মায়েদের সচেতন করতে ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
মায়েদের সচেতন করতে ভাষণ
‘গুঁড়ো দুধ নয়, মায়ের দুধ-ই শিশুদের জন্য শ্রেষ্ঠ’ শীর্ষক আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, আমন্ত্রিত আলোচকবৃন্দ ও সুধীবৃন্দ, আজকের এই সেমিনার আমাদের নাগরিক সচেতনতারই নিদর্শন। আজ সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু-চার কথা বলার জন্য আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। মা ! যে শব্দ এক স্বর্গীয় পুণ্যতায় হৃদয়-মনকে অমিয় সুধায় প্লাবিত করে। ত্রিভূবনের সবচেয়ে মধুরতম শব্দ মা। মা সবরকম স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে মমতার আধার হয়ে তার সহজাত মমত্ব ও সর্বংসহা হৃদয় দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখে। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, “মাতৃস্নেহই সকল মায়া মমতা ও ভালোবাসা এবং শেষ’।
শুরু তাই শিশুর জন্য গুঁড়ো দুধ নয়, মায়ের দুধ-ই যে শ্রেষ্ঠ তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না মায়ের দুধ। এই দুটি শব্দের মধ্যেই যেন লুকিয়ে রয়েছে বাচ্চার সুস্থ, সবল হয়ে বেড়ে ওঠার বীজমন্ত্র। তাই মায়ের দুধের সত্যিই কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই মায়ের মমতারও। নাড়ির বাঁধন ছিড়ে গিয়ে একেবারে অচেনা এই পৃথিবীতে পুরোপুরি একা হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই সদ্যোজাত মানবশিশুটিকে সঞ্জীবনী আশ্বাসের উষ্ণতা দিয়ে ঘিরে নেয় তো ওই মাতৃস্নেহই। মায়ের দুধের অমৃতস্বাদের মধ্যদিয়ে যা সঞ্চারিত হয়ে যায় শিশুর শিরায় শিরায়, প্রতিটি রক্ত বিন্দুতে।
মায়ের দুধ তখন নবজাতকের কাছে শুধুই খাদ্যপানীয় নয়, প্রথম অবলম্বন, নিরাপত্তার প্রথম নিশ্চয়তা, বিশ্বসংসারের সঙ্গে প্রথম যোগসূত্রও। দিনে দিনে শিশু যখন বাড়তে থাকে, মাতৃদুগ্ধ তাকে দিতে থাকে পর্যাপ্ত জীবনীশক্তি, দেয় বৃদ্ধি ও বিকাশ। সুধীবৃন্দ, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে, মায়ের দুধের পক্ষে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে ‘দি ওয়ার্ল্ড এ্যালায়েন্স ফর ব্রেষ্ট ফিটিং এ্যাকশন’ এই উদ্যোগে ১৯৯২ সাল থেকে ১-৭ আগস্ট পালিত হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। মায়ের দুধের বিকল্প নেই— এই বিষয়ে মা ও অভিভাবকদের সচেতন করার লক্ষেই এই সপ্তাহ পালন করার উদ্দেশ্য। ২০০১ সালে ৫৪তম বিশ্বস্বাস্থ্য সম্মেলনে শিশুদের জন্মের প্রথম ৬ মাস শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়।
২০০৩ সালে ৩১ মার্চ বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয়, ‘এদেশের শিশুরাও পূর্ণ ছয়মাস শুধু মায়ের দুধ পান করবে।” স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নিলেও বাংলাদেশে মাতৃদুগ্ধ পানের বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত লক্ষের অর্ধেকেও পৌঁছায় নি। আর তাই মায়ের দুধ শিশুর পক্ষে কেন জরুরি, কতটা জরুরি, আর শিশুকে স্তন্যদান মায়ের পক্ষেও কেনো প্রয়োজনীয় — এসব প্রশ্নের উত্তর জানতেই আজকের এ আয়োজন। সচেতন সুধীবৃন্দ, মনে রাখতে হবে যে, বাচ্চার পুষ্টির জন্য মায়ের দুধের মতো এত ভালো খাদ্য দ্বিতীয়টি আর নেই। যে তাপমাত্রায় মায়ের দুধ আসে তা-ই বাচ্চার উপযুক্ত। মায়ের দুধের মধ্যে দিয়ে বাচ্চার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
বিকোলাই-এর ইনফেকশন যদি নবজাতকের মধ্যে ঢোকে তা হলে বাচ্চার ম্যামেনজাইটিস পর্যন্ত হতে পারে, কিন্তু মায়ের দুধ খেলে বাচ্চার বিকোলাই হবে না, হলেও মারাত্মক কিছু হবে না। কেননা মায়ের দুধ থেকে সেই প্রতিরোধ ক্ষমতা শিশু পেয়ে যাবে। পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা মায়ের দুধ পান করে সেসব শিশুর ওজন সঠিক থাকে এবং সঠিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে বাচ্চাকে দুধ না খাওয়ালে মায়ের স্তন শক্ত হয়ে ব্যথা হয়। নানারকম কষ্ট দেখা দেয়। মায়ের দুধ শিশু স্তনবৃন্ত থেকে সরাসরি পান করলে পিটিউটারি গ্রন্থি থেকে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনের প্রভাবে জরায়ু আবার আগের স্থানে ফিরে আসে।
সুতরাং মায়ের সুস্থ শরীরের জন্যও বাচ্চাকে মায়ের দুধ দেয়া প্রয়োজন। সম্মানিত সুধীবৃন্দ, কোনো অবস্থাতেই, মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই— এ কথা চিরন্তন। অনেক সময় শোনা যায় যে, মায়ের দুধ বাচ্চার সহ্য হচ্ছে না। এ কথা একেবারেই ভুল। মায়ের দুধ যে কোনো অবস্থাতেই শিশুর পক্ষে আদর্শ, উপকারী। অনেক সময় গরু বা ছাগলের দুধ কিংবা গুঁড়া দুধ মায়ের দুধের পরিবর্তে খাওয়ানো হয়। খেয়াল করে দেখবেন এসব দুধের সঙ্গে পানি মেশানো হয়। পানি মিশিয়ে ওই দুধ মায়ের দুধের মতো করা হয়। আসলে মায়ের দুধে প্রোটিনের পরিমাণ গরুর দুধের চেয়ে কম থাকে।
শিশুর জন্য এই কম প্রোটিনযুক্ত দুধই প্রয়োজন। শিশুর জন্মের পর প্রথম তিনদিন দুধ হয় না। সেই সময় একটা ঘন হলুদ জাতীয় পদার্থ হয়। যাকে বলে প্রি-মিল্ক বা কলোস্ট্রাম। কলোস্ট্রামে থাকে রোগ প্রতিরোধক উপাদান। যা বাচ্চার জন্য খুব প্রয়োজন। অন্যদিকে বাচ্চাকে প্রথম তিনদিন সরাসরি স্তন্যপান না করালে চতুর্থ দিন থেকে দুধের যোগান ভালো হয় না। এই সব কারণেই শিশুকে জন্মের পর থেকেই মায়ের কাছে দিতে হবে এবং স্তন্যপান করতে দেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
বাচ্চার জন্মের পর দশদিনে ওজন কমে যায়— এজন্য ভয় পাবেন না। এটাই স্বাভাবিক। কেন না বাচ্চার শরীরের বাড়তি ফ্লুয়িড বেরিয়ে যাওয়ায় ওজন কমে। এখন প্রশ্ন ওঠতে পারে— বাচ্চা কী খাবে প্রথম দু-তিনদিন? উত্তর হল কলোস্ট্রাম খেলে বাচ্চাকে আর কিছুই খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। সুধীবৃন্দ, আজকাল বাজারে যেসব গুঁড়া দুধ পাওয়া যায় তাতে বিষাক্ত রাসায়নিক মেলামাইন ধরা পড়েছে— তা গুঁড় আপনাদের সবারই জানা।
এসব দুধ খেয়ে অনেক নিষ্পাপ শিশুই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। তাছাড়া গুঁড়া দুধ যে নির্ভেজাল, বাহিরের রোগ জীবাণু নেই তা আপনি বুঝবেন কীভাবে? তাই আবারও বলছি, মায়ের দুধ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ। বুকের দুধ পান করানোর মাধ্যমে মা এবং সন্তানের মধ্যে গভীর স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়েদের বুকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং শিশুর মুখের নিম্নাংশের ধ্বনি ভালো হয়। মায়ের দুধ পান করা শিশুর মধ্যে সারাবিশ্বে প্রতিবছর ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় মৃত্যুবরণকারী ১৫ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা পায় ।

এজন্য প্রতিটা মাকে বলছি চেষ্টা করুন, আপনার আদরের ছোট শিশুটাকে বুকের দুধ খাওয়ান। মায়ের হাসিকে চাঁদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, সবশেষে সেই মায়ের হাসির জন্য একটা সুসংবাদ দিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে যে যে-সব মায়েরা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান সে-দুধ শিশুকে ক্যান্সার, বিকলাঙ্গ-এর মতো মারাত্মক ৬টি রোগ থেকে রক্ষা করবে। সবাইকে ধন্যবাদ ।
আরও দেখুন: