মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান, নারীর মুক্তিযুদ্ধ [ Essay on Women’s contribution in liberation war ] অথবা, মুক্তিযুদ্ধে নারী – নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনার নমুনা দেয়া হল।

Table of Contents
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান রচনার ভূমিকা :
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে। নারীরা সশস্ত্র যােদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র সংরক্ষণ ও সরবরাহকারী হিসেবে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে, খাবার রান্না করে, অনুপ্রেরণা যুগিয়ে, তথ্য সরবরাহ করে, সেবাদান করে প্রভৃতি উপায়ে ভূমিকা রেখেছে।
প্রবাসেও নারীরা মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যার্থে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। নারীরা সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে, গেরিলা তৎপরতা চালিয়েছে, যুদ্ধে আহত হয়েছে এবং অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ।তাই, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান কে খাটো করে দেখার উপায় নেই। নিম্নে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান আলােচনা করা হল-
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান
১.প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নারীর অবদান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে সকল নারীরা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল- খালেদা খানম, তারামন বিবি, রিজিয়া চৌধুরী, মমতাজ বেগম প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খালেদা খানম। তিনি মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এলাকায় কাজ করেন।
তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মেয়েদের যুদ্ধে অংশগ্রহণেও উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ ছিল স্থানীয় কয়েকজন নেতার সাথে থানা আক্রমণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখ যোগ্য হলেন-বরিশালের করুণা বেগম, পােড়া রানী, বীথিকা বিশ্বাস, শিশির কণা, সাহানা, গোপালগঞ্জের আশালতা শেদ,মেহেরুন নেছা, পটুয়াখালির মনােয়ারা বেগম, যশোরের সালেহা বেগম, সুনামগঞ্জের পেয়ারা চাঁদ প্রমুখ।
তারামন বিবি ১৮ নং সেক্টরের অন্তর্গত রাজীবপুর, মােহনগঞ্জ, আগরতলা প্রভৃতি স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, করেন । বাঙালি নারীদের পাশাপাশি অনেক আদিবাসী নারীরাও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে।এসব নারী যােদ্ধা দেশের বিভিন্ন অংশে অপারেশনে অংশগণ করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে হানাদার বাহিনীকে ধ্বংস করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

২.প্রশিক্ষণে নারী
নারী সমাজের অদৃশ্য প্রাণশক্তিকে মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তৎকালীন মেলা নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের অবস্থান ছিল কলকাতার পদ্মপুকুর পার এর মধ্যবর্তী গােবরা এলাকায়। এই ক্যাম্পে নারীদের সিভিল ডিফেন্স, নাসিং ও সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় ।
এছাড়াও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিদিন চলে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ। এখানে নারী মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আবার কেউ সেবার কাজে নিয়ােজিত হন, কেউ মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংসাড়ে ভূমিকা রেখেছে, কেউ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
প্রায় ৪০০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা এই ক্যাম্পে সশথ লুদের পেশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নারীদের মধ্যে অত্যন্ত সাহসী ছাত্রলীগের কিশােরী নেত্রীদেরকে গেরিলা উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় আগরতলা ক্যাম্পে। মহিলা গেরিলা স্কোয়াড ট্রেনিং-এ প্রথম ৮ জন মহিলা অংশগ্রহণ করে ।এর মধ্যে আমেনা সুলতানা বকুল অন্যতম।
৩. মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়দান
অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দানেও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান রয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ ও বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা কৌশল অনম্বন করেছিলেন।এই গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাগণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলেন বিধায় তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়ােজন ছিল। বাংলাদেশের শহুরে, শিক্ষিত অশিক্ষিত সবশ্রেণির নারীরা মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন।
নিজেদের জীবন মৃত্যুর জেনেও তারা মুক্তিযােদ্ধাদের নিজের শােবার ঘর, বাথরুম বা গােলাঘরে লুকিয়ে রেখে পাকবাহিনী, রাজাকারের হাত থেকে রক্ষা করেন। এসব আশ্রিত মুক্তিযােদ্ধাদের মহিলারাই খাবার সরবরাহ করতেন। এছাড়া মহিলারা সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযােদ্ধাদের রেখে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র তারা খুব যত্নের সাথে চালের পারে, মুরগির খােয়াড়ে, বিছানার নিচে, মাটির তলায়, বাথরুমে ও আলমারিতে লুকিয়ে রাখতেন। পরবর্তীতে সময়মতো মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দিতেন।
৪.সেবা প্রদানে নারী
নারীরা অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের নাসিং বা সেবার দায়িত্ব পালন করেও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান রাখেন। সীমান্ত অচল ও মুক্তাঞ্চলে যেসব অস্থায়ী হাসপাতাল খােলা হয়েছিল সেখানে নারীরাই কাজ করতেন। এদের নাসিং এর উপর কোন প্রশিক্ষণ ছিল না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব নারী রােগীর সেবা করতে এগিয়ে আসতেন।
অনেক মহিলা চিকিৎসকও অসুস্থ মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসেন। ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম ১৯৭১ সালে কুমিল্লা সিএমএইচ-এ কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ২নং সেক্টরের অন্তর্গত বিশ্রামগঞ্জ ফিল্ড হাসপাতালে যােগদেন। ড. মাখদুমা নার্গিস রত্না যুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শরণার্থী শিবির ও প্রশিক্ষা শিবিরে চিকিৎসা ও সেবাকাজে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন।
এছাড়া মেয়েদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মুজিবনগর সরকার এজনা নাসিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালনা বাের্ড গঠন করেন। পরিচালনা বাের্ডের সদস্য ছিলেন মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ, বেগম রাফিয়া আক্তার, বেগম সাজেদা চৌধুরী প্রমুখ নারী মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখেন।

৫. তথ্য-আদান-প্রদানে করে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান
যেকোনাে যুদ্ধের সময় তথা আদান-প্রদান একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অনেক সাহসী নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেও । মুক্তিযুদ্ধের সময় গােপনে লিফলেট,পত্রিকা ইত্যাদি ছাপানাে এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌছানাে জরুরি ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিজীবীদের চিঠিপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌছে দেয়ার কাজে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নারী যৌনকর্মী রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিদের নিকট থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট সরবরাহ করতেন। যাতে নারীরা মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন রকম তথ্য আদান-প্রদানে সহযােগিতা করতেন।
৬.জনমত গঠনে নারীর অবদান
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে অনেক স্বাধীনতাকামী নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশি-বিদেশি নারী, লন্ডন প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয় নারী, মহিলাসমিতি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বিভিন্ন সভার আয়ােজন করে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র চুল ধরে জনমত গড়ে তােলে।
মিসেস নুরজাহান মুর্শেদ এম.এন.এ বাংলাদেশ পার্লামেন্টারী সদস্য হিসেবে বােম্বে,মাদ্রাজ, দিল্লীর, লক্ষৌ সফর করে সেসব স্থানে পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে মত বিনিময় করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি তাদের অবহিত করেন।
প্রত্যেকটি জায়গায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন এবং জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে জনমত গঠনকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছেন- মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ, বেগম রাফিয়া আক্তার, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, রেখা সাহা প্রমুখ ।
৭. অনুপ্রেরণা দানকারী হিসেবে নারী
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অনুপ্রেরণা ছিল মুক্তিকামী মানুষের বড় শক্তি। মুক্তিযুদ্ধে এদেশের বােন, মা, স্ত্রীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার তুলনা নেই। অনেক মা ছেলেকে স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন ।শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এই মহীয়সী নারী তার বড় ছেলে রুমীকে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ করেন।মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়ে রুমী সত্যিই দেশের জন্য উৎসর্গিত হয়েছিলেন। জাহানারা ইমামের মতাে অসংখ্য মা তাদের বুকের ধনকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন এবং অন্যদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছেন।
৮. প্রচার মাধ্যমে নারীর ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধা তথা সকল মুক্তিকামী জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতে, তাদের মনে বিজয়ের আশার আলাে জাগাতে বেতার মাধ্যম, পত্রিকা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।বেতারে দেশাত্মবােধক গান, নাটক, কবিতা ইত্যাদি অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো।
এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন দেশের জনপ্রিয় মহিলা সঙ্গীত শিল্পী, নাট্যকর্মী, সংবাদ পাঠিকাগণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন শিল্পী সংস্থা গঠিত হয় যারা শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়ােজন করেছেন। মহিলা শিল্পীরা এভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল চাঙ্গা করতে সহায়তা করেছেন ।

৯. কূটনৈতিক দায়িত্বে নারী
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলাদেশের নারী সমাজ ও দেশি-বিদেশী নারী সংগঠনের নেত্রীকর্মীরা এগিয়ে এসেছিলেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের সহযােগী সংগঠক হিসেবে যারা কাজ করেছেন। তাদের |মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হচ্ছেন, লুলু বিলকিস বানু। (বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটি, লন্ডন), শ্রীমতী পদ্মজা লাইডু, মুন্নী;রহমান, আমিনা পল্লী প্রমুখ।
ভারতীয় নারী ফেডারেশনের অরুনা আসাফ আলী, রেনু চক্রবর্তী, বিমলা ফারুকা, গীতা মুখার্জী, বীণা গুপ্তা, ইলামিত্র প্রমুখ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সভা-সেমিনারের আয়ােজন ও প্রচার কাজে নিয়ােজিত থেকে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করেন এবং কূটনৈতিক তৎপরতা চালান।

উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কোন একক প্রচেষ্টার ফসল ছিল না। তা ছিল নারী পুরুষ, শিশু, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি সাধারণ জনগণের যৌথ প্রচেষ্টার ফল। যেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারী সমাজও নিজ নিজ স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
নারীরা সম্মুখ যুদ্ধে সহযােগিতা করেছেন এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ, তথ্য আদান-প্রদান, সেবা প্রদান, জনমত গঠন, অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করা প্রভৃতি কর্মের মাধ্যমে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের অবদান অপরিসীম ও অসামান্য একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।
আরও পড়ুনঃ