যুবক রাজা The Young Prince অস্কার ওয়াইল্ড গল্পসমগ্র [ অনুবাদ সাহিত্য ]

যুবক রাজা

The Young Prince

যুবক রাজা The Young Prince অস্কার ওয়াইল্ড গল্পসমগ্র [ অনুবাদ সাহিত্য ]

 

যুবক রাজা The Young Prince অস্কার ওয়াইল্ড গল্পসমগ্র [ অনুবাদ সাহিত্য ]
যুবক রাজা The Young Prince অস্কার ওয়াইল্ড গল্পসমগ্র [ অনুবাদ সাহিত্য ]

রাজ-অভিষেকের আগের রাত্রি যুবক রাজা তাঁর সুন্দর ঘরে একা বসে রয়েছে। যুগের প্রথা অনুযায়ী সভাসদেরা তাঁকে আভূমি প্রণাম করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছেন। সেখান থেকে রাজপ্রাসাদের ‘গ্রেটহল’-এ তাঁরা জমায়েত হয়েছেন-রীতি শিক্ষার বিখ্যাত অধ্যাপকের কাছ থেকে রীতি সম্বন্ধে কিছু বক্তৃতা শোনার জন্যে। সভাসদদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ ছিলেন সভার আদব-কায়দাটাকে তখনো যাঁরা রপ্ত করতে পারেননি এবং আমার ধারণা, যে কোনো সভাসদের কাছে এটি একটি অমার্জনীয় অপরাধ।

সভাসদেরা চলে যাওয়ার ফলে বালকটির–সত্যিই বালক ছাড়া আর কিছু নন তিনি–ষোল বছরের যুবককে আর কী বলা যেতে পারে– কোনো দুঃখ হল না। একটি নরম সোফার ওপরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। অরণ্যবাসী কোনো দেবতার মতো খুলে দিলেন তাঁর বিস্মিত দুটো চোখ আর ঠোঁট; শিকারির জালে আটকে পড়া নতুন কোনো জন্তুর মতো অবাক বিস্ময়ে তিনি তখন তাকিয়েছিলেন।

আর সত্যি কথাই তো! তিনি যখন বাঁশি হাতে নিয়ে একটি মেষপালকের যাকে তিনি নিজের বাবা বলেই জানতেন–মেষের পাল নিয়ে চরাতে বেরিয়েছিলেন ঠিক সেই সময় হঠাৎ শিকারিরা তাঁকে ধরে নিয়ে আসে। শোনা যায়, একদিন একটি যুবক-অনেকের মতে বিদেশি-বাঁশি বাজিয়ে বৃদ্ধ রাজার কন্যাকে মুগ্ধ করেছিল। আবার কেউ কেউ বলে যুবকটি বিমিনি থেকে এসেছিল। পেশায় সে ছিল চিত্রকর। তার সাংসারিক অবস্থা সাধারণ হলেও, রাজকুমারী তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন-ততটা সম্মান তার নাকি পাওয়ার কথা ছিল। না। তারপরে গোপনে সে রাজকুমারীকে বিয়ে করে। এই যুবকটি তাদেরই পুত্র। তারপরে হঠাৎ একদিন গির্জার কাজ অসমাপ্ত রেখেই চিত্রকরটি কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। শিশুটির বয়স তখন সাত দিনও হয়নি। তার মা তখন ঘুমোচ্ছিলেন। সেই সময় বৃদ্ধ রাজার বিশ্বস্ত একটি অনুচর তাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের নীচে একটি অপুত্রক কৃষক দম্পতির বাড়িতে পোঁছে দিয়ে আসে। দুঃখে জর্জরিত হয়ে, না, তীব্র এক পেয়ালা ইতালিয়ান বিষপান করার জন্যে-খবরটা কেউ জানে না–ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীর মৃত্যু হয়। যে সময়ে রাজার বিশ্বস্ত অনুচর তাঁর শিশুপুত্রটিকে নিয়ে দূরে পাহাড়তলীতে কৃষক দম্পতির দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে আজ একদল লোক রাজকুমারীর মৃতদেহটি নিয়ে একটি পরিত্যক্ত সমাধি ক্ষেত্রে উপস্থিত হল। সেখানে আগে থেকে কবর একটা খোলাই ছিল। সেইখানেই তাঁকে কবর দেওয়া হল। লোকমুখে শোনা যায় ওরই মধ্যে আর একটি যুবককে কবরস্থ করা হয়েছিল। যুবকটি বিদেশি কিন্তু অপরূপ সুন্দর। তার দুটি হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা; আর বুকের ওপরে অনেকগুলি রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।

অন্তত এই রকমই একটা কাহিনি ওই অঞ্চলে লোকের মুখে প্রচলিত ছিল; তবে তারা এই নিয়ে কোনোদিনই একটা হইচই করেনি। তারপরে এটাও নিশ্চিত বৃদ্ধ রাজা মৃত্যুশয্যায় তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন। হয় নিজের পাপ কাজের জন্যে তিনি অনুতপ্ত হয়েছিলেন অথবা রাজসিংহাসন বাইরের কারও হাতে চলে যায় তা তিনি চাননি। সেইজন্যেই অনুচরদের পাঠিয়ে এই যুবকটিকে ধরে এনে পাত্রমিত্র সভাসদদের সামনে এঁকে রাজার পদে অভিষিক্ত করেছিলেন।

তাঁকে দেখে মনে হয় রাজার স্বীকৃতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মধ্যে সৌন্দর্যের প্রতি যে অপূর্ব একটা স্পৃহা ছিল–আর যেটা ভবিষ্যতে তাঁর ওপরে অভাবিত প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনা নিয়েছিল–সেই আশঙ্কা তাঁর দেহের অণুতে-অণুতে প্রতিবিম্বিত হয়ে উঠেছিল। যারা তাঁর সঙ্গে থাকত তাদের মুখে শোনা যায় কী এক অপূর্ব আনন্দে দিশেহারা হয়ে তিনি সুসজ্জিত। একটি প্রকোষ্ঠ থেকে আর এক প্রকোষ্ঠে ছুটে বেড়াতেন। অরণ্যজীবনের স্বাধীনতা থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন বটে, রাজসভার অজস্র কৃত্রিমতা তাঁকে যে মাঝে-মাঝে ব্যথা দিত সেকথাও মিথ্যে নয় কিন্তু রাজসভার দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে বিপুল আনন্দে তিনি প্রাসাদের মধ্যে ছোটাছুটি করতেন। এই রাজপ্রাসাদটি তাঁর কাছে নব-আবিষ্কৃত সাম্রাজ্যের মতো মনে হয়েছিল।

এই সময়ে যদিও রঙদার পোশাক পরা চাপরাশির দল তাঁর পেছনে-পেছনে ঘুরে বেড়াত, তবুও অনেকটা সময়ই তিনি একা থাকতেন। এই সময়েই তিনি স্বর্গীয় আনন্দ পেতেন, এ থেকে এইটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সমস্ত কলা গোপনে শিক্ষা করাই প্রশস্ত; আর সমস্ত জ্ঞানের মতো সৌন্দর্যকেও নিঃসঙ্গ পূজারীরাই ভালোবাসে বেশি।

যা কিছু দুষ্প্রাপ্য, আর যা কিছু মূল্যবান সে সব জিনিসের ওপরেই নিশ্চয় তাঁর একটা তীব্র আকর্ষণ ছিল। সেই সব জিনিস সংগ্রহ করার জন্যে তিনি চারপাশে লোক পাঠাতে লাগলেন। কাউকে পাঠালেন উত্তর সাগরের জেলেদের কাছে; রাজাদের কবরের তলায় যে সমস্ত অদ্ভুত–অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন সবুজ রঙের মূল্যবান পাথর থাকে সেগুলি তুলে আনতে কাউকে পাঠালেন ইজিপ্টে, কাউকে পাঠালেন সিল্কের কার্পেট আনতে পারস্যে, আবার চন্দন কাঠ আর সুন্দর পশমের তৈরি শাল সংগ্রহ করতে পাঠালেন ভারতবর্ষে।

কিন্তু যে পোশাকটি পরে তাঁর রাজ্যাভিষেক হবে সেইটি নিয়েই তিনি চিন্তা করছিলেন সবচেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে ছিল রুবি দিয়ে গাঁথা মুকুট আর মুক্তোর বুটি দিয়ে তৈরি করা লম্বা রাজদণ্ডটি। খোলা চুল্লির ভেতরে যে পাইন কাঠের গুঁড়ি জ্বলছিল সেদিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে বেশ আরামপ্রদ সোফার ওপরে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বিশেষ করে সেদিন তিনি তাদের কথাই ভাবছিলেন। সে যুগের দেশ-বিখ্যাত চিত্রকরদের নক্সা কয়েক মাস আগেই অনুমোদনের জন্যে তাঁর কাছে দেওয়া হয়েছিল; তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে নক্সা মতো কাজ শেষ করার জন্যে চিত্রকররা যেন দিনরাত্রি পরিশ্রম করে, আর এদের উপযুক্ত মণিমুক্তা আহরণের জন্যে আহরকেরা যেন সারা বিশ্বের ভাঁড়ার তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করে। কল্পনায় তিনি দেখতে পেলেন রাজার সুন্দর পোশাক পরে তিনি যেন গির্জার বিরাট বেদীর কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর সেই শিশুর ঠোঁটে হাসি উঠেছে ফুটে আর তাঁর সেই অরণ্যক দৃষ্টির ওপরে ঝলকে পড়েছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি।

একটু পরেই সোফা থেকে উঠে চিমনির গায়ে হেলান দিয়ে সেই ঘরের দিকে তাকালেন তিনি। ঘরের ভেতরে আলোর বেশি জেল্লা ছিল না। দেওয়ালগুলি মূল্যবান পর্দায় ছিল ঢাকা; তাদের ওপরে আঁকা ছিল ট্রায়াম্প অফ বিউটির ছবি। বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন গির্জার বিরাট গম্বুজটি অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িগুলির ওপর দিয়ে বুদ্বুদের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। কুয়াশায় ঢাকা নদীর চরে প্রহরীদের টহল দেওয়ার পদধ্বনি তাঁর কানে এল। অনেক দূরে বাগানে কোথায় একটা নাইটিংগেল পাখি গান করছিল। সে-সুরও তিনি শুনতে পেলেন। খোলা জানালার ভেতর দিয়ে যুঁইফুলের অস্পষ্ট একটা গন্ধ ভেসে আসছিল। তাঁর চোখ দুটি ভারী হয়ে এল; অদ্ভুত একটা আলস্য গ্রাস করে ফেলল তাঁকে। গম্বুজের ঘড়ি থেকে মধ্যরাত্রি ঘোষিত হল। তিনি একটি বেল বাজালেন। চাকররা এসে কেতাদুরস্তু-ভাবে তাঁর পোশাক পরিবর্তন করল, গোলাপজল দিয়ে ধুইয়ে দিল তাঁর হাত, তাঁর বালিশের ওপরে ছড়িয়ে দিল ফুল। চাকররা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

তারপরেই তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন এবং এটি তাঁর নিজেরই স্বপ্ন।

মনে হল তিনি যেন একটি নীচু লম্বা চিলেকোঠার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সেই ঘরের ভেতরে অনেকগুলি তাঁত চলছে। তাদেরই শব্দে গমগম করছে ঘরটা। ঝাঁঝরি-দেওয়া জানালার ভেতর দিয়ে সামান্য আলো ঢুকছে ভেতরে। সেই আলোতেই তিনি দেখতে পেলেন রোগাটে চেহারার কিছু রুগ্ন মানুষ তাঁতের ওপরে ঝুঁকে কাজ করছে। বিবর্ণ রুগ্ন কতগুলি শিশু কড়িকাঠের গায়ে বসে রয়েছে জড়াজড়ি হয়ে। তাঁতযন্ত্রের ভেতরে দিয়ে মাকুগুলো যখন তীব্রভাবে ধাক্কা দিচ্ছে, লোকগুলি সেই সব ভারী কাঠের পাটাগুলি নীচু করে সুতোগুলিকে জড়িয়ে দিচ্ছে এক সঙ্গে। তাদের মুখগুলি অনাহারে রুগ্ন; তাদের রোগা হাতগুলি কাঁপছিল; কয়েকটি অভুক্ত চেহারার মেয়েমানুষ টেবিলের ধারে বসে-বসে সেলাই করছিল। একটা বিশ্রী দুর্গন্ধে ঘরটা ভারাক্রান্ত বাতাস দুর্গন্ধময়, দেওয়াল ভিজে জ্যাবজেবে, অস্বাস্থ্যকর।

যুবক রাজা একটি তাঁতির কাছে দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখতে লাগলেন।

লোকটা রেগে তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল–তুমি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কেন? আমাদের মনিব কি গোপনে আমাদের দিকে লক্ষ রাখতে তোমাকে পাঠিয়েছে?

তোমাদের মনিব কে?-জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

তিক্তভাবে চিৎকার করে উঠল তাঁতি-আমাদের মনিব! চেহারায় আমারই মতো দেখতে–কিন্তু তফাৎ অনেক। সে সুন্দর-সুন্দর পোশাক পরে; আর আমি পরি ছেঁড়া পোশাক। আমি না খেতে পেয়ে দুর্বল হচ্ছি–আর সে দুর্বল হচ্ছে ভূরিভোজন করে।

রাজা বললেন–এটা স্বাধীন দেশ। এখানে তুমি কারও ক্রীতদাস নও।

তাঁতিটি বলল–যুদ্ধের সময় শক্তিমানেরা দুর্বলদের ক্রীতদাস বানায়; আর শান্তির সময় দরিদ্রদের ক্রীতদাস বানায় ধনীরা। বেঁচে থাকার জন্যে কাজ করতে হয় আমাদের। আর তারা আমাদের মাইনে এত কম দেয় যে আমরা না খেয়ে মারা যাই। তাদের জন্যেই সারাদিন আমরা পরিশ্রম করি। তারা তাদের সিন্দুক ভরিয়ে তোলে সোনায়। আমাদের ছেলেমেয়েরা খেতে না পেয়ে অকালেই মারা যায়। যাদের আমরা ভালোবাসি তাদের মুখ শক্ত আর নোংরা হয়ে ওঠে। আমরা আঙুল ফল মাড়াই, আর তারা খায় মদ। শস্য বুনি আমরা, ফসল তোলে তারা। আমাদের জন্যে রয়েছে শেকল–অথচ, কেউ তা লক্ষ করে না; আমরা ক্রীতদাস–যদিও সবাই বলে আমরা স্বাধীন।

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–তোমাদের সবারই কি এই অবস্থা?

তাঁতিটি বলল–সবার, সবার–যুবক, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশুসকলের অবস্থাই এই এক। ব্যবসাদার আমাদের পিষে মারে; তাদের নির্দেশ আমাদের মেনে চলতে হয়। পুরাহিতরাও মালা জপ করে আমাদের মাথায় কাঁটাল ভেঙে খায়। আমাদের অন্ধকার গলির ভেতর ক্ষুধাতুর দারিদ্র্য গুঁড়ি দিয়ে ঢোকে; পাপ আসে তারি পিছু পিছু। দুঃখের মধ্যে দিয়ে সকালে আমাদের ঘুম ভাঙে, রাত্রিতে অপমান আর লাঞ্ছনা আমাদের পাশে বসে থাকে। কিন্তু তোমার সঙ্গে এদের সম্পর্ক কী? তোমাকে তো বেশ সুখী মানুষ বলেই মনে হচ্ছে।

তাঁর বেশ ভয় হল। তাঁতিটিকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-এই পোশাকটা তোমরা তৈরি করছ কার জন্যে?

সে বলল–রাজার অভিষেকের জন্যে এই পোশাক তিনি পরবেন। কিন্তু সে সংবাদে তোমার দরকারটা কী?

যুবক রাজা চিৎকার করে উঠলেন। সেই আর্তনাদেই ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। চেয়ে দেখলেন তিনি ঘরের ভেতরেই শুয়ে রয়েছেন; জানালা দিয়ে মধুরঙা চাঁদ দেখা যাচ্ছে ধূলিমলিন বাতাসের ওপরে ঝুলতে।

আবার ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। আবার একটা স্বপ্ন দেখলেন।

মনে হল বিরাট একটা পালের জাহাজের নীচু পাটাতনের ওপরে তিনি শুয়ে রয়েছেন। জাহাজের দাঁড়ে বসেছিল একশটি ক্রীতদাস। তাঁর পাশে কার্পেটের ওপরে বসেছিল জাহাজের ক্যাপটেন। কালো কুচকুচ করছে তার দেহ; মাথার ওপরে তার লাল সিল্কের একটা পাগড়ি; কানে বড়ো মোটা মোটা রুপোর গোল দুল; হাতে তার একজোড়া হাতির দাঁতের দড়িপাল্লা।

একটুকরো ন্যাকড়া ছাড়া ক্রীতদাসরা সবাই উলঙ্গ। তারা সবাই শেকল দিয়ে একসঙ্গে বাঁধা। প্রচণ্ড সূর্যের আগুন তাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিগ্রোরা ডেকের ওপরে ছোটাছুটি করে তাদের পিঠে কেবল চাবুক মারছে। তারা তাদের দুর্বল হাতগুলি দিয়ে প্রাণপণে দাঁড় টেনে যাচ্ছে।

অবশেষে একটা উপসাগরের ধারে এসে তারা জল মাপতে শুরু করল। তাই দেখে তিনটি আরব গাধার পিঠে চড়ে সেইখানে এসে তাদের দিকে বর্শা ছুঁড়ল। ক্যাপটেন তার সেই চিত্রিত ধনুকটি তুলে নিয়ে একটি আরবের গলা লক্ষ করে তীর ছুঁড়ল। দেহটি ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে; আর দুটি আরব পালিয়ে গেল। তারপরে উটের পিঠে চড়ে সেই দিকে এল বেগুনে রঙের ঘোমটা ঢাকা একটি মেয়ে। সেই মৃতদেহটির দিকে মাঝে-মাঝে তাকিয়ে দেখতে লাগল।

তারপরে নোঙর ফেলা হল; খুলে দেওয়া হল পাল। নিগ্রোরা নীচে ছুটে গিয়ে একটা দড়ির সিড়িঁ বয়ে নিয়ে এল। তার তলায় বেশ ভারী সীসের একটা বস্তা বাঁধা। ক্যাপটেন দুটো লোহার ডাণ্ডার সঙ্গে ভালো করে বেঁধে সেটাকে জলে ফেলে দিল তারপরে নিগ্রোরা সবচেয়ে বাচ্চা ক্রীতদাসটার শেকল খুলে ধরে নিয়ে এল। তার নাক আর কান দুটো মোম দিয়ে দিল বন্ধ করে; কোমরে তার বাঁধল ভারী একটা পাথর। ছেলেটা ক্লান্তভাবে সিঁড়ি দিয়ে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল। হালের সামনে বসে একটা যাদুকর একঘেয়ে সুরে ঢাকের উপরে কাঠি ঠুকতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে হাঁপাতে-হাঁপাতে একটা মুক্তো হাতে নিয়ে ডুবুরি ওপরে উঠে এল। সেই মুক্তোটা ছিনিয়ে নিয়ে আবার তাকে জলের ওপরে ফেলে দিল নিগ্রোরা। এইভাবে বারবার সে উঠে এল মুক্তো নিয়ে; আর বারবার তাকে জলে ঠেলে দিল নিগ্রোরা। সেই সব মুক্তো নিয়ে ওজন করতে লাগল ক্যাপ্টেন। রাজা কী যেন বলতে চাইলেন; কিন্তু পারলেন না। জিব তাঁর জড়িয়ে গেল। তারপরে শেষবারের মতো ডুবুরি উঠে এল তার হাতে একটা মুক্তো। পূর্ণ চাঁদের মতো তার চেহারা। ওরমুজ-এর মুক্তোর চেয়েও সুন্দর। কিন্তু তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েচ্ছে তখন। সে ডেকের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, নাক আর কালের ভেতর থেকে ভকভক করে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল, একটু ছটফট করেই সে স্থির হয়ে গেল। নিগ্রোরা তাদের কাঁধ কোঁচকাল একটু তারপরে, তার দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সমুদ্রের ওপরে।

কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই ক্যাপ্টেন হাসতে-হাসতে হাত বাড়িয়ে সেই বড়ো মুক্তোটা নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে কাকে উদ্দেশ্য করে যেন মাথাটা নোয়াল। এটা রাজার রাজগণ্ডের জন্যে। এই কথা বলে নোঙর তুলে ফেলতে সে নিগ্রোদের নির্দেশ দিল।

এই কথা শুনে রাজা বিরাট একটা আর্তনাদ করে জেগে উঠলেন। জানালার ভেতর দিয়ে দেখলেন প্রভাতের লম্বা ধূসর আঙুলগুলি বিবর্ণ নক্ষত্রগুলির গলা টিপে ধরেছে।

আবার তিনি ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখলেন। এ স্বপ্নটাও দেখলেন তাঁর নিজের সম্বন্ধেই।

তাঁর মনে হল আবছায়া একটি বনপ্রদেশ দিয়ে তিনি হাঁটছেন। সেই বনে গাছের ডালে অদ্ভুত ফল ধরেছে, ফুটেছে সুন্দর বিষাক্ত ফুল আর পাশ দিয়ে হিস-হিস শব্দ করে সাপ চলে যাচ্ছে; চকচকে টিয়াগুলি উড়ে গেল চিৎকার করতে-করতে; গরম কাদার ওপরে বিরাট বিরাট কচ্ছপের দল পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে। তাদের ওপরে হনুমান আর ময়ূরে বোঝাই হয়ে রয়েছে।

হাঁটতে-হাঁটতে তিনি বনের শেষ প্রান্তে হাজির হলেন। সেখানে তিনি দেখলেন অসংখ্য লোক শুকনো নদীতে কাজ করছে। পিঁপড়ের মতো সার বেঁধে তারা এবড়ো-খেবড়ো তীরে উঠছে। মাটিতে বিরাট বিরাট গর্ত খুঁড়ছে; পাহাড় কাটছে বুড়ো-বুড়ো কুড়ল দিয়ে। অন্য সবাই বালি কাঁটছে। কেউ অলস হয়ে বসে নেই।

একটা গুহার অন্ধকার থেকে মৃত্যু আর লোভ লক্ষ করছিল তাদের।

মৃত্যু বলল–বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই লোকদের এক তৃতীয়াংশ আমাকে দাও। আমি চলে যাচ্ছি।

কিন্তু লোভ মাথা নেড়ে বলল–ওরা চাকর।

তোমার হাতে ওগুলি কী?

তিনটি শস্যের দানা। তাতে তোমার কী?

মৃত্যু বলল–একটা আমাকে দাও–আমার বাগানে বুনবো–মাত্র একটা দাও-আমি ঢলে যাচ্ছি ।

লোভ বলল–কিছুই দেব না। এই বলে সে তার পোশাকে হাতটা ঢেকে ফেলল।

মৃত্যু হেসে একটা কাপ তুলে নিল; তারপরে জলের মধ্যে সেটা দিল ডুবিয়ে। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কাঁপুনি জ্বর। সেই জ্বরে জনতার ভিতর দিয়ে হেঁটে গেল। এক তৃতীয়াংশ লোক মরে মাটিতে পড়ল লুটিয়ে।

এই দেখে লোভ বুক চাপড়াতে-চাপড়াতে কাঁদতে লাগল; তারপরে সে বলল–তুমি আমার তিন ভাগের একভাগ চাকরকে মেরে ফেলেছ। তুমি এখান থেকে বিদেয় হও। টার্টারির পাহাড়ে যুদ্ধ বেধেছে। প্রত্যেক দলের রাজা তোমাকে ডাকছে। আফগানেরা কালো ষাঁড় মেরে যুদ্ধের জন্যে এগিয়ে যাচ্ছে। সেইখানে যাও। আমার রাজত্বে তোমার কী দরকার যে তুমি এখানে অপেক্ষা করছ? চলে যাও। এখানে আর এস না।

মৃত্যু বলল–যতক্ষণ না তুমি আমাকে একটি শস্যকণা দিচ্ছ ততক্ষণ আমি যাচ্ছি নে।

লোভ মুঠি বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চিপে বলল–তোমাকে আমি কিচ্ছু দেব না।

মৃত্যু হেসে একটা কালো পাথর নিয়ে বনের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। বুনো হেমলকের বন থেকে আগুনের পোশাক পরে বেরিয়ে এল জ্বর। তারপর সে জনতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে স্পর্শ করল তাদের। যাদেরই স্পর্শ করল তারাই মারা গেল। যে পথ দিয়ে সে গেল সেই পথের সব ঘাস শুকিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

লোভ বলল–তুমি নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর। ভারতের ঘেরা-শহরে দুর্ভিক্ষ লেগেছে, সমরকন্দরে কুয়োগুলি সব শুকিয়ে গিয়েছে, ইজিপ্টের ঘেরা-শহরে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে, মরুভূমি থেকে উড়ে আসছে পঙ্গপালেরা। কূলগুলিকে ডুবিয়ে দিয়েছে নীল নদ। পুরোহিতরা সব ইশিস আর ওসিরিসের পুজো করছে সেখানে যাও। তারা তোমাকে ডাকছে। আমার চাকরদের ছেড়ে দাও।

মৃত্যু বলল–না। যতক্ষণ না আমাকে একটা শস্যকণা দিচ্ছ।

আমি তোমাকে কিছুই দেব না।

মৃত্য আবার হাসল, হেসে শিস দিল একটা। আকাশের উপর দিয়ে একটি মহিলা উড়ে গেল, তার কপালে প্লেগের নিশানা। অভুক্ত কতকগুলি শকুন তার পেছনে এল উড়তে-উড়তে। সারা অঞ্চলটা সে তার ডানায় ঢেকে দিল। মরে গেল সবাই।

চিৎকার করতে করতে লোভ বনের ভেতর দিয়ে ছুটে পালাল। মৃত্যু ছুটল তার লাল ঘোড়ার পিঠে চড়ে। ঝড়ের চেয়েও তীব্রতর তার গতি। বনের ভেতর থেকে নাক ফোলাতে-ফোলাতে ছুটে এল ড্রাগন আর শেয়ালের দল।

যুবক রাজা কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করল–এরা কারা? কী খুঁজে বেড়াচ্ছে?

তাঁর পেছনে একদল লোক দাঁড়িয়েছিল; সে বলল–রাজার মুকুটের জন্য রুবি খুঁজছে।

রাজা চলে আসতে-আসতে সাধুর মতো একজনকে দেখলেন; তাঁর হাতে একটা আয়না।

বিবর্ণ হয়ে রাজকুমার জিজ্ঞাসা করলেন-কোন্ রাজা?

সাধু বললেন–আয়নার ভেতরে দেখ। তাহলেই তাকে তুমি দেখতে পাবে।

রাজা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চেহারা দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তখন সূর্যকিরণ ঘরের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

সকালে রাজপুরুষরা এসে তাঁকে অভিবাদন জানালেন; রত্নখচিত চকচকে পোশাক আর মুকুট তাঁর সামনে রেখে সেগুলি পরার জন্য অনুরোধ করলেন। সেগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন রাজা। যতটা সুন্দর তিনি ভেবেছিলেন তার চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর সেগুলি। কিন্তু তিনি বললেন–এগুলি নিয়ে যাও–এসব আমি পরব না।

সবাই হাসল, কারণ, তারা ভাবল রাজা বোধ হয় ঠাট্টা করছেন।

কিন্তু তিনি বেশ কঠোর ভাবেই বললেন–এগুলি আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও-লুকিয়ে রাখ। আজ আমার অভিষেক হলেও ওগুলি আমি পরব না। কারণ দুঃখের তাঁতে আর যন্ত্রণার সাদা হাতে তৈরি হয়েছে আমার এই পোশাক। রুবির মধ্যে রয়েছে রক্ত, মুক্তোর মধ্যে রয়েছে মৃত্যু!

এই বলে সবাইকে তিনি তিনটি স্বপ্নের কথা বললেন।

সভাসদেরা এই কথা শুনে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল-নিশ্চয় উনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন। কারণ, স্বপ্নটা স্বপ্ন ছাড়া আক কী? তারা মোটেই সত্য নয়; তাদের গ্রাহ্য করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের জন্যে যারা পরিশ্রম করে তাদের কথা চিন্তা করে আমরা করবটা কী?

চ্যামবারলেন যুবক রাজাকে বললেন–মহারাজ, ওই সব কুচিন্তাগুলিকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে এই রাজপোশাকগুলি পরুন, মাথার ওপরে চড়ান এই সোনার মুকুট। কারণ রাজার পোশাক না পরলে আপনি যে রাজা সেকথা লোকে বুঝবে কেমন করে?

তাঁর দিকে রাজা তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন-তাই বুঝি? রাজার পোশাক অঙ্গে ধারণ না করলে তারা কি আমাকে রাজা বলে চিনতে পারবে না?

পারবে না মহারাজ।

আমার ধারণা ছিল এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যাঁদের দেখতে রাজার মতো। কিন্তু তুমি যা বললে তাই হয়তো সত্যি। কিন্তু তবু আমি এই পোশাক আর মুকুট কোনোটাই পরব না। বরং যে পোশাকে আমি এই প্রাসাদে এসেছিলাম সেই পোশাকেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে রাজি রয়েছি।

এই বলে তাঁকে বিদায় দিয়ে তাঁর চেয়ে বছর খানেকের ছোটো একটি চাকরকে তাঁর কাছে রাখলেন। পরিষ্কার জলে স্নান করে তিনি তাঁর নক্সাকাটা বড়ো বাক্সটা খুললেন; বার করলেন তাঁর চামড়ার পোশাক–এই পোশাক পরেই তিনি পাহাড়ের ওপরে মেষের পাল চরাতেন।

বাচ্চা চাকরটা অবাক হয়ে তার দুটো নীল চোখ তুলে চাইল তাঁর দিকে; তারপরে হেসে বলল–মহারাজ, আমি আপনার রাজপোশাক আর রাজদণ্ড দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু মুকুটটা কোথায়?

জানালার ধারে যে বুলো কাঠগোলাপ ছিল সেটা তুলে যুবক রাজা বাঁকিয়ে গোল করে মাথার ওপরে পরলেন।

এইভাবে সাজ-পোশাক করে তিনি রাজসভায় হাজির হলেন। সেখানে তাঁকে অভিবাদন জানানোর জন্যে সভাসদেরা অপেক্ষা করছিলেন।

এই পোশাকে দেখে সভাসদেরা রসিকতা করতে লাগলেন; কয়েকজন চিৎকার করে বললেন–মহারাজ, প্রজারা তাদের রাজাকে দেখতে এসেছে; আর আপনি আজ ভিক্ষুকের পোশাক পরেছেন?

কেউ কেউ বললেন–ও লোকটা আমাদের দেশের দুর্নাম করছে; আমাদের প্রভু হওয়ার যোগ্যতা ওর নেই।

কিন্তু তিনি একটা কথাও বললেন না–ব্রোঞ্জের ফটক পেরিয়ে বাইরে এলেন তিনি; তারপরে ঘোড়ায় চড়ে গির্জার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর বাচ্চা চাকরটা তাঁর পাশে-পাশে ছুটতে লাগল।

সেই দেখে লোকেরা সব হাসতে লাগল; ঠাট্টা করে বলল–দেখ, দেখ; রাজার ভাঁড় ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। তিনি ঘোড়ার রাশ থামিয়ে বললেন– না। আমি রাজা।

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বেরিয়ে এসে বলল–স্যার, ধনীদের বিলাস-বৈভব থেকেই যে দরিদ্ররা বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে তা কি আপনি জানেন না? আপনার প্রাচুর্যই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে; আপনারা যে পাপ করেন তাই আমাদের রুটি সংগ্রহে সাহায্য করে। প্রভুর জন্যে পরিশ্রম করা কষ্টকর। কিন্তু কষ্ট করার জন্যে, কোনো প্রভু না থাকাটা আরও কষ্টকর। আপনি কি কোনো ক্রেতাকে বলতে পারবেন-তুমি একটা কেনো, অথবা কোনো বিক্রেতাকে বলতে পারবেন-তুমি এই দামে জিনিস বিক্রি কর। আমি তা বিশ্বাস করি না। অতএব আপনি প্রাসাদে ফিরে গিয়ে রাজার পোশাক পরিধান করুন। আমাদের জীবন আর দুঃখ নিয়ে আপনার কী করার রয়েছে?

রাজা প্রশ্ন করলেন-ধনী আর দরিদ্র কি পরস্পরের ভাই নয়?

লোকটা বলল–তাই বটে। ধনী ভাই-এর নাম ‘কেইন’।

যুবক রাজার চোখ দুটি জলে ভরে উঠল। জনতার গুঞ্জন-ধ্বনির মধ্যে দিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। বাচ্চা চাকরটা ভয় পেয়ে তাঁর পাশ থেকে পালিয়ে গেল।

যখন তিনি গির্জার সেই বিরাট ফটকের কাছে হাজির হলেন, সৈন্যবাহিনীর লোকেরা তরোয়াল উঁচিয়ে বলল–কী চাও হেথা? রাজা ছাড়া আর কারও এ-দরজা দিয়ে প্রবেশ করার অনুমতি নেই।

রাজার মুখ রেগে লাল হয়ে গেল। তিনি বললেন–আমিই রাজা।

এই বলে তিনি ভেতরে ঢুকে গেলেন।

মেষপালকের পোশাকে তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেখে বৃদ্ধ বিশপ অবাক হয়ে তাঁর সিংহাসন থেকে উঠে তাঁর কাছে এসে বললেন–পুত্র, এটা কি রাজার পোশাক? কোন মুকুট আমি তোমার মাথায় পরাব, কোন রাজদণ্ড হতে দেব তোমার! আজ নিশ্চয় তোমার আনন্দের দিন, দুঃখের নয়।

যুবক রাজা প্রশ্ন করলেন–দুঃখ দিয়ে যে পোশাক তৈরি হয়েছে, সুখ কি তা পরতে পারে?

এই বলে তাঁর তিনটি স্বপ্নের কথা তিনি বর্ণনা করলেন।

সমস্তু শুনে ভ্রূ কুঞ্চিত করে বিশপ বললেন–পুত্র, আমি বৃদ্ধ হয়েছি, দিন আমার শেষ হয়ে আসছে। আমি জানি পৃথিবীতে অনেক অন্যায় আর অবিচার হচ্ছে। পাহাড় থেকে নেমে এসে দুর্দান্ত দস্যুরা বাচ্চাদের ধরে নিয়ে মুরদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সিংহ ওৎ পেতে বসে থাকে উটের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। জলদস্যুরা সমুদ্রোপকূলকে ধ্বংস করে জেলেদের জাহাজ পুড়িয়ে দেয়। নোনা জলায় কুষ্ঠ রোগীরা বাস করে। কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘর তৈরি করে তারা। তাদের পাড়ায় কেউ যেতে পারে না। ভিক্ষুকরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়-কুকুরদের সঙ্গে বসে তারা খায়। ওই সব কাজ না করতে তুমি কি তাদের বাধ্য করত পার? তুমি কি কুষ্ঠ রোগীদের সঙ্গে নিয়ে এক বিছানায় শুতে পার, না, ভিক্ষুকদের নিয়ে এক টেবিলে পার খেতে? সিংহ কি তোমার নির্দেশ মতো কাজ করবে, না, বন্যারা পালন করবে তোমার নির্দেশ? যিনি এই দুঃখের সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তোমার চেয়েও বিজ্ঞ নন? সেই জন্যে তুমি যা করেছ তার জন্যে তোমাকে আমি প্রশংসা করছি নো তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি প্রাসাদে ফিরে গিয়ে রাজপোশাক পরে এস। তোমার মাথায় আমি স্বর্ণ মুকুট পরিয়ে অভিষেক করব; তোমার হাতে দেব মুক্তাখচিত রাজদণ্ড। আর তোমার স্বপ্ন! ভুলে যাও ও-সব। এই বিশ্বের ভার অতীব বিশাল। একজনের পক্ষে তা বয়ে বেড়ানো কষ্টকর। বিশ্বের দুঃখ এত বেশি যে একজনের পক্ষে তা সহ্য করা সম্ভব নয়।

রাজা বললেন–ঈশ্বরের স্থানে বসে আপনি এই সব কথা বলছেন?

এই কথা বলে বিশপের পাশ দিয়ে উঠে গেলেন তিনি, যে বেদীর ওপরে যীশুখৃস্টের মূর্তি রয়েছে সেইখান গিয়ে দাঁড়ালেন। দু’পাশে তাঁর ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য-অদ্ভুত অদ্ভুত স্বর্ণ পাত্র, যীশুর শেষ নৈশ ভোজনের সবুজ মদে বোঝাই কার স্মরণ পাত্র-ইত্যাদি। যীশুর মূর্তির কাছে তিনি হাঁটু মুড়ে বসলেন-বিরাট-বিরাট বাতিগুলি জ্বলতে লাগল; ধূপের ধোঁয়া পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে উঠতে লাগল; তাঁর চারপাশে প্রার্থনার জন্যে মাথা নীচু করলেন তিনি, ধোপদুরস্ত পোশাক পরা পাদরিয়া তাঁর কাছ থেকে পালিয়ে গেল।

হঠাৎ বাইরে একটা গণ্ডগোল উঠল; তার সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত সম্প্রদায় তাদের তরোয়াল খুলে মাথার মুকুট নাড়িয়ে চেঁচাতে লাগল–সেই উন্মাদ লোকটা কোথায়? ভিক্ষুকের পোশাকধারী সে রাজা কোথায় গেল? সেই ছোকরা কোথায় যে আমাদের রাজত্বে কলঙ্ক লেপন করেছে? আমরা তাকে হত্যা করব। আমাদের শাসন করার যোগ্যতা তার নেই।

এই সব কথা শোনার পরেও রাজা প্রার্থনা করার জন্যে মাথা নোয়ালেন; প্রার্থনা শেষ করে উঠলেন তিনি; ঘুরে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তাদের দিকে।

আর সেই সঙ্গে চিত্রিত ডানালার ভেতর দিয়ে সূর্যের কিরণ ঝরে পড়ল তাঁর ওপরে। সেই সূর্যকিরণমালা তাঁর দেহে এমন একটি স্বর্গীয় পোশাক পরিয়ে দিল যার কাছে তাঁর রাজকীয় পোশাক ম্লান বলে মনে হল। শুকনো ফুল আবার ফুটল; লিলি ফুল মুক্তোর চেয়ে সাদা হয়ে দেখা দিল। শুকনো কাঁটা উঠল ফুটে; নিরাভরণ গোলাপ ফুলি রুবির চেয়েও লাল হয়ে গেল।

রাজার সেই পোশাকেই তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। মুক্তামন্দিরের দ্বার গেল খুলে–এই রহস্যময় আলোর দ্যুতিতে ভরে গেল চারপাশে। ঈশ্বরের মহিমা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে-সেন্টরাও যেন জীবন্ত হয়ে উঠলেন। সঙ্গীতের সুর উঠল, ঢাকের শব্দ পড়ল ছড়িয়ে। ভজন গাইতে লাগল ছেলেরা।

ভয়ে আর বিস্ময়ে সবাই তাঁর কাছে নতজানু হলেন; সভাসদেরা খাপের মধ্যে তাদের তরোয়াল রাখল ঢুকিযে-অভিবাদন জানাল তাঁকে। বিশপের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল-হাত কাঁপতে লাগল তাঁর। তিনি বললেন–যাকে আমি অভিষিক্ত করছি তার চেয়েও তুমি অনেক বড়ো। এই কথা বলে তিনি রাজার কাছে তার মাথাটা নীচু করলেন।

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

Leave a Comment