লিপির উদ্ভব ও বিকাশ

লিপির উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি আমাদের ভাষা ও শিক্ষা সিরিজের, ধ্বনিতত্ত্ব  বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।

লিপির উদ্ভব ও বিকাশ

 লিপির উদ্ভব ও বিকাশ

ধ্বনির লিখিত রূপই লিপি বা script। আমরা মুখে যে-সব ধ্বনি উচ্চারণ করি লিপি সে-সব ধ্বনির চিত্ররূপ। লিপি লিপি co আমরা চোখে দেখি, ধ্বনি আমরা কানে শুনি। সেজন্য লিপিকে দৃশ্যরূপ নিতে হয় আর ধ্বনিকে নিতে হয় শব্দরূপ । ধ্বনি abstract, concrete। ধ্বনি ক্ষণকালের আনন্দেই তৃপ্ত, লিপি চিরকালের অস্তিত্বে দৃঢ়। এই চিরকালের অস্তিত্বে মানুষ অমর হতে চায় বলেই সে তার মনের ভাবপ্রকাশের জন্যে বাহন খুঁজেছে। সে কথ্যভাষার অসম্পূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা বুঝলো।

সে দেখল কথ্যভাষায় সে একটা স্থানে এবং কালে ক্ষণকালের সম্রাট, কিন্তু সে তাতে তৃপ্ত নয়। সে স্থল, জল জয় করেছে; কালকেও জয় করতে চাইল। তখনই সে লিপির উদ্ভাবন করল। মানুষ যখন সবে সভ্য হয়েছে অর্থাৎ প্রায় দশ পনেরো হাজার বছর আগে, তখন তার জীবনের সর্বপ্রধান ঘটনা ছিল আহার সংগ্রহ করা। পশু এবং পশুশিকার ছিল তার দৈনন্দিন জীবনের প্রধান চিন্তা, পশুশিকার তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেই ঘটনাকেই স্থায়িত্ব দেবার জন্য তার মন ব্যাকুল হল।

[৩.৪] লিপির উদ্ভব ও বিকাশ | ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব | অধ্যায় ৩ | ভাষা ও শিক্ষা

 

যেখানে সে বাস করে, সে-পাহাড়ের গুহায় সে তখন সে ঘটনার স্থায়িরূপ দিতে চেষ্টা করল ছবি এঁকে। সে-সব ছবির অধিকাংশ জুড়ে আছে মানুষ, জন্তু, আর মানুষের জন্তু শিকার। তখনকার দিনের মানুষের বইয়ের পাতার কাজ করত গুহার দেয়াল এবং বইয়ের ছাপানো অক্ষরের কাজ করত সেই গুহার গায়ে আঁকা ছবিগুলো। এই ছবিগুলোই এখন পর্যন্ত মানুষের প্রাচীনতম লিপি।

আজকের দিনেও যেসব মানুষ সভ্যতার অনুন্নত স্তরে তারাও এভাবে তাদের জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোকে ছবির মধ্য দিয়ে স্থায়িত্ব দেয়। গাছে দাগ কেটে রেখে বয়স, পাহাড়ের গায়ে চিহ্ন দিয়ে কোনো ঘটনা বোঝানো-

এসবই তো আদিমতম লিপির স্বজাতি। উত্তর আমেরিকার যারা আদিম অধিবাসী— সেই রেড ইন্ডিয়ানদের এ-রকম ছবি এঁকে স্মরণীয় ঘটনা বোঝানো বা জানানোর পদ্ধতি তো আজ সর্বজনবিদিত লিপির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা যায় :

প্রথম স্তর | কুইপু (quipu) বা গ্রন্থিলিখন:

প্রথম স্তরে গ্রন্থিযুক্ত রঙিন দড়ির গুচ্ছের সাহায্যে কোনো ভাব বা ঘটনাকে বর্ণনা করা হতো। তার নাম কুইপু (quipu) বা গ্রন্থিলিখন। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর প্রাচীন অধিবাসীরা এ পদ্ধতিটি ব্যবহার করত।

দ্বিতীয় স্তর | চিত্রলিপি (pictogram) এবং ভাবলিপি (ideogram):

দ্বিতীয় স্তরে কোনো বস্তু বা ভাব বোঝাতে তার সম্পূর্ণ ছবি না দিয়ে শুধু সেটির রেখাচিত্র ব্যবহৃত হত। তার নাম চিত্রলিপি (pictogram) এবং ভাবলিপি (ideogram)। যেমন, বহন করা বোঝাতে মাথায়-বোঝা মানুষ, দিন বোঝাতে সূর্যের এবং রাত বোঝাতে চাঁদ ও তারার ছবি ইত্যাদি।

তৃতীয় স্তর | শব্দলিপি (phonogram):

তৃতীয় স্তরে মানুষ রেখাচিত্রের সাহায্যে কোনো বস্তু বা বিষয়-বোধক শব্দ নির্দেশ করতে থাকে। তাকে বলা হয় শব্দলিপি (phonogram) |

চতুর্থ স্তর | অক্ষরলিপি (syllabic script):

চতুর্থ স্তরে শব্দচিত্রের বা শব্দলিপির রেখা আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে সমস্ত ধ্বনিসমষ্টিকে না বুঝিয়ে শুধু প্রথম অক্ষরটিকে নির্দেশ করল। একে বলে অক্ষরলিপি (syllabic script)।

Capture 1 লিপির উদ্ভব ও বিকাশ

পঞ্চম স্তর | ধ্বনিলিপি (alphabetic script):

পঞ্চম স্তরে অক্ষরলিপি থেকে ধ্বনিলিপি (alphabetic script)। গ্রিক রোমান লিপি’ ধ্বনিমূলক। ভারতীয় লিপির কিছু ধ্বনিমূলক, কিছু অক্ষরমূলক। অ ধ্বনিমূলক কিন্তু গ (গ্ + অ) অক্ষরমূলক। তাতে ধ্বনি-সমষ্টির দ্যোতক আদ্য অক্ষরের একক প্রতীকই হল বর্ণ (letter)। বিভিন্ন ভাষার লিপিকে আজ আমরা যে চেহারায় দেখি তা একদিনে হয় নি।

এর উদ্ভব এবং বিকাশের কয়েকটি সুস্পষ্ট পর্যায় দেখা যায়, মানুষের বুদ্ধি ও সমাজ দুটোই এর পেছনে কাজ করেছে। আমরা আজকের সভ্যজগতে যেসমস্ত লিপি দেখি তা এসেছে চারটি অতি প্রাচীন লিপিচিত্র থেকে। মিশরীয় লিপিচিত্র থেকে এসেছে পরবর্তীকালের ইউরোপীয় এবং হিব্রু আরবি লিপিমালা। এই দুই শাখায় মিশরীয় লিপিচিত্র পরিবর্তিত হওয়ার মূলে আছেন সেকালের ফিনিসীয় বণিকেরা ।

তাঁরা মিশরীয় লিপিচিত্রকে নিজেদের ভাষার উপযোগী করে গ্রহণ করেন। এই পরিবর্তিত লিপিটির নাম হল ফিনিসীয় লিপি। ব্যবসায় বাণিজ্য করতে হলে এঁরা যেমন যেতেন ইউরোপে তেমনি আবার মধ্য এবং পশ্চিম এশিয়ায়। এভাবে এক শাখা থেকে হল ইউরোপীয় বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা এবং অন্য শাখা থেকে আরবি হিব্রু প্রভৃতি সেমিটিক বর্ণমালা। চৈনিক লিপিচিত্র থেকে এসেছে আধুনিক জাপানি ও চৈনিক লিপি। মেসোপটেমিয়ায় ছিল বাণমুখ লিপি। খ্রিস্টের জন্মের আগেই তা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। চতুর্থ লিপিপদ্ধতিটির নাম ভারতীয় লিপিচিত্র।

এর দুটি শাখা খরোষ্ঠী আর ব্রাহ্মী। খরোষ্ঠী লিপি পণ্ডিতদের মতে এসেছে আরবি হিব্রু প্রভৃতি সেমিটিক বর্ণমালা থেকে, আর ব্রাহ্মীলিপি কোথা থেকে এসেছে সে সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা একমত নন। বাংলা লিপি বাংলা ভাষার নিজস্ব লিপি। কুটিল লিপি থেকে এর উদ্ভব। কুটিল লিপি আবার ব্রাহ্মী লিপির একটি বিবর্তিত রূপ। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে যে লিপি প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, তার নাম ‘ব্রাহ্মী লিপি’। মহারাজ অশোকের শী রা মে ণ রা ব ণ ব ধঃ সী তা বি বা হঃ অনুশাসনে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দ) ওই লিপি পাওয়া যায়।

প্রাচীন কালে সংস্কৃত ও প্রাকৃত উভয় ভাষাই এই লিপি দিয়ে লেখা হত। অশোক এবং মৌর্যবংশীয় রাজাদের আগেকার কালের এমন আর কোনো লেখা পাওয়া যায় না, যার পাঠোদ্ধার করতে  দ্বাদশ শতকের বাংলা লিপি তাহারা বেশ্বাস দায় ন্যায় চামচাম মিরাস পায়পাতা! তাহার নগরে বসি দামন্যায় চাস চসি নিবাস পুরুষ পাঁচসাত ৷ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের প্রাচীনতম পুথি (ষোড়শ শতক) আমরা সমর্থ হয়েছি। খুব সম্ভব এই ব্রাহ্মী লিপিই হচ্ছে ভারতের আর্য-ভাষা সংস্কৃত প্রভৃতির আদি বা প্রাচীনতম লিপি। ব্রাহ্মী লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে ঠিকভাবে জানা যায় নি।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তবে অনেক পণ্ডিত বিশ্বাস করতেন এটি প্রাচীন ফিনিসিয়ার লিপি থেকে উদ্ভূত। এখনকার সময়ে কেউ কেউ মনে করেন, সিন্ধুদেশে ও দক্ষিণ-পাঞ্জাবে মহেন-জো- দাড়ো ও হরপ্পায় প্রাচীন ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগের যে লিপি পাওয়া গিয়েছে, তা থেকে ব্রাহ্মী লিপি উদ্ভূত হয়েছে। ব্রাহ্মী লিপি সরল, বর্ণের মাথায় মাত্রা-রেখা নেই; ব্যঞ্জন-বর্ণের গায়ে প্রভৃতির অনুরূপ স্বরচিহ্ন লাগানো হত। কতকগুলো ব্রাহ্মী বর্ণ এই প্রকারের :

‘ব্রাহ্মী লিপির ক্রমপরিবর্তনের ফলে, পরবর্তী যুগে, ভারতের বিভিন্ন অংশে নানা প্রাদেশিক লিপির উদ্ভব হয়, এবং আধুনিক ভারতীয় লিপি— যেমন, দেবনাগরী ও তার বিকারে কায়থী ও গুজরাটি, নেওয়ারি, বাঙ্গালা, মৈথিলি, ওড়িয়া, শারদা ইত্যাদি এবং ভারতের বাইরের প্রাচীন মধ্য-এশিয়ার কতকগুলো ভাষার লিপির উদ্ভব হয়। ’৩ “ব্রাহ্মী লিপির বিবর্তনের ইতিহাসে এর পরবর্তী স্তর কুটিল লিপি। কোনো রাজবংশের প্রভাব ছাড়াই এ লিপি ষষ্ঠ থেকে নবম খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল।

এ লিপির অক্ষর ও স্বরের মাত্রা অনেকটা কুটিলাকৃতির বলেই সম্ভবত এর নাম হয়েছে কুটিল লিপি। ভারতবর্ষের প্রায় সকল আধুনিক লিপির উৎস এই কুটিল লিপি। কুটিল লিপির উত্তর ভারতীয় কুটিল লিপির পি 3 উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় রূপ থেকে দেবনাগরী এবং পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকে অর্থাৎ মগধ অঞ্চলের কুটিল লিপি থেকে বাংলা লিপির উৎপত্তি হয়। খ্রিস্টাব্দ পূর্বাঞ্চলীয় কুটিল লিপির বিবর্তন শুরু হয় এবং এর বর্ণ আধুনিক বাংলা বর্ণের আকারে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরিত বর্ণমালার ব্যবহার দেখা যায় দশম শতকে ফলকে এভাবে বিনায়ক পালের তাম্রফলকে।

এভাবে তা গুর্জর শাসনামলে তদানীন্তন বাংলাদেশে প্রবেশ লাভ করে। পরবর্তীকালে এই বর্ণমালা স্বাধীনভাবে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে দশম যায় প্রথম মহীপালের শতকের শেষভাগে মূল বাংলা বর্ণমালায় পরিণত হয়। এই বর্ণমালার প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় প্রথম (৯৭৫-১০২৬) বাণগড় দানপত্রে এবং কম্পোজের রাজা নরপালদেবের (১০৩৬-১০৫৩) ইর্দার দানপত্রে। দ্বাদশ শতকের শেষভাগে এই বর্ণমালা আরও মধ্য প্রায় বর্তমান বর্ণমালার আকার ধারণ করে। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এবং প এবং পঞ্চদশ শতকের ‘বোধিচর্যারতার’ গ্রন্থে বাংলা লিপির পূর্ণ বিকাশ লক্ষ করা যায়। লিপি এক . বাঙলা লিপি আ আ তারপর কালের প্রবাহে রূপের বদল হয়েছে।

‘এখন যে- ধ্বনিগুলো আছে বাংলা ভাষায়, হাজার বছর আগে এখন যেভাবে এমনভাবে উচ্চারিত হত না। একেবারে ভিন্নভাবে যে উচ্চারিত হত, তাও নয়। প্রত্যেক যুগের মানুষ এ একইভাবে তাদের ভাষার ধ্বনি উচ্চারণ করে না। বাঙালিরাও করে নি। তাতেই বদলে গেছে বাংলা ভাষার ধ্বনি। বাংলার মূলে রয়েছে আর্যভাষা। তাতে অনেকগুলো ধ্বনি ছিল। স্বরধ্বনি ছিল : অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋ,। ছিল অনেকগুলো ব্যঞ্জনধ্বনি : ক, খ, গ, ঘ, ঙ; ‘চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ভ, ম, য, র, ল, ল [মূর্ধন্য-ল], হ্ল [মহাপ্রাণ- ল], ← [অন্তঃস্থ ব], শ, ষ, স, হ, ং, ঃ।

এ ধ্বনিগুলোই  বাংলা লিপির উৎপত্তি ও বিবর্তনতার অভা আছে বাংলা ভাষায়। তবে সবগুলো নেই। এগুলোর কয়েকটি লোপ পেয়েছে বাংলা থেকে। আবার কয়েকটি জন্ম নিয়েছে। বাংলা ভাষার প্রথম ধ্বনি ‘অ’। হাজার বছর আগে, ‘চর্যাপদ’-এ এই ‘অ’ অবিকল এমন ছিল না। উচ্চারণ আজকের উচ্চারণের মতো ছিল না। খুব সহজে বলা যায় তখন ‘অ’ ছিল অনেকটা আজকের ‘আ’–র অনেক কাছাকাছি। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় ‘অ’ ছিল হ্রস্ব-আ। পুরোনো বাংলা ভাষায়ও অনেকটা তাই ছিল।

এই ‘অ’ যে অনেকটা ‘আ’–র কাছাকাছি ছিল তার প্রমাণ পাই ‘চর্যাপদ’-এ। ‘চর্যাপদ’-এর বিভিন্ন শব্দের আদিতে যেখানে জোর পড়েছে, সেখানেই মাঝে মাঝে বিপর্যয় ঘটেছে ‘অ’ এবং ‘আ’-র। পাওয়া যায় ‘অইস’ আর ‘আইস’; ‘কবালী’ আর ‘কাবালী’, ‘সমাঅ’ আর ‘সামাঅ’ প্রভৃতি শব্দ। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’- ’-এও ‘অ’ অনেকটা ‘আ’-র মতোই ছিল। তাই পাই ‘আকারণ’, ‘আচেতন’, ‘আতিশয়’, ‘আতী’ প্রভৃতি শব্দ ৷

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিশ্বরূপ সেনের (রাজত্বকাল ১২০৩-১২২৫ খ্রি.) তামার ফলকে খোদিত বাংলা বর্ণমালার প্রতিলিপি । (খ) রাজা গণেশের (রাজত্বকাল ১৪১৫-১৪১৭ খ্রি.) আমলে মুদ্রায় অঙ্কিত বাংলা বর্ণমালার প্রতিলিপি। (গ) সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের (রাজত্বকাল ১৫৩৩-১৫৩৮ খ্রি.) আমলে পাথরে খোদিত বাংলা বর্ণমালা । ইউরোপে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি ছাপাখানা এল। এর প্রায় দু-শতক পরে ১৬৬৭ সালে আমস্টারডাম থেকে প্রকাশিত একটি বইতে মুদ্রিত হয়েছে বাংলা লিপির কিছু নমুনা। সে বইয়ের সংক্ষিপ্ত নাম ‘চায়না ইলাস্ক্রেতা’।

লেখক আতানাসি উস কির্থে। আজকের তুলনায় খুবই অস্পষ্ট, ছাপা ব্লকে, গুটিকয় বাংলা অক্ষরকে বলা হয়েছিল “আলফাবেতুম বেনগালিকুম’ (Alphabetum Bengalicum) বা বাংলা অক্ষরের নমুনা। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মুদ্রণযন্ত্রে বাংলা হরফের প্রথম নজির এটিই। তথ্যটা আশ্চর্য এজন্য যে সুদূর আমস্টারডামে প্রথম যন্ত্রস্থ হল বাংলা লিপি। এরপর অন্তত সাতটি বইয়ে, ইউরোপে, ছাপা ব্লকে বাংলা বর্ণমালার নমুনা মুদ্রিত হয়েছে।

 

[৩.৪] লিপির উদ্ভব ও বিকাশ | ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব | অধ্যায় ৩ | ভাষা ও শিক্ষা

 

এর মধ্যে ১৭৪৩ সালে হল্যান্ডের লাইডেন থেকে ডেভিড মিল প্রকাশিত লাতিন গ্রন্থ ‘দিসসেরতিও সেলেক্তা’ (Dissertio Selecta) -এ ব্যাকরণ আলোচনা অংশে বাংলা লিপির যে নমুনা সংযুক্ত করা হয়েছে তা বেশ পরিষ্কার। বাংলা লিপির এ-সব নমুনা, দেখতে এক-একটি এক-এক রকম। সব লিপিকরের হাতের লেখা এক রকম ছিল না, ফলে তার অনুকরণে তৈরি ব্লক-প্লেটে মুদ্রিত লিপির চেহারা বিভিন্ন হয়ে যেত। বাংলা বর্ণমালার ইউনিফরমটি বা একচেহারা বা ছাঁদের যে শৃঙ্খলা, তার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হুগলিতে ছাপা হ্যালহেডের A Grammar of the Bengal Language নামক গ্রন্থটি।

১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ওই ব্যাকরণ বই ছাপাতে ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলা ধাতব অক্ষর (movable letters)। এগুলো তৈরি করেন চার্লস উইলকিন্স। তাঁর সহকারী ছিলেন ইংরেজ জোসেফ শেফার্ড এবং বাঙালি পঞ্চানন কর্মকার। সে অক্ষরগুলোও কিন্তু হুবহু আজকের মতো নয়। তবু এঁদের প্রচেষ্টাতেই বিভিন্ন সময়ে রূপ পালটানো বাংলা বর্ণমালা প্রায় সুস্থির চেহারা পায়। এর পর উনিশ শতকে প্রায় সর্বত্র মুদ্রণ পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে যায়। ফলে হস্তলিখিত পুথির ব্যবহার হ্রাস পায় এবং বাংলা লিপির বিবর্তন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলা লিপি একটি স্থায়ি রূপ লাভ করে ৷

‘কিন্তু কিছুই চিরস্থির অবিনশ্বর নয় পৃথিবীতে। বাংলা ভাষাও নয়। হাজার বছরে পৃথিবীর কতো ভাষা ম’রে গেছে, হারিয়ে গেছে। বহু ভাষা শুধু লাশের মতো রক্ষিত হয়ে আছে কাগজের কফিনে। কোথায় আজ ভাষার রাজারা, গ্রিক- লাতিন-সংস্কৃত? কোথায় পালি-প্রাকৃত? ওই সব ভাষা আজ শুধু পণ্ডিতদের আনন্দ। কোনো মানুষের বুক থেকে মুখ থেকে সেগুলো মুখর হয়ে ওঠে না। কিন্তু বাংলা জীবিত ও জীবন্ত ভাষা, মুখর হয়ে ওঠে বাঙালির মুখ থেকে। বুক থেকে। রক্ত ও অস্তিত্ব থেকে। জন্মের পর কেটে গেছে তারও জীবনের হাজার বছরেরও বেশি সময়। এতো বছর ধ’রে স্থির অবিচল থাকে নি বাংলা ভাষা।

নানাভাবে বদলে গেছে তার রূপ। বদলে গেছে তার স্বর। কালেকালান্তরে নতুন থেকে নতুনতর হয়ে উঠেছে বাংলা।” বর্তমানে কম্পিউটারের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বিজয়, সুলেখা, রূপসী, আনন্দ, সুতন্বী প্রভৃতি চমৎকার সব সফটওয়্যার নকশায় বাংলা বর্ণমালা দিনে দিনে অপরূপ হচ্ছে।

 

সূত্র:

  • লিপির উদ্ভব ও বিকাশ | ধ্বনিমূল ও ধ্বনির শ্রেণিবিভাগ | ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব | অধ্যায় ৩ | ভাষা ও শিক্ষা

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment