যতি বা বিরাম চিহ্নের কাজ | বিরাম চিহ্নের বিবর্তন | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা , বাক্যে ব্যবহৃত পদগুচ্ছকে অর্থবহ করার জন্যে সুনির্দিষ্ট পদক্রম অনুসরণ করা হয়।
যতি বা বিরাম চিহ্নের কাজ
বাক্যের পদগুলোকে নির্দিষ্ট ছক বা রীতি অনুযায়ী সাজিয়ে তোলাই তার কাজ। পদের বিন্যাসের সঙ্গে থাকে পদসঙ্গতি। বাক্যের পদগুলোর মধ্যে ভাবের পারম্পর্য বা সঙ্গতি রক্ষা করাই পদসঙ্গতির কাজ। তাদের লক্ষ্য বাক্যকে অর্থবহ করা। এক্ষেত্রে বাক্যের বক্তা বা লেখকের নির্দিষ্ট অর্থলক্ষ্যকে সোজাসুজি শ্রোতা বা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছেদ চিহ্ন বা যতি-চিহ্ন বা বিরাম চিহ্নের কাজ ।
বিরাম চিহ্নের বিবর্তন
বিরাম-চিহ্ন ব্যবহারের বিষয়টিকে ইংরেজিতে বলে Punctuation। এর মূল গ্রিক শব্দ Punctus যার অর্থ বিন্দু। এই বিন্দু ব্যবহৃত হত হিব্রু ভাষার লিপিতে ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির সংকেত হিসেবে। পরের দিকে Vowel আর Point প্রায় সমার্থক হয়ে Vowel-point কথাটির সৃষ্টি হয়। এই Point পঞ্চদশ শতকে period of full stop রূপে ব্যবহৃত হয়। কমা, কোলন, হাইফেন শব্দগুলো ছেদ বা অঙ্গচ্ছেদবাচক।
‘ড্যাশ’ কথাটিতে আছে হঠাৎ সরে যাওয়ার ইঙ্গিত। অন্যান্য চিহ্ন এসেছে অনেক পরে। কিছু চিহ্ন স্বরলিপি চিহ্নের পরিবর্তিত রূপ, যাদের তাৎপর্যও কালক্রমে বদলে গেছে। গ্রিক-লাতিন পাণ্ডুলিপিতে সেমিকোলন ( 😉 ছিল প্রশ্নাত্মক। আজ তা অন্য অর্থ বহন করে। আমাদের দেশে বৈদিক সাহিত্যে একদা ব্যবহৃত রজাদি চিহ্ন দাঁত ? ) এখন এখন আর নেই।
ধ্বনিগত পরিবর্তনের ফলেই এরা লুপ্ত হয়েছে। বাংলা পাণ্ডুলিপিতে এক দাঁড়ি (। ) ও দু দাঁড়ি ( 11 ) ছাড়াও ০, ০, ০ ০ 0 1 0 ইত্যাদি চিহ্ন ছিল বিরামের প্রতীক হিসেবে। প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে পক্তিপূরক হিসেবে ‘- ড্যাশের ব্যবহার ছিল। এই ——’ চিহ্ন হ্রস্ব-দীর্ঘ হত পক্তি পূরণের প্রয়োজনে। ত্রিবিন্দুর (.) প্রচলনও ছিল প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কেবল এক দাঁড়ি (।) ও দু দাঁড়ি (।।) — এই দুটি বিরাম চিহ্নের ব্যবহার হত। যেমন : প্রথম চরণের শেষে এক দাঁড়ি এবং দ্বিতীয় চরণের শেষে দু দাঁড়ি ব্যবহারের নিয়ম ছিল। বাংলা প্রাচীন পুঁথিতে শব্দগুলো থাকত এক সঙ্গে। যেমন : সীতাহারাআমিযেনমণিহারাফণী। প্রাচীন যুগের চর্যাপদে কাআ তরুবর পাঞ্চবি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠা কাল ।
অথবা মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের লেখায় যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।। আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে গদ্যের উৎপত্তি হলে এই এক দাঁড়ি (1) বিরাম চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্য সকল বিরাম চিহ্ন এসেছে ইংরেজি সাহিত্য থেকে। বাংলা মুদ্রণের প্রথম কাজ শুরু হয় ইংরেজদের হাতে। গদ্য-রচনাকে পাঠযোগ্য করে তুলতে তাঁরা ইংরেজি বিরামচিহ্ন কাজে লাগালেন। সেজন্য ইংরেজি নামই বিরাম চিহ্নের পরিচয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলা গদ্যের প্রথম দিককার রচনায় বিরাম চিহ্নের ব্যবহার তেমন ছিল না।
যেমন উইলিয়াম কেরির রচনা ‘কোন সাধু লোক ব্যবসায়ের নিমিত্তে সাধুপুর নামে এক নগরে যাইতেছিলেন পথের মধ্যে অতিশয় তৃষ্ণার্ত হইয়া কাতর হইলেন নিকটে লোকালয় নাই কেবল এক নিবিড় বন ছিল তাহার মধ্যে জলের অন্বেষণে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন যে তথাতে এক মনুষ্য একাকী রহিয়াছে।’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যে প্রথম বিরাম চিহ্নের সুষ্ঠু ব্যবহার করেন। এটিই মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত মত। তবে সাম্প্রতিক গবেষকবৃন্দ ভিন্নমত পোষণ করতে শুরু করেছেন। তাঁরা অক্ষয়কুমার দত্ত ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পথিকৃৎ বিবেচনা করে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এ ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করতে চান।
বিদ্যাসাগরের রচনার উদাহরণ। যেমন— ‘বালকগণের উচিত, বাল্যকাল অবধি পরিশ্রম করিতে অভ্যাস করা; তাহা হইলে বড় হইয়া অনায়াসে সকল কর্ম করিতে পারিবে, স্বয়ং অন্ন বস্ত্রের ক্লেশ পাইবে না, এবং পিতামাতার প্রতিপালন করিতে পারগ হইবে।’ বিদ্যাসাগরই প্রথম বারের মতো বাংলা গদ্যের অন্তর্লীন ধ্বনিস্পন্দনটি ধরতে পেরেছিলেন এবং বিরাম চিহ্নের যথার্থ ব্যবহারে বাংলা গদ্যের ওজস্বিতা বৃদ্ধি করেছেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন লেখকের হাতে রচনারীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিরাম চিহ্নের অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন ঘটেছে। বিরাম-চিহ্নকে দুভাগে ফেলা যায়। ১. প্রান্তিক অর্থাৎ বাক্য যেখানে শেষ হয়। যেমন— দাঁড়ি, প্রশ্নচিহ্ন, বিস্ময়চিহ্ন ইত্যাদি। ২. বাক্যান্তর্গত অর্থাৎ যেখানে বাক্য শেষ হয় না। যেমন : কমা, সেমিকোলন, ড্যাশ ইত্যাদি।
বিরাম চিহ্ন, বিরামচিহ্ন – বাংলা ব্যাকরণ :
আরও দেখুন:
- বাচ্য পরিবর্তন | কর্মবাচ্যকে কর্তৃবাচ্যে পরিবর্তন | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- বাচ্যের প্রকারভেদ | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- বাচ্য ও বাচ্য পরিবর্তন | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- কতিপয় দৃষ্টান্ত | উক্তি পরিবর্তন | বাক্যতত্ত্ব | ভাষা ও শিক্ষা
- আমনে বাম্পার ফলন হবে,খাদ্য সংকট হবে না , পেঁয়াজ রপ্তানিও করতে পারব- কৃষিমন্ত্রী