ষত্ব বিধান নিয়ে আজ আলোচনা। এর অংশ হিসেবে আসবে ষত্ব বিধানের নিয়মাবলি। এই পাঠটি আমাদের ভাষা ও শিক্ষা সিরিজের ণত্ব ও ষত্ব বিধান বিভাগের পাঠ।
Table of Contents
ষত্ব বিধান
যে রীতি অনুসারে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের বানানে মূর্ধন্য-ষ ব্যবহৃত হয় তাকে ষত্ব বিধান বলে। অর্থাৎ তৎসম শব্দের বানানে ষ-এর সঠিক ব্যবহারের নিয়মই ষত্ব বিধান। যেমন— বিষ, কৃষক, বর্ষণ, , আভাষ ইত্যাদি।
ষত্ব বিধানের নিয়মাবলি
বাংলায় শিস্ ধ্বনির অক্ষর তিনটে—শ ষ স । ফলে বানানে গণ্ডগোল তো লাগবেই। অথচ একই ধ্বনির জন্যে একটিই বর্ণ হবে— এ ক্ষেত্রে সেটাও চলছে না : বিশ [২০ সংখ্যা], বিষ [গরল], বিস [পদ্মের ডাঁটা]। তিন জায়গাতেই উচ্চারণ একই, অথচ শ/ষ/স অক্ষরের জন্যে অর্থ কেমন পাল্টে গেল। ফলে ষত্ব-বিধানকে অবহেলা করার উপায় নেই।
আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে, বিদেশি শব্দের বানানে কখনো মূর্ধন্য ষ হয় না। নিচে ষত্ব-বিধির নিয়মগুলো সংক্ষেপে দেওয়া হল ঋ বা ঋ-কারের পরে মূর্ধন্য-ষ হবে। যেমন- ঋষভ কৃষক কৃষি কৃষ্ণা ঋষি কৃষাণ কৃষ্ণ তৃষ্ণা দৃষ্টি সৃষ্টি ব্যতিক্রম : কৃশ্ ধাতু থেকে জাত কৃশ, কৃশতা, কৃশকায় ৷
বিকর্ষণ মাধ্যাকর্ষণ শীর্ষক আকর্ষণ বিম সংঘর্ষ রেফ-এর পর মূর্ধন্য-ষ হবে। যেমন— পার্ষদ বর্ষায় বর্ষীয়ান উৎকর্ষ বার্ষিক পর্ষদ বার্ষিকী মুমূর্ষু শতবার্ষিক সপ্তর্ষি মহর্ষি মহাকর্ষ অভি বাংলা ভাষায় দেশি-বিদেশি শব্দ মিলে পঞ্চাশটিরও বেশি ‘উপসর্গ’ আছে। যেমন : অধি, অনু, উপ, পরা, পরি, পুর, প্রতি, সু ইত্যাদি। এ সব উপসর্গের মধ্যে ই-কারান্ত (অর্থাৎ সি দিয়ে শেষ হচ্ছে যেগুলো—অধি, অভি, পরি, প্রতি, বি ইত্যাদি) এবং উ-কারান্ত ( যেমন : অনু, সু ইত্যাদি ) উপসর্গের পরে মূর্ধন্য-ষ হবে।
যেমন : অধিষদ ( অথচ সভাসদ, সংসদ), অভিষেক ( < অভি + সেক। অথচ জলসেক) পরিষদ, পরিষ্কার (অথচ পুরস্কার); প্রতিষেধক, প্রতিষ্ঠান ( < প্রতি + স্থান । অথচ যথাস্থান) বিষণ্ণ, বিষম (অথচ অসম), দুর্বিষহ (অথচ অসহ), বিষয়, বিষাদ অনুষঙ্গ (অথচ সঙ্গ, আসঙ্গ, প্রসঙ্গ), অনুষ্ঠান (< অনু + স্থান। অথচ অস্থান, প্রস্থান) সুষম (অথচ সম, অসম)। ই-কারের পর সিচ্, সিধু, সদ্ প্রভৃতি ধাতুর ‘স্’ পাল্টে গিয়ে ‘ষ’ হয়। যেমন : (i) সিচ্―নিষেক, নিষিক্ত; সদ্——বিষাদ, বিষণ্ণ; সি—প্রতিষেধ, নিষেধ, নিষিদ্ধ ইত্যাদি।
অ, আ ভিন্ন অন্য স্বরধ্বনির এবং ক ও র-এর পরের বিভক্তি বা প্রত্যয়ে স থাকলে তা ষ হয়। যেমন- ভবিষ্যৎ (ত্ + অ + ব্ + ই + ষ্-ব্ এর পরে ই-এর ব্যবধান)। এরকম- চিকীর্ষা চক্ষুষ্মান মুমূর্ষু মুমুক্ষু আ ছাড়া অন্যান্য স্বরবর্ণের পরে বহু ক্ষেত্রে ষ হয়ে থাকে। অর্থাৎ ই ঈ উ ঊ এ ঐ ও ঔ এবং ি পটেটো – এদের পরে য হয়।
ষত্ব বিধান ব্যতিক্রম :
দিশা, দেশ, বিশ, বিসদৃশ, বিসংবাদ ইত্যাদি। সম্ভাষণসূচক শব্দে এ-কারের পর মূর্ধন্য ষ হয়, কিন্তু সম্ভাষণসূচক স্ত্রীবাচক শব্দে আ-কারের পর দন্ত্য স হয়। যেমন : কল্যাণীয়েষু, প্রিয়বরেষু, সুজনেষু, প্রীতিভাজনেষু, শ্রদ্ধাভাজনেষু, শ্রদ্ধাস্পদেষু, স্নেহাস্পদেষু, বন্ধুবরেষু, শ্রীচরণেষু । কিন্তু কল্যাণীয়াসু, সুচরিতাসু, পূজনীয়াসু, মাননীয়াসু, সুপ্রিয়াসু, সুজনীয়াসু হবে। ক খ প ফ – এদের আগে ইঃ ( বাঃি ) অথবা উঃ ( বা. : ) থাকলে সন্ধির ফলে বিসর্গের জায়গায় সর্বদা মূর্ধন্য ষ বসবে। যেমন :
এরকম : নিষ্পন্ন, নিষ্পিষ্ট, নিষ্প্রাণ, নিষ্পেষণ, নিষ্প্রভ, নিষ্প্রদীপ, নিষ্ক্রিয়, নিষ্কৃতি, নিষ্পত্তি, নিষ্ক্রমণ, নিষ্কলঙ্ক, নিষ্কণ্টক, নিষ্কর, জ্যোতিষ্ক ইত্যাদি। [লক্ষণীয় যে, ইঃ / উঃ –র জায়গায় যদি অঃ / আঃ থাকে, তাহলে কিন্তু স হবে, যেমন:
এরকম : আর্টিস্ট, এস্টিমেট, ওয়েস্ট, কনস্টেবল, কোস্টার, টাইপিস্ট, টেস্ট, টোস্ট, টুরিস্ট, ডাস্টার, ডাস্টবিন, ডিস্ট্রিক্ট, ডেনটিস্ট, পেস্ট্রি, পোস্ট, প্লাস্টার, প্লাস্টিক, ফরেস্ট, ফার্স্ট, ফাস্ট, ব্যারিস্টার, মাস্টার, মিস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট, রেজিস্টার, রেজিস্ট্রার, রেজিস্ট্রি, লিপস্টিক, লিস্ট, স্টক, স্টপ, স্টল, স্টার, স্টিক, স্টিমার, স্টিল, স্টুডিও, স্টেডিয়াম, স্টেশন, স্টোভ, স্ট্রাইক, স্ট্রিট, হোস্টেল ইত্যাদি। * জর্মন st কিন্তু ইংরেজির মতো উচ্চারিত হয় না, সে ক্ষেত্রে শট্ লেখা উচিত; যেমন— আইশ্টাইন (Ei- nstein) ইত্যাদি ।
পাষণ্ড, কোনো নিয়মে ফেলা যাবে না, অথচ স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয় এমন শব্দও আছে। যেমন : আষাঢ়, ঊষা, ঊষর, আভাষ, অভিলাষ, ঈষৎ, কোষ, পাষাণ, পোষণ, ভাষা, ভাষ্য, ভাষণ, ষণ্ড, মানুষ, সরিষা, ঔষধ, ঔষধি, ষোড়শ, তোষণ, পৌষ, রোষ, কলুষ, দ্বেষ, ভূষণ, শোষণ, ষড়যন্ত্র, ষটচক্র ইত্যাদি।
স্বতঃসিদ্ধ শব্দগুলোকে সহজে মনে রাখার জন্যে নিচের ছড়াটি বেশ উপকারে আসবে : ভাষা মাষা ষট্ আষাঢ় ষণ্ড কষিত পাষাণ ইষু পাষণ্ড কষায় কাষায় কাষ্ঠ কষ্ট আভাষ বাষ্প মওষিক অষ্ট পৌষ পুষ্প শষ্প ভাষ্য ষত্ব-বিধির করে না দাস্য । [এরা ষত্ব-বিধানের দাস্যবৃত্তি করে না, অর্থাৎ – কোনো নিয়মের বাঁধাবাঁধি ছাড়াই এসব শব্দে প্রকৃতিগতভাবেই ষ আসে । ]
• সংস্কৃত ‘সাৎ’ প্রত্যয়যুক্ত পদেও ষ হয় না। যেমন : অগ্নিসাৎ, ধূলিসাৎ, ভূমিসাৎ ইত্যাদি। ১০ : আরবি, ফারসি, ইংরেজি ইত্যাদি বিদেশি শব্দে কখনো মূর্ধন্য-ষ হবে না। এসব শব্দের মূল উচ্চারণ অনুযায়ী দন্ত্য-স অথবা তালব্য-শ হবে। যেমন : আরবি : নকশা, মুশকিল, শয়তান, মজলিস, সনদ, ফসল। ইংরেজি : কমিশন, ব্রিটিশ, মেশিন; স্যার, সিলেবাস, বাস । ফারসি : খুশি, খোশ, চশমা; আসর, খানসামা, রসিদ।
ষ ব্যবহারের নিয়ম:
- ঋ-কারে পরে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: ঋষি, বৃষ, বৃষ্টি।
- অ, আ, বাদে অন্য স্বরবর্ণ, ক এবং র বর্ণের পরের প্রত্যয়াদির দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: ভবিষ্যৎ, পরিষ্কার, মুমূর্ষ।
- ‘অতি’, ‘অভি’ এমন শব্দের শেষে ই-কার উপসর্গ এবং ‘অনু’ আর ‘সু’ উপসর্গের পরে কতগুলো ধাতুর দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: অতিষ্ঠ, অনুষ্ঠান, নিষেধ, অভিষেক, বিষণ্ন(‘ণ্ন’ মূর্ধ-ণ পরে দন্ত্য-ন), সুষম।
- নিঃ, দুঃ, বহিঃ, আবিঃ, চতুঃ, প্রাদুঃ এ শব্দগুলোর পর ক্, খ্, প্, ফ্ থাকলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: নিঃ + কাম > নিষ্কাম, দুঃ + কর > দুষ্কর, বহিঃ + কার > বহিষ্কার, নিঃ + পাপ > নিষ্পাপ।
- কিছু শব্দ স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: আষাঢ়, নিষ্কর, পাষাণ, ষোড়শ ইত্যাদি।
- কতগুলো শব্দ বিশেষ নিয়মে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন: সুষুপ্তি, বিষম, বিষয়, দুর্বিষহ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদি।
কোথায় কোথায় ষ-ত্ব বিধান নিষেধ বা খাটে না:
- সাৎ প্রত্যয়ের দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন: ভূমিসাৎ, ধূলিসাৎ, অকস্মাৎ।
- খাঁটি বাংলা ও বিদেশী শব্দে মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন: টেক্স, পুলিশ, জিনিস, মিসর, গ্রিস, স্টেশন, মুসাবিদা।
- অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্, খ্, প্, ফ্ সন্ধিযুক্ত হলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় দন্ত্য-স হয়। যেমন: পুরঃ + কার = পুরস্কার,ভাঃ+ কর = ভাস্কর, তিরঃ + কার = তিরস্কার, পরঃ+ পর= পরস্পর, স্বতঃ + ফূর্ত= স্বতঃস্ফূর্ত
- অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্, খ্, প্, ফ্ ছাড়াও ত থাকলেও স হতে পারে[তথ্যসূত্র প্রয়োজন], যেমন: মনঃ+ তাপ = মনস্তাপ, শিরঃ + ত্রাণ= শিরস্ত্রাণ
আরও দেখুন: