যত বড় হোক ইন্দ্ৰধনু সে সুদূর আকাশে | ভাব-সম্প্রসারণ | ভাষা ও শিক্ষা , ভাবসম্প্রসারণ করার সময় সেই গভীর ভাবটুকু উদ্ধার করে সংহত বক্তব্যটিকে পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। সেই ভাব রূপক-প্রতীকের আড়ালে সংগুপ্ত থাকলে, প্রয়ােজনে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হবে।
যত বড় হোক ইন্দ্ৰধনু সে সুদূর আকাশে আঁকা আমি ভালবাসি মোর ধরণীর প্রজাপতিটির পাখা।
অধরার সৌন্দর্যে মানুষ অধিক মোহমুগ্ধ হয়। তাকে পেতে চায় হাতের মুঠোয়। সে নিয়ে তার আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই, কল্পনাবিলাসের অন্ত নেই। নাগাল-বহির্ভূত বস্তু মানুষের কল্পনার সামগ্রী কিন্তু বাস্তব আর কল্পনা এক নয়। বহু দূরের সৌন্দর্য যা হাতের নাগালে নয়, এমন সৌন্দর্যের চেয়ে জীবনের খুব কাছাকাছি সহজ উপভোগ্য সাধারণ সৌন্দর্যের মূল্য যে অনেক বেশি, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কাছের জিনিসকে যত আপন মনে করা যায়, সহজে পাওয়া যায়, দূরের জিনিসকে সেভাবে কাছে টানা যায় না। তাই দূরের স্বপ্নিল সৌন্দর্যের চেয়ে কাছের তুচ্ছ সাধারণ বস্তুও অনেক বেশি অসাধারণ।
বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। মানুষ মাটির পৃথিবীর সন্তান। প্রকৃতির লতা-পাতা, গাছ, ফুল, পাখি এসব নিয়েই তার পরিবেশ। এই মাটির পৃথিবীকে নিয়েই তার অভ্যস্ত জীবনযাত্রা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। তথাপি মানুষ স্বপ্নবিলাসী। দূরের আকাশের সাতরঙা ইন্দ্রধনুর বিচিত্র বর্ণচ্ছটা মানুষের স্বপনচারী মনকে হাতছানি দেয়। কিন্তু যা ক্ষণস্থায়ী, যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে তা যত বড় বা যত সুন্দরই হোক না কেন তার চেয়ে আকর্ষণীয় চির পরিচিত নিত্যদিনের ধূলিমাখা এই পৃথিবী।
কেননা বর্ণসুষমায় ইন্দ্ৰধনু যতই মনোমুগ্ধকর ও নয়নরঞ্জক হোক না, বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন। বাস্তবের কঠিন মাটিতে পা ফেলে মানুষকে জীবন চালাতে হয়। বাস্তবকে উপেক্ষা করা মোটেই সম্ভবপর নয়। সেজন্য দূরের রংধনুর চেয়ে নাগালের মধ্যে যে ছোট্ট প্রজাপতিটি তার রঙিন পাখায় ভর করে উড়ে বেড়ায় তার মধ্যেই বিমূর্ত সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা যায়। সুদূরের সৌন্দর্যের বিশালতা ও মোহনীয়তা মানুষের হৃদয়কে বিস্ময়ে ও বিমূঢ়তায় করে আবিষ্ট। কিন্তু তার কুটিরের সান্নিধ্যে প্রস্ফুটিত নাম-না-জানা কত তৃণ-কুসুম, ধানের শীষে চোঁয়ানো শিশিরের জল, কত সুধাকণ্ঠ পাখির কলকাকলি তার সুদূরের মোহে উধাও হৃদয়ের দ্বারে করাঘাত করে ফিরে যায়; তবু তার দ্বার খোলে না। এখানেই মানুষের ট্রাজেডি।
অথচ প্রকৃতি-জননী নিজের হাতে সেখানে সাজিয়ে রেখেছেন অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের অন্তহীন পসরা। কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্য-প্রেমিক যাঁরা, তাঁরা সুদূরের অলীক সৌন্দর্যের মিথ্যা মায়ার আকর্ষণে প্রলুব্ধ না হয়ে তাঁদের চারপাশের বিশ্ব-প্রকৃতির সৌন্দর্যের অপরূপ রূপ-নিকেতনের মধ্যে আবিষ্কার করেন স্বর্গের অমরাবতীকে। তাঁরাই সৌন্দর্যের সফল সাধক।

সীমার বাইরে কোনো বস্তুই উপভোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। কল্পনার ভাবালুতা অর্মত্যচারী করে, অনৈসর্গিক স্বপ্নলোকে বিচরণ করায়, তাতে রোমান্টিক ভাবনার হয়ত কিছু খোরাক হতে পারে, কিন্তু বাস্তবজীবনে তার প্রয়োজন কতখানি তা ভেবে দেখা দরকার। যেখানে ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’, সেখানে রামধনুর বর্ণসুষমা নিয়ে ভাবালুতা পরিহাসতুল্য। তাই আকাশকুসুম পরিকল্পনা না করে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলা উচিত। দুষ্প্রাপ্য অলীক কোনো কিছু পাওয়ার দুরাশা না করে হাতের কাছে যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই উত্তম।
আরও দেখুন: