ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ভাগ্যের পরিহাস

ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ভাগ্যের পরিহাস - ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ভাগ্যের পরিহাস

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেভাবে শাসন করি সেটা পাল্টে ফেলবো। আমি যেমনটা আশা করি রাজ দরবার মোটেই সেরকম নয়।

হুমায়ুনের সোনার গিল্টি শোভিত সিংহাসনের সামনে অর্ধবৃত্তাকারে আসন-পিঁড়ি হয়ে উপবিষ্ট উপদেষ্টারা, চোখে বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাই দেখে বাইসানগার আর কাশিম, তাঁর প্রতি পুনরায় মনোযোগী হবার পূর্বে, পরস্পরের দিকে বিমূঢ় ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। যাই হোক না কেন তারা অচিরেই চমকপ্রদ ধারণাগুলো বুঝতে পারবে যা তার আফিম-ক্রিয়ায় স্বপ্নে সে লাভ করেছে যখন, শাসনকার্যের প্রাত্যহিক দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত, তাঁর ভাবনাগুলো তখন যেন স্ফটিক স্বচ্ছতায় প্রবাহিত হয়। সে স্বপ্নে যা কিছু দেখেছে- সবই যেন গ্রহ, নক্ষত্রের গতিপথে লিপিবদ্ধ রয়েছে…

হুমায়ুন তার ডান হাত উত্তোলিত করে এবং তাঁর ব্যক্তিগত জ্যোতিষী সারাফ, কৃশকায়, বয়স্ক আর পাখির চঞ্চুর ন্যায় নাকের অধিকারী একটা লোক যার পরনে বাদামী রঙের বাদামী বর্ণের একটা ঢাউস আলখাল্লা, চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা ভারী ঢাউস খণ্ড শিরাবহুল চওড়া হাতে ধরে সামনে এগিয়ে আসে। ঘোঁতঘোঁত শব্দে স্বস্তি প্রকাশ করে, গ্রহমণ্ডলীর প্রতিকৃতি খচিত সাদা মার্বেলের টেবিলে ঢাউস খণ্ডটা সে নামিয়ে রাখে, হুমায়ুন তাঁর সোনার গিল্টি শোভিত সিংহাসনের যা যা স্থাপন করতে বলেছে।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং পাতা উল্টাতে থাকে যতক্ষণ না সে যা খুঁজছিলো সেটা খুঁজে পায়। সেখানে তাঁর পূর্বপুরুষ, মহান জ্যোতিষবিদ উলুঘ বেগের হাতে তৈমূরের পৌত্র- একটা ছক যেখানে মহাকাশে গ্রহমণ্ডলী আর নক্ষত্রের গতিপথ অঙ্কিত রয়েছে। জটিল এই নক্সাটার দিকে যখন তাকিয়ে থাকে সে, তখন দিব্য অনুষঙ্গগুলো যেন নড়তে আরম্ভ করে রাষ্ট্রীয় সফরের আঙ্গিকে, প্রথমে ধীরে কিন্তু যখন গতিবেগ সঞ্চিত হয় তখন যেন একে অন্যকে ধাওয়া করতে থাকে। সে চোখের পলক ফেলে এবং ভালো করে তাকায়, দেখে পাতাটা স্থির হয়ে রয়েছে…এটা নিশ্চয়ই গতরাতে সেবন করা আফিমের প্রতিক্রিয়া। গুলরুখের দ্বারা কেবলই তাঁর জন্য বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে প্রস্তুতকৃত মিশ্রণটা এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে, যা তার আবাসকক্ষে মেহমেদ পৌঁছে দিয়েছে নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো জোরাল উপাদান তাতে ছিল। সূর্য দিগন্তের উপরে এক বর্শা পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করবার পরেই কেবল তার ঘুম ভাঙে এবং এমন একটা দিনে যেদিন সে তার অর্ন্তদৃষ্টি প্রকাশ করবে, তাঁকে সকাল সকাল ঘুম থেকে না উঠাবার জন্য সে জওহরকে ভর্ৎসনা করে।

হুমায়ুন সহসা সচেতন হয়ে উঠে, টের পায় তার উপদেষ্টারা তাঁর দিকে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে তারাও এখানে উপস্থিত আছে। সে নিজেকে সোজা করে দাঁড় করায়। তোমরা জান আমি গ্রহ আর নক্ষত্রের শেষ না হওয়া আবর্তন পর্যবেক্ষন করেছি, যেমনটা করেছিলেন আমার পূর্বপুরুষ। উলুঘ বেগ। অনেক ভাবনা চিন্তার পরে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে তার গবেষণাকে আমরা অতিক্রম করে যেতে পারি এবং সেই তারকারাজির ছক আর সারণি এবং বহু পূর্বে সংঘঠিত ঘটনাবলীর নথী যখন বিজ্ঞ জ্যোতিষীর সহায়তায় এবং কোনো মানুষের শুদ্ধ ভাবনার আপন ক্ষমতার দ্বারা বিবক্ষিত হয়, সেটা থেকে জীবনযাপন প্রণালীর এমনকি শাসনকার্যের একটা কাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব।

তার উপদেষ্টাদের অভিব্যক্তির দ্বারা হুমায়ুন বুঝতে পারে সে কি বিষয়ে কথা বলছে সে সম্বন্ধে এখনও তাদের কোনো ধারণা নেই। কিন্তু তাঁরা তাহলে কিভাবে এটা পারবে? সে যা অবলোকন করেছে তারা সেসব কিছুই দেখেনি যখন গুলরুখের উপাচারের কল্যাণে মুক্তি লাভ করে। তারা কল্পনাও করতে পারবে না সে মানসপটে এমনসব কল্পলোকে সে ভ্রমণ করে এসেছে। কিন্তু সে তার শাসনপদ্ধতিতে যে ব্যাপক উন্নতিসাধনের পরিকল্পনা করেছে তারা সে বিষয়ে অচিরেই জানতে পারবে।

আমি অনুধাবন করতে পেরেছি যে আমরা গ্রহমণ্ডলী আর নক্ষত্র থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার অধীনে তারা আমাদের পরিচালনা করে, কিন্তু একজন ভালো শিক্ষকের ন্যায় আমাদের অনেক কিছু শেখাতেও পারে। আগামীতে আমি কেবল সেদিনের জন্য আদিষ্ট নক্ষত্র যেসব বিষয়কে মঙ্গলময় বলে বিবেচনা করবে কেবল সুনির্দিষ্ট সেসব বিষয় আমি বিবেচনা করবো… এবং সে অনুযায়ী মানানসই পোষাক পরিধান করবো। নক্ষত্ররাজি আমাদের বলছে যে আজকের দিনটাকে, মানে রবিবারকে পরিচালনা করছে সূর্য যাঁর সোনালী রশ্মি সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। সেজন্য এখন থেকে রবিবার, উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের কাপড়ে সজ্জিত হয়ে আমি রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের বিহিত করবো। সোমবার-চন্দ্র এবং প্রশান্তির জন্য নির্দিষ্ট দিন- সেদিন অবসর সময় কাটাব এবং সবুজ রঙের পোষাক পরিধান করবো যা প্রশান্ত অভিব্যক্তির রঙ। মঙ্গলবার এই দিনটা সৈন্যদের পৃষ্টপোষক, মঙ্গলগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট- সেদিন যুদ্ধ আর ন্যায়বিচারের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদির নিষ্পত্তিতে নিজেকে নিয়োজিত রাখবো। সেদিন আমি মঙ্গলের জন্য নির্দিষ্ট লাল পোষাক পরিধান করবো, প্রতিশোধ আর ক্রোধের রঙ এবং বজ্রপাতের দ্রুততায় একই সাথে শাস্তি আর পুরষ্কার বন্টনে পারদর্শী। পুরস্কৃত করার জন্য কোষাগারের সম্পদ প্রস্তুত রাখা হবে এমন কারো জন্য যাকে উপযুক্ত মনে করবো, একই সাথে রক্ত লাল পাগড়ি মাথায় প্রহরীর দল কুঠার হাতে বর্ম পরিহিত অবস্থায় আমার সিংহাসনের সামনে প্রস্তুত থাকবে সাথে সাথে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে…

শনিবার- শনি গ্রহের জন্য আদিষ্ট দিন- এবং বৃহস্পতিবার বৃহস্পতি গ্রহের দিন-শিক্ষা আর ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি দিনটাকে উৎসর্গ করতে এবং বুধবার- বুধ গ্রহের দিনটা হবে আনন্দোচ্ছল যখন আমরা বেগুনী রঙের পোষাক পরিধানের ব্যাপারটা আসলে ঠিক কি? যেকোনো পুরুষ আর মহিলা ওয়ার্নার ব্রাদার্সের কাছে উপস্থিত হলে, তার বোনের পরণে আজকে বেগুনী বর্ণের পোক। এবং শুক্রবার নীল পোষাকে সজ্জিত হবো, অনেকটা সবকিছুকে আকর্ষণকারী নীল আকাশের মতো, এদিন আমি যেকোনো বিষয়ের বিহিত করতে পারি। যেকোনো নারী কিংবা পুরুষ- তারা কতটা দরিদ্র কিংবা বিনয়ী সেটা বিবেচ্য না আমার কাছে আসতেই পারে…তাদের যা করতে হবে সেটা হল ন্যায়বিচারের দামামাটাকে তাঁদের পরাস্ত করতে হবে আমি সেটাকে দরবার কক্ষের বাইরে স্থাপণের আদেশ দিয়েছি।

হুমায়ুন আরো একবার কথা বন্ধ রাখে। কাশিমকে, যে তাঁর খতিয়ান বইয়ে হুমায়ুনের ঘোষণা লিপিবদ্ধ করছিলো, দেখে মনে হয় সে যেন বাক্যের মাঝখানে থমকে গিয়েছে আর বাইসানগার তার বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে বহু বছর আগে তার কর্তিত ডান হাতের জায়গায় স্থাপিত ধাতব আকর্ষী টানছে। অবশিষ্ট উপদেষ্টারা তার ঘোষণা শুনে চোখেমুখে বিস্ময় এঁকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু তারা একটা সময় তার অন্তৰ্জনকে ঠিকই গ্রহণ করবে। নক্ষত্ররাজি আর গ্রহমণ্ডলীর যান্ত্রিক গতিবিধির মাঝে সবকিছু যথাযথভাবে তাঁদের আদিষ্ট স্থানে রয়েছে। এবং একটা বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা ঠিক এমনই হওয়া উচিত। সবকিছু যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে এবং যথাযথ সময়ে…

দুই কি এক মিনিট বিরতির পরে হুমায়ুন ধীরে ধীরে বলতে থাকে, তার কণ্ঠস্বর স্পষ্ট আর আনুষ্ঠানিক। আমি আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমার সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আমি পুনর্গঠিত করবো চারটা প্রধান উপাদানের কোনটা- অগ্নি, বায়ু, জল এবং মৃত্তিকা- তাঁদের উপরে আধিপত্য করে। আমার সেনাবাহিনীর জন্য জবাবদিহি করবে অগ্নির আধিপত্য বিশিষ্ট দপ্তর। বায়ুর আধিপত্যযুক্ত দপ্তর জবাবদিহি করবে রন্ধনশালা, অশ্বশালা আর পোশাকভাণ্ডারের। জলের আধিপত্যবিশিষ্ট দপ্তর আমার সাম্রাজ্যের সব নদী আর জলাশয়ের সবকিছুর জন্য জবাবদিহি করবে, সেচের ব্যবস্থা আর রাজকীয় মদ্য-ভাণ্ডারের দায়িত্ব এই দপ্তরের উপরে অর্পিত হবে। আর মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যযুক্ত দপ্তর কৃষিকাজ আর ভূমি প্রদান বা মঞ্জুরির দায়িত্ব পালন করবে। আর সব সিদ্ধান্ত, কর্মোদ্যোগ রাশিফলের গণনার নির্দেশনার সাথে সঙ্গতি রেখে গৃহীত হবে কেবল একটা বিষয় নিশ্চিত করতে যে সবচেয়ে মাঙ্গলিক উপায় অনুসৃত হয়েছে…।

আর তোমরা আমার উপদেষ্টা আর অমাত্যবৃন্দ-এই নতুন কাঠামোর ভিতরে তোমাদের সবার সুনির্দিষ্ট স্থান থাকবে। রাশিফল পর্যালোচনা করলে আমরা জানতে পারি যে মানুষকে সাধারণত তিনটা শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। আমার অভিজাত ব্যক্তি, আধিকারিক আর সেনাপতি, তোমরা সবাই সরকারের মন্ত্রীবর্গ। কিন্তু সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি আর কল্যাণের জন্য অন্য শ্রেণী দুটো গুরুত্বপূর্ণ- মহানুভব মানুষের কাফেলা, যাদের ভিতরে রয়েছে আমাদের ধর্মীয় নেতা, দার্শনিক, জ্যোতিষী আর বিনোদনের কর্তাব্যক্তিরা যাদের ভিতরে আছে কবি, গায়ক, জাদুকর, চারু আর কারুশিল্পী- যারা আমাদের জীবনকে সুন্দর আর সমৃদ্ধ করে ঠিক যেমন করে তারকারাজি আকাশকে সাজিয়ে তুলে। এই তিনটা শ্রেণীর প্রতিটাকে বারোটা স্তরে বিভক্ত করা হবে আর প্রতিটা স্তরে আবার তিনটা করে পদমর্যাদা থাকবে- উচ্চ, মধ্য আর নিম্ন। আমি যথা সময়ে তোমাদের সবাইকে জানিয়ে দেব কোনো শ্ৰেণী আর পদমর্যাদা তোমাদের জন্য ধার্য করেছি…তোমরা এবার যেতে পার। আমার এখনও অনেককিছু চিন্তা করা বাকি।

শারাফ ব্যতীত নিজের দর্শনাথী কক্ষ থেকে যখন সবাই বিদায় নেয় তখন হুমায়ুন পুনরায় উলুঘ বেগের নক্ষত্রের সারণি পরীক্ষা করে, সময়ের সব বোধ তাঁর লুপ্ত হয়। প্রথম ঘন্টা শেষ হতে পরবর্তী ঘন্টা তার ক্ষণ গণনা শুরু করে। সূর্য অস্ত যেতে শুরু করলে, আগ্রা দূর্গের দিকে বেগুনী ছায়া গুটিসুটি পায়ে এগিয়ে আসতে থাকলে, তখনি কেবল হুমায়ুন সারণির পাতা থেকে মুখ তুলে তাকায়। সে যখন তার আবাসনকক্ষের দিকে ফিরে আসছে তখন আফিমের নির্যাস সিক্ত সেই ঘন সুরার জন্য তার ভিতরে একটা আকুল আকাঙ্খার জন্ম হয় যা তাঁর আত্মাকে বন্ধনমুক্ত করে তাঁর মাঝে পুনরায় উত্থিত করে এবং নিজের অজান্তেই তাঁর হাঁটার গতি দ্রুত হয়ে উঠে।

*

 

ভাগ্যের পরিহাস - ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

কাশিম, আমি বুঝতেই পারিনি এত সময় অতিবাহিত হয়েছে, হুমায়ুন নিজের চোখ কচলায় এবং যেখানে ছিল সেখান থেকে সটান উঠে দাঁড়ায় আর সেখান থেকে বেগুনী-রেশমী কাপড়ে-আবৃত ডিভানে সে তাসের ঘরের মতো ভেঙেচুরে শুয়ে পড়ে। ডিভানটায় একটা পরস্পরচ্ছেদী নক্ষত্ররাজির জটিল নক্সা সোনার জরি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং হুমায়ুন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এটার উপরে শুয়ে অনেক গভীরভাবে চিন্তা করতে পারে। পরিষদমণ্ডলী কি এখনও সমবেত রয়েছে? বাংলায় আমার মনোনীত রাজ্যপালের কাছ থেকে আগত প্রতিনিধির কি সংবাদ?

অনেকক্ষণ আগেই পরিষদমণ্ডলীর সভা শেষ হয়েছে। আর আপনার প্রতিনিধির খবর বলতে ইতিমধ্যে বহুবার তার সাথে সাক্ষাঙ্কার বাতিল করেছেন কারণ আপনি মনে করেন এ ধরনের আলোচনার জন্য বর্তমান সময়টা ঠিক উপযুক্ত না এবং একবার- সুলতান, এটা উল্লেখ করার জন্য আমায় মার্জনা করবেন- যখন আপনার উপস্থিতিতে দর্শনার্থী কক্ষে ভুল দরজা দিয়ে প্রবেশ করায় নিজের উপস্থিতিতে দর্শনার্থী কক্ষ থেকে তাঁকে বিবাসিত করেছিলেন, সেই দিনটাও এমন প্রকৃতির আলোচনার জন্য খুব একটা মঙ্গলময় নয় বলে আপনার ধারণা। গঙ্গা আর যমুনার বুক চিরে বাংলায় যাবার সময়টা ক্রমেই সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে এবং আরও অপেক্ষা করাটা তার জন্য ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। বাইসানগার আর আমি তাই আপনার পক্ষ অবলম্বনপূর্বক নির্দেশনা প্রদানের গুরু দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে কর আরোপের মাত্রা এবং সৈন্য সংখ্যা কতটা বৃদ্ধি করতে হবে সেটা নির্ধারন করেছি। নিজের নৌকায় আরোহন করে সে ফিরতি পথে রওয়ানা হতে দুই ঘন্টা আগে তারা নোঙর তুলেছে।

এই দুই বৃদ্ধ তাঁর কর্তৃত্বের মাঝে অন্যায়ভাবে নাক গলিয়েছে ধরে নিয়ে হুমায়ুন ক্ষনিকের জন্য ক্রুদ্ধ হয়।

সুলতান, আমরা যা বলেছি আপনি যদি তার সাথে ভিন্ন মতো পোষন করেন তাহলে অবশ্যই তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আরেকটা দ্রুতগামী নৌকা পাঠাতে পারি।

কাশিম নিশ্চিতভাবেই তাঁর বিরক্তি আঁচ করতে পেরেছে, হুমায়ুন ভাবে। তারই অন্যায় হয়েছে। বার্তাবহ কূটনীতিক লোকটা একাধারে বাঁচাল এবং সেই সাথে বিরক্তিকর। সে ইচ্ছাকৃতভাবেই লোকটার সাথে দেখা করতে দেরী করেছে, কখনও এমনসব অজুহাত দেখিয়েছে যা তার নিজের কাছেই অনেকসময় অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হত। হুমায়ুন তাঁর কণ্ঠস্বরের তীব্রতা হ্রাস করে। কাশিম, আমি নিশ্চিত যে আগামীকাল সকালে আমি যখন শুনবো আপনি আর বাইসানগার কি উপদেশ দিয়েছেন সেটা আমার পছন্দই হবে। এখন আপনি যান, আমি আরেকটু বিশ্রাম আর নিরুদ্বিগ্নভাবে সময় কাটাতে চাই।

কাশিমকে দেখে মনে হয় সে আরও কিছু বলতে চায়, সে দাঁড়িয়ে থেকে কেবল দুই পায়ের উপরে দেহের ভার পরিবর্তন করে আর বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে নিজের আলখাল্লার একটা সোনালী টাসেল নিয়ে আপনমনে নাড়াচাড়া করে। তারপরে সে নিজের মন ঠিক করে এবং যা বলতে চেয়েছিল সেটা বলতে শুরু করে। সুলতান, আপনি বোধহয় অবগত আছেন যে আপনার মরহুম আব্বাজান আর আপনার অধীনে কত দীর্ঘ সময় আমি বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্বপালন করছি।

হ্যাঁ, আর আমি সেটার প্রশংসাও করি।

আমি কি তাহলে আমার এতো বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আপনাকে সামান্য কিছু পরামর্শ দিতে পারি? সুলতান মার্জনা করবেন কিন্তু আমি না বলে পারছি না, আপনি আফিমে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। আপনার আব্বাজানও সুরা আর ভাঙ- গাঁজার মতোই আফিমটাও উপভোগ করতেন।

তবে?

আমাদের ভিতরে অনেকেই এসব নেশাজাতীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশী সহজাত সহ্যক্ষমতার অধিকারী হয়। এমনকি আমার যখন বয়স অল্প ছিল, ভাঙের কারণে কখনও এমনও হয়েছে যে পরপর বেশ কয়েকদিন আমি সব কাজ ফেলে নির্জীবের মতো পড়ে রয়েছি তাই আপনার আব্বাজানের শত অনুরোধ সত্ত্বেও এধরনের উপাচার গ্রহণ করা থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিরত রাখি। মহামান্য সুলতান আপনি যতটা অনুমান করছেন এগুলো সম্ভবত তারচেয়েও বেশী আপনাকে প্রভাবিত করছে।

না, কাশিম। তাঁরা আমাকে চিন্তা করতে আর দেহমনকে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। আপনি কি আমাকে এটাই বলতে চেয়েছিলেন?

হ্যাঁ, কিন্তু অনুগ্রহ করে কেবল একটা কথা মনে রাখবেন যে এমনকি আপনার আব্বাজানও প্রতিদিন এই জিনিষটাকে প্রশ্রয় দিতেন না, বিশেষ করে যখন তাঁকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। কাশিম মাথা নত করে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালে, হুমায়ুন তাঁর বলিরেখা পূর্ণ মুখমণ্ডলে গভীর দুশ্চিন্তার একটা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তার উৎকণ্ঠায় কোনো খাদ নেই। আত্মবিলোপী, স্বল্পভাষী এই বৃদ্ধ লোকটাকে এই অল্প কয়টা কথা বলতে গিয়ে প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছে। হুমায়ুন তার উপরে রাগ করতে পারে না।

আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনার কথাগুলো আমি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবো।

*

হুমায়ুনের সিংহাসনের সামনে পরিচরেরা আকাশের মতো দেখতে রেশমী নীল রঙের একটা বিশালাকৃতি বৃত্তাকার কার্পেট বিছান শুরু করতে সে চোখেমুখে সন্তুষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কার্পেটের জমিনে অনেকগুলো বৃত্তের একটা পর্যায়ক্রমের রূপরেখা- লাল, হলুদ, বেগুনী আর সবুজ রঙের শিকল ফোড়ের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং গ্রহমণ্ডলী উপস্থাপনকারী বৃত্তগুলো- সে যেভাবে আদেশ দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই স্থাপন করা হয়েছে। তাঁতিদের সে পুরস্কৃত করবে তাঁদের এই অসামান্য দক্ষতা এবং যত দ্রুত তারা তার এই পরিষদমণ্ডলীর কার্পেটকে বাস্তবতা দান করেছে।

কয়েকমাস আগে বিশেষভাবে প্রাণবন্ত একটা স্বপ্নবেশের সময় সে প্রথম ধারণাটা লাভ করে- গুলরুখের আফিম আর সুরার মিশ্রণ পান করার পরে বাস্তবিকই তাঁর মাদকজনিত ঘুম প্রতিবারই যেন আরও বেশী চমকপ্রদ আর গুপ্ত তথ্যের বিস্ময়কর প্রকাশ হয়ে উঠছে। তারকাণ্ডলীর একটা যেন বিশেষভাবে তাকে কিছু বলতে চায়, এমন একটা কার্পেট তৈরী করতে বলে যার ফলে তাকে পরামর্শ দেবার কালে তার উপদেষ্টারা যে বিষয়ে সেই বিশেষ মুহূর্তে আলোচনা করছে সেই বিষয়ের সবচেয়ে নিয়ামক গ্রহের উপরে অবস্থান করতে পারে। সে কার্পেট তৈরীর বিষয়টা সম্পূর্ণ গোপন রেখেছিল, দিনরাত চব্বিশ ঘন্টাই যেন তাঁতিরা কার্পেটের বয়ন অব্যাহত রাখে সেটা সে নিশ্চিত করেছিল। শারাফ ব্যতীত আর কেউ এই কার্পেট বয়নের কথা জানতো না- না বায়সানগার, না কাশিম এমনকি খানজাদাকেও সে কিছু জানায়নি। তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীর সবার মতো, তাঁদের কাছেও ব্যাপারটা একটা চমক হিসাবে থাকুক, তাঁর সাথে যোগ দেবার জন্য তিনজনকেই এখন এখানে আসতে বলেছে সে।

উপদেষ্টাবৃন্দ দ্রুতই এসে উপস্থিত হয়। দিনটা আজকে বুধবার বিধায় হুমায়ুনের মতো তাঁদেরও পরণে উজ্জ্বল বেগুনী রঙের আলখাল্লা এবং কোমরে কমলা রঙের পরিকর। হুমায়ুন সামনে বিস্তৃত হাল্কা নীলের ঝকঝকে বৃত্তের দিকে সবাইকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসে। বাবা ইয়াসভালো নিজের বিভ্রান্তি লুকিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে না।

এই বিস্ময়কর কার্পেটটা সম্বন্ধে আপনাদের তারিফ শোনার জন্য এখানে আসতে বলেছি। আমাদের মাথার উপরের চিরচেনা আসমানের একটা প্রতিকৃতি এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই বৃত্তগুলো একেকটা গ্রহকে উপস্থাপন করছে এই যে এখানে রয়েছে, মঙ্গল, বুধ আর বৃহস্পতি আর ওখানে দেখছেন আমাদের সবার পরিচিত চাঁদকে। আপনাদের কারও যদি আমাকে কিছু বলার থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই উপযুক্ত বৃত্তের উপরে দাঁড়িয়ে সেটা উপস্থাপন করতে হবে। কেউ যদি আমার সাথে সামরিক বিষয়ে কিছু আলাপ করতে চায় তাকে অবশ্যই সেটা মঙ্গলের উপরে দাঁড়িয়ে বলতে হবে। যার ফলে আপনারা গ্রহমণ্ডলীকে সাহায্য করবেন আপনাদের পরিচালিত…

হুমায়ুন নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে কিন্তু সহসা কোনো উপদেষ্টার মুখ আলাদা করে চিনতে পারে না- ভাবনায় কটি করা ললাট নিয়ে কে ওখানে দাঁড়িয়ে, কাশিম? …সে নিশ্চিত হতে পারে না…তার চারপাশের সবকিছুই যেন কেমন অস্পষ্ট। নিবিষ্টভাবে নক্ষত্রদের অবলোকনের জন্য রাতের বেলা আগ্রা দূর্গের প্রাকারবেষ্টিত ছাদে উঠে একাগ্র দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিংবা দীর্ঘক্ষণ নক্ষত্রদের সারণি পর্যালোচনা করার কারণে হয়ত ক্লান্তি এসে তার চোখের দৃষ্টি এমন ঝাপসা করে তুলেছে।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। হ্যাঁ, কাশিমই তার দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এবং বাবা ইয়াসভালের চোখে মুখে, সম্ভবত কার্পেটের প্রতীকীত্বের ক্ষমতা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে, অথৈ জলে পড়া সাঁতার না জানা লোকের দৃষ্টি। কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা আসাফ বেগ কি ভাবছে? হুমায়ুনের কার্পেট খুটিয়ে দেখার সময় তার চেহারায় যেন একটা হাসির ভাব ফুটে উঠে- ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞার ফণা। হুমায়ুনের দিকে সরাসরি তাকাবার জন্য সে যখন মাথা উঁচু করে তার অভিব্যক্তিতে তখন যেন ব্যঙ্গ-পরিহাসের চেয়েও ভিন্ন কিছু একটা ফুটে উঠে। হুমায়ুনের মাঝে দাবানলের মতো ক্রোধের একটা ঝাপটা বয়ে যায়। কাবুলের এই আকাঁ মূর্খ ছিঁচকে গোত্রপতির এভোবড় স্পর্ধা নিজের সম্রাটকে উপহাস করে?

এই যে আপনি! হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং ক্রোধে কাঁপতে থাকা আঙ্গুল তুলে আসাফ বেগকে নির্দেশ করে। আপনার এতখানি ধৃষ্টতা, ঠিক আছে আপনার এই অবজ্ঞার উপযুক্ত পুরষ্কারই আপনি পাবেন। প্রহরী- এই উজবুকটাকে বাইরের প্রাঙ্গণে নিয়ে গিয়ে পঞ্চাশ ঘা দোররা লাগাও। আসাফ বেগ নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবেন এই জন্য যে মাথার বদলে আজ কেবল আপনার নিতম্বের চামড়াই খোয়ালেন।

একটা সম্মিলিত শ্বাস নেবার শব্দের সাথে সাথে দরবারের ভিতরে কবরের স্তব্ধতা নেমে আসে। তারপরে একটা কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সুলতান…

সমালোচনা কিংবা মতানৈক্য কোনটাই সহ্য করবে না বলে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়ে, ক্রুদ্ধ বাঘের ঝাঁপট নিয়ে হুমায়ুন ঘুরে তাকায় কিন্তু দেখে সেটা কাশিমের কণ্ঠস্বর। তার এবং আব্বাজানের অধীনে যে লোকটা দায়িত্বের সাথে কর্তব্যরত ছিল, এবং যাকে সে বিশ্বাস করে, সেই লোকটার চেহারায় সত্যিকারের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ফুটে উঠতে দেখে, তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হতে শুরু করে। একই সাথে সে অনুভব করে তার শ্বাসপ্রশ্বাস অনিয়মিত, নাড়ীর স্পন্দনে ঘোড়ার খুরের বোল আর কপালে স্বেদবিন্দুর সৃষ্টি হয়েছে।

কাশিম, আপনি কি কিছু বলবেন?

সুলতান, আমি নিশ্চিত যে আপনাকে অসম্মান করাটা আসাফ বেগের অভিপ্রায় ছিল না…পুর্নবিবেচনার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।

আসাফ বেগ, ভয়ে বিবর্ণ এবং তাঁর চওড়া ঠোঁটে হাসির লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না আর সচরাচর হাস্যোজ্জ্বল, চোখে মিনতি নিয়ে হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের মতো অসম্মান আসাফ বেগের সাথে সাথে তার গোত্রের জন্যও ভীষণ অপমানজনক বলে বিবেচিত হবে, হুমায়ুন সেটা ভালো করেই জানে। যুদ্ধক্ষেত্রে আসাফ বেগের সাহসিকতার কথা সে বিবেচনা করে। নিজের হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য সে ইতিমধ্যেই অনুতপ্ত।

কাশিম- বরাবরের মতোই, আপনি যথার্থই বলেছেন। আসাফ বেগ, আমি এবারের মতো আপনাকে মার্জনা করলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে আর কখনও আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে যাবেন না তখন হয়ত আমি এতটা দয়ালু নাও হতে পারি। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় নিজের উপদেষ্টাদের বিদায় নেবার ইঙ্গিত করতে তারা সবাই সচরাচরের চেয়ে যেন দ্রুতই তাঁর আদেশ পালন করে। হুমায়ুন যখন আবার বসে সে নিজেকে তখন থরথর তরে কাঁপতে দেখে। কার্পেটের আবেদন পুরোপুরি লুপ্ত হয়েছে। রাতও অনেক হয়েছে। বিশ্রামের জন্য বোধহয় তাঁর এখন নিজের আবাসনকক্ষে ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে নিজের কক্ষে যখন প্রবেশ করতে খানজাদাকে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে বিস্মিত হয়।

ফুপুজান, কি ব্যাপার?

তোমার পরিচরদের বিদায় কর। আমি তোমার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাই।

হুমায়ুন জওহর আর অন্যান্য পরিচরদের ইঙ্গিতে বাইরে যেতে বলে। দুই পাল্লার দরজা বন্ধ হয়েছে কি হয়নি খানজাদা শুরু করেন। ঝরোকার পেছন থেকে আজ উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনার সময়ে কি হয়েছে আমি সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। হুমায়ুন…এমনটা ঘটা সম্ভব আমি কল্পনাও করতে পারি না…প্রথমে তুমি একজন মোহগ্রস্ত লোকের মতো আচরণ করলে এবং তারপরে বদ্ধ উন্মাদের মতো…

আমার উপদেষ্টারা সবসময়ে বুঝতে পারে না, আমি যা করছি সেটা যে মঙ্গলের জন্য কিন্তু আপনার সেটা বুঝতে পারা উচিত। একজন শাসকের কাছে নিজেকে জাহির করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আপনার কাছেই আমি শিখেছি তুল্যমূল্য অনুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ আপনিই দিয়েছিলেন এবং শাসনকার্যের সহায়ক হিসাবে কৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবহারে আমাকে উৎসাহিত করেছেন…

কিন্তু সেজন্য যুক্তি বা মানবতাকে বিসর্জন দিতে বলিনি…

নক্ষত্রদের বরাভয় স্মরণে রেখে আমি নতুন পদ্ধতি আর রীতির পরিকল্পনা করেছি। শাসনকার্য এর ফলে সহজ হবে। আমার উপদেষ্টা আর পরামর্শদাতারা যদি আমার নির্দেশনা অনুসরণ করে তাহলে দরবার কক্ষে সময়ের বিরক্তিকর অপচয় হ্রাস পাবে, ভাগ্যেচক্রের অথৈই গভীরতায় আরও ব্যাপক অনুসন্ধানের জন্য আমাকে মুক্তি দেবে।

নক্ষত্রের নখরামি আপাতত বাদ দাও। তোমার সমস্ত মনকে তারা আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং তুমি বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছ। আমি তোমাকে আগেও সতর্ক করতে চেয়েছি কিন্তু তুমি আমার কথায় কর্ণপাত করেনি। এখন তোমাকে নিশ্চয়ই শুনতে হবে নতুবা যা কিছু অর্জনের জন্য তুমি বিচেষ্টিত হয়েছে সেসব কিছু তোমার হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে- তোমার আব্বাজানের অর্জিত সবকিছু… হুমায়ুন আমার কথা কি আদৌ তোমার কানে যাচ্ছে?

হ্যাঁ, আমি শুনছি। কিন্তু সে মনে মনে ভাবে, খানজাদা ভুল করছে…তাকে দীর্ঘদিন ধরে একাধারে কষ্ট দিয়েছে আবার আকর্ষণ করেছে অন্য যেসব প্রশ্নগুলো তাদের উত্তর সে কেবল গ্রহ আর নক্ষত্রের বিন্যাসের মাঝে খুঁজে পেতে পারে। নিয়তির দ্বারা আসলেই কি সবকিছু কোনোভাবে পূর্ববিহিত করা? তার আব্বাজানের অকালমৃত্যু কি আসলে আরেকটা বিশাল পরিকল্পনার একটা অংশ? একটা মানুষের নিয়তির কতটুকু তার নিজের হাতে থাকে? নিয়তির কতটুকু পূর্বনির্ধারিত যেমন অবস্থান বা পরিবার যেখানে সে জন্মগ্রহণ করেছে এবং এর সাথে প্রাপ্ত সুবিধা আর দায়িত্বসমূহ? এবং সে এসব কিভাবে জানতে পারবে…? একজন বৃদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু হুমায়ুনের যৌবনে যার সাথে তার দেখা হয়েছিল- কাবুল থেকে প্রায় একশ মাইল পশ্চিমে বামিয়ানের উপত্যকায় পাহাড়ে খোদাই করা বিশাল এক বৌদ্ধ মূর্তির পাশে সেই ভিক্ষুর নির্জন আশ্রয়ে, তিনি তাঁকে বলেছিলেন যে তার জন্মের সময়, স্থান এবং তারিখ নির্ভুল আর ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বলতে পারলে তিনি হুমায়ুনের জীবনের পরিণতি কেবল না সেইসাথে পরবর্তী জীবনে কোনো প্রাণী হিসাবে তাঁর পুনর্জন্ম হবে সবকিছু আগাম বলতে পারবেন। তাঁর কাছে পুনর্জন্মের ধারণাটা অবান্তর মনে হয়েছে কিন্তু সেই ভিক্ষুর বাকি কথাগুলো তাকে ভাবিত করে তুলে। সে ইতিমধ্যে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে- যে রাশিচক্র আর গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান, সারণি এবং বহুকাল পূর্বের ঘটনাবলীর লিপিবদ্ধ ভাষ্য যার অধ্যয়নে সে প্রচুর সময় ব্যয় করেছে এবং তাঁর আফিম-উদ্বুদ্ধ স্বপ্নে তাঁর কাছে জীবন্ত বলে প্রতিয়মান স্বপ্নগুলো দ্বারা সে জীবন যাপন আর শাসনকার্যের একটা কাঠামো সৃষ্টি করতে পারবে এবং ইতিমধ্যে সেই কাজে অনেকদূর অগ্রসরও হয়েছে।

হুমায়ুন! তুমি কি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে?

খানজাদার কণ্ঠস্বর মনে হয় যেন দূরে কোথায় থেকে ভেসে আসছে এবং সে যেন তার দিকে তাকিয়ে থাকায় তার আকৃতি হ্রাস পেতে শুরু করে, সে একটা খর্বকায় পুতুলে পরিণত হয় যে কিনা অনবরত নিজের হাত আন্দোলিত করছে আর মাথা নাড়ছে। পুরো ব্যাপারটাই একটা হাস্যরসাত্মক মাত্রা লাভ করে।

তুমি কি বিপদের ভিতরে আছো, আমি যখন সে বিষয়ে কথা বলছি তুমি হেসেই চলেছো… খানজাদা তার বাহু দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরলে, তার তীক্ষ্ণ নখ হুমায়ুনের বাহুর মাংসের গভীরে গেঁথে বসে, তাঁকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে কথা না বললেই চলছে না… যা কিনা সম্ভবত আমিই তোমাকে বলতে পারি… কিন্তু মনে রেখো তোমায় ভালোবাসি বলেই কথাগুলো আমি বলছি।

আপনি যা বলতে চান বলতে পারেন।

 

ভাগ্যের পরিহাস - ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

হুমায়ুন, তুমি আফিমে আসক্ত হয়ে বিভ্রান্তির মাঝে দিনযাপন করছে। একটা সময়ে যোদ্ধা হিসাবে, শাসক হিসাবে তোমার সুনাম ছিল। কিন্তু এখন একজন ভাবুক আর কল্পনাবিলাসী ছাড়া তোমাকে কি অন্য কিছু বলা যাবে? আমি কখনও চিন্তাও করিনি এই কথাগুলো আমি কখনও তোমায় বলবো…কিন্তু একজন শাসককে অবশ্যই দৃঢ়চেতা হতে হবে, তাকে অবশ্যই হতে হবে সিদ্ধান্তগ্রহণে সক্ষম। তাঁর প্রজারা সবসময়ে যেন জানে যে তার উপরে তারা নির্ভর করতে পারে। এসব তুমি জান। এসব বিষয়ে তুমি আর আমি অতীতে কতবার না আলোচনা করেছি। আজকাল কদাচিৎ তোমার সাথে আমার দেখা হয়… এবং আমি যখন দরবারের দিকে তাকাই সেখানে আমি কেবল আতঙ্কিত আর অনিশ্চিত অভিব্যক্তি দেখতে পাই, আর তোমার পিঠ পেছনে আড়ষ্ঠ হাসির শব্দে আমার কান বিদীর্ণ হয়। এমনকি যারা তোমায় একসময়ে ভালো করে চিনতো এবং দীর্ঘদিন বিশ্বস্ততার সাথে তোমায় আজ্ঞা পালন করছে- কাশিম আর বাবা ইয়াসভালো যেমন- তাঁদের কাছেও তুমি একজন আগন্তুকে পরিণত হয়েছে। তোমার বিবেচনাবোধের উপরে তারা আজকাল আর আগের মতো আস্থা রাখতে পারছে না। তোমার প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁরা সন্দিহান তাদের আচরণে তুমি প্রসন্ন হবে না ক্রুদ্ধ হবে তাই নিয়ে তারা সবসময়ে সন্ত্রস্ত থাকে। কখনও ঘন্টার পর ঘন্টা তারা তোমার কাছ থেকে নিজেদের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো নির্দেশনা কিংবা মন্তব্য জানতে পারে না… এমনকি কখনও এমন পরিস্থিতি কয়েক দিনও বিরাজ করে…

খানজাদা পূর্বে কখনও তাঁর সাথে এভাবে কথা বলেনি এবং নিজের ভেতরে একটা বিরক্তি জমছে সে বুঝতে পারে। যদি আপনি কিংবা আমার অমাত্যরা আমার সিদ্ধান্তসমূহ এবং সাম্রাজ্য আমি যেভাবে শাসন করবে বলে মনস্থির করেছি। সেটা সম্বন্ধে বৈরী মনোভাব পোষণ করেন তাহলে বুঝতে হবে বিষয়টা আপনাদের কাছে বোধগম্য হয়নি। কিন্তু অচিরেই এমন একটা সময় আসবে যখন দেখবেন আমি আমাদের সবার মঙ্গলের জন্যই সবকিছু করেছি।

সময় এখন আর তোমার অনুকূলে নেই। তুমি যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতে ব্যর্থ হও, তোমার অনুগত সেনাপতি আর অভিজাতদের মনোযোগ তখন তোমার সৎ-ভাইদের দিকে আকৃষ্ট হবে। বিশেষ করে আমি কামরানের কথা বলছি। হুমায়ুন, মাথা স্থির করে একবার ভেবে দেখো। সে বয়সে তোমার চেয়ে কয়েকমাসের ছোট এবং ইতিমধ্যে নিজের শাসনাধীন প্রদেশে একজন দক্ষ যোদ্ধা আর কঠোর শাসক হিসাবে সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। তোমার মতোই তারও ধমনীতে বাবর আর সেইসাথে তৈমূরের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তুমি জান সে উচ্চাকাঙ্খি- এতটাই উচ্চাকাঙ্খি যে তোমার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একবার ষড়যন্ত্র করেছে। সে আবারও একই কাজ করবে না তোমার এমনটা ভাববার কোনো সুযোগ নেই। তোমার মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগেনি কেন গুলরুখ নিজেকে তোমার সেবাদাসীতে পরিণত করেছে, কেন সে তার সেই পানীয় দিয়ে তোমায় সিক্ত করছে? দূর আকাশের নক্ষত্রের মাঝে নিহিত অপার রহস্যের দিকে তাকিয়ে থাকার চেয়ে নিজের চারপাশের লোকদের মনের গভীরে ডুব দিয়ে দেখাটাই…তাদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে সজাগ থাকা একজন শাসকের পক্ষে শোভনীয়। কামরান আর আসকারির হয়ে তোমার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহের সাহস গুলরুখের কখনও হবে না…কতখানি ধুরন্ধর আর কুশলী হলে আফিমের নেশায় আসক্ত করে সে তোমাকে অধঃখাতে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করতে পারে। এবং তোমার ক্ষমতা যখন দুর্বল হবে এবং শীথিল হয়ে আসবে আর তোমার প্রজারা একদা যে শাসককে শ্রদ্ধা করতো তাঁকেই অবজ্ঞা জ্ঞানে তাচ্ছিল্য করতে শুরু করবে, তার কোনো সন্তানের কাছে তখন যদি তারা শরণ প্রার্থনা করে তখন কিন্তু বিষয়টাকে মোটেই অস্বাভাবিক মনে হবে না? উলুঘ বেগের পরিণতির কথা স্মরণে রেখো। তোমার মতোই- সে যখন তারকারাজি এবং জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁরা তাঁকে কি সলুকসন্ধান দিতে পারে সেসব নিয়ে বেশী আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, তখন তারই এক ছেলে তাঁকে হত্যা করে এবং তাঁর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়।

ঈর্ষা আর ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে আপনি কথা বলছেন। উৎসব বিষয়ে আমি আপনার ভাবনাগুলো গ্রহণ করে গণনার সাহায্যে আপনার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছাপিয়ে তাদের উন্নত করেছি বলে আপনি বিষয়টা মেনে নিতে পারছেন না। আমি একদা আপনার উপর যেমন নির্ভরশীল ছিলাম তেমনটা আজ আর নই বলে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে এমন একজন মানুষে পরিণত হয়েছি বলে এবং কোনো স্ত্রীলোকের- আপনার, বা গুলরুখের কারও পরামর্শ তার প্রয়োজন নেই দেখে, আপনি বিরক্ত…আপনাদের সবারই…নিজ নিজ অবস্থান সম্বন্ধে সচেতন হওয়া উচিত।

খানজাদাকে রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বুঝতে পারে কতটা আঘাত সে তাঁকে করেছে, কিন্তু কিছু বিষয়ে তাঁকে সতর্ক করাটাও জরুরী ছিল। খানজাদাকে সে খুবই ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে, কিন্তু তিনি নন, সম্রাট হল সে আর তাই হুমায়ুন নিজে সিদ্ধান্ত নেবে কিভাবে সে রাজ্য পরিচালনা করবে।

তোমাকে সতর্ক করতে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। তুমি যদি মনস্থির করেই থাক যে আমার কোনো কথাই তুমি শুনবে না তাহলে আমার আর কিছু করার থাকে না… খানজাদার কণ্ঠস্বর নীচু আর সংযত কিন্তু হুমায়ুন ঠিকই লক্ষ্য করে তার কপালের পাশে একটা শিরা দপদপ করছে আর তার দেহটা থরথর করে কাঁপছে।

ফুপুজান… হুমায়ুন তাঁর বাহুমূল স্পর্শ করতে চেষ্টা করতে তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং দরজার উদ্দেশ্যে প্রস্থান করেন আর নিজেই এক ধাক্কায় পাল্লা দুটো খুলে দেন। তার জন্য অপেক্ষারত নিজের দুই খাস পরিচারিকাকে ডেকে নিয়ে মশাল আলোকিত করিডোের দিয়ে দ্রুত নিজের কামরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। হুমায়ুন তাঁর গমনপথের দিকে নিরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। সে আগে কখনও খানজাদার সাথে কোনো কিছু নিয়ে তর্ক করেনি কিন্তু সে আজ তাঁকে যা বলেছে সেটা বলা প্রয়োজন ছিল, সে নিজেকে সেরকমই বোঝায়। তারকারাজি আর তাদের বয়ে আনা বার্তা কোনোমতেই উপেক্ষণীয় নয়। কোনো মানুষকে- এমনকি সে যদি সম্রাটের মতো ক্ষমতাধরও হয়- কোনোভাবেই অনন্ত বিশ্বের মাঝে তারকারাজির আপাতদৃষ্টিতে এই শেষ না হওয়া আবর্তনের সাথে তুলনা করা যায় না। সে যদি তাঁদের ইঙ্গিত অনুসরণ করে তবে তাঁর রাজত্ব অবশ্যই সমৃদ্ধি লাভ করবে।

আর গুলরুখের ব্যাপারে ফুপিজান যা বলেছেন…সেটাও ভুল। দরবারের আর দশজনের মতোই সেও অবশ্যই সম্রাটের নেক নজরে থাকতে চায়। তাকে তুষ্ট করে গুলরুখ হয়ত আশা করে যে সে নিজের সন্তানদের জন্য, তার সৎ-ভাই কামরান আর আসকারির জন্য সুযোগসুবিধা আর অনুগ্রহ নিশ্চিত করতে পারবে… কিন্তু এর বেশী কিছু না। গুলরুখের আফিম মিশ্রিত গাঢ় বর্ণের সুরা যা তাঁকে মননকে সমৃদ্ধকারী মার্গ দর্শনে সাহায্য করে সেটা তাঁকে দেয়া গুলরুখের উপহার এবং এই সুরা পান করা থেকে সে নিজেকে বিরত রাখতে চায় না, সে সেটা পারবেও না…বিশেষ করে এই সুরা যখন তাকে প্রতিনিয়ত অস্তিত্বের রহস্যময়তা পুরোপুরি আয়ত্ত করার কাছাকাছি নিয়ে চলেছে।

*

ঢাকের আওয়াজ করছে যে তাকে আসতে দাও। আজ শুক্রবার- আজি সেই দিন যেদিন আমি আমার সবচেয়ে দীনহীন প্রজার প্রতিও ন্যায়বিচার করতে প্রস্তুত। হুমায়ুন তাঁর উঁচু পৃষ্টদেশযুক্ত সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে হাসে। গত ছয়মাসের ভিতর আজই প্রথম সিংহাসনটাকে দর্শনার্থীদের সাথে সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত কক্ষের বাইরে এনে রাখা হয়েছে কারণ সম্রাটের কাছে সুবিচার প্রার্থনা করে অজ্ঞাত কেউ একজন মোষের চামড়া দিয়ে তৈরী অতিকায় ঢাকে বোল তুলেছে। শুরুতে শব্দটা মৃদু আর অনিয়মিত ছিল এবং এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল সেটাও বুঝি বন্ধ হয়েছে। হুমায়ুন তারপরে পুনরায় শব্দটা শুনতে পায়। ন্যায়বিচারের ঢাকে যেই বোল তুলে থাকুক মনে হচ্ছে এবার যেন সে একটু সাহসী হয়েছে। ঢাকের বোলের আওয়াজ জোরাল হয় এবং সেটা এবার দ্রুত লয়ে ধ্বনিত হয়। এই মুহূর্তটার মুখোমুখি তাকে হতে হবে সেটা সে আগেই জানতো ঠিক যেমন সে জানে- সময়ে তার অমাত্যবৃন্দ ঠিকই সে যেসব সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সেসব মেনে নেবে। এমনকি পোড় খাওয়া কাশিমও, যে এই মুহূর্তে তার সিংহাসনের পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, স্বীকার করতে বাধ্য হবে সেই সঠিক ছিল।

নীল পাগড়ি পরিহিত তাঁর দেহরক্ষী দলের ছয়জন সদস্য দূর্গ প্রাঙ্গন থেকে বের হয়ে যেতে তাদের পায়ের শব্দে পাথুরে মেঝেতে প্রতিধ্বনি তুলে। তারা যখন ফিরে আসে তাদের সাথে লাল সিল্কের শাড়ি পরিহিত কপালে লাল তিলক দেয়া একজন অল্পবয়সী হিন্দু রমণীকে দেখা যায়। মেয়েটার মাথার লম্বা কালো চুল তার কাঁধের উপরে ঢেউয়ের মতো ভোলা পড়ে আছে এবং তার অভিব্যক্তির মধ্যে একাধারে উদ্বেগ আর দৃঢ়তা ফুটে আছে। প্রহরীর দল তাঁকে সিংহাসনের দশ ফিটের ভিতর নিয়ে আসতে সে হুমায়ুনের সামনে নিজেকে নতজানু করে।

উঠে দাঁড়ান। সম্রাট আপনার অনুরোধ শ্রবণে প্রস্তুত, কাশিম মন্দ্র কণ্ঠে বলে। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আপনি অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবেন।

সিংহাসনে উপবিষ্ট হুমায়ুনের রত্নশোভিত, দীপ্তিময় অবয়বের দিকে মেয়েটা কেমন একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে তাকিয়ে থাকে যেন তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছে না সে সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সুলতান, আমার নাম সিতা। আমি আগ্রার এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী। আমার স্বামী লবঙ্গ, জাফরান আর দারুচিনির মতো মশলার একজন ব্যবসায়ী। এক সপ্তাহ পূর্বে তিনি দিল্লীর বাজার থেকে মশলা কিনে সেগুলো খচ্চরের একটা ছোট বহরের পিঠে চাপিয়ে আগ্রায় ফিরে আসছিলেন। দিল্লী থেকে দুদিনের দূরত্বে আমাদের পবিত্র হিন্দু শহর মধুরার কাছে তিনি আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা ডাকাতের কবলে পড়েন যাঁরা তাঁদের বহন করে আনা সবকিছু লুট করে নেয়- এমনকি তাদের পরনের কাপড়ও তাঁরা খুলে নেয়। ডাকাতের দল খচ্চরের বহর নিয়ে রওয়ানা দেবে এমন সময় আপনার একদল সৈন্য সেখানে এসে উপস্থিত হয়। সৈন্যরা ডাকাতদের হত্যা করে ঠিকই কিন্তু আমার স্বামীকে তার মালপত্র ফিরিয়ে দেবার বদলে তারা আমার স্বামীকে উপহাস করে। তারা বলে যে তিনি ভেড়ার মতো ভয়ে ভ্যা ভ্যা করছিলেন আর তার সাথে সেরকমই আচরণ করা উচিত। ডাকাতদের বাধা দড়ি খুলে দিয়ে তাঁকে বাধ্য করে নগ্ন অবস্থায় এবং খালি পায়ে তপ্ত বালির উপর দিয়ে দৌড়াতে, ঘোড়ার পিঠে সওয়াড় হয়ে তাঁরা তাঁকে ধাওয়া করে এবং বিদ্রূপ করে আর তাঁদের বর্শার ডগা দিয়ে তাকে নির্মমভাবে খোঁচাতে থাকে। তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডে নিজেরাই হাঁপিয়ে উঠলে, রক্তাক্ত আর পরিশ্রান্ত অবস্থায় আমার স্বামীকে বালির উপরে ফেলে রেখে তারা চলে যায়। এবং যাবার সময় তারা মূল্যবান মশলা বোঝাই আমার স্বামীর সবগুলো খচ্চর তাদের সাথে করে নিয়ে যায়…।

এহেন অবিচারের কারণে সিতার কণ্ঠস্বর ক্রোধে কাঁপতে থাকে কিন্তু সে নির্ভয়ে সরাসরি হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি আমার স্বামীর জন্য ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। সে মহামান্য সুলতানের একজন বিশ্বস্ত প্রজা এবং সর্বোপরি তাঁর বয়স হয়েছে। আপনার সৈন্যদের উচিত ছিল তাঁর প্রতি নির্দয় আচরণ না করে তাঁকে রক্ষা করা। আজ তিনি মৃতবৎ নিজের বাসায় শুয়ে আছেন তাঁদের দেয়া আঘাতের ফলে তার সারা দেহে সৃষ্ট ক্ষতস্থানগুলোতে পূজ জমেছে…

মহিলাকে প্রশ্ন করতে প্রস্তুত কাশিম সামনে এগিয়ে আসে কিন্তু হুমায়ুন তাঁকে পেছনে সরে আসতে ইঙ্গিত করে। সৈন্যদের এহেন আচরণ তাঁর মর্যাদার জন্য ক্ষতিকর। নিজের প্রজাদের কাছে তাঁকে সূর্যের মহিমায় মহিয়ান হতে হবে। তাঁদের সবার উপরেই যেন তাঁর দীপ্তি আর উষ্ণতা আপতিত হয় কিন্তু এই হতভাগ্য ব্যবসায়ী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছেন…

এই সৈন্যদের সম্পর্কে আপনি আমাকে আর কিছু কি বলতে পারবেন? আপনি কি তাদের নাম জানেন?

আমার স্বামী কেবল বলেছেন যে সৈন্যদের একজন তাদের দলপতিকে মিরাক বেগ বলে সম্বোধন করেছিল এবং সে লম্বা, চওড়া দেখতে আর তার নাক ভাঙা এবং একটা সাদা ক্ষতচিহ্ন তাঁর ঠোঁটকে বিকৃত করেছে।

হুমায়ুন ভালো করেই চেনে মিরাক বেগকে বাদখশানের এক উজ্জ্বল, ন্যায়নীতি বিবর্জিত এক গোত্রপতি যে হিন্দুস্তান অভিযানের সময় হুমায়ুন আর তাঁর আব্বাজানের সাথে সেখান থেকে এসেছিল। পানিপথে নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে শত্রুপক্ষের একটা রণহস্তির পেছনের পায়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শত্রুপক্ষের তিরন্দাজদের হত্যা করতে, যারা জন্তুটার পিঠে স্থাপিত একটা হাওদায় অবস্থান করে হুমায়ুনের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে অনবরত তীর নিক্ষেপ করছিল, সেখান থেকে একলাফে সে জন্তুটার পিঠে উঠে বসে স্বাতন্ত্রমণ্ডিত একজন যোদ্ধা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানের অপরাধের জন্য অতীতের বীরত্ব কোনো অজুহাত হতে পারে না। মিরাক বেগকে অবশ্যই নিজের এই যথেচ্ছাচারের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

আপনি এতোক্ষণ যা বলেছেন সেটা যদি সত্যি হয়, আমি ওয়াদা করছি আপনি ন্যায়বিচার পাবেন। আপনি এখন বাসায় ফিরে যান এবং আমার সমনের জন্য অপেক্ষা করেন। কাশিম- মিরাক বেগকে খুঁজে বের করে যত দ্রুত সম্ভব আমার সামনে এনে হাজির কর।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত কক্ষ থেকে ছুটে বেড়িয়ে আসে। তার গা গুলিয়ে উঠে বমি পায়। তার মাথা আবার ব্যাথা করছে- তাঁর চোখের পেছনে তীক্ষাগ্র কোনো কিছু দ্বারা আঘাতের যন্ত্রণাটা আজকাল প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে আর সেইসাথে ভুল দেখার মাত্রাও বেড়ে গিয়ে কোনো কিছুর প্রতি মনোনিবেশ করাটা তার জন্য আরও কঠিন করে তুলেছে। যন্ত্রণা উপশমের জন্য, তার মনকে প্রশান্ত করতে আর দরবারের এইসব বিরক্তিকর বাধ্যবাধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, তাঁর আরও আফিম এবং সুরা প্রয়োজন।

*

 

ভাগ্যের পরিহাস - ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

সপ্তাহের মঙ্গলবার পরিচালিত হয় মঙ্গল গ্রহ দ্বারা, এদিনের জন্য যথার্থ পোষাক রক্ত লাল রঙের আলখাল্লা পরিহিত হুমায়ুন মিরাক বেগের অবাধ্য মুখাবয়বের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। শিকল দিয়ে বেঁধে তাঁকে দরবার কক্ষে আনা হয়েছে বটে, কিন্তু সে তারপরেও নিজের চিরাচরিত হামবড়াভাব ঠিকই বজায় রেখেছে। হুমায়ুনের মুখের দিকে সে তার কালো চোখ দিয়ে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে এবং তাঁকে দেখে মনেই হয় না সদ্য তেল দেয়া কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জল্লাদদের বা প্রাণবধকারী পাথরের গায়ে জমে যাওয়া লাল রক্তের কালো দাগ- সে লক্ষ্য করেছে। সিংহাসনের ডান পাশে স্থাপিত প্রকাণ্ড কালো গ্রানাইট পাথরটার উপরে একটু আগেই উন্মত্তের হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে মিরাক বেগের চারজন লোক তাদের ডান হাত খুইয়েছে এবং সদ্য কর্তিত হাতের অবিশিষ্টাংশ সংক্রমন রোধে গনগনে লাল লোহার টুকরো দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লোকগুলোকে সরিয়ে নেয়া হলেও, বাতাস এখনও তাদের মাংস পোড়র গন্ধে ভারী হয়ে আছে।

মিরাক বেগ, তোমার সৈন্যদের কপালে কি শাস্তি জুটেছে সেটা যাতে তুমি প্রত্যক্ষ করতে পার, সেজন্য আমি তোমাকে সবার শেষে আনতে বলেছি। তারা অন্যায় করেছে এবং সেজন্য উপযুক্ত শাস্তি পেলেও, তুমি, তাদের নেতা হিসাবে তাদের এই জঘন্য অপরাধের দায়দায়িত্ব তোমাকেই বহন করতে হবে। নিজের অপরাধ তুমি কোনো প্রকারের ভণিতা ছাড়াই স্বীকার করেছে কিন্তু শাস্তির হাত থেকে তুমি বাঁচতে পারবে না… তোমার কর্মকাণ্ডের কারণে আমার যে সম্মানহানি হয়েছে তোমার মৃত্যুই কেবল পারে সেই কলঙ্কমোচন করতে। আরেকটা কথা, জল্লাদের কুঠারাঘাতে তুমি মৃত্যুর অভয় লাভ করবে না। তোমার অপরাধের সম্পূরক মাত্রায় তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। বোন আপনি কাছে এগিয়ে আসেন।

গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দরবারের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বেশর বণিকের স্ত্রী সীতাকে ইঙ্গিতে হুমায়ুন সামনে এগিয়ে আসতে বলে। হুমায়ুন আপন মনে ভাবে, চোখের সামনে অঙ্গচ্ছেদ দেখেও মেয়েটা একটুও বিচলিত হয়নি এবং এবার সে দেখবে সত্যিকারের রাজকীয় ন্যায়বিচার। মিরাক বেগের জন্য যে শাস্তির কথা সে ঘোষণা করতে যাচ্ছে সেটার ধারণা সে স্বপ্নে লাভ করেছে আর এর যথার্থতা তাঁকে প্রীত করেছে। সবার জন্যই একটা চমক অপেক্ষা করছে সিংহাসনের দুপাশে তাঁর আদেশ অনুযায়ী দরবারে উপস্থিত সব অমাত্যদের মতো লাল পোষাক পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা কাশিম বা বাইসানগারের সাথেও সে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেনি।

মিরাক বেগ, হাঁটু গেড়ে বসে নতজানু হও। গোত্রপতির চেহারায় এতক্ষণে বিস্ময় ফুটে উঠে যেন এর আগ মুহূর্ত পর্যন্তও সে বিশ্বাস করেনি হুমায়ুন তাঁকে সত্যিই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবে। তার মুখ রক্ত শূন্য হয়ে পড়তে তার উপরের ঠোঁটের সাদা ক্ষতচিহ্নটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়ে পুরো মুখে মসৃণ পাণ্ডুর পৃষ্টের মতো একটা অশুভ দীপ্তি ফুটে উঠে। সে জীহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজায়, তারপরে পুনরায় সাহস সঞ্চয় করে, দরবারে উপস্থিত সবাই শুনতে পাবে এমন কণ্ঠে কিছু বলতে শুরু করে।

সুলতান…প্রথমে পানিপথে এবং পরবর্তীতে গুজরাতে আমি জীবনপণ করে আপনার জন্য লড়াই করেছি…আপনার প্রতি আমি সবসময়ে অবিচল আনুগত্য প্রদর্শন করে এসেছি। পেটমোটা, ভীরু আর কাপুরুষ এক বণিকের সাথে রঙ্গরসিকতা করতে গিয়ে আমি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সেজন্য মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হতে পারে না। আমি আর আমার লোকেরা সবাই যোদ্ধার জাত, কিন্তু গুজরাতের পরে আপনি আমাদের আর কোনো যুদ্ধের সুযোগ দেননি…না কোনো বিজয়ের গৌরব…আফিম সেবন করে তারকারাজির দিকে তাকিয়ে থেকেই আপনি আজকাল সময় অতিবাহিত করছেন যখন আপনার উচিত ছিল নিজের সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়া। নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে আমরা সেজন্যইতো এসেছি…সে প্রতিশ্রুতিই আপনি আমাদের দিয়েছিলেন…একটার পরে একটা বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার সময় আমাদের ঘোড়ার খুরের দাপুটে বোল পৃথিবীর বুকে প্রতিধ্বনি তুলবে…।

যথেষ্ট! দাঁড়িয়ে থাকা দুই জল্লাদকে হুমায়ুন তাঁর হাত তুলে কিছু একটা ইশারা করে। তারা তাদের হাতের কুঠার নামিয়ে রাখে এবং পাশের একটা স্তম্ভের আড়াল থেকে তাদের একজন একটা ছোট বস্তা তুলে নেয়। তারপরে, হুমায়ুনের প্রহরীরা দুপাশ থেকে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা মিরাক বেগের কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরতে, জল্লাদদের একজন তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, আকষ্মিকভাবে তার মাথা পেছনের দিকে টেনে ধরে এবং তাঁকে মুখ খুলতে বাধ্য করে। বস্তা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা এবার বস্তার ভেতরে হাত ঢুকায়। লোকটা এবার উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের একমুঠো গুড়ো বস্তার ভেতর থেকে বের করে এনে সেটা, মিরাক বেগের ব্যাদান হয়ে থাকা মুখের গহ্বরে ঠেসে গুঁজে দিতে গোলমরিচ আর হলুদ গুড়োর তীব্র ঝাঝালো গন্ধ হুমায়ুনের নাকে এসে ধাক্কা দেয়।

মিরাক বেগ সাথে সাথে নিঃশ্বাস নেবার জন্য খাবি খেতে শুরু করে। তাঁর হা-হয়ে থাকা চোয়ালের ভিতর দিয়ে তাঁর গলার ভেতরে দ্বিতীয়বার তারপরে তৃতীয়বার মুঠোভর্তি গুড়ো ঠেসে দিতে বেচারার দড়দড় করে পানি পড়তে থাকা চোখ দুটো যেন মাথার ভেতর থেকে ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়। তার মুখ ইতিমধ্যে বেগুনী বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে এবং তার নির্যাতিত মুখ থেকে হলুদ নিষ্ঠীবনের ধারা গড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে নাক দিয়ে অঝোরে শ্লেষ্ম ঝরছে। নতজানু অবস্থায় তাকে ঠেসে ধরে থাকা লৌহমুষ্ঠির হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করতে থাকে এবং উঠে দাঁড়াবার জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তির সময়ে ফাঁসিতে ঝোলান কোনো লোকের মতো পা দুটো উদ্দেশ্যহীনভাবে লাথি মারে।

হুমায়ুন তার চারপাশে আঁতকে উঠে দমবন্ধ করার শব্দ শুনতে পায়। কাশিম মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং বাইসানগারও আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ করতে। এমনকি সীতাকেও বিপর্যস্ত দেখায়, নিজের অজান্তে হাতের তালুতে নখ গেঁথে যাওয়া একটা হাত সে মুখের কাছে তুলে আনে এবং তাঁর চোখ দুটো আতঙ্কে গোল দেখায়। আর কয়েকটা মুহূর্ত এবং তারপরেই সবকিছু চুকেবুকে যাবে। মিরাক বেগ শেষবারের মতো দেহের সবটুকু শক্তি জড়ো করে অঝোরে পানি পড়তে থাকা চোখ দুটো খুলে এবং এক মুহূর্তের জন্য সে চোখের দৃষ্টি হুমায়ুনকে বিদ্ধ করে, আর তারপরেই তাঁর দেহ নিথর হয়ে যায়।

হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়। অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি। আমার আইন অমান্য করার ধৃষ্টতা যারা দেখাবে তাঁদের সবাইকে এই একই পরিণতি বরণ করতে হবে। হুমায়ুনের সোনালী সিংহাসন, সিংহাসনের গদি- দিনটি মঙ্গলের প্রভাবাধীন হওয়ায় লাল মখমলে আবৃত, যে মঞ্চে অবস্থিত সেখান থেকে সে নেমে দাঁড়ায় এবং দুপাশে নিজের দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে সে দরবার কক্ষ ত্যাগ করে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সেখানে নিরবতা বিরাজ করে, তারপরে তাঁর অমাত্যরা আরো একবার নিজেদের জীহ্বার উপর দখল ফিরে পেলে তার পেছনে অনেকগুলো কণ্ঠস্বরকে একসাথে হড়বড় করে কথা বলতে শোনে।

সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। যমুনার বুকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, ইতিমধ্যে চাঁদ উঠেছে এবং রূপালী আলোয় নদীর তীর ভাসিয়ে দিচ্ছে যেখানে উট আর গরুর পাল জলের তৃষ্ণা মেটাতে এসেছে। সে আজকে সালিমার কাছে যাবে। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার কারণে আজকাল আর সে আগের মতো তাঁর কাছে যায় না। সালিমার তুলতুলে, সোনালী দেহটার কথা ভেবে সে মুচকি হাসে।

রূপালী কারুকার্যখচিত একটা নীচু ডিভানে সালিমা শুয়ে তার খিদমতে নিয়োজিত এক পরিচারিকা তাঁর পায়ের পেলব পাতায় মেহেদীর জটিল নক্সা আঁকছে। গুজরাত অভিযানের সময় হুমায়ুন যে ধনসম্পদ অভিহরণ করেছিল সেখান থেকে সালিমাকে সে রত্নখচিত যে পরিকরটা দিয়েছিল দুই মেয়েটা কেবল সেটাই পরিধান করে রয়েছে।

সেই অভিযানটাকে এখন কতদিন আগের কথা বলে মনে হয় যেন অন্য কোনো জীবনের স্মৃতি। অভিযোগ প্রকাশ করে মিরাক বেগের বলা কথাগুলো আপনি আমাদের কোনো বিজয় এনে দেননি…আফিম সেবন আর তারকারাজির দিকে তাকিয়ে আপনি আপনার সময় অতিবাহিত করছেন। মিরাক বেগের মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য কিন্তু তাঁর অভিযোগের ভিতরে কোথায় যেন সামান্য হলেও সত্যের নিবিড়তা উঁকি দেয়। সে সাম্রাজ্যের শাসনকার্য যেভাবে পরিচালনা করছে, কিংবা তার আফিম সেবনের পরিমাণ সম্বন্ধে তার আব্বাজান কি মন্তব্য করতেন? কাশিম আর খানজাদা যেমন অনুরোধ করেছে, তার চারপাশে যারা রয়েছে তাঁদের প্রতি আরো বেশী মনোযোগী হবার স্বার্থেই হয়তো মাদক গ্রহণের মাত্রা তার হ্রাস করা উচিত। কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে, তাই কি মনে হয় না? মোগলদের যাযাবর, বর্বর সময় এখন কেবলই স্মৃতি। সে একটা সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা এবং সমৃদ্ধি আর অনুপ্রেরণার নতুন উৎস, শাসনকার্য পরিচালনার নতুন পদ্ধতি যে সে খুঁজে চলেছে সেটা আর কারো না একান্তই তার এক্তিয়ারভুক্ত। তারকারাজি যাদের দীপ্তি এমনকি কোহ-ই-নূরের চেয়েও প্রখর তারা তাকে হতাশ করবে না।

হতাশ করবে না সালিমাও। তাঁর পরিচারিকাটি দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করতে, সালিমা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে প্রণয়সিক্ত ভঙ্গিতে সে হুমায়ুনের লাল আলখাল্লার বাধন আলগা করতে শুরু করলে, নরম রেশমের নীচে তার কাঁধ আর বাহুর শক্ত পেশীর উপরে তার আঙ্গুলগুলো আসন্ন আনন্দের বার্তা নিয়ে দৌড়ে বেড়ায়। সে ফিসফিস করে কেবলই আউড়াতে থাকে, আমার সম্রাট। সালিমার নগ্ন স্তনে এলিয়ে থাকা লম্বা কালো চুল সে দুহাতে আকড়ে ধরে এবং সবেগে তাঁকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, সঙ্গসুখের জন্য ব্যগ্র তারা পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করে যতক্ষণ না মোনতা ঘামের ধারায় তাঁদের দুজনের দেহ সিক্ত হয়ে উঠে অবশেষে রিক্ত পরিশ্রান্ত হয়ে একে অপরের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় তারা বিছানায় লুটিয়ে পড়ে।

কয়েক ঘন্টা পরের কথা, হুমায়ুন সালিমার পাশে শুয়ে আছে। উন্মুক্ত বাতায়ন পথে বাতাসের স্নিগ্ধ একটা স্রোত বয়ে চলে আর পূর্বদিকের আকাশে ইতিমধ্যে ধুসর আলো ফুটতে শুরু করেছে। সালিমা ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলে এবং তারপরে ঘুরে গিয়ে নিজের নরম, মসৃণ কটিদেশ দিয়ে হুমায়ুনকে স্পর্শ করে, নিজের স্বপ্নের মাঝে বিভোর হয়ে যায়। কিন্তু কোনো দুর্বোধ্য কারণে নিদ্রাদেবী হুমায়ুনের কাছ থেকে কেবলই পালিয়ে বেড়ায়। সে চোখ বন্ধ করে যতবার ঘুমাতে চেষ্টা করে প্রতিবারই মিরাক বেগের বিকৃত, নিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা মুখবিবরে ফেনায়িত হলুদ লালা আর করোটি থেকে অর্ধেক বেড়িয়ে আসা আতঙ্কগ্রস্থ দুটো চোখ সে দেখতে পায়। অস্থিরতা সৃষ্টিকারী এসব প্রতিকৃতিগুলোকে মন থেকে বিতাড়িত করতে অনেক আগেই তার উচিত ছিল গুলরুখের বিখ্যাত সুরা পান করা কিন্তু সুরার পাত্রটা সে নিজের আবাসন কক্ষে রেখে এসেছে। সে যাই হোক, নিজের অস্থির চিত্তকে সে এখনও প্রশান্ত করতে পারে। সে নিজের গলায় একটা সরু চেন দিয়ে ঝোলান নীলকান্তমণি খচিত সোনার লকেটের ভেতর থেকে আফিমের বেশ কয়েকটা দলা বের করে এবং একটা পাত্রে পানি নিয়ে সেগুলো গলাধঃকরণ করে। সে গলায় সেই পরিচিত তিক্ত কটু স্বাদ টের পায় কিন্তু তারপরেই সে টের পায় তন্দ্রালু, অবসন্ন একটা উষ্ণতা কোথা থেকে যেন চুঁইয়ে তার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে। চোখের পাতা শেষ পর্যন্ত ভারী হয়ে আসতে থাকলে, হুমায়ুন টানটান হয়ে শুয়ে থাকে। চন্দনকাঠের তেলের মানসিক প্রসন্নতা আনয়নকারী মাধুৰ্য যা দিয়ে সালিমা নিজের দেহ সিক্ত করতে পছন্দ করে, হুমায়ুনের নাসারন্ধ্র আপুত করলে সে ধীরে ধীরে তার অতলে তলিয়ে যেতে শুরু করে।

 

ভাগ্যের পরিহাস - ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই- অন্তত হুমায়ুনের কাছে তাই মনে হয় নির্বন্ধিতভঙ্গিতে একটা নারী কণ্ঠ তাঁকে সম্বোধন করছে সে শুনতে পায়।

সুলতান…সুলতান…একজন বার্তাবাহক এসেছে।

বিমূঢ় অবস্থায়, হুমায়ুন উঠে বসে। সে কোথায় আছে? সে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাতে সালিমাকে দেখতে পায়, তাঁর পাশে এখন উঠে বসছে আর রেশমের একটা গোলাপী রঙের আলখাল্লা টেনে নেয় নিজের নগ্নতাকে আড়াল করতে। কিন্তু যাঁর কণ্ঠস্বরে সে ঘুম থেকে জেগেছে সেটা তাঁর না। সেটা হারেমের এক খিদমতগার, বারলাসের বেটে আর মোটা একটা মহিলা যার মুখের ত্বক আখরোটের মতো বলিরেখায় পূর্ণ।

সুলতান, আমায় মার্জনা করবেন, হুমায়ুনের নগ্ন দেহের উপর থেকে বারলাস নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বার্তাবাহক পূর্ব দিক থেকে এসেছে, সে বলছে আপনার ভাই আসকারির কাছ থেকে জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছে। এখন যদিও অনেক সকাল, সে অবিলম্বে আপনার সাথে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছে এবং কাশিম আমাকে আদেশ করেছে আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সংবাদটা জানাতে।

বারলাসের দিকে হুমায়ুন অমনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে কি বলছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে কিন্তু আফিম তার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে অনেক শ্লথ করে ফেলেছে। ঠিক আছে। আমি এখনই আমার আবাসনকক্ষে ফিরছি। কাশেমকে বলবে বার্তাবাহককে নিয়ে সেখানে আমার সাথে দেখা করতে।

নিজের আবাসনকক্ষে ফিরে এসে, চোখে মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে এবং বেগুনী রঙের একটা সাদাসিধে জোব্বা পরিহিত অবস্থায়, আধ ঘন্টা পরে হুমায়ুন পূর্বাঞ্চল থেকে আগত লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে যার আগমনের কারণে বিশ্রামরত অবস্থা থেকে উঠে আসতে সে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘকায়, হালকা পাতলা গড়নের বার্তাবাহক লোকটার ঘামের দাগ লেগে থাকা কাপড় তখনও রাস্তার ধূলোয় ধুসরিত। হুমায়ুনের সাথে কথা বলার জন্য অতিশয় ব্যগ্র থাকায় সে অভিবাদন জ্ঞাপনের কৃত্যানুষ্ঠান প্রায় ভুলতে বসেছিল যতক্ষণ না কাশেম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তাকে সে কথা মনে করিয়ে দেয়। নতজানু অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই সে কথা শুরু করে। সুলতান, আমার নাম কামাল। জৌনপুরে আপনার ভাই আসকারির অধীনে আমি কাজ করি। সেখানে শের শাহের নেতৃত্বে একটা জোরাল বিদ্রোহের কথা আমাদের কানে এসেছে। আপনার ভাই বিষয়টা কতখানি বস্তুনিষ্ট সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন তারপরেই আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে সর্তক করতে।

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে তাকিয়ে থাকে। শেরশাহ বাংলায় যদিও বিশাল একটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু ঘোড়া বিক্রেতার নাতি নিশ্চয়ই তাকে হুমকি দেবার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করবে না। মোগলদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে নিজে বাবরের কাছে মুচলেকা দিয়েছে। উচ্চাকাঙ্খ অবশ্য অনেক সময়েই মানুষকে হঠকারী পথের দিকে নিয়ে যায়। সে শের উপাধি গ্রহণ করেছে, যার মানে ব্যাঘ, ব্যাপারটা সম্ভবত একটা অশুভ ইঙ্গিত বহন করে। সম্ভবত সত্যিকারের ব্যাঘ্র রাজবংশ- মোগলদের, সরাসরি দ্বৈরথে আহবান জানাবার অভিপ্রায়ে সে এসব করছে। হুমায়ুন তার আঙ্গুলের তৈমূরীয় অঙ্গুরীয়টার দিকে তাকায়, কিন্তু আফিমের কারণে তখনও তার চোখের মণি প্রসারিত হয়ে থাকায়, সে অঙ্গুরীয়টার উপরিতলে খোদাই করা ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের খোদাই করা প্রতিকৃতির উপরে ঠিকমতো ফোকাস করতে পারে না।

 

ভাগ্যের পরিহাস - ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
ভাগ্যের পরিহাস – ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

হুমায়ুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বার্তাবাহকের প্রতি পুনরায় নিজের মনোযোগ নিবদ্ধ করে। আমাকে আরও খুলে বল।

শেরশাহ মোগল এলাকার একটা বিশাল অংশ নিজের বলে দাবী করছে। সে নিজেকে মোগলদের বিরুদ্ধে সমগ্র হিন্দুস্তানের প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং শপথ নিয়েছে তৈমূরের বংশে জন্ম নেয়া সব যুবরাজের কবল থেকে হিন্দুস্তানকে রক্ষা করবে। এমনকি সবচেয়ে গর্বিত গোত্রপতিরাও ক্রমশ তাঁর বশংবদে পরিণত হচ্ছে। আপনার ভাইয়ের কাছ থেকে আমি আপনার জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছি যা আপনাকে সেখানে আসলে কি ঘটেছে তার সবকিছু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করবে- শেরশাহ কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে, তার প্রতি কতজন গোত্রপতি নিজেদের সমর্থন ঘোষণা করেছে…–চিঠিটা এখানে রয়েছে, উটের চামড়া দিয়ে তৈরী একটা থলি তার দিকে এগিয়ে দেয়।

ওটা আমার উজিরকে দেবে। আমি যখন বিশ্রাম নেব তখন আমি চিঠিটা পড়ে দেখবো।

বার্তাবাহক লোকটা বিস্মত দেখায় কিন্তু এক মুহূর্তও দেরী না করে সে থলিটা কাশিমের হাতে তুলে দেয়।

কাশিম- আপনি নিজে বিষয়টা লক্ষ্য করবেন যেন দূর্গের ভেতরে বার্তাবাহকের থাকা আর খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু কাশিমও তাঁর দিকে বিচিত্র ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। সে বুঝতে পারেনি যে তাড়াহুড়ো করে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কোনো লাভ হবে না। হুমায়ুনের মনের ঘোর যখন কেটে যাবে- পরে কখনও- তখন সে নিজের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে ভেবে দেখবে। এখন যাও। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।

বার্তাবাহক আর কাশিমের পেছনে দরজার পাল্লা বন্ধ হয়ে যেতে, হুমায়ুন গবাক্ষ দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। নির্মেঘ আকাশের বুকে একটা নিখুঁত কমলা রঙের চাকতির মতো সকালের সূর্য উঠছে। দূর্গের লাল বেলেপাথর এমন ভাবে আভা ছড়ায় যেন এক্ষুনি পুরো দূর্গটা আগুনের শিখায় ঝলসে উঠবে। হুমায়ুন চোখ কচলায় এবং তার পরিচারককে ইশারায় জানালার শুকনো ঘাসের তৈরী পর্দা টাট্টি নামিয়ে দিয়ে নির্মম উজ্জ্বলতাকে আড়াল করতে বলে যার ফলে তাঁর মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। শেরশাহের খবরটা সত্যিই আতঙ্কিত হবার মতো এবং তাকে অবশ্যই সমুচিত জবাব দিতে হবে কিন্তু তারও আগে তাঁর ঘুম দরকার আর এমন কিছু একটা করা যার ফলে তাঁর মন প্রশান্ত হবে। সে লাল রঙের সুগন্ধিযুক্ত রোজউডের তৈরী একটা কারুকার্যখচিত আলমারির দিকে এগিয়ে যায় এবং সেটা খুলে ভেতর থেকে গুলরুখের তৈরী সুরার একটা বোতল বের করে আনে। এটা তাকে সাহায্য করবে, করার তো কথা? সে বোতলটার ছিপি খুলে কিন্তু তখন তার মনে হয় মধ্যাহ্নের আগে শেরশাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সময় তাঁর মাথা পরিষ্কার থাকা দরকার। কিন্তু কি এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণটা মধ্যাহ্ন পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়। সে আকিক পাথরের তৈরী পানপাত্রে গুলরুখের তৈরী মিশ্রণটা ঢালে। কয়েক মিনিটের ভিতরের সে ভেসে যেতে থাকে আর প্রায় সাথে সাথে তার স্বপ্নের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা এসে ভর করে।

টাট্টিগুলো তুলে দাও আর সুলতানের সাথে আমাকে একটু একা থাকতে দাও, একটা ক্রুদ্ধ মহিলা কণ্ঠ শোনা যায়। হুমায়ুন। কণ্ঠটা এবার তাঁর নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে এবং ক্রমশ মনে হয় তার দিকে এগিয়ে আসছে। হুমায়ুন! শীতল পানি একটা ঝাপটা তাঁকে সচেতন করে তুলতে সে হাঁসফাঁস করে উঠে বসে। কোনোমতে চোখ খুলে সে খানজাদাকে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, হাতে পিতলের একটা খালি পানির কলসি আর দুচোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।

আপনি কি চান? হুমায়ুন নির্বোধের মতো খানজাদার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক বুঝতে পারে না আসলের ফুপিজান সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাকি এটাও একটা কল্পনা।

উঠে বস। তুমি একজন যোদ্ধা- একজন সম্রাট- কিন্তু তোমার সাম্রাজ্য যখন হুমকির সম্মুখীন তখন হারেমের একজন খোঁজার মতো মাদকাচ্ছন্ন অবস্থায় আমি তোমাকে অন্ধকার এক কোণে শুয়ে থাকতে দেখছি…আসকারির বার্তাবাহকের আগমন আর কি খবর সে নিয়ে এসেছে আমি এইমাত্র জানতে পেরেছি। তুমি তোমার উপদেষ্টামণ্ডলীদের তখনই কেন ডেকে পাঠাওনি?

আমি যখন প্রস্তুত হব তখন তাদের ডেকে পাঠাব…

নিজের দিকে একবার চেয়ে দেখো! খানজাদা রুবি দিয়ে কারুকাজ করা একটা আরশি তুলে নিয়ে সেটা হুমায়ুনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বার্ণিশ করা উপরিতলে সে বিষণ্ণ একটা মুখ আর বিস্ফারিত তারারন্ধ্রযুক্ত দূরাগত একজোড়া চোখ আর তাঁদের নীচে সৃষ্ট প্রায় গাঢ় বেগুনী বর্ণের থলের ছবি ফুটে উঠতে দেখে। খুবই পরিচিত মনে হওয়া মুখাবয়বের দিকে সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকে কিন্তু খানজাদা এক ঝটকায় আরশীটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারতে আরশীর ধাতব উপরিতল বেঁকে যায় আর অনেকগুলো রুবি স্থানচ্যুত হয়ে মেঝেতে খসে পড়ে। রক্তবিন্দুর মতো লাল পাথরগুলো মেঝেতে পড়ে থাকে।

খানজাদা হুমায়ুনের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে তার কাঁধ আকড়ে ধরে। আফিম তোমার স্মৃতি শক্তিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে…আরশিতে তুমি নিজেকেই নিজে চিনতে পারনি, তাই না? তুমি কে সেটা কি আমাকে তোমায় মনে করিয়ে দিতে হবে… তোমার সাহসিকতা, তোমার আব্বাজানের পক্ষে তোমার অগণিত যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস, তোমার নিয়তি আর মোগল রাজবংশের প্রতি তোমার দায়িত্বের কথা কি আমি তোমায় বলে দিব? আমরা কে- তৈমূরের উত্তরসূরী- আমরা- তুমি আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছি সবকিছু কি তুমি ভুলে গিয়েছে? আমি তোমাকে আগেও সতর্ক করতে চেষ্টা করেছি যে বাস্তবতার সাথে তোমার সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে আসছে কিন্তু তুমি আমার কথায় গুরুত্ব দাওনি। কিন্তু আমি এবার বাধ্য হব জোর করতে। তোমার ধমনীতে যে রক্ত বইছে আমার ধমনীতেও সেই একই রক্ত বইছে। তোমার আব্বাজান আমার ভাই- যার জন্য লড়াই করেছেন এতো কষ্ট সহ্য করেছেন, সেসব কিছু খোয়াবার ভয় ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়েই আমি ভীত নই।

ফুপিজান এসব কি বলছে? সহসা সে হুমায়ুনকে ছেড়ে দিয়ে, পেছনে হেলান দিয়ে বসে, নিজের ডান হাত দিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তিতে হুমায়ুনের একটা চড় বসিয়ে দেয়। খানজাদা পাগলের মতো তাঁকে আঘাত করতে থাকে। প্রথমে ডান গালে তারপরে তাঁর বাম গালে। তার গাল বেয়ে অঝোরে কান্নার ঢল নেমে আসে।

তুমি আবার আগের মতো হও। তোমার আব্বাজানের মনোনীত উত্তরাধিকারীর যোগ্য হয়ে উঠ, সে চিৎকার করে বলতে থাকে। আফিম আর কৃত্যানুষ্ঠানের এই জাল যা তোমার অমাত্যদের বিরূপ করে তুলছে আর শাসক হিসাবে তোমার যোগ্যতাকে আপোসপ্রবণ করে তুলেছে এসব পরিত্যাগ কর। তোমার বাবার মতোই তুমিও একজন যোদ্ধা। তারকারাজি কি বলছে সে সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা করা বন্ধ কর এবং বাবর যেমন প্রত্যাশা করতেন পারলে সেরকম হয়ে উঠ, দোহাই এই একটা কাজ কর!

ফুপিজান তাকে আঘাত করা বন্ধ করেছে কিন্তু তীব্র ব্যাথায় তার মনের কুয়াশা পরিষ্কার হতে শুরু করে। তিনি প্রথমে কথা শুরু করার পরে সেই কথাগুলো যা প্রথমে অর্থহীন মনে হয়েছিল ধীরে ধীরে অর্থবোধক হয়ে উঠতে থাকে। কথাগুলো তার মনের ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট অতীতের প্রতিচ্ছবি যা তারা তাঁর মানসপটে ভাসিয়ে তুলে- যুদ্ধের উন্মাদনা, অমাত্যদের সাথে মল্লযুদ্ধের সময় বা আব্বাজানের সাথে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে শিকারে যাবার সময়ে সে নিজের মাঝে যে আন্ত্রিক উত্তেজনা অনুভব করে। সেই প্রাণবন্ত, পরিপূর্ণ, পার্থিব জগত এক সময়ে সে নিজে যেখানে বাস করতো…

হুমায়ুন, আফিমের নেশা ত্যাগ কর…নেকাটা তোমাকে শেষ করে ফেলছে। আফিম তুমি কোথায় রাখো?।

কয়েকমাস আগে বাংলায় তার মনোনীত শাসনকর্তার প্রতিনিধিকে কাশিম আর বাইসানগার তার পরিবর্তে যখন পরামর্শ দিতে বাধ্য হয় তখন কাশিমের মৃদুকণ্ঠে, উচ্চারিত সতর্কবাণীর কথা তার মনে পড়ে যায়। সে যদি নিজে লোকটার সাথে কথা বলতো তাহলে হয়তো সে লোকটার আচরণে কোনো তারতম্য খেয়াল করতো বা কোনো নির্দেশনা দিতে পারতো যা শেরশাহকে বিদ্রোহ করা থেকে বিরত রাখতে পারতো? বা শেরশাহ সম্ভবত বাংলায় কি ঘটছে সে বিষয়ে তাঁর অনীহা সম্বন্ধে কোনভাবে জানতে পেরেছিল। হুমায়ুনের হাত ধীরে ধীরে তার গলায় মালার ঝুলতে থাকা লকেট স্পর্শ করে। সেটা খুলে নিয়ে সে লকেটটা খানজাদার হাতে তুলে দেয়। তারপরে, একইরকম মন্থরবেগে, সে তখনও আধখোলা অবস্থায় থাকা আলমারির দিকে হেঁটে যায় যেখানে সে গুলরুখের আফিম মিশ্রিত সুরার বোতল রাখে। বোতলের খোঁজে সে ভিতরে হাত দিলে ভেতরের অন্ধকারে গাঢ়, প্রায় বেগুনী বর্ণের তরল চিকচিক করে উঠে। এতো জ্ঞান, এতো আনন্দ এটা তার জন্য বয়ে নিয়ে এসেছে…চিন্তার এতো খোরাক যুগিয়েছে। কাশিম আর খানজাদার দাবী অনুযায়ী আসলেই কি এটা এতো ধ্বংসাত্মক শক্তির অধিকারী?

আমার মরহুম আব্বাজানও আমি সেবন করতেন… বোতলটা ফিরিয়ে দেবার সময় সে ধীরে ধীরে বলে।

হ্যাঁ, কিন্তু তোমার মতো না…বাবর আফিমকে কখনও তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা তার কোনো কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করতে দেননি। আফিমের জন্য সে কখনও তার অমাত্য, সেনাপতি বা বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের অবহেলা করেননি। কিন্তু তোমার ভিতরে এটা একজন সম্রাটকে দাসে পরিণত করেছে। তুমি আসক্ত হয়ে পড়েছে…ঠিক অনেকটা সেই মানুষটার মতো যে সুরা ভর্তি পুরো মশকটা খালি করার বাসনা ছাড়া একপাত্র সুরার স্বাদও উপভোগ করতে পারে না। হুমায়ুন এই সর্বনাশা নেশা তোমায় ছাড়তেই হবে, নতুবা এটা তোমাকে ধ্বংস করে ফেলবে। তোমার মরহুম আব্বাজানের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্য তুমি খোয়াবে। অনেক দেরী হয়ে যাবার আগে আফিমের নেশা ত্যাগ কর।

সে এখনও লুকান গোপনীয়তা আর আনন্দের উৎস বোতলজাত তরলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে তারপরে তখনও অশ্রুসিক্ত খানজাদার মুখের দিকে তাকায় এবং দেখে তাকে কতটা ভীত, কতটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। এবং সে ভালো করেই জানে যে এই ভয় হুমায়ুনের জন্য এবং তাঁর রাজবংশের জন্য সে যার একটা অংশ এবং যে বংশের জন্য সে নিজে অশেষ দুর্ভোগ সহ্য করেছে। তার মনের অলিন্দে জমে থাকা আফিমের বিষবাষ্প সরিয়ে ধীরে ধীরে খানজাদা ঠিক কথা বলেছে, কাশিমও ঠিকই বলেছিল এবং অন্যান্য সবাই যারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল তারাই ঠিক ছিল এই বোধটা তার মাঝে জন্ম নিতে থাকে। তাকে অবশ্যই শক্ত হতে হবে নিজের ভেতরে শক্ত। বাইরের কারো সহায়তা তার প্রয়োজন নেই। সহসা সে পুনরায় খানজাদার শ্রদ্ধা, তার সম্মতি লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সে তার ঘনিষ্ঠ পরামর্শকদের সাথে আর খানজাদার সাথে কেমন আচরন করেছে সেটা চিন্তা করে নিজের কাছেই লজ্জিত হয়ে উঠে।

হুমায়ুন, বোতলটা আমাকে দাও।

না, ফুপিজান। গবাক্ষের কাছে গিয়ে সে বোতলের তরল বাইরে ঢালতে থাকে তারপরে বোতলটা খালি হলে সেটা নীচের দিকে ছুঁড়ে ফেলতে নীচ থেকে বোতল ভাঙার একটা মৃদু, ভঙ্গুর শব্দ ভেসে আসতে শুনে। গুলরুখের মাদক মিশ্রিত সুরা আমি আর গ্রহণ করবো না- এটা আমি নিজে তাকে বলে দেবো। তৈমূরের এই অঙ্গুরীয়ের নামে আমি আপনার সামনে শপথ করছি যতই কঠিন হোক আমি আর কখনও আফিম বা সুরা পান করবো না। আমি গুলরুখকে তার কোনো এক ছেলের সাথে থাকবার জন্য পাঠিয়ে দেব। আমি আমার মরহুম আব্বাজানের বিশ্বাসের যোগ্য এটা আমি আপনার কাছে এবং সেই সাথে নিজের কাছে আবারও নতুন করে প্রমাণ করবো।

খানজাদা দুহাতে হুমায়ুনের মুখটা ধরে তার কপালে চুমু খায়। এই আসক্তি জয় করতে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আফিমের আসক্তি এতোটাই প্রবল যে সহজে এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। হুমায়ুন তুমি একজন মহান যোদ্ধা, বিশাল মনের মানুষ আমি সেটা সবসময়েই জানতাম তুমি আরও মহীয়ান হয়ে উঠবে।

আর আমি সবসময়েই জানি আপনি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।

আর এখন?

বার্তাবাহককে পুনরায় ডেকে এনে আমি তাকে পুনরায় প্রশ্ন করার আগে আপনি কিছুটা সময় আমার সাথে থাকেন। আমি চাই তার বক্তব্য আপনিও শোনেন। তার কথা যদি সত্য হয় তাহলে অবিলম্বে আমাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

সেদিন অপরাহ্নে হুমায়ুন তাঁর সিংহাসনে গিয়ে বসে। তার অমাত্য আর সেনাপতিরা তাঁর সামনে। সে যেমনটা আদেশ দিয়েছে তারা কেউই। এমনকি সে নিজেও দিনের নিয়ন্ত্রণকারী গ্রহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রঙের পোষাক পরিধান করেনি। খানজাদা ঠিকই বলেছিল। সে যে কৃত্যানুষ্ঠানের প্রচলন করেছিল তার ফলে দরবারে না এসেছিল একতা না একাগ্রতা। তাঁর অমাত্যদের শ্রদ্ধা আর বিশ্বস্ত তা তাঁকে অন্যভাবে অর্জন করতে হবে। এবং সেটা অর্জনের একটা পথ হল যুদ্ধের ময়দানে বিজয় হাসিল করা।

বার্তাবাহক কামালের বয়ে আনা সংবাদ আপনারা ইতিমধ্যে শুনেছেন। মোগলদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শেরশাহের হামলা আমাদের সম্মানের প্রতি প্রকাশ্যে অবমাননা যা আমি কখনও বরদাশত করবো না। সেনাবাহিনী প্রস্তুত হওয়া মাত্র আমরা এই ভুঁইফোড়ের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হব। এবং শেরশাহের সাথে আমার বিরোধের যখন নিষ্পত্তি হবে তখন আমি তাকে দাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেব, শেরশাহের পূর্ব পুরুষেরা যেমন অর্থব ঘোড়া কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিত।

হুমায়ুনের বক্তব্য শেষ হতে, বিগত মাসগুলোতে প্রায় স্তব্ধ হয়ে আসা দরবার কক্ষে একটা প্রবল গর্জন শোনা যায়। হুমায়ুনের সেনাপতিরা তাদের গোত্রের বহু প্রাচীন প্রথা অনুসারে নিজেদের ঢালের সাথে নিজেদের তরবারি আঘাত করতে থাকে এবং তাঁদের মন্দ্র কণ্ঠস্বরে একটা শ্লোগান ধীরে ধীরে ধ্বনিত হতে থাকে মির্জা হুমায়ুন, মির্জা হুমায়ুন, যা তাঁর ধমনীতে বহমান তৈমূরের রক্তের কথা ঘোষণা করে। হুমায়ুন তার সিংহাসনের একপাশের দেয়ালে অনেকটা উপরে অবস্থিত নক্সাকরা জাফরির দিকে তাকায় যার পেছনে দাঁড়িয়ে সে জানে যে খানজাদা তাঁকে দেখছে এবং তাঁর কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আরো একবার মোগল সম্রাট নিজের বাহিনীকে নেতৃত্ব দেবে। শান্তির কুশীলব হিসাবে সে হয়তো নিজেকে প্রমাণ করতে পারেনি কিন্তু একজন সেনাপতি হিসাবে সে নিজের দক্ষতা কি প্রমাণ করেনি?

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

cropped Bangla Gurukul Logo ভাগ্যের পরিহাস - ( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment