণার্ত থাকে এবং তাদের তৃষ্ণা মেটায় সাংবাদিকদের কলমের কালি। কখনো কখনো তাদের অজান্তে একেবারে নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক কোনো তথ্য তাদের হাতে এসে যায়। সেটি ইচ্ছে করলে দেশের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করা যায়, আবার সেটাই দেশের
সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য সহজেই ব্যবহার করা যথেষ্ট হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই তাই সাংবাদিকরা খুব স্পর্শকাতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। আবার দুঃখজনক হলেও সত্যি, কেউ কেউ নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে দেশের স্বার্থ বিরোধী কাজ করার সাংবাদিকতার সুযোগ নিয়ে থাকেন। এরা মহান পেশায় থেকে দেশকে কলঙ্কিত করতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিবেদিত সাংবাদিকরা, যারা দেশের জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তাদেরই উচিত, এসব মুখোসধারী ব্যক্তি, যারা সংবাদিকতার কলঙ্ক, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ।
বলাবাহুল্য, মানব সভ্যতার এক অনন্য দীপ্তি এবং গণমানুষের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে সংবাদপত্র। এটি পাঠককে দেশ-বিদেশ ও পারিপার্শ্বের নাগরিক জীবনকে প্রভাবিত কিংবা আপন করে ভুলতে পারে। পাঠক শ্রোতাকে নির্ভরযোগ্য বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দূর নিকটে কোথায় কি হচ্ছে তা ছাপার অক্ষরে তুলে ধরে থাকে। বার বার পড়ার সুযোগ থাকে। ফলে পাঠক হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হন। কিন্তু সংবাদপত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে রেডিও, টেলিভিশন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ই-মেইল ও ইন্টারনেটের আবির্ভাব ঘটেছে। এসব চ্যানেল বা মাধ্যম পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষকে জানিয়ে দেয় কোথায় কি হচ্ছে বিজ্ঞানের এ সাফল্য উভয়ের গৌরব আরো বৃদ্ধি করেছে।
অনেক সময় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাংবাদিকরা প্রাণ হারাচ্ছেন, বিকলাঙ্গ হচ্ছেন। সংবাদপত্র জগতের এমন বিপন্নতা প্রতিরোধ অবশ্যই জরুরি। প্রত্যেক মানুষের মতো একজন সাংবাদিকেরও নিজস্ব মত ও চিন্তা আছে। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের বস্তুনিষ্ঠ দাবি অত্যন্ত প্রবল। এ সাংবাদিকদের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি ও অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তাদের কলমযুদ্ধ অবিরত চালিয়ে যাবেন— এ প্রত্যাশা সকলের।
স্বাধীনতার বিরূপ প্রভাব : সংবাদপত্র জনসংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবাদপত্র জনগণের শিক্ষকও বটে। দেখা গেছে পৃথিবীর অধিকাংশ স্বাক্ষর লোক সংবাদপত্র ছাড়া এর বেশি কিছু পড়েন না। সংবাদপত্রের মাধমে তারা শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি ইত্যাদির সমকালীন ধারা সম্বন্ধে নিজেদের অবহিত রাখেন। সুতরাং সংবাদপত্রকে যথার্থই জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় বলা যেতে পারে। অথচ জনগণের সংবাদপত্র আজ অন্যতম এক শিল্প আঙ্গিক।
সাংবাদিকরা অনেক সময় স্বাধীনতার আতিশয্যে তাদের দায়-দায়িত্বের কথা ভুলে যান। তখন তারা সংবাদ পরিবেশনে পক্ষপাতিত্বের পক্ষ নেন। দেশ, সমাজের তখন মারাত্মক ক্ষতি হয়। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং জনগণের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে :
৩৯ (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জ্ঞান শৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা অদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে। ক. প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের; খ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সহজেই অনুমেয় যে, স্বাধীনতার সঙ্গে পরাধীনতার বিষয়টিও জড়িত। অর্থাৎ একজন সৎ, নিষ্ঠাবান সাংবাদিক কখনো তার দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধকে আইন ও নৈতিকতার বিরোধী হিসেবে প্রয়োগ করতে পারে না। আর যখন তিনি এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের আশ্রয় নেন তখন সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নামক বিষয়টি পরাভূত হয়। এ অবস্থায় সংবাদপত্রকে বলা হয় dangerous colate অর্থাৎ বিপজ্জনক প্রতিষ্ঠান। অবশ্য এর মূল কারণ বোঝা দুঃসাধ্য নয়।
ব্যবসায়িক স্বার্থ ও মুনাফার মৃগয়া যেখানে অবাধ উদ্যম, যেসব দেশে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রভৃতি পর্যন্ত সে বিকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে প্রযুক্ত হয়- ধর্ম এবং দেবতাও নিস্তার পায় না। ‘মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা’ কথাটা কার্যত হয়েছে স্বত্ত্বাধিকারী মহামালিকদের যদৃচ্ছ আত্মপ্রচারের উদ্দেশ্য সিদ্ধির স্বাধীনতা। তখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হয়। সংবাদপত্রে ইয়েলো জার্নালিজম বলে একটা কথা প্রচলিত আছে- যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অতিরঞ্জিতের ফসল। মি. জোসে পুলিৎজার জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি আর্থিক অবস্থার কারণে জার্মানি ছেড়ে চলে যান। তিনি খুব লেখাপড়া জানতেন না । কিন্তু তাকে আমেরিকার প্রথম সাংবাদিকতায় অংশগ্রহণ করতে হয় । তিনি মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে পরে তিনটি সংবাদপত্রের মালিক হন। বিশেষ করে সংবাদপত্রে আগে মহিলা কলাম লেখা, দুর্নীতি ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয়ে পত্রিকায় সংবাদ হিসেবে তিনিই প্রথম স্থান করে দেন। তিনি বাহ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বাজে শিরোনাম, সংবাদে যৌন আবেদন, তথ্য বিভ্রাট, রসবোধ, লেখনীর মাধ্যমে সংবাদ ছাপাতে শুরু করেন। এর ফলে ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিকভাবে ধনকুবের হয়ে উঠেন।
১৮৯০ সাল থেকে মি. জোসে সংবাদের ভাষা ছবির কার্টুনের মাধ্যমে শুরু করেন। এই কার্টুনে হলুদ রং ব্যবহার শুরু করেন। এর নাম দেয়া হয় ‘ইয়েলো কিড’। তিনি ১৮৯০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বিবেকবর্জিত ও বেপরোয়াভাবে সংবাদপত্রের পাতায় নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় অর্থনৈতিক সংবাদ, ছবি, কার্টুন, স্ক্যান্ডালিং সবকিছু ছাপানো শুরু করেন।
কথায়, মানুষ বলে হলুদ সাংবাদিকতা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ সংবাদ বা খবরে উপযুক্ত অর্থনৈতিক হলুদ লাগালে খবরটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন সংবাদ আর সংবাদ থাকে না। সাংবাদিকদের স্বাধীনতার অপব্যবহার ও অতিরঞ্জিত ব্যবহারের ফসল এই ইয়েলো জার্নালিজম। এর ফলে জনগণ বিভ্রান্ত হয়, তথ্য সন্ত্রাস ও বিভ্রান্তি ঘটে, পক্ষপাতিত্বের দাবানলে প্রতিপক্ষ ঘায়েল হয় অযথা ইত্যাদি অযাচিত ঘটনার সূত্রপাত ঘটে।

উপসংহার : সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কুফল ও সুফল উভয় দিক পরিলক্ষিত হলেও এ কথা সত্য যে, সংবাদ ও সাংবাদিকের স্বাধীন মত প্রকাশে এর বিকল্প নেই। একজন সাংবাদিক সমাজেরই মানুষ, কাজেই সামাজিক মানুষ হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য তার লেখায় প্রতিফলিত হবে এটা অবান্তর কিছু নয়। কিন্তু সেই সামাজিক অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে তিনি স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় গ্রহণ করলে তা দেশ ও সমাজে বিরূপ প্রভাব পড়বে সংবাদিকদের এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। জনসম্পর্কের অন্যতম সেতু ও বাহন সংবাদপত্রের ও জনসংযোগের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কেননা সংবাদপত্র নাগরিকদের দায়িত্ব সচেতন করতে পারে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির স্বরূপ উদঘাটন করতে পারে এবং তা প্রবাহিত করতে পারে বহু মানুষের মধ্যে।
রাষ্ট্রের বিধি ব্যবস্থা প্রচার ও জাতিগঠনের কাজে সংবাদপত্রের দান অসামান্য। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তাই সাংবাদিকতায় আমাদেরকে আরো এগিয়ে যেতে হবে। উন্নত ধরনের সাংবাদিকতার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের একান্ত প্রয়োজন। নিরপেক্ষ ও সত্য সংবাদ প্রকাশ করে জনসাধারণকে নানা বিষয়ে শিক্ষার আলোক দান করার শুরু দায়িত্ব সংবাদপত্রকে বহন করতে হবে। তবেই আমাদের সাংবাদিকতা সার্থক হবে। আমাদের দেশের কল্যাণ হবে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও বিরোধী দলগুলোর একত্রে অবস্থান জরুরি। এ স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে সংবাদ ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আমাদের সাবলীল পথচলা সুগম হবে।
আরও দেখুন: