লালসালু উপন্যাস – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [ ১৮০১]

লালসালু উপন্যাস বাঙালি লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অভিষেক উপন্যাস। ১৯৪৮ সালে রচিত এবং প্রকাশিত উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী সৃষ্টিকর্ম হিসেবে বিবেচিত। এর পটভূমি ১৯৪০ কিংবা ১৯৫০ দশকের বাংলাদেশের গ্রামসমাজ হলেও এর প্রভাব বা বিস্তার কালোত্তীর্ণ। ধর্মভীরু গ্রামীণ মুসলিম সমাজে সাধারণ মানুষের সরলতাকে কেন্দ্র করে এক কল্পিত মাজারকে পুঁজি করে চতুর ধর্মব্যবসায়ী কীভাবে প্রতিষ্ঠা পায়, ধর্মকে ব্যবসার উপাদানরূপে ব্যবহার করে কিভাবে স্বার্থহাসিল করে তাই চিত্রিত হয়েছে এ উপন্যাসে। ওয়ালীউল্লাহ এই উপন্যাসের জন্যে ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। উপন্যাসটি উর্দু, ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান ও চেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।

 

লালসালু উপন্যাস - সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

 

লালসালু – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ .PDF Download

Table of Contents

লালসালু উপন্যাস – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

 

লেখক পরিচিতি :

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চট্টগ্রাম জেলার এক সম্ভ্রান্তও শিক্ষিত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আহম্মদউল্লাহ ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। ময়মনসিংহ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের চাকুরিতে নিযুক্ত থাকার সময় তিনি পরলোক গমন করেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অল্প বয়সেই মাতৃহীন হন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতার বিভিন্ন কর্মস্থলে তাঁর স্কুল শিক্ষা সম্পন্ন হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি আনন্দমোহন কলেজ থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হন। তারপর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়ার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু এম এ ডিগ্রী নেওয়ার আগেই ১৯৪৫ সালে তিনি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দি স্টেট্সম্যান’ এর সাংবাদিক হন এবং সাংবাদিকতার সূত্রেই কলিকাতার সাহিত্যিক মহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তখন থেকেই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর রচনা প্রকাশিত হতে থাকে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি ঢাকায় এসে বেতার কেন্দ্রে সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫০ এ তিনি করাচী বেতারে বার্তা সম্পাদক হন এবং তারপর তিনি কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োজিত হন। প্রথমে নয়াদিল্লীতে তারপর ক্রমান্বয়ে ঢাকা, সিডনী, করাচী জাকার্তা, বন, লন্ডন এবং প্যারিসে তিনি চাকরি করেন। তাঁর শেষ কর্মস্থল প্যারিস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করার জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের চাকরি ত্যাগ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই ১৯৭১ সালের অক্টোবরে তিনি প্যারিসে পরলোক গমন করেন।

রচিত গ্রন্থের সংখ্যা কম হলেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যকর্ম সমগ্র বাংলা সাহিত্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। বিশেষত তাঁর গল্প এবং উপন্যাসে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বহিলোক এবং অন্তলোকের যে সূক্ষ্ম ও গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। কুসংস্কার ও অন্ধ ধর্মবিশ্বাসে আচ্ছন্ন, বিপর্যস্ত, আশাহীন ও মুক্তপ্রায় সমাজ জীবনের চিত্র যেমন এঁকেছেন একদিকে, তেমনি অন্যদিকে মানুষের মনের ভেতরকার লোভ, প্রতারণা, ভীতি, ঈর্ষা প্রভৃতি প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিজ্ঞানীর মতোই উদঘাটিত করেছেন। শুধু উপভোগ্য মজাদার গল্প রচনা তাঁর অভীষ্ট কখনোই ছিল না। তিনি মানব জীবনের মৌলিক সমস্যাগুলিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘নয়ন চারা’ ও ‘দুই তীর’ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৪৬ ও ১৯৬৫ সালে এবং উপন্যাস ‘লালসালু’ ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও কাঁদো নদী কাঁদো’র প্রকাশ কাল যথাক্রমে ১৯৪৮, ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ

নিরীক্ষামূলক তিনখানি নাটকও লিখেছেন সেগুলি হল ‘বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ ও সুড়ঙ্গ।

 

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px White লালসালু উপন্যাস - সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [ ১৮০১]

 

লেখক পরিচিতি বিষয়ক তথ্য সামারি :

  • পিতা- সৈয়দ আহমদউল্লাহ।
  • জন্ম- ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট, চট্টগ্রামে।
  • মৃত্যু- ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর, প্যারিসে।
  • তিনি বাংলা কথা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার।
  • তিনি বাংলাদেশের কথা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পথিকৃৎ।
  • কর্মক্ষেত্রে নয়াদিলিগু, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে দায়িত্ব পালন শেষে মৃত্যু পর্যন্ত প্যারিসে কর্মরত ছিলেন।
  • প্যারিসে অবস্থান কালে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করেন।
  • তাঁর প্রথম গ্রল্পগ্রন্থ- নয়নচারা (১৯৫১)।
  • তাঁর প্রথম উপন্যাস- লালসালু (১৯৪৮)।
  • তাঁর স্ত্রী- ফরাসি রমণী অ্যান মারি।
  • তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস লালসালু ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় অন–দিত হয়।

লেখকের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম:

  • উপন্যাসঃ লালসালু (১৯৪৮, চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) ও কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)।

ছন্দে ছন্দে উপন্যাস:

  • বেলা লাল সালু কাপড় পড়ে চাঁদের অমাবস্যায় রাতে কাঁদতে কাঁদতে নদীর পাড়ে যায়।

ছন্দে ছন্দে নাটক:

  • নাটকঃবহিপীরসুড়ঙ্গ পথে তরঙ্গ ভঙ্গ করল।
  • গল্পগ্রন্থঃ বহিপীর (১৯৬৫), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৬) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪)।

 

 

 

 

 

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px Dark লালসালু উপন্যাস - সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ [ ১৮০১]

 

লালসালুর উপন্যাস:

লালসালুর প্রকাশতথ্য :

‘লালসালু’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে। ঢাকার কমরেড পাবলিশার্স এটি প্রকাশ করে। প্রকাশক মুহাম্মদ আতাউল্লাহ। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার কথাবিতান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির ষষ্ঠ সংষ্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই উপন্যাসটির দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে মধ্যেই উপন্যাসটির দশম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। নওরোজ কিতাবিস্তান ‘লালসালু’ উপন্যাসের দশম মুদ্রণ প্রকাশ করে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ‘লালসালু’ উপন্যাসের উর্দু অনুবাদ করাচি থেকে প্রকাশিত হয় ‘Lal Shalu’ নামে। অনুবাদক ছিলেন কলিমুল্লাহ। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’র ফরাসি অনুবাদ। ‘L Arbre sans racines’ নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি অনুবাদ করেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সহধর্মিণী অ্যান মারি থিবো। প্যারিস থেকে এ অনুবাদটি প্রকাশ করে Editions du Seuil প্রকাশনী। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এ অনুবাদটির পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘লালসালু’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। ‘Tree without Roots’ নামে লণ্ডনের Chatto and Windus Ltd. এটি প্রকাশ করেন। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিজেই এই ইংরেজি অনুবাদ করেন।

 

সাহিত্যের রূপশ্রেণি : উপন্যাস

উপন্যাসে আধুনিক কালের একটি বিশিষ্ট শিল্পরূপ। উপন্যাসের আক্ষরিক অর্থ হলো উপযুক্ত বা বিশেষরূপে স্থাপন। অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে কাহিনী রূপ একটি উপাদানকে বিবৃত করার বিশেষ কৌশল, পদ্ধতি বা রীতি। ‘উপন্যাস’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হড়াবষ। উপন্যাস হচ্ছে গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনী যার ভেতর দিয়ে মানব মানবীর জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়ে থাকে। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক এর মতে, কমপক্ষে ৫০ হাজার শব্দ দিয়ে উপন্যাস রচিত হওয়া উচিত।

 

লালসালু উপন্যাসের নামকরণের তাৎপর্য:

লালসালু হচ্ছে লাল রঙের কাপড়। এমনিতে লাল কাপড়ের তেমন কোনো মহিমা নেই। তবে এটি খুব উজ্জ্বল রং হওয়ায় একে বিশেষ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো যায়। বাংলাদেশের এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী যুগ-যুগ ধরে লাল রংটিকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে আসছে। কবরের উপর লাল কাপড় বিছিয়ে দিলে কবরের গুরুত্ব অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। তখন তা আর সাধারণ কবরে সীমাবদ্ধ থাকে না_মাজারে পরিণত হয়। কবরটি তখন মানুষের ভক্তিপ্রীতির আকর্ষণ হয়ে দাড়ায়। এ ধরনের কবরে মানুষ প্রতিনিয়ত ভিড় জমায়, জেয়ারত করে, দোয়া দরুদ পড়ে এবং শিরনি দেয়। টাকা পয়সা দেয়। এভাবে মাজারটি হয়ে দাড়ায় পরলোক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু। এই মাজার বাংলাদেশের লোকজীবনে অসামান্য প্রভাব ফেলে। এখানেই ‌লালসালু নামকরণের তৎপর্য ইঙ্গিতময় হয়ে ওঠে। এর সাথে পীর-ফকিরদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

 

‘লালসালু’ উপন্যাসের সমাজবাস্তবতা :

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’। ‘লালসালু’ একটি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। এর বিষয় : যুগ যুগ ধরে শেকড়গাড়া কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাঙ্খার দ্ব›দ্ব। গ্রামবাসীর সরলতা ও ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী মজিদ প্রতারণাজাল বিস্তারের মাধ্যমে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তারই বিবরণে সমৃদ্ধ ‘লালসালু’ উপন্যাস। ‘লালসালু’র প্রধান উপাদান সমাজ বাস্তবতা। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানবতাবাদী লেখক। মানব মুক্তির স্বাভাবিক আকাঙ্খা তাঁর সাহিত্যসাধনার কেন্দ্রে সক্রিয়।
চরিত্র সৃষ্টি

এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। উপন্যাসের সকল ঘটনার নিয়ন্ত্রক মজিদ। মজিদ একটি প্রতীকী চরিত্র-কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক। মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা ‘লালসালু’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র। নিঃসন্তান মজিদের সন্তান কামনাসূত্রে তার দ্বিতীয় স্ত্রীরূপে আগমন ঘটে জমিলার।

 

‘লালসালু’ উপন্যাসের চরিত্র:

মজিদ

উপন্যাসের মূল চরিত্র। শীর্ণদেহ। মোদাচ্ছের পীরের মাজার প্রতিষ্ঠা করে মহব্বতনগর গ্রামে। কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক। মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর সাথে স্বার্থের গাঁটছড়া বেধে তাহের কাদেরের বাবাকে পাগল বানিয়ে নিখোঁজ করে। আক্কাস আলীর স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নষ্ট করে তাকে গ্রামছাড়া করে। সে নিঃসঙ্গ ভণ্ড, ধর্মব্যবসায়ী, স্বার্থপর ও পোষক প্রকৃতির।

রহিমা:

মজিদের প্রথম স্ত্রী। মহব্বতনগর গ্রামের মেয়ে। স্বামীর একান্ত অনুগত এবং স্বামীর গৌরবে গর্বিত। লম্বা চওরা শারীরিক শক্তি সম্পন্ন।
লেখকের মতে, “রহিমা ঠান্ডা, ভীতু মানুষ”।, তার মন স্বামীর তুলনায় বিপরীতমুখী। খোদাকে ভয় পায়, মাজারকে ভয় পায়।

জমিলা:

মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী। রয়সে নিতান্ত কিশোরী। গরিব ঘরের মেয়ে। রহিমা তার কাছে মাতৃসম বড়বোন বলে বিবেচিত। রহিমার সামান্য শাসনে ও তার চোখে জল আসে। স্বামী এবং স্বামীর বয়স নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। মজিদকে প্রথম দেখে জমিলা তার ভাবী শ্বশুর মনে করে। মজিদের মুখে থুথু দিয়েছিল। মাজার, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের বিপরীত। সন্ধ্যা না হতেই ঘুমানোর অভ্যাস তার। জায়নামাযে সিজদারত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে।

খালেক ব্যাপারী:

সামন্তবাদী সমাজের প্রতিভূ। মহব্বতনগর গ্রামের মাতব্বর। মাতব্বর হলেও তিনি শান্তিপ্রিয়, ধর্মপ্রাণ ও নরম মনের মানুষ। গ্রামের সকল উৎসব ও অনুষ্ঠান তার নির্দেশে হয়। তার স্ত্রী দুজন। মজিদের নির্দেশে তেরো বছরের দাম্পত্য জীবন ত্যাগ প–র্বক তার প্রথম বউকে তালাক দেয়।

দুদু মিঞা:

সাত ছেলের বাপ। আধাপাকা মাথা। মজিদের প্রশ্নে তার মুখে ছিল লজ্জার হাসি। থতমত খেয়ে হাসি বন্ধ করে। গাধার মতো পিঠে-ঘাড়ে সমান। তার উক্তি “আমি গরিব মুরুক্ষ মানুষ।”

মোল্লা শেখ:

মোল্লা। তাহের কাদেরের মায়ের জানাযা পড়াবে।

আমেনা:

খালেক ব্যাপারীর ১ম পক্ষের বিবি। তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়। বর্তমান বয়স ৩০।

সতীন তানু বিবি:

আওয়ালপুর পীরের পানি পড়া আনতে বলেন ব্যাপারীকে। তাহের কাদের বাপ।  নামবিহীন এ চরিত্রটি বাদরাগী ও জেদি। তার তিন ছেলে, একমেয়ে (হাসুনির মা)।

বৃদ্ধ ব্যক্তি :

মজিদের আধ্যাতিœক শক্তিতে অবিশ্বাসী। বৌ এর সাথে সবসময় ঝগড়া করে। বৌকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। বৌও তাকে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল দেয়। তার তিন ছেলে তাহের, কাদের, রতন। এককালে বুদ্ধিমান লোক ছিল।

ধলা মিয়া :

নির্বোধ ও অলস প্রকৃতির। খালেক ব্যাপারীর ২য় স্ত্রী তনু বিবির বড় ভাই।

হাসুনির মা:

তাহের কাদেরের বোন। এ উপন্যাসের দুস্থ, দরিদ্র, বিধবা নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর বাবার বাড়িতে থাকে। বাড়ি বাড়ি ধান ভানার কাজ করে। তার নিকা করতে আপত্তি। শ্বশুরবাড়িতে সে যেতে চায় না। তার ভাষায়, “তারা মনুষ্যি না।” ঝড় এল হৈ চৈ করার অভ্যাস।

মতলব খাঁ :

ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট।

দুদু মিয়া:

গ্রামের জনতা।

আক্কাস মিয়া:

গ্রামের জনতা।

 

লালসালু উপন্যাসের সারসংক্ষেপ:

উপন্যাসের মূল চরিত্র মজিদ নামক এক প্রতারক। স্বার্থান্বেষণে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সে উপনীত হয় মহব্বতপুর গ্রামে। গ্রামের মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে সে ঘাঁটি গাড়ে। মহব্বতনগর গ্রামে বাঁশঝাড়সংলগ্ন একটি কবর‌ আছে। কবরটি কার তা গ্রামবাসীর জানা ছিল না। লোক জমায়েত করে মজিদ প্রচার করে কবরটি এক ‘মোদাচ্ছের’ (নাম না জানা) পীরের এবং স্বপ্নাদেশে সেই মাজার তদারকির জন্যই এ গ্রামে তার আগমন। মাজিদের প্রচারের সহজ সরল গ্রামবাসী প্রতারিত হয়। ফলে জঙ্গলাকীর্ণ কবরটি পরিষ্কার করে ঝালরওয়ালা লালসালুতে ঢেকে দেওয়া হয়। যথারীতি সেখানে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বলে; কবরটি অচিরেই পরিণত হয় মাজারে, মজিদ হয় সে মাজারের খাদেম। গ্রামবাসীর মাজারকেন্দ্রীক ভয়-ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে মজিদ।

কৃপাপ্রার্থীরা মাজারটিতে টাকা-পয়সা দান করতে থাকেন। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মজিদ ঘরবাড়ি, জমি-জিরাতের মালিক হয়ে বসে। মাজারটি পরিণত হয় গ্রামজুড়ে মজিদের আধিপত্য বিস্তারের প্রধান কেন্দ্রে। তার ভেল্কিবাজি গ্রামবাসীর কাছে তাকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলে। ফলে ধর্মকর্মের পাশাপাশি সে হয়ে ওঠে গ্রামের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তি। এ প্রভাব বজায় রাখতেও সে সচেষ্ট হয়। তার চক্রান্তেই তাহের ও কাদেরের বাপ নিরুদ্দেশ হয়। এছাড়া খালেক ব্যাপারীর প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেওয়ানো, যুবক আব্বাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার আয়োজনকে বিদ্রূপ করা ও তাকে অধার্মিক হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রামছাড়া করা প্রভূত কাজের মধ্য দিয়ে মজিদ গ্রামে নিজের প্রভাব নিরঙ্কুশ করে।

মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা। স্বামী মজিদের প্রতিটি কথাতার কাছে অবশ্য পালনীয়। মজিদের ধূর্ততা, শঠতা, ভণ্ডামি তার চোখে পড়ে না। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা একেবারেই বিপরীত। প্রথম থেকেই মজিদকে জামিলা স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারে নি। মজিদ জমিলাকে শাসন করার চেষ্টা করে; কিন্তু পারে না। জমিলার থুথু নিক্ষেপের ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয় সে। জমিলাকে মাজার ঘরের অন্ধকারে খুঁটিতে বেঁধে রাখে। রহীমার হৃদয় ব্যাকুল হয়। মজিদের প্রতি যে রহীমার বিশ্বাস ছিল পর্বতের মতো অটল সে রহীমাই বিদ্রোহ করে।

একসময় শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে গ্রামবাসী মজিদের কাছে প্রতিকার চায়। কিন্তু মজিদের কাছ থেকে ধমক ছাড়া তখন আসে না কিছুই। পরিশেষে বিপর্যস্ত পারিবারিক জীবন, বিধ্বস্ত ফসলের ক্ষেত এবং দরিদ্র গ্রামবাসীর হাহাকারের মধ্যদিয়ে লালসালু উপন্যাসের কাহিনী শেষ হয়।

 

 

লালসালু উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি:

১। “কলমা জানো মিঞা?” মজিদ কাকে এ কথা জিজ্ঞেস করে – সাত ছেলের বাপ দুদু মিঞাকে।

২। দুদু মিঞার সাথে এসেছিল – এক ছেলে।

৩। “কলমা জানস না ব্যাটা” উক্তিটি – খালেক ব্যাপারীর।

৪। খালেক ব্যাপারী গ্রামে কী দিয়েছে – একটি মক্তব।

৫। মজিদের শক্তির মূল উৎস – মাজার।

৬। মজিদের শক্তি প্রতিফলিত হয় – রহিমার উপর।

৭। কেঁপে ওঠা মোমবাতির আলোয় ঝলমল করে ওঠে – রূপালি ঝালর

৮। কার বাপ মরণযোগ যন্ত্রণা পাচ্ছে – ছুনুর বাপ।

৯। কে পক্ষাঘাতে কষ্ট পাচ্ছে – খেতানির মা।

১০। কয় গ্রাম পড়ে বড় নদী – চার গ্রাম

১১। “শরীলে রং ধরছে ক্যান, নিকা করবি নাকি?” উক্তিটি – তাহেরের।

১২। কে এককালে উড়ূনি মেয়ে ছিল – বুড়ি।

১৩। কোনটি বড় ভয়ানক বস্তু – মানুষের রসনা।

১৪। কত হিজরিতে প্রিয় পয়গম্বরের বানি এল – ৫ম।

১৫। নবীজি (স.) কার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রত্যাবর্তনকালে বিবি আয়েশা (রা.) দলচ্যুত হয়ে যায়-মুখস্থ লিখ-এর।

১৬। বিবি আয়েশাকে খুঁজে পায় – এক নওজোয়ান সিপাই।

১৭। কারা হযরতের বিবি নামে কুৎসা রটাতে লাগল – হযরতের পেয়ারা।

১৮। মজিদ বুড়োকে, মাজারে কত পয়সার সিন্নি দিতে বলেছে – পাঁচ পইসার।

১৯। ঝুঁটিওয়ালা মুরগিটার রং – লাল।

২০। মতিগঞ্জের সড়ক ধরে তিন ক্রোশ দ–রে গঞ্জে গিয়েও তালাশ করা হয় কাকে – বুড়োকে

২১। মজিদ কতৃক হাসুনির মাকে দেয়া শাড়িটির – বেগুনি রং, কালো পাড়।

২২। শুকতারা জ্বলমল করছে – পশ্চিম আকাশে।

২৩। ইউনিয়ান বোর্ডের প্রেসিডেন্ট কে – মতলুব খঁ।

২৪। রাত যত গভীর হয় আগুন তত কী হয়ে ওঠে – মাথা

২৫। আওয়ালপুর পীরের প্রধান মুরিদ – মতলুব খঁ।

২৬। “সোহবতে সোয়ালে তুরা সোয়ালে কুনাদ” অর্থ কী – সুসঙ্গ মানুষকে ভালো করে।

২৭। ‘লালসালু’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় – ১৯৪৮ সালে

২৮। এই উপন্যাসটি উর্দু অনুবাদ প্রকাশিত হয় – করাচি থেকে (‘খধষ ঝযধষঁ’নামে)

২৯। ‘লালসালু’ উপন্যাসটির উর্দু অনুবাদক – কলিমুল্লাহ

৩০। লালসালু কোন ধরনের উপন্যাস – সামাজিক সমস্যাম–লক উপন্যাস

৩১। কোনটির মত দীর্ঘ রেল গাড়িটির ধৈর্যের সীমা নেই – অজগরের

৩২। দুর জঙ্গলে কী ডাকে – বাঘ

৩৩। নিরাক পড়েছে কখন – শ্রাবণের শেষাশেষি

৩৪। দিগন্ত পর্যন্ত স্থির হয়ে আছে – তামাটে নীলাভ রং

৩৫। বিস্তৃত ধানক্ষেতের এক প্রান্তে কারা আছে – তাহের-কাদের

৩৬। একসময় ঘুরতে ঘুরতে তাহেরদের নৌকা কোন সড়কটার কাছে এসে পড়ে – মতিগঞ্জের

৩৭। নিরাকপড়া আকাশ কাকে পাথরের ম–র্তিতে রূপান্তরিত করেছে – অপরিচিত লোকটিকে (মজিদকে)

৩৮। অপরিচিত লোকটিকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে দেখে কারা – তাহের-কাদের

৩৯। মোনাজাত শেষ করে অপরিচিত লোকটি কোন দিকে হাটতে থাকে – উত্তর দিকে

৪০। উত্তরদিকে খানিকটা এগিয়ে কোন গ্রাম- মহব্বতনগর

৪১। মহব্বতনগরে মজিদের প্রবেশটা কেমন – নাটকীয়

৪২। সলেমাননের বাপ কোন ধরনের রোগী – হাঁপানী

৪৩। মজিদ ছিল – গারো পাহাড়ে, মধুপুর থেকে ৩ দিনের পথ।

৪৪। “অমনি করে হাঁটতে নাই।” কে, কাকে বলল – মজিদ, রহিমাকে।

৪৫। খোদা তা’আলার রহস্যময় দিগন্ত কার অন্তরে বিদ্যুতের মতো থেকে ঝিলিক দিয়ে ওঠে – রহিমার।

৪৬। কোন মাসের শীত খেলা মাঠে হাড় কাঁপায় – অগ্রাহায়নের।

৪৭। মাছের পিঠের মতো কবরটি কী দ্বারা আবৃত্ত হলো – ঝালরওয়ালা সালু কাপড় দ্বারা।

৪৮। পানি সরে এলেও কোন মাসে কচুরিপানা জড়িয়ে থাকে জমিতে – কার্তিক মাসে।

৪৯। কোচ বিদ্ধ হয়ে নিহত হয় কে – ছমিরুদ্দিন।

৫০। সালু কাপড়ে ঢাকা কবরটি কেমন – রহস্যময়।

৫১। গোস্তায় কে – কালু মিয়া।

৫২। ভাং-গাজা খাওয়া রসকসশ–ন্য হাড়িগিলে চেহারা কার- কমান্ডারের

৫৩। ব্যাপারীর ২য় পক্ষের বউ এর ভাইয়ের নাম – ধলা মিয়া।

৫৪। ধলা মিয়া কেমন মানুষ – বোকা কিছিমের।

৫৫। মজিদের বিবি রহিমার কত প্যাঁচ – চৌদ্দ।

৫৬। আমেনা বিবিকে মাজারের চারপাশে ঘুরতে হবে – সাতবার।

৫৭। কার বাড়ির কাঁঠালগাছের তলে একটা ম–র্তি নজরে পড়ে – মোলÐাশেখের।

৫৮। আমেনা বিবি কী বারে রোজা রাখে – শুক্রবারে।

৫৯। “তোমার দাড়ি কই মিঞা।” উক্তি কে, কাকে করেছে – মজিদ, আক্কাসকে

৬০। করিমগঞ্জের ইস্কুলে পড়াশুনা করেছে – আক্কাস

৬১। বিদেশে বহুদিন ছিল – আক্কাস

৬২। আক্কাসের বাবার নাম – মোদাব্বের মিঞা

৬৩। মজিদ মহব্বতনগর গ্রামে বাস করে কত বছর ধরে – দশ, বারো বছর

৬৪। মোটাতাজ পোলা কে – হাসুনি।

৬৫। হাসুনিরে পুষ্যি রাখার সখ কার – রহিমার

৬৬। উৎসব ছিল কোন পাড়ায় – ডোমপাড়ায়।

৬৭। দীর্ঘ কত বছরের মধ্যে রহিমা তার স্বামীকে অনেকবার রাগতে দেখেছে – ১২ বছর

৬৮। অবশেষে কীসের মুখে ছিপি দিয়ে মজিদ সরে যায় – আগ্নেয়গিরির

৬৯। শত্রুর আভাস পাওয়া হরিণের চোখের মত সর্তক হয়ে ওঠে কার চোখ – জমিলার।

৭০। মজিদের কণ্ঠে গানের মতো গুনগুনিয়ে ওঠে – পাঁচপদের ছুরা আল-ফালাখ।

৭১। জিকির করতে করতে জ্ঞান হারিয়েছিল – মজিদ।

৭২। কাপড়ে ঢাকা মানুষকে কোরানের ভাষায় কী বলে – মোদাচ্ছের।

৭৩। জমিলা থরথর করে কাঁপে – ক্রোধে

৭৪। মজিদ জমিলাকে বেধে রাখে – মাজারে।

৭৫। মাজারটি ভেসে যায় – বন্যার পানিতে।

 

 

লালসালু উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (জ্ঞানমূলক):

১। মধুপুর গড় থেকে গারো পাহাড় কত দিনের পথ? – তিন দিনের
২। মাজারের আকৃতি কেমন? – মাছের পিঠের মতো
৩। ‘বতোর’ কাদের উৎসব? – গ্রামের কৃষকদের
৪। মরণরোগে যন্ত্রণা পাচ্ছে কে? – ছুনুর বাপ
৫। পক্ষাঘাতে কষ্ট পাচ্ছে কে? – খেতানির মা
৬। হাসুনির মা কী কাজ করে? – ধান ভানার
৭। হাসুনির মা কীসের আর্জি নিয়ে রহিমার কাছে আসে? – মওতের
৮। হাসুনির মার কয় ভাই? – তিন ভাই
৯। হাসুনির মার কনিষ্ঠ ভাইয়ের নাম কী? – রতন
১০। বড় ভয়ংকর বস্তু কী? – রসনা
১১। ঝড়ের সময় হাসুনির মা কী খুঁজে পায় না? – ঝুঁটিওয়ালা মুরগি
১২। বিছানা থেকে উঠে বুড়ো কী খেতে চায়?- চিড়া
১৪। পির সাহেবের কেমন ক্ষমতা আছে? – রুহানি তাকত ও কাশফ
১৫। কার আগমনে মজিদ শঙ্কিত হয়? – জাঁদরেল পীরের
১৬। পির সাহেব কোথায় বসেন? – বট গাছের নীচে
১৭। পির সাহেব কোন ভাষায় ওয়াজ করেন? – ফারসি
১৮। কোন গ্রামে হাসপাতাল রয়েছে? – করিমগঞ্জ
১৯। মজিদ কেমন জুতা পায়ে দিয়ে করিমগঞ্জ হাসপাতালে যায়?- ক্যানভাসের জুতা
২০। পির সাহেবের সাঙ্গপাঙ্গরা কার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে?- কালু মিয়া
২১। খালেক ব্যাপারীর প্রথম স্ত্রীর নাম কী? – আমেনা
২২। খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কী? – তানু বিবি
২৩। আওয়ালপুর যাওয়ার পথে ধলা মিয়ার কার সাথে দেখা হয়?- মজিদের
২৫। আমেনা বিবি কীসের পাত্রে পড়াপানি পান করে?- তামার পাত্রে
২৬। আমেনা বিবি কীসে চড়ে মাজারে আসে? – পালকিতে
২৭। কয় বছর পর পর মাজারে গাত্রাবরণ বদলানো হয়?- দুই বছর পর
২৮। আক্কাসের পিতার নাম কী? – মোদাব্বের মিঞা
২৯। রহিমা কাকে নিয়ে পাটি বুনতে বসে? – জমিলাকে
৩০। জমিলার চলাফেরা কেমন? – লাটবিবির মতো
৩১। জমিলার ঘুম কীসের মতো? – কাঠের
৩২। ঢোলকের শব্দ কখন থামল? – মধ্যরাতে
৩৩। মজিদ রহিমাকে কী নির্দেশ দেয়? – তারাবির নামাজ পড়ার
৩৪। মজিদ কোথায় শত সহস্র সিংহের গর্জন শুনতে পায়?- মাজার ঘরে
৩৫। মজিদের মুখে থুথু নিক্ষেপ করেছিল কে? – জমিলা
৩৬। মজিদ জমিলা কিভাবে মাজারে নিয়ে যায়? – পাঁজকোলে করে
৩৭। কারণে অকারণে নিজের দরিদ্রতাকে টেনে আনে কে?- দুদু মিঞা
৩৮। বুড়ো কেমন মেজাজের লোক? – খিটখিটে
৩৯। মানুষের রসনা কীসের মতো ভয়ঙ্কর? – বিষাক্ত সাপের
৪০। মজিদ জমিলাকে কোথায় বসতে নিষেধ করে?- চৌকাঠের উপর
৪১। মজিদকে বিচলিত করে তোলে কে? – জমিলা
৪২। ‘লালসালু’ উপন্যাসে কোন পাহাড়ের কথা উলে­খ আছে?- গারো পাহাড়ের
৪৩। পায়ে বুট এঁটে শিকারে যায় কে? – এক সরকারি কর্মচারী
৪৪। শিকারী লোকটি আসলে কে? – এক সরকারি কর্মচারী।
৪৫। বাড়ির কথা বলতে গিয়ে কার মনে হঠাৎ স্মৃতি জাগে?- মৌলভীর
৪৬। গভীর রাতে বাড়ির ভিটের জন্য কার চোখের কোণ চকচক করে ওঠে? – মৌলভীর
৪৭। ‘লালসালু’ উপন্যাসে বর্ণিত কার চোখে শিকারীর সূচাগ্রতা লক্ষ করা যায়? – তাহেরের চোখে
৪৮। ‘লালসালু’ উপন্যাসে আমরা তাহের কর্তৃক কোন মাছ শিকারের বর্ণনা পাই? – রুই মাছ
৪৯। ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদকে প্রথম কোথায় দেখতে পাওয়া যায়? – মতিগঞ্জে
৫০। নিরাকপড়া আকাশ কাকে পাথরের মূর্তিতে রূপান্তরিত করেছে? – মজিদকে
৫১। আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল কে? – মজিদ
৫২। মতিগঞ্জ সড়কের কোন দিকে মহব্বতনগর গ্রাম?- উত্তর দিকে
৫৩। কার ঘরে জটলা দেখা যায়? – খালের ব্যাপারী
৫৪। তাহের ও কাদের কোন সময়ে বাড়ি ফেরে? – অপরাহ্ণে
৫৫। কার আগমন মহব্বতনগর গ্রামের সকল মানুষকে চমকে দেয়? – মজিদের আগমন
৫৬। মজিদ মহব্বতনগর গ্রামের এক প্রাচীণ কবরকে কোন পিরের মাজার বলে দাবি করেন? – মোদাচ্ছের পিরের
৫৭। মজিদের বর্ণনায় গারো পাহাড়ের মানুষ কোন প্রকৃতির ছিল? – অশিক্ষিত ও বর্বর
৫৮। বর্বর হলেও কাদের দিল সাচ্চা, খাঁটি সোনার মতো ছিল?- গারো অঞ্চলের
৫৯। কবরটি আবৃত হলো কী দ্বারা? – ঝালরওয়ালা লালসালু
৬০। কে হাঁটলে মাটিতে আওয়াজ হয়? – স্ত্রী রহিমা হাঁটলে
৬১। “কলমা জানো মিঞা?” – মজিদ প্রশ্নটি কাকে করেছে?
৬২। মজিদ এবং খালেক ব্যাপারীর শক্তির মধ্যে কী রয়েছে?- প্রভেদ
৬৩। মজিদের শক্তি কার উপর প্রতিফলিত হয়? – রহিমার
৬৪। তাহেরের বাপ বিচার থেকে এসে কয়দিন উপোস থাকে?- দুদিন
৬৫। তাহেরের বাপ কার কাছে ক্ষমা চায়? – হাসুনির মায়ের
৬৬। সূর্যকে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে কে? – নতুন পির সাহেব
৬৭। মজিদের ভাষ্যে শয়তানের উদ্দেশ্য কী?- মানুষকে বিপথে পরিচালিত করা
৬৮। মজিদ হাসপাতালে গিয়ে কাকে ডাক্তার মনে করে?- কম্পাউন্ডারকে
৬৯। জীবনস্রোতে মজিদ ও খালেক ব্যাপারী কীভাবে মিলে গেছে?- খাপে খাপে
৭০। মজিদের মতে আমেনার সন্তান না হওয়ার কারণ কী? – আমেনার পেটে বেড়ী পরায়
৭১। মজিদ কাকে তালাক দেওয়ার নির্দেশ দেয়? – খালেক ব্যাপারীকে তার প্রথম বিবি আমেনাকে
৭২। সাত জন্মের চেষ্টায়ও শয়তান কাকে আক্রমণ করতে পারে না? – মজিদকে
৭৩। একটি মাত্র শব্দ তিনবার উচ্চারণেই কোন বিষয়ের সমাধা হয়? – স্ত্রী তালাক দেওয়া
৭৪। আমেনা বিবির ব্যাপারে খালেক ব্যাপারী কী মনস্থির করে?- তালাক দেওয়ার
৭৫। মহব্বতনগর গ্রামবাসী স্কুল শিক্ষার পরিবর্তে কোনটিকে বেশী প্রয়োজনীয় মনে করে? – মক্তব্য শিক্ষাকে
৭৬। আক্কাসের কোন বিষয়টি গ্রামবাসীর কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়?- স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি
৭৭। মজিদ কার হেদায়েতের জন্য দোয়া করে? – আক্কাসের
৭৮। আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তা কীসে রূপ নেয়?- মসজিদ তৈরিতে
৭৯। মসজিদ নিয়ে মজিদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় কার উপস্থিতি নি¯প্রয়োজন? – আক্কাসের মতো খামখেয়ালী বুদ্ধিহীন যুবকের
৮০। যাদের টাকায় পয়সা নেই মসজিদ তৈরিতে তাদের কী দিয়ে সাহায্য করার জন্য মজিদ নির্দেশ দেয়? – শ্রম দিয়ে
৮১। মসজিদ তৈরিতে খরচের বারো আনা বহন করার জন্য কে আর্জি পেশ করে? – খালেক ব্যাপারি
৮২। “তোমার একটা সাথী আনুম”- এখানে ‘সাথী” মানে কী? – সতীন
৮৩। মসজিদের কাজ শেষ হয় কখন? – জ্যৈষ্ঠের কড়া রৌদ্রের সময়ে
৮৪। কোন মাসে মজিদ দ্বিতীয় বউ ঘরে তোলে? – জ্যৈষ্ঠ মাসে
৮৫। মজিদের দ্বিতীয় বউকে লেখক কীসের সাথে তুলনা করেছেন?- বিড়াল ছানার সাথে
৮৬। মজিদের নতুন বউয়ের নাম কী? – জমিলা
৮৭। “সোনালি মিহি সুন্দর হাসির ঝংকার।”- কার হাসির কথা বলা হয়েছে? – জমিলার
৮৮। কার হাসি শুনে মজিদ স্তব্ধ হয়ে যায়? – জমিলার
৮৯। সতীন রহিমাকে দেখে জমিলার কী মনে হয়েছিল? – শাশুড়ি
৯০। মহব্বতনগরে প্রথম কে মজিদের হুকুম অমান্য করে?- দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা

 

 

লালসালু উপন্যাসের অনুধাবনমূলক প্রশ্নোত্তর:

১ । “আপনারা জাহেল, যে এলেম, আনকাড়াহ, মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করে ফেলি রাখছেন?” মজিদ এ কথাটি বলেছে কেন?

উত্তর : মহব্বতনগর গ্রাম নিজের প্রবেশটাকে নাটকীয় করে তুলতে এবং গ্রামের মানুষের কাছে নিজের প্রতিপত্তি জাহির করতে মজিদ উক্তিটি করেছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। একদিন সে মতিগঞ্জের সড়ক দিয়ে সোজা মহব্বতনগর গ্রামে এসে প্রবেশ করে। তার প্রবেশ ছিল নাটকীয় এবং চমকপ্রদ। সে গ্রামে ঢুকে খালেক ব্যাপারী ও মাতব্বর রেহান আলীসহ গ্রামবাসীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। মজিদ বলে, তারা একজন কামেল পীরের মাজারকে অবহেলায় ফেলে রেখেছে। তখন তাদের জ্ঞান নিয়ে মজিদ প্রশ্ন তোলে এবং অধার্মিক নালায়েক জ্ঞান করে আলোচ্য উক্তিটি করে।

 

২। “তবে তার শক্তি তার চওড়া দেহ, তা বাইরের খোলসমাত্র। কথাটি বলা হয়েছে কেন?”

উত্তর: মজিদের প্রথমা স্ত্রী রহিমার বিশাল দেহ এবং প্রবল শক্তি থাকা সত্তেও মজিদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে, তাই তার সম্পর্কে উক্তিটি করা হয়েছে। রহিমা লম্বা চওড়া মানুষ, হাড় চওড়া মাংসল দেহ। তার শক্তিও কম নয়। বড় বড় হাঁড়ি অনায়াসে এক স্থানে তুলে নিয়ে যায়, গোয়ালের ধামড়া গাইকেও স্বচ্ছন্দে গোয়ালাঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই রহিমাই মজিদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সারাক্ষণ। কারণ শীর্ণদেহী মানুষটির পেছনে আছে মাছের পিঠের মতো মাজারটির বৃহৎ ছায়া, যা তাকে শক্তিশালী করেছে বহুগুণে। রহিমা মনে করে মজিদ খোদার মানুষ। তাই তার বিশাল দেহ ও দৈহিক বক্ষ খোলসমাত্র। এ শক্তির কোন বহি:প্রকাশ করার সাহস তার নেই।

 

৩। “খেলোয়াড় চলে গেছে,খেলবে কার সাথে”- উক্তিটি করা হয়েছে কেন?

উত্তর : তাহেরের বাবা নিরুদ্দেশ হবার পর তাহেরের মা ঝগড়া না করতে পেরে বিষাদগ্রস্তভাবে শুয়ে থাকত সারাক্ষণ, তখন তার সম্পর্কে উক্তিটি করা হয়েছে। তাহেরের বাবা এবং তাহেরের মা সারাদিন ঝগড়া লেগে থাকত। প্রায়ই তাহেরের বাবা তাকে মারত। তাহেরের মাও সারাক্ষণ তাহেরের বুড়ো বাবার মৃত্যু কামনা করত। কিন্তু তাদের ঝড়গার মাঝেও ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। তাইতো যখন তাহেরের বাবা নিরুদ্দেশ হয় তখন তার মন বিষাদের ছায়ায় ঢেকে থাকে। যে মানুষটি তার চক্ষুশূল ছিল আজ তার অনুপস্থিতি যেন ভারাক্রান্ত করে রাখে মনকে। তাইতো ঔপন্যাসিক এই উক্তিটি করেছেন।

 

৪। “গৃহস্থদের গোলায় গোলায় যখন ধান ভরে ওঠে তখন দেশময় আবার পীরদের সফর শুরু হয়।”- কথাটি বুঝিয়ে দাও।

উত্তর : সম্পদের আকর্ষণে সুযোগসন্ধানী ধর্মব্যবসায়ীদের তৎপরতা বাড়ে এটি বোঝাতে উক্তিটি করা হয়েছে। গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা অতি সহজসরল। তারা ধর্মভীরু এবং পুরোহিতদের প্রতি অন্ধভক্ত। ধর্ম তাদের কাছে খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এই স্পর্শকাতরতাকে কিছু কপট ধূর্ত ব্যক্তি নিজের মূলধন করে তোলে। এরা সুযোগসন্ধানী। তাই যখন কৃষকের গোলায় ধান ওঠে, কৃষক সচ্ছলতার মুখ দেখে তখন এদের আগমন ঘটে। গ্রামে গ্রামে এরা নিজেদের আস্তানা গাড়ে। ফলে মানুষের দুনিয়া আখেরাতের ফসল পূর্ণ করার পাশাপাশি পীর সাহেবের আখের গোছানো হয়ে যায়।

 

৫। “জাদরেল পীররা যখন আশপাশে এসে আস্তানা গাড়েন, তখন মজিদ শঙ্কিত হয়ে ওঠে।”- কেন?

উত্তর : নিজের কপটতা, ভণ্ডামি, অজ্ঞতা ধরা পড়ার ভয়ে মজিদ সবসময় শঙ্কিত থাকে। মাজারের ছায়ায় মজিদ নিজের মায়াজাল বিস্তৃত করেছে। মহব্বতনগরে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজের এক অদৃশ্য রাজত্ব। গ্রামের মাতব্বর খালেক ব্যাপারীও তার একান্ত অনুগত একজন ব্যক্তি। কিন্তু এই সবকিছুর আড়ালেও তার মন তার কপটতা, ভণ্ডামি, শঠতা, অজ্ঞতা ধরা পড়ার ভয়ে শঙ্কিত থাকে।

তাই যখন জাদরেল পীরের আগমন ঘটে তখন মজিদের মন অজ্ঞতা ধরা পড়ার আশঙ্কাতে কেঁপে উঠে। জাদরেল পীরদেহ জ্ঞান ও প্রতিপত্তি বেশি থাকে। তাদের প্রভাবে মানুষের চোখ খুলে গেলে মজিদের মিথ্যার ভীত তছনছ হয়ে যেতে পারে। এজন্য জাদরেল পীররা যখন আশেপাশে এসে আস্তানা গাড়ে তখন মজিদে শঙ্কিত হয়ে ওঠে।

 

৬। “সে বলে পীর সাহেব সূর্যকে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে।”- উক্তিটির মাধ্যমে কী প্রকাশ পেয়েছে?

উত্তর : আলোচ্য উক্তিটির মাধ্যমে সুযোগসন্ধানী ধর্মব্যবসায়ীদের চরম ভণ্ডামি, শঠতা প্রকাশ পেয়েছে। গ্রামবাংলার মানুষ সহজসরল জীবনযাপন করে থাকে। তাদের এই সরলতার সুযোগ নেয় ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীরা। উপন্যাসে লক্ষ করা যায় আউয়ালপুর গ্রামে একজন পীর সাহেবের আগমন ঘটে, যে দাবি করে সে সূর্যকে আটকে রাখার ক্ষমতা রাখে। সে তার কথার ছলে মানুষকে প্রতারিত করে।

আলোচ্য উক্তিটির মাধ্যমে এর প্রমাণ লাভ করা যায় এবং এসব অসাধু, সুযোগসন্ধানী ধর্ম ব্যবসায়ীদের চরম ভণ্ডামি ফুটে ওঠে। আবহমানকালধরে ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের মনে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার লালন করিয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। ভয় থেকে আসে আলোকিত ক্ষমতার দৌরাত্ম্য। আর এগুলোই ধর্মব্যবসায়ীর মূল হাতিয়ার। এগুলোর মাধ্যমে তারা ইহকাল ও পরকালের কাহিনী বানায় এবং নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে।

 

৭। “একজনের আছে মাজার, আরেকজনের জমিজোতের প্রতিপত্তি।”- উক্তিটি বুঝিয়ে দাও।

উত্তর : ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ী এবং শোষক শ্রেণির ভূমিদস্যুদের যোগসূত্রের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে উক্তিটির মাধ্যমে। যুগ যুগ ধরে সমাজের সাধারণ মানুষ প্রতারিত এবং শোষিত হয়ে আসছে। এখানে দেখা যায় মহব্বতনগর গ্রামে দুইজন ব্যক্তি তাদের অদৃশ্য রাজত্ব বিস্তৃত করেছে। একজনের শক্তির উৎস মাজার, আরেকজনের শক্তির উৎস জমিজমা প্রতিপত্তি। উৎস ভিন্ন হলেও দ্ইুজনই মানুষকে প্রতারিত এবং শোষণ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এই দৃশ্যটি মর্মান্তিকভাবে ফুটে উঠেছে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে। সামন্তপ্রভুর সাথে পুরোহিতের অন্তরঙ্গতার দৌরাত্মে নিস্পেষিত হয় সমাজ, যা আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে আমাদের সামনে মূর্ত হয়েছে।

 

৮। “তাগো কথা হুনলে পুরুষ মানুষ আর পুরুষ থাকে না, মেয়ে মানুষেরাও অধম হয়।”- খালেক ব্যাপারী মজিদকে কথাটি বলেছিল কেন?

উত্তর : নারী জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করে মজিদ আপন স্বার্থসিদ্ধির পায়তারা করেছে, যেখানে নিজের অন্ত:সারশূন্যতা ঢাকতে খালেক ব্যাপারী এমন উক্তি করেছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে সমাজের নানারকম কুসংস্কার এবং অসাধু ধর্মব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম প্রকাশ পেয়েছে। খালেক ব্যাপারী স্ত্রীর কথায় সন্তান লাভের আশায় ধলা মিয়াকে আউয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছে পাঠায়। কিন্তু যখন মজিদ ঘটনাটি জানতে পারে, তখন খালেক ব্যাপারী তার নিজের অন্ত:সারশূন্যতাকে ঢাকতে কথাটি বলেছিলেন। এখানে তিনি স্ত্রীকে জ্ঞানশূন্য এবং মূর্খ প্রতিপন্ন করে নিজের অজ্ঞতাকে ঢাকতে চেয়েছেন। নারী জাতির প্রতি মজিদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মৌন সমর্থক খালেক ব্যাপারী। ব্যাপারীর এ উক্তির মাধ্যমে পুরোহিত ও সামন্তপ্রভুর অভিন্ন স্বার্থ প্রকাশিত হয়েছে।

 

৯। “মেয়েলোকের মনের মস্করা সহ্য করবে অতটা দুর্বল নয় সমাজ।”- কথাটি বুঝিয়ে বলো।

উত্তর : অসার সামাজিক মূল্যবোধ এবং নারীর প্রতি বক্রদৃষ্টির চরম রূপ ফুটে উঠেছে উক্তিটির মাধ্যমে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর উপর পীড়নের এক নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে। সন্তান নারীসত্তাকে পূর্ণতা দেয়। শুধু এই ছোটো চাওয়াটি আমেনার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। মজিদ তার কূটকৌশলের মাধ্যমে খালেক ব্যাপারীকে বাধ্য করে আমেনাকে তালাক দিতে। মাত্র তের বছর বয়সে সে সংসারে তার আগমন মজিদের রোষানলে পড়ে সে সংসার তাকে ত্যাগ করতে হয়। এভাবেই নারীরা যুগে যুগে পীড়িত হচ্ছে। সমাজ যেন নারীর প্রতি ক্রুর, অসহিষ্ণু। সব অসঙ্গতি সে মেনে নেয় কিন্তু নারীকে দিতে হয় চরম মূল্য। কেউ রাগে ক্ষোভে কিংবা ভুল করে একবার আত্মহত্যার কথা বললে, সে যদি পরে পিছিয়ে আসে সমাজ তাকে পেছাতে দেয় না। বরং আত্মহত্যা করার সব আয়োজন করে দেয়, কারণ সে নারী।

 

১০। “এই নিঃসঙ্গতা কালের মতো আদি অন্তহীন, যার কাছে মানুষের জীবনের সুখ দুঃখ অর্থহীন অপালাপ মাত্র।” উক্তিটির মাধ্যমে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : মহাকালের শাশ্বত গতিধারায় চিরন্তন সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে মানুষের জীবনের কঠিন সত্যগুলো উদ্ভাসিত হয়েছে। সুখ-দু:খ, হাসি-কান্না মানুষের জীবনেরই অংশবিশেষ, মানুষের জীবনে সুখ যেমন আসে দুঃখও আসে। একটি আরেকটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সুখ মানুষের প্রত্যাশিত এবং দুঃখ চরম অপ্রত্যাশিত। এই দুঃখ দূর করতে মানুষ অলৌকিক শক্তির শরণাপন্ন হয়। মানুষ মাজারে, কবরে নানা রকম আকুতি জানায়। কিন্তু নির্লিপ্ততা যার একমাত্র পুঁজি তার কাছে মানুষের জীবনের সুখ দু:খ উপস্থাপন করা লক্ষ্য ছাড়া জীবনের মতোই অর্থহীন।

 

১১। “লালসালু আবৃত মাজারের আশেপাশে যারা আসে তারাও কোনদিন হাসে না। অনেক সময় কান্নার রোল ওঠে।”- কথাটি বুঝিয়ে বলো।

উত্তর: মাজারে দুঃখী মানুষেরা আসে, তাদের দুঃখ দূরের আর্জি নিয়ে। হাসি নয় কান্নাই হয় যাদের আর্জি প্রকাশের উপায়। ‘লালসালু’ উপন্যাসে সালু আবৃত মাজারটিকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের আবর্তন। মাজারটি প্রতীকীরূপে উপন্যাসে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রামের মানুষেরা তাদের দু:খ দূর করার আশায় মাজারে নানারকম আর্জি নিয়ে আসত। অন্যদিকে মজিদ মানুষের মনে মাজার নিয়ে ভয় এবং রহস্যের বেড়াজাল সৃষ্টি করে রেখেছিল। দুঃখ এবং ভয় বিষয়গুলোর সাথে হাসি নয় কান্না জড়িত। তাই মাজারের আশপাশে যারা আসে তাদের মুখে হাসি নয়, কান্নার রোল ওঠে।

 

১২। “নেশার লোভ কাকে সে ঘরে আনল”- মজিদের এমন উপলদ্ধি হয় কেন?

উত্তর : প্রথম দৃষ্টিতে জমিলাকে অত্যন্ত শান্ত এবং বাধ্যগত মনে হলেও পরে তার চঞ্চলতা, চপলতা আর বেয়ারাপনা মজিদকে ভাবিয়ে তোলে এবং তার এই উপলদ্ধি হয়। ‘লালসালু’ উপন্যাসের শেষভাবে আবির্ভাব ঘটে উপন্যাসের অতি তাৎপর্যময় চরিত্র জমিলার। জমিলার বাহ্যিক রূপ দেখে মজিদ মুগ্ধ হয়। সে ভাবে, অতি শান্ত এই মেয়েটি তার সংসারকে আলোময় করবে কিন্তু হায় জমিলার চঞ্চলতা, বেয়ারাপনা তাকে ভাবিয়ে তোলে। যেই জমিলার তার সংসারকে আলোময় করার কথা সে বিষাদময় করে তোলে তার জীবনকে। তখন তার এই উপলদ্ধি হয়।

 

১৩। “অন্তরে যে ক্রোধ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সে ক্রোধ ফেটে পড়বার পথ না পেয়ে অন্ধ সাপের মতো ঘুরতে থাকে ফুঁসতে থাকে।”- কেন?

উত্তর : মহব্বতনগর গ্রামে দীর্ঘ রাজত্বকালে আপন হোক পর হোক কেউ কোনদিন মজিদের আদেশ অমান্য করতে সাহস পায়নি কিন্তু জমিলা নির্দ্বিধায় মজিদের আদেশ অমান্য করে, তাই মজিদের অন্তরে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। মহব্বতনগর গ্রামের অঘোষিত রাজা মজিদ। গ্রামের কেউ মজিদের আদেশ অমান্য করার সাহস পায় না। কিন্তু তার ঘরের একরত্তি বউ যাকে সে নেশায় ঝোঁকে ঘরে এনেছিল, সেই জমিলা আজ তার আদেশ অমান্য করার দুঃসাহস দেখায়। এ যেন তার জন্য চরম অপমানের বিষয় তাই ক্রোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে তার মনে অন্ধ সাপের মতো ফুঁসতে থাকে।

 

১৪। “কও বিবি, কী করলাম? আমার বুদ্ধিতে জানি কুলায় না।”- মজিদ রহিমাকে কথাটি বলেছিল কেন?

উত্তর : মজিদ নানা কৌশলে জমিলা নামের মুক্ত পাখিটিকে খাঁচায় বন্দি করতে চেয়েছে, কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। তখন সে হতাশ হয়ে রহিমার কাছে পরামর্শ চায়। ‘লালসালু’ উপন্যাসে জমিলার আবির্ভাব যেন অগ্নিকন্যারূপে। জমিলা যেন স্বাধীনমুক্ত পাখি, যাকে শাসনের বেড়াজালে আটকে রাখা যায় না। চঞ্চলতা, চপলতা যার চরিত্রকে অবিচ্ছেদ্য অংশ। মজিদ কূটকৌশলে জমিলার ”ঞ্চলতা, চপলতাকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। জমিলার প্রাণশক্তি মজিদের সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সে কোন পথ খুঁজে পায় না। অবশেষে রহিমার কাছে পরামর্শ চায় কীভাবে সে জমিলাকে নিয়ন্ত্রণে আনবে।

 

১৫। “কাইল তুমি আমারে বেইজ্জত করছ, খালি তা না, তুমি তাঁনারে নারাজ করছ।”- মজিদ এ উক্তিটি করেছে কেন?

উত্তর : জমিলা রাতের অন্ধকারে ঘরের বাইরে যাওয়ায় মজিদ ক্ষোভের বহি:প্রকাশ রূপে কথাটি বলেছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদ শাসনের এক বেড়াজালে বেষ্টিত করে রেখেছে সবাইকে। মহব্বতনগর গ্রামে সবাই যেন এক অদৃশ্য খাঁচায় বন্দি। সেই খাঁচায় জমিলা এক মুক্ত স্বাধীন পাখি। সে মজিদের শাসনের বেড়াজাল ভেদ করতে চায়। তাইতো যখন মাজারে সবাই জিকিরে মশগুল, কৌতূহলবশত সে ঘরের বাইরে যায়। মজিদের কাছে যা ছিল চরম অন্যায়ের কাজ। তাই মজিদ উক্তিটির মাধ্যমে জমিলার মনে অপরাধবোধ জাগানোর নিস্ফল চেষ্টা করেছে।

 

১৬। পীরের মাহাত্ম বর্ণনা করতে গিয়ে মজলুব খাঁ কী বলেছিল?

উত্তর : পীরের মাহাত্ম বর্ণনা করতে গিয়ে মতলুব খাঁ তারি মিথ্যা ও অলৌকিক গুণ বর্ণনা করছিল। পীরের মুরিদ মতলুব খাঁ পীরের গুণাগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে পীরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা বলেছে। তার মতে, পীর সাহেব ইচ্ছে করলে সূর্যকেও এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন। সূর্যকে ধরে রেখে পীর যখন ইচ্ছে জোহরের নামাজ পড়তে পারেন।

 

১৭। “দৃষ্টি বাইরের’ পানে, মস্ত নদীটির ওপারে, জেলার বাইরে- প্রদেশেরও।”- উক্তিটি বুঝিয়ে দাও।

উত্তর : আলোচ্য উক্তিটিতে শস্যহীন জনবহুল অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়া ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। শস্যহীন জনবহুল অঞ্চলটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। কারও ঘরেই খাবার নেই। ভাগাভাগি, স্থান বিশেষে খুনাখুনি করে তারা শেষ হয়। জ্বালাময়ী আশা ; ঘরে হা-শূন্য মুখ থোবড়ানো নিরাশা বলে তাতে মাত্রাতিরিক্ত প্রখরতা। এসব কারণে তারা দূরের টানে বাইরের পানে চেয়ে থাকে।

১৮। আমেনা বিবির মনে আশার সঞ্চয় হয় কেন?

উত্তর : সন্তানলাভের ক্ষীণ সম্ভাবনায় আমেনা বিবির মনে আশার সঞ্চার হয়। সন্তানলাভের তদবিয়ে আমেনা বিবি প্রথমে নিরাশ হয়েছিল। কারণ আওয়ালপুরে আগত পীর সাহেবের পানিপড়া সে পায়নি। তাই সে ধরেই নিয়েছিল তার আর সন্তান হবে না। কিন্তু মজিদ যখন পেটের বেড়ির কথা বলে এবং সাতের বেশি বেড়ি না থাকলে তা খোলার ব্যবস্থার কথা জানায় তখন তার মনে আশার সঞ্চার হয়।

১৯। খালেক ব্যাপারী তার স্ত্রীকে তালাক দেয় কেন?

উত্তর : আওয়ালপুরের পীরের প্রতি প্রতিহিংসায় মজিদ খালেক ব্যাপারীকে প্ররোচিত করায় সে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়। খালেক ব্যাপারী একজন ব্যক্তিত্বহীন মানুষ। তার নিজস্ব কোন চিন্তা চেতনা নেই। সে ও মজিদ আওয়ালপুরে আগত পীরের বিরুদ্ধে একাট্টা। অথচ এই ব্যাপারী স্ত্রী আমেনা বিবির অনুরোধে ধলা মিয়াকে দিয়ে সেই পীরের কাছ থেকে পানিপড়া আনতে পাঠায়। ধলা মিয়া সে কথা মজিদকে বলে দেয়। তখন মজিদ খেপে নিয়ে খালেক ব্যাপারীকে কুপরামর্শ দেয় সে যেন এই বউকে তালাক দেয়। এ কারণেই খালেক ব্যাপারী তার স্ত্রীকে তালাক দেয়।

২০।অন্যের আত্মার শক্তিতে মজিদের খাঁটি বিশ্বাস নেই কেন?

উত্তর : মজিদ জানে যে তার নিজের ঐশ্বরিক কোন শক্তি নেই, তাই অন্যের আত্মার শক্তিতে তার বিশ্বাস নেই। মজিদের আবিস্কৃত মাজারটিকে সবাই ঐশ্বরিক শক্তির আধার মনে করে। কিন্তু মজিদ ভালোভাবেই জানে তাতে কিছুই নেই। তার নিজের মাঝেও কোন ঐশ্বরিক শক্তি নেই। যা তার নিজের মাঝে নেই তা অন্য কারও মাঝে থাকতে পারে বলে সে মনে করে না। এমনটিই ভাবে মজিদ। এ কারণেই অন্যের আত্মার শক্তিতে তার খাঁটি বিশ্বাস নেই।

২১। “কিন্তু মজিদের শীতল চোখ দুটোর পানে তাকিয়ে হঠাৎ সে বোঝে যে, মিথ্যা কথা বলা বৃথা।”- কেন?

উত্তর : খালেক ব্যাপারীর গোপনীয় ব্যাপারটি মজিদ জেনে ফেলেছে- এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই ব্যাপারী এর রকম জটিল অবস্থার মধ্যে পড়ে। জীবন¯্রােতে মজিদ তার খালেক ব্যাপারী এমনভাবে মিলে গেছে যে, অজান্তে অনিচ্ছায়ও দুজনের কারও পক্ষে উল্টো পথে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রথম স্ত্রী আমেনা বিবির অনুরোধ রক্ষা করতে খালেক ব্যাপারী আওয়ালপুরে আগত পীর সাহেবের কাছে ধলা মিয়াকে পাঠায়। মজিদ এ ব্যাপারটি ধলা মিয়ার কাছ থেকেই জানতে পারে। ফলে সে এ প্রসঙ্গে খালেক ব্যাপারীকে প্রশ্ন করে। খালেক ব্যাপারীও বোঝে যে মজিদ যেভাবেই হোক তা শুনেছে। এ প্রসঙ্গেই প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করা হয়েছে।

২২। “তাগো কথা শুনলে পুরুষ মানুষ আর পুরুষ থাকে না, মেয়ে মানুষের অধম হয়।”- কেন? বুঝিয়ে দাও।

উত্তর : খালেক ব্যাপারীর পৌরুষে আঘাত দেওয়ার জন্যই মজিদ প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করে। মজিদ ও খালেক ব্যাপারীর পথ এক ও একাট্টা। মজিদ তাই পীর সাহেবকে ইবলিশ বলে সম্বোধন করে। খালেক ব্যাপারীও তখন তাতে সম্মতি দেয়। অথচ আমেনা বিবির কথা শুনে আবার পড়াপানির জন্য তার কাছেই ধলা মিয়াকে পাঠায়। এ ঘটনা এক সময় মজিদ জেনে যায়। এতে মজিদ ক্ষুদ্ধ হলে খালেক ব্যাপারী লজ্জিত হয়। ব্যাপারী বাহানা দেয় মেয়ে মানুষের মন যে কী করতে পারে। তাই মজিদ খালেক ব্যাপারীর দুর্বল জায়গায় আঘাত করে বলে পুরুষ মানুষ আর পুরুষ থাকে না, মেয়ে মানুষেরও অধম হয়।

২৩। “বার্ধক্যের শেষ স্তরে কারও মৃত্যু ঘটলে দু:খটা তেমন জোরালোভাবে বুকে লাগে না।”- কেন? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : হাসুনির মা তার মায়ের মৃত্যুতে তেমন কিছু শোক পায়নি এ রকম ভাবনা থেকেই মজিদ প্রশ্নোক্ত ভাবনায় ভাবিত হয়। হাসুনির মা’র মায়ের মৃত্যুসংবাদ শোনে মজিদ। হাসুনির মা নাকিসুরে কান্নাকাটি করলেও মজিদ বুঝতে পারে যে, হাসুনির মার কান্নাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, আসল উদ্দেশ্য এই বলা যে, যা ঘটেছে তা হাসার নয়, কান্নার ব্যাপার। হাসুনির মাকে দেখে মজিদ বুঝতে পারে দুঃখবোধ যতটা না আত্মার, তার থেকে বেশি বাহ্যিক। মজিদ এই ভাবনাটির মাধ্যমে কারণও খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে।

২৪। দীর্ঘ এক যুগ সময়ের মাঝে মজিদ কীভাবে বহু ভগ্ন, নির্মমভাবে আঘাত পাওয়া হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছে?

উত্তর : মাজারের সান্নিধ্যে বসবাস করার ফলে মজিদ এই দীর্ঘ এক যুগ সময়ের মধ্যে বহু ভগ্ন, নির্মমভাবে আঘাত পাওয়া হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছে। মজিদ গ্রামবাসীকে মাজারের কাল্পনিক তাৎপর্য বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। তাই নিরক্ষর গ্রামবাসী মাজারকে ঐশ্বরিক শক্তির ধারক বলে বিশ্বাস করেছে। তারা ভাবে, এ মাজারটিই তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তাই তারা নিজেদের দুঃখের কথা মাজারের পাশে এসে বলে এবং বিলাপ করে। মাজারের সান্নিধ্যে থেকে মজিদ বহু ভগ্ন ও নির্মমভাবে আঘাত পাওয়া হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছে।

২৫। মজিদ আকাশের পানে হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল কেন? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : অন্যদের কাছে নিজেকে আল্লার খাস বান্দা প্রমাণ করার জন্য মজিদ আকাশের পানে দুহাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ‘লালসালু’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ মহব্বতনগরে প্রবেশ করে নাটকীয়ভাবে। তার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থোদ্ধার করা, ধর্মব্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে শিকড়হীন বৃক্ষ থেকে বটগাছে পরিণত করা। তাই সে সবার কাছে নিজেকে ধার্মিক প্রমাণের জন্য আকাশের পানে দুহাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল।

২৬। “তোমার একটা সাথি আনুম?” উক্তিটি দ্বারা মজিদ কী বোঝাতে চেয়েছে?

উত্তর : “তোমার একটা সাথি আনুম” উক্তিটি দ্বারা মজিদ তার দ্বিতীয় বিয়ে করার পরিকল্পনাকে বোঝাতে চেয়েছে। বহু বছর হলো মজিদ রহিমাকে বিয়ে করেছে। রহিমা তাকে সন্তান দিতে পারেনি। তাই সন্তানের জন্য তার নিঃসঙ্গতা। শুধু তাই নয়, হাসুনির মায়ের অনাবৃত শরীর দেখে তার কামনা জাগে। সে দ্বিতীয় বিয়ে করে তার উন্মাদনা চরিতার্থ করতে চায়। সেজন্যই কৌশলে রহিমাকে সে দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা জানায়। প্রশ্নোক্ত উক্তিটি দ্বারা মজিদ এ বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছে।

২৭। জমিলার মনে কেন বিদ্রোহ জাগে?

উত্তর : মজিদের নিষ্ঠুরতা জমিলাকে বিদ্রোহী করে তোলে। হীন মানসিকতার অধিকারী মজিদ। জমিলার নামাজ পড়ার কড়া হুকুম জারি করে মজিদ। জমিলা নামাজ পড়তে গিয়ে ক্লান্তিতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত জমিলাকে দেখে মজিদ ভাবে যে, সে নামাজ পড়েনি। তাই কোনকিছু জিজ্ঞেস না করেই তাকে শাস্তি দেয়। মজিদের এমন আচরণে রুষ্ট জমিলার মনেও বিদ্রোহী চেতনা জেগে ওঠে।

২৮। রহিমা জমিলাকে কীভাবে গ্রহণ করেছিল?

উত্তর : রহিমা সতিন জমিলাকে নিজের সন্তানের মতোই স-স্নেহে গ্রহণ করেছিল। সম্পর্কে জমিলা রহিমার সতিন হলেও জমিলার বয়স রহিমার অর্ধেক। অন্যদিকে রহিমা স-স্নেহে প্রবণ মাতৃহৃদয়ের অধিকারী। তাই সতিন হওয়া সত্তেও রহিমা জমিলার মাঝে সন্তানের ছায়া দেখতে পেয়েছিল। এজন্যই রহিমা জমিলাকে সন্তানের স্নেহে গ্রহণ করেছিল।

২৯। মজিদ আওয়ালপুরে যায় কেন? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : আওয়ালপুরে আগত পীরের কারসাজি ধরিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার জন্যই মজিদ আওয়ালপুরে যায়। মহŸতনগরের লোকেরা মজিদকে মান্য করে। আওয়ালপুরে আগত পীরের কাছে তাদের যাতায়াত ধর্মব্যবসায়ী মজিদকে ব্যবসায়ে ধর্ম সম্পর্কে শঙ্কিত করে তোলে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা, একবার তার প্রতি কারও অবিশ্বাস বা সন্দেহ দেখা দিলে তা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মজিদ তাই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আওয়ালপুরে যায়।

৩০। হাসুনির মা বাবার বাড়িতে থাকত কেন? বুঝিয়ে দাও।

উত্তর : বিয়ের কিছুদিন পর স্বামী মারা যায় বলে হাসুনির মা তার বাবার বাড়িতে থাকত। হাসুনির মা নিম্ন বিত্তের বিপন্ন মানুষ। তার বাবার আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। বিয়ের কিছুদিন পর তার স্বামী মারা যায়, অর্থাৎ সে অকাল বিধবা। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার সাথে খারাপ আচরণ করত। তাই বাঙালি সমাজের চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী তাকে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে।

৩১। সজোরে নড়তে থাকা পাখাটার পানে তাকিয়ে সে মূর্তিবত বসে থাকে’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : সজোরে নড়তে থাকা পাখাটার পানে তাকিয়ে সে মূর্তিবৎ বসে থাকে’ বলতে লেখব অপমানিত, ঈর্ষাকাতর মজিদের নির্লিপ্ত ভাবকে বুঝিয়েছেন। আওয়ালপুর গ্রামে নতুন এক পীরের আবির্ভাব ঘটে। সেই গ্রাম তখন লোকে লোকারণ্য। পীরের কীর্তিকলাপ দেখতে মজিদও সেখানে যায়। কিন্তু বেঁটে হওয়ার কারণে সে পীরের মুখ দেখতে পায় না, শুধু পাখা নাড়ানো দেখে। সবাই পীরকে নিয়ে ব্যস্ত, মজিদকে কেউ সমীহ করে না, এমনকি যারা তাকে চেনে তারাও না। এতে মজিদ অপমান বোধ করে। উপরন্তু যখন মতলুব খাঁ পীরের গুণাবলি ব্যাখ্যা করে এবং তা শুনে লোকজন ডুকরে কেঁদে ওঠে তখন মজিদ সজোরে নড়তে থাকা পাখাটির দিকে তাকিয়ে মূর্তির মতো বসে থাকে।

৩২। “এখন সে ঝড়ের মুখে উড়ে চলা পাতা নয়, সচ্ছলতায় শিকড়গাড়া বৃক্ষ”- কেন?

উত্তর : এখন সে ঝড়ের মুখে উড়ে চলা পাতা নয়, স্বচ্ছলতায় শিকড়গাড়া বৃক্ষ- উক্তিটির মধ্য দিয়ে মজিদের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। একদিন মসজিদে যাওয়ার পথে ধুলো ওড়া মাঠের দিকে তাকিয়ে মজিদের অতীত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে দশ বারো বছর আগে সে এ গ্রামে যখন প্রথম এসেছিল তখন তার কিছুই ছিল না। অথচ আজ তার অনেক কিছু হয়েছে। আর্থিক অবস্থা ফিরেছে, সম্মান প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সময় এখন ভালোই কাটছে। সে আশা করে ভবিষ্যতের দিনগুলোও তার আরও ভালো কাটবে। কারণ সে এখন আর ঝড়ের মুখে উড়ে চলা পাতা নয়, তার এখন সংসার আছে। সে সচ্ছল এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তার শেকড় সমাজের অনকে গভীরে প্রোথিত হয়েছে। আজ সে শিকড়গাড়া বৃক্ষ।

৩৩। “গ্রামের লোকেরা যেন রহিমার অন্য সংস্করণ”- ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা সহজ, সরল, ধর্মভীরু হওয়ায় লেখক প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন। সরলতা ও বিশ্বাসের দিক থেকে গ্রামের লোকের যেন তারই মতো। রহিমা ঠান্ডা, ভিতু মানুষ। তার এই ভীতি, নরম-কোমল, শান্ত রূপের পেছনে সক্রিয় রয়েছে ঈশ্বর বিশ্বাস এবং মাজার বিশ্বাস। মাজারের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামী মজিদের প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য ও প্রগাঢ় ভক্তি। মহব্বতনগর গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অন্ধধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলোও এমন। রহিমা তাদের একজন যোগ্য প্রতিনিধি।

৩৪। ‘যেন বিশাল সূর্যোদয় হয়েছে, আর সে আলোয় প্রদীপের আলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’- ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : প্রশ্নোক্ত বাক্যে আওয়ালপুরে আগত পীর সাহেবের জনপ্রিয়তার মজিদের মাজারের শোচনীয় অবস্থাকে নির্দেশ করা হয়েছে। আওয়ালপুরে পৌঁছে মজিদ দেখে পীর সাহেব আস্তানা গেড়েছে সেখানে তুমুল ভিড়। সামনে শত শত লোক বিভোর হয়ে বসে আছে, কেউ কাউকে লক্ষ করছে না। মজিদকে চেনে এ রকম অনেক লোক সেখানে আছে। ভিড়ের মাঝে তারাও মজিদকে চেনার চেষ্টা করছে না। পীর সাহেবের দ্যুতির কাছে মজিদ আজ প্রদীপের আলো।

৩৫। আমেনা বিবিকে কিরূপ শাস্তি দিয়েছিল মজিদ?

উত্তর : প্রতিহিংসাবশত মজিদ আমেনা বিবিকে শাস্তি স্বরূপ খালেক ব্যাপারীকে তালাক দিতে বাধ্য করেছিল। নিঃসন্তান আমেনা বিবি মজিদের নিষেধ অমান্য করে আওয়ালপুরে আগত পীরের পানিপড়া খেতে চেয়েছিল। এক্ষেত্রে মজিদ অমানবিক, নিষ্ঠুর, ধর্মব্যবসায়ী। সে গ্রামের সবাইকে আওয়ালপুরে আগত পীরের কাছ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য। তাই আমেনা বিবি তা অমান্য করায় মজিদ তাকে শাস্তি দিতে খালেক ব্যাপারীকে বাধ্য করেছিল তার স্ত্রী আমেনাকে তালাক দিতে।

৩৬। “চোখে তার তেমনি শিকারির সুচাগ্র-একাগ্রতা”- বুঝিয়ে লেখ।

উত্তর : প্রশ্নোক্ত বাক্যটিতে তাহেরের একাগ্রচিত্তে মাছ ধরার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। শ্রাবণের শেষাশেষি নিরাক পড়া এক দিনে মহব্বতনগরের তাহের ও কাদের দুই ভাই নৌকায় করে মাছ ধরতে যায় বিস্তীর্ণ ধানখেতে। অতি সন্তর্পণে ধানের ফাঁকে ফাঁকে তারা নৌকা চালায়, তাতে ঢেউ হয় না, শব্দ হয় না। সেখানে গলুই এ মূর্তির মতো তাহের দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে তার ধারালো দৃষ্টি, তা যেন সূচের অগ্রভাগের মতো তীক্ষèতাসম্পন্ন, মাছ দেখলেই তার উপর কৌশল প্রয়োগ করার সতর্কতা।

৩৭। “বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে চোখ।”- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দিশেহারা মানুষের কাছে বিশ্বাস ছাড়া আর কিছু নেই- এ বিষয়টি বোঝাতেই প্রশ্নোক্ত কথাটি বলা হয়েছে। গ্রামের মানুষের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের সোনালি ফসল প্রচন্ড ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় কৃষকরা ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তারা ত্রাণকর্তা মজিদের কাছে ছুটে যায়। তখন মজিদ তাদের বলে- ‘খোদার উপর তোয়াক্কল রাখো।’ আর তখন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীর মুখে আর কোন কথা জোগায় না। তারা ঝরে পড়া ধানের ধ্বংসস্তুপ প্রত্যক্ষ করে। বিশ্বাসের পাথরে যেন খোদাই সে চোখ।

৩৮। ‘দলিল দস্তাবেজ জাল হয়, কিন্তু খোদাতালার কালাম জাল হয় না।’ – এ কথার তাৎপর্য কী?

উত্তর : আমেনা বিবির জন ধলা মিয়া মজিদের কাছে পানিপড়া চাইলে মজিদ প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করে খোদার কালামের পুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছে। ধলা মিয়া ভিতু ও অলস প্রকৃতির মানুষ। খালেক ব্যাপারীর দ্বিতীয় পক্ষের বিবির বড় ভাই সে। ব্যাপারী তাকে আওয়ালপুরে আগত পীরের কাছ থেকে পানি পড়া আনতে আদেশ দেয়। ভূতের ভয়ে সেখানে না গিয়ে মজিদের কাছে গিয়ে সে বিষয়টি জানায় এবং তাকে পানিপড়া দিতে বলে। ধলা মিয়া ব্যাপারটি ফাঁকি দিতে চায়। তখন তাকে মজিদ প্রশ্নোক্ত কথাটি বলে।

৩৯। “মজিদের শক্তি ওপর থেকে আসে, তখন ঐ সালু কাপড়ে আবৃত মাজার থেকে”- ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : মজিদের সব ক্ষমতার উৎস যে ঐ মাজার সেখানে সেটিই বোঝানো হয়েছে। মজিদ মহব্বতনগরে পুরনো জীর্ণ কবরকে জনৈক মোদাচ্ছের পীরের কবর বলে চালিয়ে দিয়েছে, যা গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ বিশ্বাস করেছে। সালু আবৃত মাজারটি মজিদের সব অপশাসন ও ক্ষমতার উৎস। গ্রামের ধনী ব্যক্তি খালেক ব্যাপারী গ্রামের মানুষকে শাসন করলে তাদের মনে একটু প্রতিহিংসা জাগে, অথচ মজিদের বেলায় তা জাগে না- কারণ মজিদের ক্ষমতার উৎস হলো মাজার, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধর্মীয় অনুভূতি। প্রশ্নোক্ত উক্তিটি ছাড়া এ বিষয়টিকে বোঝানো হয়েছে।

৪০। “শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি”- বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : “শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি” বলতে বোঝানো হয়েছে খাদ্য না থাকলেও লোক দেখানো ধর্মচর্চায় কেউ কার্পণ্য করে না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘লালসালু’ উপন্যাসে যে এলাকার বর্ণনা দিয়েছেন সেখানকার মানুষ প্রচন্ড অভাবী। এই অভাবের মধ্যে তারা ধর্মচর্চা করে। ঘরে খাদ্য না থাকলেও সেই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ধর্মচর্চায় কোন কার্পণ্য নেই। তাদের মধ্যে সবাই খোদার ভক্তে ধর্মচর্চা করে এমন নয়। কেউ কেউ ধর্মের নামে প্রতারণা ও ভন্ডামি করে। এই প্রতারকরাই ধর্মের আগাছা। তাই লেখক আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।

৪১। ‘দেশটা কেমন মরার দেশ’- এখানে কোন অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে, কেন?

উত্তর : ‘দেশটা কেমন মরার দেশ’- এখানে বাংলাদেশের সেই অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে শস্যশূন্য মাঠ, জনসংখ্যার আধিক্য, অভাব অনটন তাদের নিতসঙ্গী। ‘লালসালু’ উপন্যাসের শুরুতেই লেখক বাংলাদেশের শস্যহীন জনবহুল এক অঞ্চলের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে শস্য নেই। শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি অর্থাৎ অভাবের মধ্যে ধর্মচর্চা ও কুসংস্কার লালনের প্রতিযোগী বেশি। সেই অঞ্চল কেমন যেন মরার দেশ। শস্য যা উৎপন্ন হয় তা জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় অতি সামান্য। সেই অঞ্চলেই মজিদের বাড়ি। সেখান থেকে অন্যদের সাথে মজিদ জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে।

৪২। মজিদ কীভাবে মহব্বতনগর গ্রামে শিকড় গেড়েছিল?

উত্তর : মজিদ অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে খোদাভীতি জাগিয়ে মহব্বতনগর গ্রামে শিকড় গেড়েছিল। মজিদ কথিত মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে কেন্দ্র করে মহব্বতনগর গ্রামবাসীকে ধর্মের ভয় দেখায় এবং আত্মস্বার্থ সিদ্ধির জন্য শোষণের জাল বিস্তার করে। অল্পদিনের মধ্যেই সে ঐ গ্রামে শিকড় গেড়ে বসে। সেখানে যদি কেউ তার বিরোধিতা করতে চেয়েছে তাকে সে অপমান করেছে, শাস্তি দিয়েছে। শঠতা, প্রতারণা ও মিথ্যার মাধ্যমে সে তার প্রভুত্ব চালিয়েছে। গ্রামের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিদের সে হাত করেছে, সাধারণ মানুষকে ধর্ম পালনের নানা রকম অপব্যাখ্যা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গই বোঝানো হয়েছে প্রশ্নোক্ত বাক্যে।

৪৩। হাসুনির মাকে তার বাপ পিটিয়েছিলেন কেন?

উত্তর : বাবা মায়ের ঝগড়া বিবাদে রাগের বশে বলা একান্ত ব্যক্তিগত কথা হাসুনির মা বাইরে প্রকাশ করায় হাসুনির মা কে তার বাপ প্রাণের আশ মিটিয়ে পিটিয়েছিল। বুড়োর প্রতি ক্ষুদ্ধ বুড়ি ঝগড়া করার সময় রাগে বশে অনেক কথা বলে। সেসব কথার মধ্যে বুড়ো যাদের সন্তান ভাবছে তারা তার ঔরসজাত সন্তান নয় বুড়ি এমন কথাও বলে। বুড়ো এ কথাকে বুড়ির প্রলাপ মনে করলেও তাদের মেয়ে হাসুনির মা ব্যাপারটি ঘরের বাইরে প্রকাশ করে। এতে বুড়ো প্রচÐ ক্ষুদ্ধ হয় এবং বুড়ো বুঝতে পারে যে হাসুনির মা-ই ঐ কথা ছড়িয়েছে। তাই বাড়িতে পৌঁছামাত্রই হাতের কাছে পেয়ে যায় হাসুনির মাকে। ইচ্ছামতো পিটিয়ে নিজের মনের ক্ষোভ মেটায়।

 

৪৪। ‘গ্রামের লোকেরা যেন রহিমারই অন্য সংস্করণ’- মন্তব্যটি বুঝিয়ে লেখ।

উত্তর : মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা সহজ, সরল, ধর্মভীরু হওয়ায় লেখক প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন। সরলতা ও বিশ্বাসের দিক থেকে গ্রামের লোকেরা যেন তারই মতো। রহিমা ঠান্ডা, ভিতু মানুষ। তার এই ভীতিবিহবল নরম কোমল শান্ত রূপের পেছনে সক্রিয় রয়েছে ঈশ্বর বিশ্বাস এবং মাজার বিশ্বাস। মাজারের প্রতিনিধি হিসেবে স্বামী প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য ও ভক্তি। মহব্বতনগর গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অন্ধধর্ম বিশ্বাসী মানুষগুলোও এমন। রহিমা তাদের একজন যোগ্য প্রতিনিধি।

 

৪৫। “পোলা মাইনষের মাথায় একটা বদ খেয়াল ঢুকছে”- উক্তিটি দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষা প্রসারে মহব্বতনগর গ্রামের শিক্ষিত যুবক আক্কাসের উদ্যোগের বিরোধিতার বিষয়টিকে নির্দেশ করা হয়েছে। মহব্বতনগর গ্রামের আক্কাস আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক। সে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা দূর করতে চায়। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তখন মাজার ব্যবসায়ী মজিদ এর বিরোধিতা করে। সে আক্কাসের স্কুল প্রতিষ্ঠাকে তার জন্য হুমকি মনে করে। তাই তার স্কুল প্রতিষ্ঠার ভাবনাকে বদ খেয়াল বলে সে আখ্যায়িত করে।

 

৪৬। “সজ্ঞানে না জানলেও তারা একাট্টা, পথ তাদের এক।”- ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : সজ্ঞানে না জানলেও তারা একট্টা পথ, তাদের এক খালেক ব্যাপারী এবং মজিদের আন্ত:সাদৃশ্য সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে। মহব্বতনগর গ্রামের ভূ-স্বামী খালেক ব্যাপারী এবং তথাকথিত ধর্মীয় মোল্লা মজিদের মধ্যে নিজ নিজ প্রয়োজনে অনিবার্যভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কারণ দুজনের ভূমিকাই শোষকের। একজনের কাছে আছে মাজার, অন্যজনের জোতজমি ও প্রতিপত্তি। মজিদ মহব্বতনগর গ্রামবাসীর ধর্মবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে মাজারকে কেন্দ্র করে ধর্মের দোহাইদিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করেছে। শিক্ষিত যুবক আক্কাসকে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। এতে মজিদের সঙ্গে গ্রামের সম্পদশালী খালেক ব্যাপারীও যোগ দিয়েছে।

 

৪৭। “রহিমা অলক্ষে ছাপিয়ে ওঠা অশ্রুর সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই করে জমিলা তারপর কেঁদে ফেলে।”-

উত্তর : নিজের জীবনের অপ্রত্যাশিত পরিণতির কথা চিন্তা করে রহিমার অলক্ষে ছাপিয়ে ওঠা অশ্রুর সঙ্গে লড়াই করে জমিলা কেঁদে ফেলে। মজিদ যখন বিয়ে করতে যায় তখন তাকে দেখে জমিলার মনে ‘তানি বুঝি দুলার বাপ।’ বিয়ের পর মজিদের বাড়িতে এসে রহিমাকে দেখে মনে হয়েছিল শাশুড়ি। অথচ তারা তা নয়-এ বিষয়টি ভাবতে গিয়ে জমিলা হাসতে থাকে। এ বিষয়টি জেনে রহিমার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে, যা দেখে জমিলা নীরব হয়ে যায়। তার চোখ ছলছল করে ওঠে। কারণ সে ভাবতে পারেনি একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে তার বিয়ে হবে। নিজের এই দুর্ভাগ্যে কথা চিন্তা করে রহিমার অলক্ষে ছাপিয়ে ওঠা অশ্রুর সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই করে জমিলা তারপর কেঁদে ফেলে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

৪৮। “আজ সেখানে নির্ভেজাল নিষ্ঠুর হিং-।”- এর অর্থ বুঝিয়ে দাও।

উত্তর : প্রশ্নোক্ত বাক্যে বিদ্রোহী জমিলার প্রতি ক্রোধোন্মত্ত মজিদের আচরণের দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। মজিদের নাান অত্যাচার ও নিস্পেষণে জমিলা এক সময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ অবাধ্যতা ও দুঃসাহসে মজিদ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। ভিতরে ভিতরে সে অন্ধ সাপের মতো ফুঁসতে থাকে। মজিদের সেই চেহারা দেখে রহিমার বুক কেঁপে ওঠে। রহিমা স্বামীর রাগ অনেকবারই দেখেছে, তবে সেই রাগ ছিল সমবেদনার। কিন্তু আজ সেখানে নির্ভেজাল নিষ্ঠুর হিংস্রতা।

 

৪৯। মজিদের মুখে কে থুথু দিয়েছিল? কেন?

উত্তর : হঠাৎ সিধা হয়ে মজিদের বুকের কাছে এসে পিচ করে তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করল জমিলা। ‘লালসালু’ উপন্যাসে মজিদের বিপরীতে প্রবাহিত একমাত্র সক্রিয় চরিত্র হলো জমিলা। মহব্বতনগরের সবাই মজিদকে ভয় পেলেও জমিলা ভয় পায় না। তাই মজিদ জমিলার অন্তরে ভীতি সঞ্চার করার জন্য তাকে মাজারে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু জমিলা তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মজিদের কঠিন হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন ছাড়াতে পারে না তখন মজিদের এমন অন্যায় কাজের প্রতিবাদস্বরূপ সে মজিদের বুকের কাছে এসে পিচ করে তার মুখে থুথু নিক্ষেপ করে।

 

৫০। ‘ধান দিয়া কী হইব, মানুষের জান যদি না থাকে’- এ উক্তি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : বাইরে প্রচন্ড ঝড়-শিলাবৃষ্টি হচ্ছে দেখে মজিদ ধানের ক্ষতি সম্পর্কে কথা বলায়, রহিমা ক্ষুদ্ধ হয়ে মজিদকে প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছে। জমিলাকে মাজার আঙ্গিনা থেকে বন্ধনমুক্ত করে তাকে ঘরে নিয়ে আসতে বলা প্রসঙ্গে রহিমা মজিদকে উক্তিটি করেছে। জমিলাকে শাস্তি দিতে এক রাতে মজিদ তাকে মাজারের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে। এর পর শুরু হয় ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি। সেই অবস্থায় নির্দয় মজিদ জমিলার কথা না ভেবে মাঠে ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে কথা বলে। জবাবে উৎকণ্ঠিত রহিমা প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করে জমিলাকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসতে বলে। উপন্যাসজুড়ে ব্যক্তিত্বহীন রহিমা এখানে এসে মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বময়ী হয়ে উঠেছে।

 

৫১। “তাই তারা ছোটে, ছোটে”- কেন? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর : ‘লালসালু’ উপন্যাসে অভাবের তাড়নায় অনাহারক্লিষ্ট গরিব মানুষেরা কাজের সন্ধানে ছুটে চলে। এখানে প্রশ্নোক্ত বাক্যটিতে মানুষের এই ছুচে চলাকে বোঝানো হয়েছে। ‘লালসালু’ উপন্যাসে উল্লেখকৃত অঞ্চলটিতে খেতে শস্য নেই, কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। তাদের ঘরে কিছু নেই। ভাগাভাগি লুটালুটি, আর স্থানবিশেষে খুনাখুনি করে সর্বপ্রচেষ্টার শেষ। দৃষ্টি তাদের বাইরের দিকে। দূরে তাকিয়ে তাদের চোখে আশার আলো জ্বলে। তাই সেই এলাকার লোকজন বেঁচে থাকার তাগিদে দেশের নানা অঞ্চলে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়।

 

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment