বিশ্বায়ন ও আমাদের সংস্কৃতি | ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : বিশ্বায়ন মূলত একটি সর্বব্যাপী ও সার্বক্ষণিক চলমান প্রক্রিয়া। তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের ফলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষই একটি একীভূত বিশ্বব্যবস্থার মিলিত হচ্ছে। ক্রমেই দীন হচ্ছে ভৌগোলিক সীমারেখা ও চিন্তার ভিন্নতাসূচক স্বাতন্ত্র্যবোধ।
বিশ্বায়ন ও আমাদের সংস্কৃতি | ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি | বাংলা রচনা সম্ভার
বিশ্বায়ন ও আমাদের সংস্কৃতি
মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করলেও প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ফলে। এভাবে মানুষ একে অপরের খুব কাছে আসতে পারছে। কিন্তু এ কাছে আসা, পরিচিত হওয়া ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার ফলে এসেছে লাভালাভের প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো লাভবান হচ্ছে আর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের এ যুগে উন্নত সংস্কৃতি দুর্বল সংস্কৃতিকে গ্রাস করবে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বব্যাপী। আমাদের সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে অনেক গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বায়ন আমাদের সংস্কৃতিতে কি প্রভাব বিস্তার করবে, সুদূরপ্রসারী কি পরিবর্তন ঘটবে তা এখনই ভেবে দেখার বিষয়।
বিশ্বায়ন: নব্বই-এর দশকের শুরুতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোচিত একটি বিষয় হলো বিশ্বায়ন। মার্শাল ম্যাকলোহান-এর মতে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর অন্য একটি রূপই হচ্ছে বিশ্বায়ন। একে অভিহিত করা হয় এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে, যা রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের পুরোনো কাঠামো ও সীমানাকে অবলুপ্ত করেছে।
বিশ্বায়নকে বলা হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ক্রমবর্ধমান পরাজাতীয়করণ (Transnationalization), যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশ্ব সীমানা, এক বিশ্ব সম্প্রদায়। এটি এমন একটি সর্বব্যাপী অভিজ্ঞতা যে আমাদের জীবনের অধিকাংশ দিকই এর আওতাভুক্ত হয়ে পড়েছে।
গিয়েন্স (Giddens) বিশ্বায়ন প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্থানিক অভিজ্ঞতার মূলসূত্রই বদলে গেছে, নৈকট্য ও দূরত্ব পরস্পরের সাথে এমনভাবে একত্র হয়েছে যার তুলনা অতীত থেকে মেলা ভার।’
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিশ্বায়ন কোনো একক প্রক্রিয়া নয় বরং এটি সর্বব্যাপী ও সার্বিক প্রক্রিয়া। বিশ্বায়ন রাষ্ট্রীয় সীমানার প্রাচীর ভেঙে অর্থনৈতিক যোগাযোগ ও লেনদেন, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপকতর পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ফলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা- চেতনা এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।
বিশ্বায়নের সাম্প্রতিক ধারা: বর্তমানে যে বিশ্বায়নের কথা বলা হচ্ছে তা মূলত পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের উপনিবেশবাদী চেহারা ছাড়া আর কিছু নয়। এর মাধ্যমে সম্পদশালী দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের ওপর অর্থনৈতিক নয়া উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠা করে পুঁজিবাদের হাতকে শক্তিশালী করতে চায়। সুতরাং পুঁজিবাদের তথাকথিত বিশ্বায়ন থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। এ কথাটি অর্থনীতির বেলায় যেমন প্রযোজ্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম।
সংস্কৃতি : সংস্কৃতি শব্দটির অর্থ অত্যন্ত জটিল। সংস্কৃতির সাথে জীবনের নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। সংস্কৃতিকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সংস্কৃতি হলো মানুষের আচরণের সমষ্টি। মানুষের জাগতিক নৈপুণ্য ও কর্মকুশলতা, তার বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা, কলা ও নৈতিকতা, রাজনীতি, ভাষা, মূল্যবোধ সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজের মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নীতি, নিয়ম, সংস্কার ও অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে দক্ষতার জটিল সমাবেশ। মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বাচা|
সংস্কৃতি সম্পর্কে ম্যাথু আর্নল্ড বলেন, ‘সংস্কৃতি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় বিশ্বের সর্বোত্তম জিনিসগুলোর সঙ্গে এবং সে সঙ্গে মানুষের গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গেও।’
কালটাজার গ্রাসিয়ান বলেন, ‘মানুষ জন্মায় বর্বর হয়ে, সংস্কৃতিই তাকে করে সুসভ্য । আবার শওকত ওসমান বলেন, ‘সংস্কৃতি জীবনকে মোকাবিলার চেতনা।
’ সুতরাং এক কথায় বলা যায়, সংস্কৃতি হলো চলমান জীবনের দর্পণ অর্থাৎ মানুষের দৈনন্দিন জীবন প্রণালীর গ্রহণযোগ্য চর্চা বা প্রথা যা কোনো সমাজের মানুষের পরিচয় বহন করে ।
আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার: সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো মানুষের দীর্ঘদিনের আচার-আচরণ, কাজকর্ম, কথাবার্তা প্রভৃতির মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য কোনো প্রথা বা উপাদান। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে ধর্মীয় রীতিনীতি, উৎসব, লোকসাহিত্য, সঙ্গীত, ঋতুভিত্তিক উৎসব, বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সামাজিক প্রথা, খেলাধুলা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সংস্কৃতি হাজার বছর ধরে তামাটে বাঙালিদের জীবন বোধের উপর গড়ে উঠেছে।
জীবন ধারণের জন্য কৃষিকাজ, ঈশ্বর বিশ্বাসে ধর্ম-কর্ম, স্নেহ মাখা পারিবারিক বন্ধন, গ্রামীণ কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্ট লোকসাহিত্য, গ্রামীণ সঙ্গীত, জীবনঘনিষ্ঠ হরেক রকম উপাদান আমাদের সংস্কৃতিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। আর্যজাতি থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন শাসকদের সময়ে আমাদের সংস্কৃতির ভিত একটু একটু করে প্রাণপুষ্ট হয়েছে। তুর্কি, ইরানি, আফগানসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমনে ভিন্ন সংস্কৃতির নানা দিক ধারণ করে আমাদের সংস্কৃতি শোভিত হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় আমাদের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে, পরিবর্ধন ও সমৃদ্ধি এসেছে।
মধ্যযুগে সুলতানী শাসনামলে আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। সুলতানী শাসকগণ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চা, ধর্মীয় চর্চাকে উৎসাহিত করতেন; মুঘল শাসকগণ গল্প, কবিতা, উপন্যাস রচনায় সাহিত্যিকদের উৎসাহ দিতেন। রাজদরবারে কবিতা, গল্প শোনার জন্য লেখকদের আহ্বান করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে বাংলা সংস্কৃতি। এরপরে পাকিস্তান আমলে আমাদের সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক কারণে অস্তিত্বের ইস্যুছাড়া আর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি: এক সংস্কৃতির মানুষের সাথে যখন অন্য সংস্কৃতির মানুষের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ ঠিক তখনই বিশ্বায়নের প্রশ্ন দেখা দেয়। সংস্কৃতি পারস্পরিক বিনিময়যোগ্য। এটি চিরদিন স্থির থাকে না। বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে মিশে এর রূপ পরিবর্তন হবে, নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বায়নের মূল বিষয় হলো এক সংস্কৃতির আচার-অনুষ্ঠান, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য, তথ্য-প্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিজ্ঞান-দর্শন, শান্তি ইত্যাদির সাথে অন্য সংস্কৃতির মিলন। তাহলে দেখা যাচ্ছে সংস্কৃতি বিশ্বায়নের তুলনায় একটি ক্ষুদ্র বিষয়। আর বিশ্বায়ন হলো কতগুলো সংস্কৃতির সমষ্টি। এ সামান্য পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয়ের সাথে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব : জ্যান নেডারভিন (Jan Nederveen) মনে করেন, বিশ্বায়ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে একটি সংকর সংস্কৃতি (Hybrid Cuture) সৃষ্টি করবে। তিনি এর নাম নিয়েছেন ‘তৃতীয় সংস্কৃতি’। এ নয়া সংস্কৃতি এখন স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। Jayaweera-এর মতে, বিশ্বায়ন থেকে যে সামাজিক সম্পর্ক উদ্ভূত হয় তা গোটা বিশ্বকে ক্রমান্বয়ে একটা একক প্রধান অর্থনীতি, একক সরকার ব্যবস্থা এবং একক সংস্কৃতিতে সংহত করে।
এই একক সংস্কৃতি স্থানীয় সংস্কৃতির পৃথক বৈশিষ্ট্য ও জনগণের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চাহিদার প্রতি অসংবেদনশীল, কৃত্রিম ও অগভীর। কারণ সংস্কৃতির মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ জনগণের আচার-আচরণ, জীবন যাত্রার প্রতিফলন ঘটানো তা এ সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বরং বিশ্বায়ন থেকে জাত এ নয়া সংস্কৃতি বিনোদন ও যৌনতার পৃষ্ঠপোষকতাই কেবল করে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সংস্কৃতির এ ধারা প্রায় সর্বাংশেই উন্নত থেকে স্বল্পোন্নত দেশের দিকে ধাবিত।
বিশ্বায়ন ও আমাদের সংস্কৃতি : বিশ্বায়নের তোড়ে আন্তঃব্যক্তিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ বৃদ্ধির কারণে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ব্যাপকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদানও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইড ও সুযোগের অভাবে পৃথিবীর অনেক সংস্কৃতিই প্রতিযোগিতায় উন্নত বিশ্বের সংস্কৃতির কাছে মার খাচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে বিদেশী সংস্কৃতির মাঝে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। এ দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কারণ, নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরার যথেষ্ট সুযোগ না পাওয়ায় এসব দেশে অবাধেই বিদেশী সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে।
বাংলাদেশও এই পরিস্থিতির শিকার। আমাদের শিশু ও যুবকদের মাঝে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা আর বিদেশী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের যে সর্বনাশা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা তাদেরকে উদ্দেশ্যহীন এক দুর্গম পথের যাত্রীতে পরিণত করেছে। ফলে ভেঙে যাচ্ছে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রতিষ্ঠান, মূল্যবোধ। আর নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ে সমাজ কাঠামো আজ ধ্বংস প্রায়। বস্তুবাদী আর ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার মানবিকতা বোধ ও বিচারকে ক্ষতবিক্ষত করেছে প্রতিনিয়ত। বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের সংস্কৃতি আজ বিপদাপন্ন।
বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব: বিশ্বায়ন আমাদের সংস্কৃতিকে এমনভাবে আঘাত করছে যে, এর প্রতিরোধহীন অবিরাম থ্রোতে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠেছে। পশ্চিমা চটকদার সংস্কৃতি আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। ফলে আমরা আমাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ক্রমেই সাংস্কৃতিক দৈন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছি। ফলে এর প্রভাব পড়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
১. সমাজ কাঠামো ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উপর প্রভাব: বিশ্বায়ন আমাদের সমাজ কাঠামো ও : সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন ও প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আবহমান বাংলায় যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল তা এখন প্রায় অচল। বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ এখন নেই বললেই চলে। বিদেশী সংস্কৃতির স্রোতে ভাসমান আমাদের তরুণেরা অনেক বেশি স্বাধীনতা চায়। কিন্তু তারা জানে না যতটুকু স্বাধীনতা দরকার তার মাত্রা অতিক্রম করলে পথভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবং আমাদের সমাজে তাই হচ্ছে। ফলে আমাদের তরুণ সমাজ আজ পথভ্রষ্ট।
২. পরিবার ব্যবস্থায় প্রভাব : সংস্কৃতির বিশ্বায়নে আমাদের পরিবার ব্যবস্থায় এসেছে বিকৃতি। এখন মানুষ যৌথ সংসারে তৃপ্তি পায় না, চায় স্বামী-স্ত্রীর একক সংসার। সন্তানদের কাজের লোকের দায়িত্বে রেখে পিতামাতা উপার্জন কিংবা সামাজিকতার স্বাদ আস্বাদন করছে।
সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার আন্তরিকতা ও স্নেহবোধ, দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতার বন্ধন ধীরে ধীরে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। একই সাথে বয়ঃবৃদ্ধ বাবা-মাকে দূরে বা নিভৃত পল্লীতে রেখে সন্তান বাইরে সুখ-খুঁজে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও আমাদের পরিবার কাঠামো পারিবারিক জীবনের সুমধুর বন্ধনকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। পশ্চিমা সমাজের বিবাহহীন অবাধ যৌনাচারের সংস্কৃতি ও পারিবারিক বন্ধনহীন বাউন্ডুলের জীবনের বিকৃত ধারণা আমাদের হাজার বছরের পুরোনো পারিবারিক জীবনের ধারণাকে প্রায় পরাস্ত করে ফেলেছে।
৩. সঙ্গীত ও লোককাহিনীর উপর প্রভাব : দেশীয় সংস্কৃতিতে অন্য একটি বিপর্যয় নেমে এসেছে আমাদের সঙ্গীতের ক্ষেত্রে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী সুরসম্ভার হারিয়ে যাচ্ছে বিজাতীয় সঙ্গীতের প্রভাবে। আবদুল আলীম, আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে পল্লী জীবনের যে হৃদয়গ্রাহী চিত্র ফুটে উঠত তা এখন আর শোনা যায় না। ব্যান্ড সঙ্গীতের নামে আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা সে চেচামেচির মহড়া দেয় তা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে না মোটেও।
তথাপি একদল উঠতি যুবকের অবচেতন মনের দুর্বলতাকে পুঁজি করে এসবের বাজার দিন দিন গরম হচ্ছে। আগে যেখানে একতারা, দোতরা, সারিন্দা, তবলা, ঢোল এবং বাঁশির সুরে বাঙালির হৃদয় আকুল হতো, এখন গীটার আর কী বোর্ডের কর্কশ সুরের মাঝে তা খুঁজে পাওয়া যায় না। আগেকার দিনে বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, কমলার বনবাস কিংবা আলোমতি প্রেমকুমারের যে যাত্রাগান পালাগান হতো এবং গ্রাম বাংলায় মানুষ রাতভর প্রাণ ভরে উপভোগ করতো, তাও এখন আর দেখা যায় না।
৪. পোশাক-পরিচ্ছদের উপর প্রভাব : পোশাক-পরিচ্ছদে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল। বিদেশী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও চর্চা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। জিন্স, টি-শার্ট, স্কার্ট এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয়। শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা পাজামা-পাঞ্জাবি এখন আর তাদের তেমন প্রিয় নয়। আমাদের মেয়েদের অনেকেই স্বল্পবসনকে আধুনিক জীবনের নমুনা বলে ভুল করে। এমনকি পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে তারা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনের অচিন পাখিকে ধরতে পারে না, তেমনি দেশীয় সংস্কৃতির সাথেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তারা একটি দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয় এবং অবশেষে জীবন হয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন ও হতাশাপূর্ণ।
৫. ভাষা ও সংলাপের উপর প্রভাব: বিশ্বায়নের আর একটি প্রত্যক্ষ ও বাহ্যিক ধরন হলো আমাদের নতুন প্রজন্মের কথাবার্তার পরিবর্তন। অনুকরণপ্রিয় শিশুরা বাবা-মাকে বাংলা ভাষায় সম্বোধন না করে বিদেশী বিশেষত ইংরেজিতে পাপা-মাথী/মন ডাকতে আগ্রহী। কথায় কথায় অন্য ভাষার শব্দের ব্যবহার, বাংলা শব্দের বিকৃতি এখন প্রায়শ লক্ষ্য করা যায়।
৬. চলচ্চিত্রের উপর প্রভাব: বিদেশী চলচ্চিত্রের অশুভ প্রভাব পড়েছে আমাদের চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রে এখন স্বল্প বসনা নারীদের পদচারণা খুব বেশি। শিল্পের ছোঁয়া নেই এসব অভিনয়ে। উত্তেজক দৃশ্যসমূহে শিহরিত হয় দর্শকবৃন্দ। বিদেশী চলচ্চিত্রে তরুণদের বিয়ার খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমাদের তরুণেরা মাদকের নেশায় মত্ত। বিদেশী সংস্কৃতির মরণ ছোবল আমাদের যুব সমাজকে অপরাধপ্রবণও করে তুলেছে।
৭. ব্যবসার উপর প্রভাব: বিদেশী সংস্কৃতির অনুকরণে ব্যবসা ক্ষেত্রে যেসব নতুন বিষয়ের চর্চা শুরু হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো শহর এলাকায় ক্যাট ওয়াক সংস্কৃতি। এর সাথে আমাদের সংস্কৃতির কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। পাশ্চাত্য স্টাইলে নানা ফ্যাশন শো, পণ্যের বিজ্ঞাপনে মডেলদের ব্যবহার প্রভৃতি আমাদের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমাজের বিত্তবান ও অনুকরণপ্রিয় ব্যক্তিরা এসব সংস্কৃতিকে দেশীয় সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।
৮. খাদ্যভ্যাসের উপর প্রভাব: বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের খাদ্যাভাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। কোনো খাবারের পুষ্টিমান বিবেচনা না করে টেলিভিশন চ্যানেলে খাবারের বিজ্ঞাপন প্রচারে আমাদের নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হচ্ছে। এমন কি বড়দের ক্ষেত্রেও আত্মীয় স্বজন বেড়াতে এলে রকমারী পিঠা-পায়েস, গুড়-মুড়ির পরিবর্তে নুডুলস, চিপস বা বিজাতীয় সংস্কৃতির কোনো খাদ্য উপাদান দিয়ে আপ্যায়ন করা হচ্ছে।
৯. ফাস্ট ফুড : আমাদের সংস্কৃতির নতুন সংযোজন হলো ফার্স্ট ফুড সংস্কৃতি। বর্তমানে তরুণ- তরুণীসহ শিশু-কিশোর এমনকি বয়স্কদের মাঝেও এ সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে। এ চর্চাটি সাধারণত শহর এলাকায় দেখা যায়।
১০. ধর্মীয় জীবন বোধ ও নৈতিক শিক্ষার উপর প্রভাব : বিদেশী সংস্কৃতি আমাদের জীবনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে চরমভাবে আঘাত করেছে, সেটি হলো আমাদের ধর্মীয় জীবনবোধ ও নৈতিক শিক্ষা। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের ধর্মনিষ্ঠা এবং নৈতিকতা বোধ আহত হচ্ছে নিঃসন্দেহে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অবাধ যৌনাচার আর অ্যালকোহলিক সংস্কৃতি বিশেষ করে ইসলামী সংস্কৃতির বিরোধী। অথচ সুখী-সুন্দর ও শান্তিময় জীবনের জন্য এসব কিছুর চেয়ে ধর্মীয় জীবনের প্রয়োজনীয় অনুসরণ খুবই জরুরি। বিদেশী সংস্কৃতির প্রাবল্য আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
১১. উৎসবের উপর প্রভাব : আমাদের সংস্কৃতির ওপর আর এক ভয়ংকর থাবা পড়েছে যা গ্রাস করেছে সম্ভাবনাময় তারুন্যকে। থার্টি ফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন্স ডে প্রভৃতি বিজাতীয় সংস্কৃতি তরুণ-তরুণীদের গ্রাস করেছে, তাদের সুকুমার বৃত্তিকে করেছে কলুষিত। বাঙালির পয়লা বৈশাখ, পয়লা ফাল্গুন তরুণ-তরুণীদের একটা আলোড়িত করতে পারছে না |
ইতিবাচক প্রভাব : বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক নিকের মতো সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আন্তর্জাতিক সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার মতো উপযোগী করে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের দ্বার বন্ধ করে ভ্রমরটাকে রোখার আগে দেখতে হবে খোলা জানালার বাইরে আমাদের জন্য কল্যাণের অনেক কিছুই আছে। সংস্কৃতি এমন কোনো জিনিস নয় যার কোনো পরিবর্তন করা যাবে না, বরং সমাজ ও জীবনের পরিবর্তন এবং সময়ের ধারায় এ সংস্কৃতি পরিবর্তিত হতে পারে। এমন কি অন্য কোে সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
বিশ্বায়নের এ যুগে বিজাতীয় সংস্কৃতির সান্নিধ্য আমাদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়েছে নিঃসন্দেহে। এটি আমাদেরকে বিভিন্ন সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করার সুযোগ করে নিচ্ছে। বিভিন্ন বিদেশী সংস্কৃতির সাথে অবাধ মেলামেশার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বৃহত্তর রাজ্যে আমাদের অনুপ্রবেশ সহজতর হয়েছে। ফলে ধীরে হলেও আমরা ক্রমে আধুনিক জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। অনুপ্রাণিত হচ্ছি বিশ্বের বিভিন্ন জাতির ঈশ্বর্ণীয় সংস্কৃতি দেখে।
বিশ্বায়ন আমাদের সংস্কৃতিকে বিদেশী সংস্কৃতির সংস্পর্শে যেমন নিয়ে গেছে, তেমনি এর ফলে আমাদের সংস্কৃতিও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যেই আমাদের বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে।
আমাদের করণীয়: বর্তমানে এক পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে বিশ্ব সাম্রাজ্যের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আমাদের নেই। তাই এর মধ্যে থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর স্বার্থকে বাঁচিয়ে রেখে চলতে হবে। আর জটিল এ বিশ্বব্যবস্থায় চলতে হলে আমাদের আরো বেশি কুশলী হতে হবে। সেজন্য –
১. বিদেশী সংস্কৃতির দরজা বন্ধ করে নিজেদেরকে আরো বেশি প্রতিযোগিতার উপযোগী করে তুলতে হবে।
২. দেশীয় সংস্কৃতিকে লালন আর বিদেশী সংস্কৃতির মোকাবেলায় টিকে থাকার জন্য দেশীয় সংস্কৃতিকে যুগোপযোগী করে তুলতে হবে।
৩. বিদেশী সংস্কৃতির অনুসরণ ও অনুকরণের ক্ষেত্রে আরো বেশি সজাগ হতে হবে।
৪. আমাদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের সমগ্রপ্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্যাটেলাইট চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ অনুষ্ঠান সম্প্রচারে আরো বৈচিত্র্য আনয়ন করতে হবে।
৫. বিদেশী সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। সেজন্য বিভিন্ন সংস্কৃতির উপযোগিতা সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার বিবেচনার পর তা দেশে সম্প্রচারের অনুমোদন দিতে হবে।
৬. বিজাতীয় কুরুচিপূর্ণ সংস্কৃতি বন্ধের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে।
৭. বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশই আভিজাত্যের পরিচায়ক তরুণদের এ ভ্রান্ত ধারণা ঘোচাতে হবে।
৮. সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি করতে হবে।
উপসংহার: বিশ্বায়নের এ বিশ্বব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো নিজেকে সভ্যতা থেকে আলাদা করে রাখা। এটা কোনো জাতির জনই সুখকর নয়। এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি নিজস্ব সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেই বিশ্বব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে হকে যদি তাই হয়, তাহলে এটাও অস্তিত্বের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। কেননা, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার সুযোগ উন্নত দেশগুলো অনেক আগেই গ্রহণ করেছে।
এবার তাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পালা। সুতরাং তাদের উপেক্ষা করা অসম্ভব হলেও নিজের অস্তিত্বের খাতিরে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
আরও দেখুন: