যানজট একটি ভয়াবহ সমস্যা শিরোনামে একটি প্রতিবেদন রচনার নমুনা তৈরি করবো আজ। মনে রাখতে হবে আমাদের সকল প্রতিবেদন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই প্রতিবেদন থেকে শিক্ষার্থীরা ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।
যানজট একটি ভয়াবহ সমস্যা শিরোনামে একটি প্রতিবেদন রচনা
যানজটের কারণে ‘ক’ শহরে স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ যাতায়াত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যানজট শুধু আমাদের অমূল্য সময়ই কেড়ে নিচ্ছে না, নাগরিক জীবনেও ডেকে আনছে নানা দুর্ভোগ। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, শ্রমিক, পথচারী সবাই আজ সর্বগ্রাসী যানজটের শিকার। এখন নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনো নিশ্চয়তা নেই। নাগরিক জীবনে মানুষের অন্তহীন কাজ। জীবন ও জীবিকার তাগিদে সবাইকে ছুটতে হয় অফিস-আদালত, হাসপাতাল ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে। ছাত্রছাত্রীরা যাচ্ছে স্কুল-কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু পথে নামলেই যানজট দৈত্যের মতো পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে। যানজটের কারণে গতি থমকে থাকলেও সময় থমকে থাকে না। কর্মস্থলে সময় মতো না পৌঁছার কারণে কাজের কাজ কিছুই হয় না। দশ মিনিটের রাস্তা পেরোতে লাগে দু ঘণ্টা। ফলে কাজে বেরুলে প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা দেয় ব্যর্থতা। সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা, যখন-তখন, যেখানে-সেখানে যানজট। রাজপথ, গলিপথ, ফুটপাত কোথাও স্বস্তি নেই। সর্বত্র ভিড় আর ভিড়, যানজটের ভিড়, ভিড় মানুষের। যানজটের ভিড়ে একবার আটকে গেলে কখন তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে তা বলা মুশকিল।
রোগীসহ অ্যাম্বুলেন্স যখন যানজটে আটকিয়ে পড়ে তখন ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, এমনকি পথিমধ্যে যানজটের কারণে মৃত্যুও ঘটে। বর্তমানে অপরিসীম ক্ষতি, ক্ষোভ ও বিরক্তির একটা বড় কারণ এ যানজট। এতে একদিকে বিপুল পরিমাণ সময় নষ্ট হচ্ছে অপরদিকে হারিয়ে যাচ্ছে অগণন শ্রমঘণ্টা। এর অর্থমূল্য নির্ণয় করা গেলে দেখা যেত প্রতিদিন কি বিশাল অঙ্কের অর্থের অপচয় হচ্ছে যানজটের কারণে। হচ্ছেও তাই, শুধু যানজটের কারণে কোটি কোটি টাকার জ্বালানীর অপচয় হচ্ছে। যানজট মোকাবিলা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল করার জন্য বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এতে সমস্যার তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। বরং এটি একটি সাংবাৎসরিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এর কারণে ব্যস্ত শহরের কার্যক্রম একটা দীর্ঘ সময় ধরে অচল থাকে।
যানজটের কারণ:
১। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাংলাদেশের সড়ক পথের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সীমিত রাস্তাঘাটের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যাধিক্যই যানজটের অন্যতম কারণ।
২।ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত ও ভারসাম্যহীন নগরায়ণ, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে যানজট ও রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
৩। দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ সড়কগুলোর কার্যকর পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব।
৪। আবাসন সংঙ্কট ও নগরায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাস্তাঘাটের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়ন না হওয়া।
৫। অপরিকল্পিতভাবে ওয়াসা, ডেসা, গ্যাস, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ এবং বেসরকারি সংস্থা বিজ্ঞাপন বিলবোর্ডসহ নানা কারণে প্রায়ই জনবহুল রাস্তাসহ আবাসিক রাস্তাতেও খোঁড়াখুঁড়ি করে। খোঁড়াখুঁড়ির পর পুনরায় রাস্তা মেরামত না করা।
৬। রাস্তায় ওভারব্রিজের স্বল্পতা, ট্রাফিক আইন না মানা এবং রাস্তা পারাপারে নিয়ম মেনে না চলা, আধাপাকা ও কাঁচা রাস্তায় অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বোঝাই যানবাহন চলাচল করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা ইত্যাদি।
৭। টেকসই ও পরিকল্পিত রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, সংস্কারের অভাব। অধিকাংশ রাস্তা অপ্রসস্ত ও সংকীর্ণ।
৮। জনসাধারণের যাতায়াতের জন্যে ২৫% ফুটপাত থাকার কথা, কিন্তু তা নেই। আবার যেটুকু আছে তার অধিকাংশ স্থান কলকারখানা, হোটেল, রেস্তোরা ও ফেরিওয়ালাদের দখলে। রাস্তার অনেকাংশে যত্রতত্র বাসস্ট্যান্ড, ট্রাকস্ট্যান্ড ও টেম্পোস্ট্যান্ড দখল করে রেখেছে। এসব কারণে রাস্তা সংকীর্ণ ও অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
৯। ট্রাফিক আইন না মানা, আইনের প্রতি অবজ্ঞা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালনা, ডাইভিং লাইসেন্স না থাকা, প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি।
১০। নাগরিক সচেতনতার অভাব। যানজট নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা, সেমিনার এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। এর কারণ এবং নিরসনের উপায়গুলো চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু যানজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বা সাফল্য অর্জিত হতে দেখা যায়নি।

যানজট কমানোর জন্য কতকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে :
যানজট নিরসনে গৃহীত পদক্ষেপ:
১। অবৈধ রিকশার দৌরাত্ম্য কমাতে হবে;
২। যত্রতত্র গড়ে ওঠা এলোপাতাড়ি বাজার, মার্কেট বিপণী বিতান উচ্ছেদ করা;
৩। যত্রতত্র যানবাহন থামিয়ে লোক ওঠা-নামা না করা;
৪। অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা;
৫। ফুটপাতগুলোকে হকারমুক্ত করা;
৬। বেশির ভাগ রাস্তাকে ওয়ানওয়ে করা ও ক্রসিং কমিয়ে দেওয়া;
৭। রাজধানীতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে;
৮। যে কোনো স্ট্রাকচার নির্মাণের আগে প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বহুমুখী ফ্লাইওভার (ইন্টারসেকশন ট্রাফিক সিস্টেম) নির্মাণ করা, যাতে যে কোনো মোড়ে কোনো গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়া নিজের পথে চলতে পারে;
৯। এছাড়া ট্রাফিক সিগন্যাল বাতিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে না চালিয়ে প্রতিটি পয়েন্টে উপ-নিয়ন্ত্রণ কক্ষ অথবা রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম করলে কিছুটা যানজট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব;
১০। শহরের ব্যস্ত এলাকার বাস টার্মিনাল উঠিয়ে দিতে হবে;
১১। রাজধানীর অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানাগুলোকে শহরের বাইরে নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করতে হবে;
১২। শহর থেকে কিছু হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস- আদালত শহরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
১৩। পাতাল রেলের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি যানজট নিরসনের অন্যতম কৌশল হিসেবে সংযোগ সড়ক স্থাপন বাড়াতে হবে। এর বাস্তব সুফল দেখা গেছে পান্থপথ টু মিরপুর রোডের সংযোগ সড়কের মাধ্যমে। নাগরিক জীবনকে স্বচ্ছন্দ, সাবলীল ও গতিশীল করে তুলতে যানজট সমস্যার সমাধান অবশ্যই করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা ও সময়োপযোগী সুন্দর বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা ও তার দ্রুত বাস্তবায়ন। আমার মনে হয় এটা এমন কোনো সমস্যা নয় যা একেবারেই অসাধ্য। আশা করি উপরোক্ত পদক্ষেপসমূহ বিবেচনায় নিলে দ্রুত যানজট নিরসরন হবে।
আরও দেখুন: