Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজ | ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি | বাংলা রচনা সম্ভার

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজ | ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : সংস্কৃতি সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণস্বরূপ। কোনো সমাজের সংস্কৃতির দিকে তাকালেই সে সমাজের চেহারা দেখা যায়। অন্যকথায়, সংস্কৃতি কোনো সমাজের স্বাতন্ত্রের নির্ধারক। প্রতিটি সমাজেরই নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি থাকে। এ সংস্কৃতিই বিশ্বের দরবারে একটি জাতির গৌরব-অগৌরবের জানান দেয়। কিন্তু আধুনিককালে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি ক্রমেই গৌণ হয়ে আসছে।

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজ | ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি | বাংলা রচনা সম্ভার

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজ

বিশ্বায়নের তোড়ে আন্তঃব্যক্তিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ বৃদ্ধির কারণে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ আর মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদানও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে । কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইস ও সুযোগের অভাবে পৃথিবীর অনেক সংস্কৃতিই প্রতিযোগিতায় উন্নত বিশ্বের সংস্কৃতির কাছে মার খাচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে বিদেশী সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির শিকার হচ্ছে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। কারণ নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরার যথেষ্ট সুযোগ না পাওয়ায় এ সকল দেশে অবাধেই বিদেশী সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে। বাংলাদেশও এ পরিস্থিতিরই শিকার।

 

স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের বিস্তারে আমাদের শিশু ও যুবকদের মাঝে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা আর বিদেশী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের যে সর্বনাশা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা তাদেরকে উদ্দেশ্যহীন এক দুর্গম পথের যাত্রীতে পরিণত করছে। ফলে ভেঙ্গে যাচ্ছে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ আর নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ে সমাজ কাঠামো আজ ধ্বংসপ্রায়। বন্ধুবাসিতা আর ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার মানবিকতাবোধ ও বিচারকে ক্ষত-বিক্ষত করছে প্রতিনিয়ত।

বাংলাদেশে মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির বিস্তৃতি : পৃথিবীর আর দশটা দেশের মতো বাংলাদেশেও মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির বিস্তৃতি কম নয়। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সুবাদে আমাদের দেশের মানুষও আজ দেশী- বিদেশী নানামুখী চ্যানেল ও ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। আগে যেখানে একমাত্র বিটিভিই ছিল এ দেশের ইলেকট্রনিক বিনোদন মাধ্যম, সেখানে স্যাটেলাইটের সুবাদে এখন এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, এনটিভি, আরটিভি, চ্যানেল ওয়ান, বৈশাখী, বাংলাভিশনসহ বেশ কয়টি চ্যানেল বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের ডালি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হচ্ছে।

এছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী দেশে আইটিভি, যমুনা টিভিসহ আরো কিছু চ্যানেল তাদের কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে বহু বিদেশী চ্যানেল সার্বক্ষণিক অনুষ্ঠান প্রচার করেই যাচ্ছে। ২০০৪ সালে অশ্লীলতার বিবেচনায় সরকার এটিভি, টিভি-৬, চ্যানেল-ভিসহ বেশ কয়টি চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও এমটিভি, সনিটিভি, জিটিভি, এইচবিও, স্টার টিভি, B4U ইটিসি, এক্সক্স এনসহ অনেক মিউজিক ও মুভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান পে-চ্যানেলের মাধ্যমে শহরের ঘরে ঘরে সার্বক্ষণিক প্রচারিত হচ্ছে।

তাছাড়া বিবিসি, সিএনএন, স্কাই নিউজসহ বেশ কয়টি আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলও দেখা যায়। আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, ডিসকভারি, এনিমেল প্লানেট, অ্যাডভেঞ্চারার্সসহ বেশ কিছু চ্যানেল আছে  যেগুলো বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টিকে আমাদের সামনে তুলে ধরছে। আবার ইএসপিএন, স্টার স্পোর্টস, টেন স্পোর্টসসহ বেশ কটি স্পোর্টস চ্যানেল প্রতিনিয়ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত খেলাধুলার খবর সরাসরি সম্প্রচার করছে। তবে ইন্টারনেটের বিস্তার আমাদের দেশে এখনো ব্যাপক না হলেও দিনে দিনে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও আমাদের সমাজে এর প্রভাব : বিশ্বায়নের এ যুগে স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেট সংস্কৃতির প্রভাব থেকে পৃথিবীর কোনো দেশ, এমনকি কোনো ব্যক্তিই মুক্ত নয়। এর নেটওয়ার্ক এতই বিস্তৃত যে এর আওতার বাইরে পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ আপাতত নেই। তাই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, জেনে বা অজান্তে যেভাবেই হোক আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি সমাজ এবং ব্যক্তি আকাশ সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত। তবে ( বিস্তৃতিও এর প্রভাবের ধরন ও মাত্রা সকল দেশ এবং সমাজে একরূপ নয়।

পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশে এর সূচনা হয়েছে অনেক আগে, ফলে সেসব দেশে এর বেশি। সেসব দেশের জনগণের নিজেদের সৃষ্ট প্রযুক্তিগত আধুনিক এ সংস্কৃতি তাদের জীবনের সাথেও পুরোদস্তুর মানানসই । অন্যদিকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে আকাশ সংস্কৃতির ঢেউ যেমন প্রবল নয়, তেমনি এটা এসব দেশ ও সমাজের মানুষের জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সব ক্ষেত্রে মানানসইও নয়। কেননা এ সংস্কৃতি তাদের নিজের নয়। তাই আকাশ তরঙ্গে ভেসে আসা এ ভিনদেশী সংস্কৃতির চাপড়ে এসব সমাজদেহ ক্ষতবিক্ষত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। স্যাটেলাইট সংস্কৃতির আহ্বান দেশের সকল মানুষকে আকুল করতে না পারলেও শহুরে জীবনে এর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে লক্ষণীয় হারে। তবে স্যাটেলাইট তথা মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির এ প্রভাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক হলেও এর ইতিবাচক দিকগুলোকে উপেক্ষা করা অনুচিত। সংস্কৃতি আসলে একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, একটি জীবনবোধ বিনির্মাণের কলাকৌশল। এটি মানুষের জীবনের একটি শৈল্পিক প্রকাশ, সমাজ জীবনের স্বচ্ছ দর্পণ।

এ সংস্কৃতির দর্পণে তাকালে কোনো সমাজের মানুষের জীবনাচার, জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। অন্যকথায়, সমাজ মানুষের জীবনাচার, দৃষ্টিভঙ্গি আর বোধ-বিবেচনা থেকেই সে সমাজের সংস্কৃতি জন্মলাভ করে। তবে সংস্কৃতি এমন কোনো জিনিস নয় যে, এটি একবার ছাঁচে তৈরি হবে, তার আর কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। বরং সমাজ ও জীবনের পরিবর্তন এবং সময়ের ধারায় এ সংস্কৃতি পরিবর্তিত হতে পারে। এমন কি অন্য কোনো সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন নতুন উপাদান সপ্তাহ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। অন্যদিকে ভিনদেশী সংস্কৃতির তোড়ে, আপনার অস্তিত্ব হারিয়েও ফেলতে পারে। আর এ দুর্ভাগা পরিণতি যে সমাজের হয় সে সমাজেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের জন্ম হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে ঠিক এটিই ঘটেছে। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির নামে স্যাটেলাইটের নগ্ন আর বস্তুবাদী সংস্কৃতি আমাদের সমাজকে এমন আঘাত করেছে যে এর তোড়ে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠেছে। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মুক্তবাজারে আমরা মার খেয়ে বসেছি। পশ্চিমা চটকদার সংস্কৃতি আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। ফলে আমরা আমাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ক্রমেই সাংস্কৃতিক দৈন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি।

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যে রঙিন জীবনবোধ তা আমাদের দেশীয় জীবনরোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। স্যাটেলাইটে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে বস্তুবাদিতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর নগ্নতার হাজারো পাঠ। এ পাঠের শিক্ষকরা অনেক পটু, যারা এগুলোকে অনেক রঙ ঢঙ আর লালসার আবরণ লাগিয়ে পসরা সাজিয়ে ধরছে আমাদের সামনে। ফলে মনের অজান্তেই আমরা ছুটছি এক স্বপ্নিল ভুবনের দিকে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমাদেরও একটা নিজস্ব ভুবন আছে, একটি নিজস্ব জীবনবোধ আছে। আমাদের এ আত্মবিস্মৃতিই আমাদেরকে প্রতিনিয়ত হতাশার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে এর প্রভাব পড়ছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।

আকাশ সংস্কৃতির ছোঁয়া আমাদের সমাজ কাঠামো ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন ও প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের পরিবার কাঠামো ও পারিবারিক জীবনের সুমধুর বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। পশ্চিমা সমাজের বিবাহহীন অবাধ যৌনাচারের সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধনহীন বাউণ্ডেলের জীবনের বিকৃত ধারণা আমাদের হাজার বছরের পুরনো পারিবারিক জীবনের ধারণাকে প্রায় পরাস্ত করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, আবহমান বাংলায় যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল তা এখন প্রায় অচল।

বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ এখন নেই বললেই চলে। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির স্রোতে ভাসমান আমাদের তরুণরা অনেক বেশি স্বাধীনতা চায়। কিন্তু তারা জানে না যতটুকু স্বাধীনতা দরকার তার মাত্রা অতিক্রম করলে পথভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবং আমাদের সমাজে তাই হচ্ছে। ফলে আমাদের তরুণ সমাজ আজ পথভ্রষ্ট। বিদেশী চলচ্চিত্রে তরুণদের বিয়ার খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমাদের তরুণরা মাদকের নেশায় মত্ত; মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা, স্পাইস গার্লস, ব্যাক স্ট্রীট বয়, শাকিরা, শ্রীদেবী আর শিল্পা শেঠীর বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি দেখে আমাদের যুবক-যুবতীরা আজ উন্মাদপ্রায়। পাশাপাশি স্যাটেলাইট সংস্কৃতির মরণছোবল আমাদের যুবসমাজকে অপরাধপ্রবণও করে তুলেছে।

আরেকটি বিষয় হলো, বিদেশী সংস্কৃতির ব্যাপক আমদানির ফলে আমাদের বিপুল সাংস্কৃতিক সম্পদ আজ অবহেলা আর অযত্নে ধ্বংস হতে চলেছে। আবদুল আলীম, আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে পল্লী জীবনের যে হৃদয়গ্রাহী চিত্র ফুটে উঠত তা এখন আর শোনা যায় না। ব্যান্ড সঙ্গীতের নামে আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা যে চেঁচামেচির মহড়া দেয় তা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে না মোটেও। তবু একদল উঠতি যুবকের অবচেতন মনের দুর্বলতাকে পুঁজি করে এসবের বাজার দিন দিন গরম হচ্ছে।

 

আগে যেখানে একতারা, দোতরা, সারিন্দা, তবলা, ঢোল এবং বাঁশির সুরে সরলপ্রাণ বাঙালির হৃদয় আকুল হতো এখন গীটার আর কী-বোর্ডের কর্কশ সুরের মাঝে তা খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেকার দিনে বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, কমলার বনবাস কিংবা আলোমতি-প্রেম কুমারের যে যাত্রা গান, পালাগান হতো এবং গ্রাম-বাংলার মানুষ রাতভর প্রাণভরে উপভোগ করতো, তা-ও এখন আর দেখা যায় না।

বিদেশী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও চর্চা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদ এবং চাল-চলনেও ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। জিন্স, টি-শার্ট আর স্কার্ট এখন আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের খুবই প্রিয়। শাড়ি, লুঙ্গি কিংবা পাজামা-পাঞ্জাবি এখন আর তাদের তেমন পছন্দ নয়। এমনকি আমাদের যুবকদের আধুনিক জীবনের যে মাদকতা তা অনেক সময় তাদের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা ও বোধ বিচারকেও পরাহত করে বসে। ডিশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচলনের ফলে আমাদের মেয়েদের অনেকেই স্বল্পবসনকে আধুনিক জীবনের নমুনা বলে ভুল করেন।

এমনকি পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে তারা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনের অচিন পাখিকে ধরতে পারে না, তেমনি দেশীয় জীবন ও সমাজব্যবস্থার সাথেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। ফলে তারা একটি দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয় এবং অবশেষে জীবন হয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন ও হতাশাপূর্ণ।

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি আমাদের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে চরমভাবে আঘাত করেছে, সেটি হলে আমাদের ধর্মীয় জীবনবোধ ও নৈতিক শিক্ষা। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের ধর্মনিষ্ঠা এবং নৈতিকতার বোধ কিছুটা আহত হচ্ছে নিঃসন্দেহে। নারী-পুরুষের অবাধ  যৌনাচার আর অ্যালকোহলিক সংস্কৃতি বিশেষ করে ইসলামী জীবনাচারের বিরোধী। অথচ সুখী-সুন্দর ও শান্তিময় জীবনের জন্য এসব কিছুর চেয়ে ধর্মীয় জীবনের প্রয়োজনীয় অনুসরণ খুবই জরুরি। ভাষাড় আকাশ সংস্কৃতির প্রাবল্য আমাদের সামাজিক মূলাবোধের অবক্ষয়ে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

ইতিবাচক প্রভাব: তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার আর বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে দরজা বন্ধ করে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো উপযোগী করে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে হবে । এক্ষেত্রে আমাদের দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রোখার আগে দেখতে হবে, খোলা জানালার সমীরণ আমাদের জন্য কল্যাণকর অনেক কিছুই বয়ে নিয়ে আসছে। 

বিশ্বব্যাপী তথ্যের যে অবাধ প্রবাহ এ তথ্যব্যবস্থার সাথে নিজেদের সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট প্রযুক্তির প্রসার অপরিহার্য। ইন্টারনেট আর স্যাটেলাইট প্রযুক্তির প্রচলন আমাদেরকে বিশ্বের বৃহত্তর তথ্যসমাজের সদস্য হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাগুলোর সাথে আমাদের পরিচিতি আমাদেরকে দেশ, জাতি ও আন্তর্জাতিক সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে। ইন্টারনেটের প্রচলন যোগাযোগ ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তা থেকেও আমরা পুরোপুরি বঞ্চিত নই।

তাছাড়া মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির সান্নিধ্য আমাদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়েছে নিঃসন্দেহে। এটি আমাদেরকে বিভিন্ন সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে অবাধ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান- বিজ্ঞানের বৃহত্তর রাজ্যে আমাদের অনুপ্রবেশ অনেক সহজতর হয়েছে। ফলে ধীরে হলেও আমরা ক্রমে আধুনিক জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছি, অনুপ্রাণিত হচ্ছি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ঈর্ষণীয় উন্নতি দেখে। 

আবার মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি আমাদেরকে বিদেশী সংস্কৃতির সংস্পর্শে যেমন নিয়ে গেছে, তেমনি এর ফলে আমাদের সংস্কৃতিও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার সুযোগ হয়েছে। ইতিমধ্যেই আমাদের বেশ ক’টি স্যাটেলাইট চ্যালে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এতে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে।

আমাদের করণীয় : বর্তমানকালে এক পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে এ বিশ্ব সাম্রাজ্যের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আমাদের নেই। তাই এর মধ্যে থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর স্বার্থকে বাঁচিয়ে রেখে চলতে হবে। আর জটিল এ বিশ্বব্যবস্থায় চলতে গেলে আমাদেরকে অনেক বেশি কুশলী হতে হবে। সে জন্য প্রথমত, বিদেশী সংস্কৃতির দরজা বন্ধ না করে নিজেদেরকে আরো বেশি প্রতিযোগিতার উপযোগী করে তুলতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতির লালন আর বিদেশী সংস্কৃতির মোকাবিলায় টিকে থাকতে হলে দেশীয় সংস্কৃতিকে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

দ্বিতীয়ত, আকাশের দরজা বন্ধ করা না গেলেও বিদেশী সংস্কৃতির অনুসরণ ও অনুকরণের ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো বেশি সজাগ হতে হবে। তৃতীয়ত, বর্তমানে চালু আমাদের স্যাটেলাইটগুলোর সম্প্রচারে আরো বৈচিত্র্য আনয়নের পাশাপাশি নতুন নতুন স্যাটেলাইট চ্যানেল চালুর পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরি। চতুর্থত, স্যাটেলাইট সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সেজন্য বিভিন্ন চ্যানেলের মান ও অনুষ্ঠানের উপযোগিতা সম্পর্কে সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনার পরই তা চালানোর অনুমতি দান আবশ্যক।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version