মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব রচনার একটা নমুনা তৈরি করি আজ। এই রচনাটি আমাদের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।
Table of Contents
মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব
ভূমিকা :
পরিবেশ শব্দের তাৎপর্য খুবই গভীর ও ব্যাপক। মানুষকে পরিপূর্ণরূপে যা বিকশিত করে, যা তার জীবন-চেতনার সার্বিক অভিব্যক্তির পথ নির্দেশক, তার অদৃশ্য চালিকাশক্তি, তাই তার পরিবেশ। পরিবেশই চরিত্র গঠনের গোপন মন্ত্র, ব্যক্তিত্ব বিকাশের চাবিকাঠি। পরিবেশই জননীর মতো অবোধ অসহায় সন্তানকে আদরে-যত্নে, স্নেহে-সোহাগে, প্রীতি-ভালোবাসায় বিকশিত করে তোলে।
মানুষ প্রকৃতির সন্তান। শিশু মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে এক অজানা-অচেনা পরিবেশে আগমন করে। ক্রমান্বয়ে এ অজানা পরিবেশে পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনসহ বিশাল পরিমণ্ডলকে সে আপন করে নেয়। সার্বিক পরিবেশের প্রভাবে গড়ে ওঠে তার জীবন; পারিবারিক ও সামাজিক আদর্শে আদর্শায়িত হয়ে গড়ে ওঠে স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ জীবনধারা। এ প্রকৃতি ও পরিবেশের গণ্ডির বাইরে তার জীবনের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। কেননা পরিবেশই তাকে দেয় মনুষ্যত্বের দীক্ষা। তাকে দেয় সহনশীলতার শক্তি, গ্রহণ-বর্জন সামঞ্জষ্যের অসীম ক্ষমতা।
পরিবেশ :
‘পরিবেশ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিধি, পরিবেষ্টন মণ্ডল, চতুষ্পার্শ্বস্থ অবস্থা। এক কথায় আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, সব মিলিয়েই পরিবেশ। মানুষের পরিবেশ মূলত দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্তু বা উপাদানের এক সমন্বিত রূপ যা তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ পরিবেশই পরিপূর্ণভাবে মানুষকে বিকশিত করে, জীবনচেতনার সার্বিক অভিব্যক্তির দিক-নির্দেশনা দেয়। এ পরিবেশই তার অদৃশ্য চালিকাশক্তি।
পরিবেশ ও মানবসভ্যতা :
পরিবেশের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে আছে মানবজাতির অস্তিত্ব। মানুষ পর্বতের গুহা ও জঙ্গলের আবাসস্থল থেকে বেরিয়ে এসে পরিবেশের ক্রমাগত ধারার সাথে সুন্দরভাবে তাল মিলিয়ে সভ্যতার পাহাড় গড়েছে। এ পরিবেশই তাকে উন্নত জীবনবোধে উজ্জীবিত করেছে। সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বোচ্চ স্তরে তাকে উপনীত করেছে।
পরিবেশের ধরন :
পরিবেশ মানুষকে প্রভাবিত করে। এরই আদর্শে মানুষ গড়ে ওঠে। কখনো পিতামাতা, ভাইবোন, কখনো খেলার সাথী, কখনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, আবার কখনো শিক্ষক- ছাত্র বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মানুষ বিচরণ করে। পরিবেশের বেশ কয়েকটি দিক তুলে ধরা যায়। যথা- ক. ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক পরিবেশ, খ. পারিবারিক পরিবেশ, গ. প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ, ঘ. সামাজিক পরিবেশ, ও রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি।
মানবজীবন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ :
প্রকৃতির সাথে মানব জীবনের নিবিড় সম্পর্ক। মানুষের চারপাশে ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির অবাধ উন্মুক্ত লীলানিকেতন। উদার অনন্ত আকাশ তাকে দেয় মুক্তির আনন্দ।
নদ-নদী ও সাগরের কলতানে সে শোনে জীবনের গান। অরণ্য-পর্বতে সে খোঁজে বিজয়ী প্রাণের স্পর্শ। তাকে ঘিরে আছে শ্যামল সবুজের সমারোহ। প্রকৃতিই তাকে দেয় মহৎ উপলব্ধির আশ্বাস, দেয় জীবনে মুক্তির আশ্বাস। প্রকৃতিই নিয়তির মতো জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করার অর্থই মহৎ উত্তরাধিকার থেকে নির্বাসন। প্রকৃতি মানুষকে করে উদার ও মহৎ। তার মধ্যে ঘটায় মনুষ্যত্বের জাগরণ। মানুষকে করে অমৃতের সন্তান। এ জন্যই মনীষী কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ‘তরুদ্গতায় শাখাপল্লবিত নাট্যশালায় ছয় অঙ্কে ছয় ঋতুর নানা রসবিচিত্র গীতিনাট্যাভিনয় তাদের সম্মুখে ঘটিয়ে দাও।’ এই ঋতুবৈচিত্র্য মানুষকে করে তোলে সজীব ও প্রফুল্ল।
মানবজীবন ও পারিবারিক পরিবেশ:
পরিবার মানবজীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। জন্মের পরেই শিশু প্রথম বিচরণ করে এ পরিমণ্ডলে। পরিবার তাকে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারায় গড়ে তোলে। মানুষের সামাজিকীকরণের প্রাথমিক ধাপটি সম্পন্ন হয় পরিবারেই। পিতামাতা, ভাইবোন ও নিকটতম আত্মীয়দের সাথে তার সৃষ্টি হয় গভীর মিতালী। তাদের মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, শিক্ষা-দীক্ষা সবই শিশুর মনকে গভীরভাবে আন্দোলিত করে। পরিবার যদি তাকে শেখায় ‘Father’ তবে সে তা-ই শেখে, যদি বলে ‘আব্বা’ তবে তা-ই শেখে, যদি শেখায় ‘বাবা’ তবে সে তা- কথাবার্তা, চাল-চলন, ই শেখে। একইভাবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা, আদর্শ- নৈতিকতা, বুদ্ধি-বিবেক সবই পারিবারিক ধারায় গড়ে ওঠে। পরিবারের পরিবেশ সংহত ও সুস্থ হলে মানুষ নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারে সুন্দর রূপে। আর পারিবারিক সম্পর্ক ভঙ্গুর হলে মানুষের জীবনও হয়ে পড়ে বিপথগামী।

শিক্ষামূলক পরিবেশের প্রভাব :
পরিবারের গণ্ডি থেকে সামান্য দূরে গিয়ে মানব-শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে মিলিত হয়। এ বিশাল পরিমণ্ডল তাকে গড়ে তোলে তারই ইচ্ছামতো। ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার এ ক্ষেত্র বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতায় ভরপুর। বিভিন্ন পারিবারিক পরিমণ্ডলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী একই প্রতিষ্ঠানে ভিড় করে। তাদের পারস্পরিক আচার-আচরণ, কথাবার্তা, আদর্শ-নৈতিকতা সবই শিশুর জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে । শিক্ষকদের দিক-নির্দেশনা, জ্ঞান, যোগ্যতা, মেধা ও শাসনের গণ্ডিতে শিক্ষার্থীরা আদর্শিক ধারায় উন্নত জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দেহ ও মনের সুষম বিকাশে অনুকূল একটি পরিবেশ উপহার দিতে সর্বদাই সচেষ্ট থাকে ।
সামাজিক পরিবেশের প্রভাব:
মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক অনুশাসন ও সমাজের গণ্ডির ভিতরে সে লালিত-পালিত হয়। সামাজিক আচার-আচরণ, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও আদর্শের ছাঁচে ব্যক্তিজীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সামাজিক পরিবেশের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ সামাজিক পরিবেশ মনুষ্যত্ব বিকাশের অনিবার্য দাবি। সামাজিক পরিবেশ যদি অসুস্থ, নোংরা ও কলুষিত হয়, তাহলে মানবতার জন্য তা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে।
সামাজিক অনাচারে-ব্যভিচারে, উচ্ছৃঙ্খলতায়, উন্মত্ততায়, সমাজবিরোধী কার্যকলাপে, অপসংস্কৃতির রাহুগ্রাসে সুস্থ জীবন বিকাশের সুযোগ তিরোহিত হয়। সামাজিক পরিবেশ বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের আকর। এ পরিবেশে এসে বিত্তশালীরা যেমন হয়ে ওঠে অমিতচারী, বিলাসী, কর্তৃত্বলোভী, অলস ও পরমুখাপেক্ষী, পাশাপাশি দরিদ্ররা হয় বেপরোয়া এবং ভবিষ্যৎ শূন্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণী হয় অনেকটা ভীরু, বাকস কপটাচারী। সামাজিক পরিবেশ যেমন সুন্দর ও আদর্শ মানুষ গড়ে তোলে, তেমনি এ পরিবেশের পঙ্কিলতা মানবজীবনকে করে দূষিত ও পঙ্কিলময়।
রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব :
যে কোনো দেশ, জাতি ও সমাজের ওপর রাজনৈতিক পরিস্থিতিও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আধুনিক বিশ্ব রাজনৈতিক পরিবেশ মানবীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিকে বিপুলভাবে পরিবর্তিত ও আন্দোলিত করছে।
তাই বলা হয়ে থাকে, in the modem world the culture of a nation directed by political power. রাজনৈতিক শক্তিতে যারা এগিয়ে থাকে, তারাই আজ যে কোনো দেশ ও জাতির শাসক হয়। তা গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক বা অন্য যে কোনো পন্থায়ই হোক না কেন। দুর্নীতিপরায়ণ, স্বৈরতান্ত্রিক ও সামরিক শাসকদের অধীনে যে অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয় তা সামগ্রিকভাবে সুস্থ জীবন বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক শক্তির আদর্শ অনুসারে যে কোনো দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়, যা মানবজীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে।
উপসংহার :
পরিবেশই মানুষের জীবনে আনে সুস্থতার অঙ্গীকার। পরিবেশই তার জীবনকে ভরিয়ে দেয় সফলতার অঙ্গীকারে আবার পরিবেশ থেকে পায় অভিশাপ। অসুস্থ পরিবেশ জীবনকে প্রতি পদে করে আদর্শবিমুখ ও চরিত্রভ্রষ্ঠ। নৈতিক অধঃপতনে সে জীবন হয় পঙ্কিল। ক্ষুদ্র দলাদলি, ব্যক্তি হিংসা-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা, রাজনৈতিক ধূর্ততা গ্রাস করে ব্যক্তি, জাতি ও দেশকে। স্বাভাবিক জীবন বিকাশের পথ হয় অবগুন্ঠিত। জাতি হয় পরনির্ভর ও আত্মশক্তিহীন। আবার পরিবেশের মধ্যে রয়েছে সেই অমিত শক্তি, যা মানুষকে দেয় অমৃত্বের সন্ধান দেয় মহৎ জীবনের অধিকার। কাজেই দেশ ও জাতির শাশ্বত কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক পরিবেশের সুস্থ বিকাশ অপরিহার্য।