বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

দ্বিতীয় পর্ব – বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা

এক

টার্মিনাস-… গ্যালাকটিক ইতিহাসে যে ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে গ্রহটিকে বেছে নেয়া হয়েছিল, সে লক্ষ্য পূরণের পক্ষে গ্রহটির অবস্থান (ম্যাপ দেখুন) অদ্ভুত হলেও ছিল অনিবার্য। অবশ্যি অনেক লেখকই এই দ্বিতীয় ব্যাপারটির দিকে কখনো অঙ্গুলি নির্দেশ করার চেষ্টা করেননি। বিচ্ছিন্ন একটি সূর্যের একমাত্র গ্রহ টার্মিনাস গ্যালাকটিক কুণ্ডলির একেবারে প্রান্তে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে দরিদ্র এবং অর্থনৈতিক মূল্যের দিক থেকে নগণ্য এই গ্রহটিতে, এটি আবিষ্কারের পাঁচ শতাব্দী পরেও, বসতি স্থাপন করা হয়নি। বিশ্বকোষ রচয়িতাগণ-ই প্রথম আবাস গড়ে তোলেন এখানে।…

একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে ওঠার পর টার্মিনাস অবধারিতভাবেই ট্রানটর থেকে আসা মনোইতিহাসবিদদের দেহাংশ হয়ে রইল না আর। হয়ে উঠল তার অতিরিক্ত একটা কিছু। অ্যানাক্রিয়নীয় বিদ্রোহ এবং স্যালভর হার্ডিনের ক্ষমতা গ্রহণের পর…

–ইনসাইক্লোপীডিয়া গ্যালাকটিকা

.

উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত ঘরটির এক কোনায় তার ডেস্কে বসে ব্যস্তভাবে কাজ করছেন লুইস পিরেন। কাজের সমন্বয় করতে হয়েছে। প্রচেষ্টাকে সংগঠিত করতে হয়েছে। সুতোগুলো বুনতে হয়েছে এক বিশেষ প্যাটার্নে।

পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে; পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে নিজেদের থিতু করতে আর প্রথম ইনসাইক্লোপীডিয়া ফাউণ্ডেশনকে একটা সুষম ওয়ার্কিং ইউনিটে পরিণত করতে। কাঁচামাল যোগাড় করতে আর প্রস্তুতি নিতে বেরিয়ে গেছে পঞ্চাশটি বছর।

কাজটা করা গেছে। আর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে গ্যালাক্সির সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রয়াসের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হবে। তারপর প্রতি দশ বছর অন্তর নিয়মিত একটার পর একটা খণ্ড বের হতে থাকবে। সেই সঙ্গে চলতি ঘটনার ওপর বিশেষ আর্টিকল নিয়ে অতিরিক্ত খণ্ডও বেরোবে, যতদিন পর্যন্ত না

ডেস্কের নীরব বাজারটা জ্যান্ত হয়ে উঠতে অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে উঠলেন পিরেন। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন অ্যাপয়েন্টমেন্টটার কথা। ডোর রিলিজটা ঠেলে দিলেন তিনি, চোখের এক নির্লিপ্ত কোনা দিয়ে দেখতে পেলেন খুলে গেল দরজা, আর ভেতরে ঢুকল স্যালভর হার্ডিনের দশাসই দেহটা। মুখ তুলে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না পিরেন।

আপন মনে হাসলেন হার্ডিন। ব্যস্ত তিনি নিজেও। কিন্তু তাই বলে কাজের মধ্যে বাধা পেলে বা কেউ বিরক্ত করলে পিরেনের মতো এরকম রামগরুড়ের ছানা হয়ে যান না। ডেস্কের এপাশের চেয়ারটায় বসে পড়লেন তিনি। অপেক্ষা করতে থাকলেন।

কাগজের ওপর মৃদু খস খস শব্দ তুলে ছুটে চলেছে পিরেনের স্টাইলাসটা। ব্যস, আর সব শুনশান। গেঞ্জির পকেট থেকে একটা টু-ক্রেডিট কয়েন বের করলেন হার্ডিন। ছুঁড়ে দিলেন ওপরের দিকে। ডিগবাজি খেতে খেতে নামার সময় পয়সাটার মরিচাবিহীন ইস্পাত-শরীরের ওপর আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠল। ধরে ফেলে আবার ওপরের দিকে পয়সাটা ছুঁড়ে দিয়ে অলস চোখে আলোর প্রতিফলন দেখতে থাকলেন হার্ডিন। যে-গ্রহের প্রয়োজনীয় সব ধাতু আমদানি করতে হয়, সে-গ্রহের বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মরিচাবিহীন ইস্পাতই ভাল।

মুখ তুলে চোখ পিটপিট করে তাকালেন পিরেন। স্টপ দ্যাট! ঝামটে উঠলেন তিনি।

কী?

ওই ঘোড়ার ডিমের পয়সা ছোঁড়াছুঁড়ি। বন্ধ কর।

ও আচ্ছা। ধাতব চাকতিটা পকেটে চালান করে দিলেন হার্ডিন। তোমার কাজ শেষ হলে জানিও, কেমন? কৃত্রিম জলপ্রণালীর প্রজেক্টটা ভোটে তোলার আগে সিটি কাউন্সিল মিটিং-এ ফিরে যাব বলে কথা দিয়ে এসেছি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে ক্ষান্ত দিলেন পিরেন। আমি তৈরি। কিন্তু আশা করব, তুমি আমাকে শহর-সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে জ্বালাবে না। কথাটা খেয়াল রেখ, প্লীজ। আমার সমস্ত সময় ঐ ইনসাইক্লোপীডিয়ার জন্যে বরাদ্দ।

খবরটা শুনেছ? নির্লিপ্ত স্বরে হার্ডিন শুধোলেন।

কোন খবর?

যে-খবর টার্মিনাস সিটি আন্ট্রাওয়েভ সেট দুঘন্টা আগে রিসিভ করেছে। প্রিফেক্ট অভ অ্যানক্রিয়ন-এর রয়্যাল গভর্নর রাজা উপাধি গ্রহণ করেছেন।

বেশ তো, তাতে কী হয়েছে?

এম্পায়ার-এর কেন্দ্র থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, হার্ডিন জবাব দিলেন। আমরা অবশ্যি এরকম কিছু হবে বলে আশঙ্কা করছিলাম; কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। স্যানটানি, ট্র্যানটর আর খোদ ভেগা পর্যন্ত আমাদের অবশিষ্ট ট্রেড রুটের একেবারে মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানাক্রিয়ন। এখন আমাদের মেটাল আসবে কোত্থেকে? গত ছ মাসের মধ্যে আমরা স্টীল কিংবা অ্যালুমিনিয়ামের কোনো শিপমেন্ট যোগাড় করতে পারিনি, আর এবার থেকে অ্যানাক্ৰিয়নের রাজার অনুগ্রহ ছাড়া আদৌ যোগাড় করতে পারব না।

পিরেন অধৈর্যের সঙ্গে বললেন, তাহলে তার সাহায্যেই যোগাড় করার ব্যবস্থা কর।

বাট ক্যান উই? শোনো, পিরেন, যে সনদ অনুযায়ী এই ফাউণ্ডেশন স্থাপিত হয়েছে, সে-সনদ ইনসাইক্লোপীডিয়া কমিটির বোর্ড অভ ট্রাস্টিজকে পূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়েছে। টার্মিনাস শহরের মেয়র হিসেবে আমার ক্ষমতা স্রেফ এটুকুই যে, তুমি কাউন্টারসাইন করে অনুমতি দিলে তবেই আমি আমার নিজের নাকটা উড়িয়ে দিতে পারি, বা একটা হাঁচি দিতে পারি। সুতরাং, ব্যাপারটা নির্ভর করছে তোমার বোর্ড আর তোমার ওপর। শহরটার উন্নতি নির্ভর করছে গ্যালাক্সির অবাধ বাণিজ্যের ওপর। আর এই শহরের দোহাই দিয়ে বলছি, একটা ইমার্জেন্সি মিটিং ডাকো

থামো! ভোট কুড়ানো বক্তৃতায় কাজ হবে না। দেখ, হার্ডিন, টার্মিনাসে মিউনিসিপল গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে বোর্ড অভ ট্রাস্টিজের তরফ থেকে কোনো বাধা নেই। যেহেতু ফাউণ্ডেশন স্থাপিত হয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে, আর যেহেতু লোকজন ক্রমবর্ধমান হারে ইনসাইক্লোপীডিয়া-সংক্রান্ত-নয় এমন কাজে জড়িয়ে পড়ছে, সেহেতু এ-ধরনের একটা গভর্নমেন্টের প্রয়োজনীয়তা আমরা উপলব্ধি করি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সমস্ত মানবজ্ঞানের চূড়ান্ত সীমা নির্দেশক একটা ইনসাইক্লোপীডিয়া প্রকাশ করা এখন আর ফাউণ্ডেশনের প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নেই। হার্ডিন, আমরা একটা স্টেট-সোপার্টেড বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান। লোকাল পলিটিক্সে আমরা নাক গলাতে পারি না, গলাবও না।

লোকাল পলিটিক্স! পিরেন, দিস ইজ আ ম্যাটার অভ লাইফ অ্যাণ্ড ডেথ। নিজ শক্তিতে একটা যান্ত্রিক সভ্যতা চালাবার ক্ষমতা টার্মিনাস গ্রহের নেই। তার কারণ, মেটাল নেই এ-গ্রহের। তুমি নিজেও সেটা ভাল করে জান। গ্ৰহটার পাথুরে জমিতে লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম বা তেমন দামি কোনো কিছুর চিহ্ন নেই। অ্যানাক্ৰিয়নের রাজা যদি আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে ইনসাইক্লোপীডিয়ার কী হবে বলতে পার?

আমাদের ওপর? তুমি কি ভুলে গেছ যে আমরা খোদ ম্রাটের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের আওতায় আছি? প্রিফেক্ট অভ অ্যানাক্রিয়ন বা অন্য কোনো প্রিফেক্টের অধীন নই আমরা। কথাটা মাথায় গেঁথে নাও। আমরা সম্রাটের ব্যক্তিগত এলাকার অংশ। কেউ আমাদের গায়ে টোকা মারতে পারবে না। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা এম্পায়ারের আছে।

সেক্ষেত্রে এম্পায়ার অ্যানাক্ৰিয়নের রয়্যাল গভর্নরের এই বেয়াড়াপনা ঠেকাতে পারল না কেন? আর শুধু কি অ্যানার্জিয়ন? গ্যালাক্সির সবচেয়ে দূরবর্তী প্রিফেক্টগুলোর মধ্যে কমপক্ষে বিশটা, সত্যি বলতে গোটা পেরিফেরিই নিজেদের খেয়াল খুশিমত কাজ করে যাচ্ছে। এম্পায়ারের ওপর, এবং আমাদের রক্ষা করার ব্যাপারে এম্পায়ারের সামর্থ্যের ওপর আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই, কথাটা জানিয়ে রাখছি তোমাকে।

যত্তসব! রয়্যাল গভর্নর আর রাজা- এ-দুটোর মধ্যে তফাতটা কোথায়? এম্পায়ারের ভেতর একটু আধটু পলিটিক্স বরাবরই ছিল, এখনো আছে; উল্টো-সিধে কাজ কেউ না কেউ সব সময়ই করছে। গভর্নররা বিদ্রোহ করেছে আর সে কারণে কোনো কোনো ম্রাটের পতন হয়েছে, কেউ কেউ খুন হয়েছে। কিন্তু তাতে খোদ এম্পায়ারের কী হয়েছে? ফরগেট ইট, হার্ডিন। এটা আমাদের মাথাব্যথা নয়। আমরা বৈজ্ঞানিক, এটাই আসল কথা। আমাদের একমাত্র মাথাব্যথা হচ্ছে। ইনসাইক্লোপীডিয়া। ও, ভাল কথা, হার্ডিন, আমি তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম!

কী ব্যাপার?

তোমার ঐ পত্রিকাটার ব্যাপারে একটা কিছু কর তো! পিরেনের গলায় রাগ।

টার্মিনাস সিটি জার্নাল-এর কথা বলছ? ওখানে আমার হাত নেই। ওটা ব্যক্তিমালিকানাধীন। তা, কী করেছে পত্রিকাটা?

কয়েক হপ্তা ধরেই সুপারিশ করছে যেন ফাউণ্ডেশনের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনটা সরকারি ছুটির দিন বলে ঘোষণা করা হয় এবং বেশ জাঁকজমকের সাথে উদযাপন করা হয়।

কেন নয়? তিন মাসের মধ্যে ফার্স্ট ভল্টটা খুলবে রেডিয়াম ক্লক। এটাকে আমি একটা বড় ঘটনাই বব। তুমি বলবে না?

না। তার কারণ, এটা কোনো অর্থহীন প্রদর্শনীর উপলক্ষ নয়। ফার্স্ট ভল্ট আর সেটার খোলার বিষয়টা শুধু বোর্ড অভ ট্রাস্টিজের ব্যাপার। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটলে জনসাধারণকে জানানো হবে। এটাই শেষ কথা। দয়া করে এটা জার্নালকে জানিয়ে দিয়ো।

আমি দুঃখিত পিরেন; তুমি নিশ্চয়ই জান, সিটি চার্টার ছোট্ট একটা ব্যাপারে সবরকম নিশ্চয়তা দেয়, আর সেটা হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।

সিটি চার্টার দিতে পারে, কিন্তু বোর্ড অভ ট্রাস্টিজ দেয় না। হার্ডিন, টার্মিনাসে সম্রাটের প্রতিনিধি আমি, আর এ ব্যাপারে পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে আমাকে।

হার্ডিনের চেহারা দেখে মনে হল, তিনি মনে মনে এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনছেন। মুখ কালো করে তিনি বললেন, একটা খবর আছে আমার কাছে। তুমি যেহেতু সম্রাটের প্রতিনিধি, তাই লেটেস্ট খবরটা তোমাকেই দিতে চাই।

অ্যানক্রিয়ন সম্পর্কে? পিরেনের ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে চেপে বসল একটা আরেকটার ওপর। বিরক্তি বোধ করছেন তিনি।

হ্যাঁ। অ্যানার্জিয়ন থেকে একজন বিশেষ দূত পাঠানো হচ্ছে আমাদের এখানে। দুহপ্তার মধ্যে।

দূত? এখানে? অ্যানাক্রিয়ন থেকে? কিসের জন্যে?

উঠে দাঁড়ালেন হার্ডিন। চেয়ারটা ডেস্ক ঘেঁষে ঠেলে রাখলেন আবার। সেটা ভেবে বের করার একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে।

আর কিছু না বলে, কোনো বিদায় সম্ভাষণের তোয়াক্কা না করে, বেরিয়ে গেলেন তিনি।

.

দুই

ভদ্রলোকের নাম অ্যানসেল্ম হট রডরিক (মাঝের শব্দটা আভিজাত্যের প্রতীক)। পুমার সাব-প্রিফেক্ট; অ্যানাক্রিয়নের রাজার বিশেষ দূত। আরো আধ ডজন উপাধি আছে তার। রাষ্ট্রীয় উপলক্ষের যাবতীয় আঁকাল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে স্পেস পোর্টে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল স্যালভর হার্ডিনের।

মুখে আড়ষ্ট হাসি নিয়ে মৃদু বাউ করে হোলস্টার থেকে তার ব্লাস্টারটা বের করলেন সাব-প্রিফেক্ট। বাটের দিকটা বাড়িয়ে দিলেন হার্ডিনের দিকে। উপহার গ্রহণ করলেন হার্ডিন। তারপর বিশেষভাবে আজকের অনুষ্ঠানের জন্যে ধার করে আনা আরেকটা ব্লাস্টার দিয়ে তিনি শুভেচ্ছা জানালেন অতিথিকে। স্থাপিত হল বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য। হট রডরিকের কাঁধের অতি সামান্য স্ফীত যদিও লক্ষ্য করেও থাকেন হার্ডিন বিচক্ষণের মতো চুপ করে রইলেন তিনি।

পর্যাপ্ত সংখ্যক পদস্থ কর্মকর্তার অভ্যর্থনা গ্রহণ শেষে একটা গ্রাউণ্ড কারে চড়ে বসলেন দুজন। ধীর গতিতে, রাজকীয় ভঙ্গিমায়, সাইক্লোপীডিয়া স্কোয়ারের উদ্দেশে এগিয়ে চলল সেটা। পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে অত্যুৎসাহী জনতা সোল্লাসে হাত নেড়ে তাদের শুভেচ্ছা জানাল। জনতার সেই হর্ষধ্বনি অতিথি যেরকম সৌজন্যপূর্ণ নির্লিপ্ততার সঙ্গে গ্রহণ করলেন তা তার মতো একজন সৈনিক ও সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তিকেই মানায়।

হার্ডিনের উদ্দেশে তিনি বললেন, এই শহর নিয়েই বুঝি আপনাদের গোটা বিশ্ব?

কোলাহলের ওপর গলা চড়িয়ে হার্ডিন জবাব দিলেন, আমাদের রাজ্যটা খুবই ছোট, ইওর এমিনেন্স। আমাদের এই দরিদ্র গ্রহের মাত্র কয়েক বছরের ইতিহাসে অল্প কয়েক জন সম্ভ্রান্ত অতিথি এসেছেন। সেজন্যই এতো উৎসাহ-উদ্দীপনা।

নিশ্চিত করেই বলা যায়, সম্ভ্রান্ত শব্দটার ভেতরের প্রচ্ছন্ন শ্লেষটা সম্মানিত অতিথি ধরতে পারেননি।

গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, পঞ্চাশ বছর ধরে আছেন আপনারা এখানে। হুম–! তাহলে তো প্রচুর জমি আছে আপনাদের, মেয়র। এগুলো এস্টেটে ভাগ করে দেবার কথা ভাবেননি আপনারা?

এখনো তার প্রয়োজন পড়েনি। আমরা পুরোপুরি সেন্ট্রালাইজড়। ইনসাইক্লোপীডিয়ার জন্যেই সেন্ট্রালাইজড় হতে হয়েছে আমাদের। যখন জনসংখ্যা বাড়বে তখন হয়ত

অদ্ভুত এক জায়গা তো! ইউ হ্যাভ নো পেজনট্রি? চাষাবাদ করে না এখানে কেউ?

হিজ এমিনেন্স যে কথা বের করার চেষ্টা করছেন সেটা বোঝার জন্য খুব একটা বুদ্ধির দরকার হয় না, ভাবলেন হার্ডিন। গাছাড়াভাবে তিনি উত্তর দিলেন, না, সম্ভ্রান্তবংশীয় লোকও নেই কোনো।

হট রডরিকের ভুরু ধনুক হয়ে গেল। কেন- আপনাদের নেতা- যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি?

ড. পিরেনের কথা বলছেন? হ্যাঁ, তিনিই বোর্ড অভ ট্রাস্টিজ-এর চেয়ারম্যান। সম্রাটের ব্যক্তিগত প্রতিনিধিও বটে।

ডক্টর? অন্য কোনো উপাধি নই তাঁর? স্রেফ একজন স্কলার? তিনিই জনসাধারণের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরান?

অবশ্যই, অমায়িকভাবে জবাব দিলেন হার্ডিন। স্কলার আমরা কম-বেশি সবাই। আফটার অল, আমরা তো একটা সায়েন্টিফিক ফাউণ্ডেশনের মতো কোনো বিশ্ব নই, বরং সম্রাটের একেবারে প্রত্যক্ষ শাসনের আওতার ভেতরই আছি।

মেয়র তাঁর বাক্যের শেষাংশে হালকা একটু জোর দেয়ায় সামান্য অপ্রতিভ বোধ করলেন সাব-প্রিফেক্ট। সাইক্লোপীডিয়া স্কোয়ার পর্যন্ত ধীর গতির বাকি যাত্রাটুকুতে আর কোনো কথা না বলে গম্ভীর মুখ কী যেন ভাবতে লাগলেন।

বিকেল এবং সন্ধ্যা একঘেয়েমিতে কাটলেও হার্ডিন অন্তত এটা দেখে স্বস্তি পাচ্ছিলেন যে পিরেন এবং হট রডরিক একে অপরের সংসর্গ অপছন্দ করছেন আরো বেশি; যদিও প্রথম সাক্ষাতের সময় তারা বেশ সরবেই পারস্পরিক সৌজন্য এবং সৌহার্দ্য বিনিময় করেছেন।

ইনসাইক্লোপীডিয়া বিল্ডিং-এ ইন্সপেকশন ট্যুরের সময় জ্বলজ্বলে চোখে পিরেনের লেকচার শুনলেন হট রডরিক। রেফারেন্স ফিল্ম-এর বিশাল বিশাল সব স্টোর হাউস আর অগুনতি প্রজেকশন রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মুখে একটা মার্জিত, অর্থহীন হাসির মুখোশ এঁটে শুনে গেলেন তিনি পিরেনের বকবকানি।

লেভেলের পর লেভেল নেমে কম্পোজিং ডিপার্টমেন্ট, এডিটিং ডিপার্টমেন্ট, পাবলিশিং ডিপার্টমেন্ট এবং ফিল্মিং ডিপার্টমেন্ট- সব দেখার পরই কেবল প্রথম একটা অর্থপূর্ণ মন্তব্য করলেন তিনি। পুরো ব্যাপারটাই খুব ইন্টারেস্টিং। কিন্তু পূর্ণবয়স্ক লোকদের কাজ হিসেবে বেশ অদ্ভুত। কী লাভ এতে?

হার্ডিন লক্ষ্য করলেন, হট রডরিকের এই মন্তব্যের জবাবে পিরেন কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না। যদিও তাঁর চেহারায় এমন একটা ভাব ফুটে উঠল যে ইচ্ছে করলেই তিনি জুতসই একটা কিছু শুনিয়ে দিতে পারেন।

রাতে, ডিনারের সময়, বিকেলের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটল। কথকের ভূমিকাটা এবার একচেটিয়াভাবে নিলেন হট রডরিক। অ্যানাক্রিয়ন এবং সদ্য রাজ্য বলে ঘোষিত প্রতিবেশী স্মিরনোর মধ্যেকার সাম্প্রতিক যুদ্ধে ব্যাটালিয়ান প্রধান হিসেবে তাঁর নিজের ভূমিকার কথা অপরিমিত এবং অবিশ্বাস্য উৎসাহের সঙ্গে, প্রতিটি খুঁটিনাটিসহ বলে গেলেন তিনি।

ডিনার শেষ হয়ে গেল, খুদে অফিসাররা একে একে কেটে পড়লেন, তার পরেও তাঁর গল্প ফুরল না; পিরেন এবং হার্ডিনকে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। গ্রীষ্মসন্ধ্যার উষ্ণ হাওয়া উপভোগ করতে করতে খণ্ড-বিখণ্ড স্পেস শিপের উল্লসিত বর্ণনা দিয়ে তবেই তিনি তাঁর বিজয়-গাথার সমাপ্তি টানলেন।

আমুদে গলায় তারপর বললেন, এবার তাহলে একটু সিরিয়াস ব্যাপারে যাওয়া যাক।

বাঁচি তাহলে, বিড়বিড় করে হার্ডিন বললেন। ভেগা-র তামাক দিয়ে তৈরি একটা লম্বা সিগার ধরালেন তিনি। আর অল্প কয়েকটা আছে, ভাবলেন মনে মনে। পেছনের দুপায়ের ওপর দাঁড় করালেন চেয়ারটাকে।

আকাশে, অনেক উঁচুতে অস্পষ্ট একটা লেন্সের আকার নিয়ে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে আছে গ্যালারি। মহাবিশ্বের এই প্রান্তসীমায় অল্প যে-কটা তারা মিটিমিটি করছে, অন্য অংশের তুলনায় সেগুলো নেহাতই নগণ্য।

সাব-প্রিফেক্ট বললেন, অবশ্যি কাগজ-পত্তর সই থেকে শুরু করে এ-ধরনের যাবতীয় একঘেয়ে, আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলো আপনাদের কাউন্সিলের সামনেই সারব। ভাল কথা, কী যেন নাম আপনাদের কাউন্সিলের?। বোর্ড অভ ট্রাস্টিজ, ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন পিরেন।

অদ্ভুত নাম তো! সে যাই হোক, ওসব আগামীকালের জন্যই রইল। এখন বরং কিছু ছোটখাটো বিষয়ে আলাপ সেরে আগাছা পরিষ্কার করে রাখি খানিকটা। কি বলেন?

অর্থাৎ- হার্ডিন একটা খোঁচা দিতে চাইলেন।

স্রেফ এই যে, পেরিফেরির পরিস্থিতিতে সামান্য একটু পরিবর্তন ঘটেছে আর তার ফলে আপনাদের গ্রহের সামাজিক মর্যাদা খানিকটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে। খুব ভাল হতো, যদি গোটা অবস্থাটা সম্পর্কে আমরা একটা আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং-এ পৌঁছুতে পারতাম। ভাল কথা, মেয়র, আপনার ঐ সিগার আর আছে?

অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা বের করে দিলেন হার্ডিন।

অ্যানসেল্ম হট রডরিক সিগারটা নাকের কাছে নিয়ে শুকলেন একবার। চাপা একটা হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। ভেগান টোবাকো! পেয়েছেন কোত্থেকে?

লাস্ট শিপমেন্টে কিছু এসেছিল। আর নেই বললেই চলে। স্পেস জানে, আবার কবে পাবো, বা আদৌ পাবো কিনা।

পিরেন ভ্রুকুটি করলেন। ধূমপান করেন না তিনি- গন্ধটাও সহ্য করতে পারেন

একেবারে। একটা ব্যাপার বুঝতে দিন আমাকে, ইওর এনিমেন্স। আপনার মিশনের উদ্দেশ্য তো শুধু ঘুরেফিরে দেখা?

এরি মধ্যে সিগারে জম্পেস কয়েকটা টান দিয়ে, ধোঁয়া ছেড়ে, নিজেকে ঢেকে ফেলেছেন হট রডরিক। সেই ধোঁয়ার আড়াল থেকে মাথা ঝাঁকালেন তিনি।

সেক্ষেত্রে সেটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এক নম্বর ইনসাইক্লোপীডিয়া ফাউণ্ডেশন বরাবর একই রকম আছে।

আচ্ছা। তা, এটা কী অবস্থায় আছে?

একটা স্টেট-সাপোর্টেড বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের এবং মহামান্য সম্রাটের ব্যক্তিগত এলাকার একটা অংশ হিসেবে।

সাব-প্রিফেক্ট প্রভাবিত হয়েছেন বলে মনে হল না। ধোয়ার বলয় ছাড়লেন তিনি আরেকটা।

এটা একটা চমৎকার থিয়োরি, ড. পিরেন। ধরে নিতে পারি, ইম্পেরিয়াল সীল-এর ছাপ মারা সনদও আছে আপনাদের কাছে; কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটা কী? স্মিরনোর বিপরীতে আপনাদের অবস্থান কোথায়? স্মিরনোর রাজধানী থেকে আপনাদের দূরত্ব পঞ্চাশ পার্সেক-ও নয়, আপনি জানেন। কোনোম আর ড্যারিবো থেকে?

পিরেন উত্তর দিলেন, কোনো প্রিফেক্টের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। সম্রাটের ব্যক্তিগত এলাকার অংশ হিসেবে-

গোল্লায় যাক আপনার বিজ্ঞান। ঝামটে উঠলেন রডরিক। স্মিরনো যেখানে যে কোনো সময় টার্মিনাস দখল করে নিতে পারে, সেখানে বিজ্ঞান কী করবে?

আর সম্রাট? তিনি চেয়ে চেয়ে দেখে যাবেন শুধু?

 

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

শান্ত হয়ে এলেন হট রডরিক। বললেন, ঠিক আছে, ড. পিরেন, বুঝলাম আপনি সম্রাটের সম্পত্তির ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল, অ্যানাক্রিয়নও তাই; কিন্তু স্মিরনো তা না-ও হতে পারে। মনে রাখবেন, মাত্র কিছুদিন আগে সম্রাটের সঙ্গে একটা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি আমরা। আগামীকাল আপনাদের বোর্ড অভ ট্রাস্টিজকে তার একটা কপি দেখাব। আর সেই চুক্তিতে প্রিফেক্ট অভ অ্যানাক্রিয়নের সীমান্তের ভেতরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে আমাদের ওপর। অবশ্যই সেটা সম্রাটের পক্ষ থেকে। আমাদের কর্তব্যটা কী, সেটা পরিষ্কার হয়েছে নিশ্চয়ই?

অবশ্যই। কিন্তু টার্মিনাস তো প্রিফেক্ট অভ অ্যানাক্ৰিয়নের অংশ নয়।

আর স্মিরনো-

প্রিফেক্ট অভ স্মিরনোর অংশ-ও নয় এটা। কোনো প্রিফেক্টেরই অংশ নয় টার্মিনাস।

স্মিরনো কী সেটা জানে?

স্মিরনো কী জানে আর না জানে, আমি তার পরোয়া করি না।

আমরা করি। এই কিছুদিন আগে একটা যুদ্ধ শেষ করলাম আমরা ওদের সঙ্গে। স্মিরনো এখনো আমাদের দুটো স্টেলার সিস্টেম দখল করে আছে। এই দুই জাতির মাঝখানে একটা অত্যন্ত স্ট্রাটেজিক স্পটে রয়েছে টার্মিনাস।

ক্লান্ত বোধ করলেন হার্ডিন এতো কথার ফুলঝুরি দেখে। নাক গলালেন তিনি। আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?

মনে হল, আর কথা না ঘুরিয়ে সরাসরি মূল প্রসঙ্গে যাবার জন্যে তৈরি-ই ছিলেন সাব-প্রিফেক্ট। তিনি চটপট উত্তর দিলেন, একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার। টার্মিনাস যেহেতু নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না, তাই অ্যানাক্রিয়নকে তার নিজের স্বার্থেই গ্রহটাকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আপনাদের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যাপারে নাক গলাবার কোনো ইচ্ছে আমাদের নেই।

হুঁহু-হুঁ, একটু ঘেঁৎ ঘোঁৎ করে উঠলেন হার্ডিন।

-কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, সবচেয়ে ভাল হবে যদি এ-গ্রহে অ্যানাক্ৰিয়নের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়।

আর আপনারা কি শুধু এটাই চান- মালিকানাবিহীন একটা বিশাল এলাকা জুড়ে একটা সামরিক ঘাঁটি- আর কিছু নয়?

দেখুন, প্রোটেক্টিং ফোর্সের ভরণপোষণের ব্যাপারটা তো থাকবেই।

হার্ডিনের চেয়ারটার বাকি দুটো পায়া সশব্দে নেমে এল মেঝেতে। হাঁটুর ওপর দুই কনুই রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন হার্ডিন। এতক্ষণে আসল কথায় এসেছি আমরা। আরো ভোলালা করা যাক ব্যাপারটা। টার্মিনাসকে একটা আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হতে হচ্ছে এবং নজরানা দিতে হচ্ছে।

নজরানা নয়, কর। আমরা আপনাদের রক্ষা করছি, আর সেজন্য আপনারা আমাদের দাম দিচ্ছেন।

প্রচণ্ড শব্দে চেয়ারের হাতলে একটা চাপড় বসালেন পিরেন। আমাকে কথা বলতে দাও, হার্ডিন। ইওর এমিনিন্স, অ্যানাক্রিয়ন, স্মিরনো বা আপনার ঐ লোকাল পলিটিক্স আর ফালতু যুদ্ধের কানাকড়িও মূল্য নেই আমার কাছে। আমি আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি, এটা একটা স্টেট-সাপোর্টেড ট্যাক্স-ফ্রি ইন্সটিটিউশন।

স্টেট-সাপোর্টেড? কিন্তু স্টেট তো আমরাই, ড. পিরেন। অ্যাণ্ড উই আর নট সাপোটিং।

রাগে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলেন পিরেন। ইওর এমিনেন্স, আমি মহামান্য সম্রাটের–

প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি, তিক্ত কণ্ঠে পাদপুরণ করলেন অ্যানসেলুম হট রডরিক। আর আমি অ্যানাক্ৰিয়নের রাজার প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। অ্যানক্রিয়ন কিন্তু আরো অনেক কাছে ড. পিরেন।

কাজের কথায় ফেরা যাক, তাড়া দিলেন হার্ডিন। তথাকথিত এই কর আপনারা কীভাবে নেবেন, ইওর এমিনেন্স? মানে বলতে চাইছ, কী নেবেন- গম, আলু, শাক-সজ্বি, নাকি গবাদি পশু?

মুহূর্তে চোখ দুটো বড় হয়ে গেল সাব-প্রিফেক্টের। কী যা-তা বলছেন! ওসব দিয়ে কী করব আমরা? অঢেল আছে আমাদের ওগুলো। অবশ্যই সোনা নেব। আর যদি আপনাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্রোমিয়াম বা ভ্যানাডিয়াম থাকে তাহলে তো কথাই নেই।

হো হো করে হেসে উঠলেন হার্ডিন। লোহা-ই পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই আমাদের, তো সোনা আর ক্রোমিয়াম! আমাদের মুদ্রার চেহারাটা একটু দেখুন তো। দূতের দিকে একটা পয়সা ছুঁড়ে দিলেন তিনি।

হট রডরিক সেটা লুফে নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন। কী এটা? স্টীল?

ঠিক ধরেছেন।

কিছুই বুঝতে পারছি না।

টার্মিনাস গ্রহে কোনো ধাতু নেই। সব ধাতু আমরা আমদানি করি। দাম দেবার মতো কিছু নেই আমাদের না সোনা, না অন্য কিছু। অবশ্যি যদি কয়েক হাজার বুশেল আলু চান তো দিতে পারি।

তাহলে- ম্যানুফ্যাকচার্ড গুডস্ দিলেই চলবে।

ধাতু ছাড়া ম্যানুফ্যাকচার্ড গুডস্! আমাদের মেশিন তৈরি করছি কী দিয়ে আমরা?

খানিকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না। অতঃপর পিরেন নীরবতা ভঙ্গ করলেন। গোটা আলোচনাটাই অপ্রাসঙ্গিক। টার্মিনাস কোনো গ্রহই নয়। একটা সায়েন্টিফিক ফাউণ্ডেশন, যা বিশাল এক ইনসাইক্লোপীডিয়া তৈরি করছে। স্পেসের দোহাই, বিজ্ঞানের প্রতি কি আপনাদের কোনো শ্রদ্ধা নেই?

ইনসাইক্লোপীডিয়া দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায় না। হট রডরিকের ভুরু জোড়া কুঁচকে গেছে। পুরোপুরি অনুৎপাদনশীল গ্রহ একটা একরকম বন্ধ্যাই বলা যায়। তা, বেশ তো, জমি দিতে পারেন আপনারা।

কী বলতে চাইছেন? জিগ্যেস করলেন পিরেন সচকিত হয়ে।

গ্রহটা প্রায় পুরোই খালি। আর মালিকানাবিহীন জমিগুলো সম্ভবত উর্বরও। অ্যানাক্ৰিয়নে অভিজাত শ্রেণীর অনেকেই আছেন যাঁরা তাঁদের এস্টেটের পরিমাণ বাড়াতে ইচ্ছুক।

আপনি এধরনের প্রস্তাব করতে পারেন না–

এত ভয় পাবার কিছু নেই, ড. পিরেন। আপনাদের যত খালি জমি আছে তাতে আমাদের সবার হয়েও বেশি হয়ে যাবে। পরিস্থিতি যদি সে পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়। আর আপনার সাহায্য করেন, তাহলে আপনাদের যাতে লোকসান না হয় সে ব্যবস্থা আমরা করতে পারব। হয়ত উপাধি পেয়ে গেলেন গোটাকতেক, সেই সঙ্গে এস্টেটও বরাদ্দ করা হল আপনাদের দুজনের নামে। আমার কথা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?

ব্যাঙ্গাত্মক একটা হাসি হেসে পিরেন শুধু বললেন, ধন্যবাদ!

ঠিক সেই মুহূর্তে ভালমানুষের মত মুখ করে একটা প্রশ্ন করে বসলেন হার্ডিন, আচ্ছা, আমাদের অ্যাটমিক-পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুটোনিয়াম সাপ্লাই দিতে পারবে অ্যানাক্রিয়ন? আমাদের যা আছে তা দিয়ে আর মাত্র কয়েক বছর চলবে।

মুহূর্তের জন্যে হাঁ হয়ে গেলেন পিরেন, বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললেন না। শেষ পর্যন্ত হট রডরিক যখন মুখ খুললেন তার গলা একেবারে অন্যরকম শোনাল।

আপনাদের অ্যাটমিক পাওয়ার আছে?

অবশ্যই! এতে অবাক হবার কী হল? অ্যাটমিক পাওয়ার তো আমার জানা মতে পঞ্চাশ হাজার বছরের পুরনো জিনিস। আমাদের থাকবে না কেন? পুটোনিয়াম পাওয়াটাই একটু সমস্যা, এই যা।

হ্যাঁ… হ্যাঁ, থেমে গেলেন দূত ভদ্রলোক। তারপর কোনো রকমে জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে- কাল এ-ব্যাপারে আলাপ করা যাবে। যদি কিছু মনে না করেন আমি তবে-

হট রডরিকের গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পিরেন। দাঁতে দাঁত ঘষে বলে উঠলেন, মাথামোটা, জঘন্য গাধা একটা! একটা-

হার্ডিন মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মোটেই তা নয়। লোকটা কেবল তার পরিপার্শ্বের একটা প্রোডাক্ট মাত্র। আমার কাছে একটা বন্দুক আছে, তোমার কাছে নেই এই ব্যাপারটার বাইরে আর তেমন কিছু বোঝে না সে।

রেগে হার্ডিনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন পিরেন। ঐ সামরিক ঘাঁটি আর নজরানা নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলে কী করতে তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল নাকি তোমার?

না। আমি স্রেফ লোকটাকে দিয়ে কথা বলিয়ে নিয়েছি। খেয়াল করেছ নিশ্চয়ই, অ্যানাক্ৰিয়নের আসল উদ্দেশ্য অর্থাৎ টার্মিনাসের ভূ-সম্পত্তি গ্রাস করার ব্যাপারটা প্রথমে বলতে চায়নি লোকটা। তবে অবশ্যই আমি সেটা হতে দিচ্ছি না।

তুমি হতে দিচ্ছ না! কিন্তু তুমি কে হে বাপু? আর বলো তো দেখি, কোন আক্কেলে তুমি আমাদের অ্যাটমিক-পাওয়ার প্ল্যান্টের কথা ফাঁস করে দিলে? কাজটা করে তুমি আমাদের একটা মিলিটারি টার্গেটে পরিণত করলে।

হ্যাঁ ঠিকই বলেছ, দাঁত বের করে হাসলেন হার্ডিন। এমন এক মিলিটারি টার্গেট যার কাছ থেকে সরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। কেন কথাটা তুলেছিলাম সেটা কি পানির মতো পরিষ্কার নয়? আমার একটা ঘোরতর সন্দেহের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমি প্রসঙ্গটা তুলে।

তা সেই সন্দেহটা কী?

সেটা হচ্ছে, এখন আর অ্যাটমিক-পাওয়ার অর্থনীতি নেই অ্যানাক্রিয়নের। যদি থাকতো, তাহলে আমাদের বন্ধুবরের এটা জানা থাকত যে, পাওয়ার প্ল্যান্টে এখন আর প্লটোনিয়াম ব্যবহার করা হয় না; প্রাচীনকালে হতো অবশ্যি। সুতরাং এতে করে বোঝা যাচ্ছে, পেরিফেরির বাকি অংশে অ্যাটমিক-পাওয়ার নেই। স্মিরনোর যে নেই তা তো সহজেই বোঝা যায়, কারণ সেক্ষেত্রে অ্যানাক্ৰিয়নের পক্ষে ওদের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে ওঠা সম্ভব হতো না। ইন্টারেস্টিং, কি বল?

ঘোঁৎ জাতীয় একটা শব্দ করে পিরেন চলে গেলেন।

মুচকি হাসলেন হার্ডিন।

ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি হাতের সিগারটা। ওপরের সুবিস্তৃত গ্যালাক্সির দিকে মুখ তুলে তাকালেন। তেল আর কয়লার যুগে ফিরে গেল নাকি ওরা? বিড় বিড় করে আপন মনে প্রশ্ন করলেন তিনি। ভাবনার বাকি অংশটা আর বের না করে চেপে রাখলেন ভেতরেই।

.

তিন

জার্নাল-এর মালিকানার কথাটা অস্বীকার করে হার্ডিন সত্যি কথাই বলেছেন। তবে সেটা শুধু কথার মারপ্যাঁচ, তার বেশি কিছু নয়। গোটা টার্মিনাসকে একটা স্বায়ত্তশাসিত পৌরনগরে পরিণত করার যে চেষ্টা চলছে, হার্ডিন তার প্রাণপুরুষ। টার্মিনাসের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিনিই। কাজেই এতে অবাক হবার কিছু নেই যে, যদিও জার্নাল স্টকের একটা শেয়ারও তার নামে নেই, একটু ঘুরপথে এসব শেয়ারের ষাট শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।

করার উপায়ও আছে।

আর সেজন্যেই, এটা মোটেই কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে, হার্ডিন যখন বোর্ড অভ ট্রাস্টিজ-এর মিটিং-এ তাঁকে অংশগ্রহণ করতে দেয়ার ব্যাপারে পিরেনকে পীড়াপীড়ি করতে লাগনে, ঠিক সেই সময়েই জার্নাল ঐ একই বিষয়ের পক্ষে লেখালেখি শুরু করল। শুধু তাই নয়, ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট-এ শহর-এর প্রতিনিধিত্বের দাবিতে ফাউণ্ডেশনের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো একটা জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।

শেষ পর্যন্ত মুখ ভার করে হলেও রাজি হতে হলো পিরেনকে।

টেবিলের এক মাথায় বসে হার্ডিন ভাবছিলেন, ফিজিক্যাল সায়েন্টিস্টরা প্রশাসনিক কাজে কেন এত খারাপ হন। তার একটা কারণ হয়ত এই যে, অনমনীয় অপরিবর্তনীয় তথ্য নিয়ে কাজ করতেই অতি মাত্রায় অভ্যস্ত তারা। এবং নমনীয়, জনসাধারণ সম্পর্কে ঠিক ততটাই অনভ্যস্ত।

হার্ডিনের বাঁয়ে বসেছেন টোমাজ সাট এবং জর্ড ফারা; লানডিন ক্রাস্ট আর ইয়েট ফুলহ্যাম ডাইনে। পিরেনও ডাইনে, সভাপতির আসনে। সবার সঙ্গেই পরিচয় আছে হার্ডিনের, তবে এই বিশেষ সভা উপলক্ষে গাম্ভীর্যের একটা বাড়তি মুখোশ পরে আছেন সবাই।

প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতার সময়টুকু ঝিমিয়ে পার করে দিলেন হার্ডিন। পিরেন তাঁর সামনে রাখা পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে কথা শুরু করতে নড়েচড়ে বসলেন তিনি।

বোর্ডকে একটা কথা জানাতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি। আমাদের শেষ মিটিং-এর পর এম্পায়ার-এর চ্যান্সেলর লর্ড ডরউইন আমাকে কথা দিয়েছেন, দু সপ্তাহের মধ্যেই টার্মিনাসে আসছেন তিনি। এটা একরকম ধরেই নেয়া যায় যে, বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করা হলে অ্যানাক্রনিয়নের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পুরোপুরি সহজ হয়ে যাবে।

মৃদু হেসে টেবিলের শেষ মাথায় বসে থাকা হার্ডিনের উদ্দেশে তিনি বললেন, এ-ব্যাপারে জার্নাল-কে তথ্য সূরবরাহ করা হয়েছে।

হার্ডিন চাপা হাসি হাসলেন একটু। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তাঁকে এই সুরক্ষিত দুর্গে পিরেন যেসব কারণে ঢুকতে দিয়েছেন তার একটা হচ্ছে তাঁকে এই তথ্যটা দেয়া।

শান্ত গলায় তিনি বললেন, লর্ড ডরউইন ঠিক কী করবেন বলে আশা কর তুমি, পরিষ্কার করে বলবে?

উত্তরটা এল টোমাজ সাটের কাছ থেকে। যখন বেশ একটা রাজকীয় মেজাজে থাকেন, লোকজনকে তখন তৃতীয় পুরুষে সম্বোধন করার একটা বদ-অভ্যাস আছে তাঁর।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, মেয়র হার্ডিন ন্যাকামোতে ওস্তাদ। ভদ্রলোকের এটা না বোঝার কথা নয় যে, তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুণ্ণ হোক এটা সম্রাট কোনোক্রমেই চাইবেন না।

কেন? ওরা তা করতে চাইলে তিনি কী করবেন?

বিরক্তিতে নড়েচড়ে উঠলেন পিরেন। বললেন, তুমি একেবারেই অকেজো হয়ে গেছ। একটু থেমে যোগ করলেন, আর তুমি যেসব মন্তব্য করছ তা প্রায় : রাজদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে।

আমি কি ধরে নেব আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, তোমার যদি আর কিছু বলবার না থাকে–

দাঁড়াও, দাঁড়াও, অতো তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে চলে যেও না। একটা প্রশ্ন আছে আমার। অ্যানাক্ৰিয়নের হুমকি রোধ করতে বাস্তবসম্মত কিছু কি করা হয়েছে, এই কূটনৈতিক চালটুকু ছাড়া? কথাটা এজন্য জিগ্যেস করছি যে, চালটাতে কাজের কাজ তেমন কিছু না-ও হতে পারে।

ইয়েট ফুলহ্যাম তার ভয়ঙ্করদর্শন গোঁফ জোড়ায় তা দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি তাহলে এসবের মধ্যে হুমকি দেখতে পাচ্ছেন?

আপনি পাচ্ছেন না?

এক বিন্দুও না, রীতিমত অবজ্ঞার সুরে জবাব এল। সম্রাট—

গ্রেট স্পেস! প্রচণ্ড বিরক্তি বোধ করলেন হার্ডিন। এটা কী! সবাই দেখছি কথায় কথায় হয় সম্রাট, নয় এম্পায়ার-এর নাম নিচ্ছে; ভাবখানা, শব্দ দুটো একেবারে জাদুমন্তর। এখান থেকে ঝাড়া পঞ্চাশ হাজার পার্সেক দূরে রয়েছেন আপনাদের সম্রাট; আর তিনি আমাদের কথা আদৌ চিন্তা করেন কি না সে নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে আমার। আর যদি করেনও তিনি কি কিছু করতে পারবেন? ইম্পেরিয়াল নেভির যা কিছু এই এলাকায় ছিল তা এখন চার রাজ্যের দখলে। আর তাতে অ্যানাক্ৰিয়নেরও ভাগ আছে। একটা কথা শুনে রাখুন, যুদ্ধ আমাদের করতে হবে অস্ত্র দিয়ে, কথা দিয়ে নয়।

এবার আরেকটা কথা মাথায় গেঁথে নিন। এ-পর্যন্ত আমরা দুমাসের মতো সময় পেয়েছি। তার প্রধান কারণ, অ্যানাক্রিয়নকে আমরা এই ধারণা দিয়েছি যে, আমাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এটা যে একটা নির্জলা মিথ্যে কথা সেকথা সবাই জানি। অ্যাটমিক পাওয়ার আমাদের আছে ঠিকই; কিন্তু সেটা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য, আর তাতে কিছুই এসে যায় না। এ-ব্যাপারে ওরা শিগগিরই জেনে যাবে আর তখন ওদের খুশিটা শুধু নাচানাচিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে একথা ভাবলে মস্ত বড় ভুল করবেন।

 

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

জনাব–

থামুন! কথা শেষ করিনি এখনও, উত্তেজিত হয়ে উঠছেন হার্ডিন। এই ঝামেলা মেটাতে চ্যান্সেলরকে ডেকে আনছেন ভাল কথা। কিন্তু আরো ভাল হবে যদি সেই সঙ্গে পারমাণবিক বোমা ঠাসা বড় বড় কয়েকটা সীজ গান-ও আনার ব্যবস্থা করা যায়। দুটো মাস নষ্ট করেছি আমরা, নষ্ট করার মতো আরো দু মাস সময় আমার না-ও পেতে পারি। তা, এখন কী করবেন বলে ভাবছেন?

লানডিন ক্রাস্ট-ই কথা বললেন প্রথম। লম্বা নাকটা তার ফুলে ফুলে উঠছে রাগে। আপনি যদি ফাউণ্ডেশন-এর মিলিটারাইজেশনের কথা বলতে চান, সেক্ষেত্রে আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি। তার কারণ, এতে করে রাজনীতির ব্যাপারে নাক গলানো হবে। মি. মেয়র, আমরা একটা সাসেন্টফিক ফাউণ্ডেশন ছাড়া আর কিছু নই।

সাট যোগ করলেন, উনি এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না সামরিক শক্তি তৈরির অর্থই হচ্ছে ইনসাইক্লোপীডিয়া থেকে লোকজন দরকারি লোকজন- সরিয়ে নেয়া। অথচ পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, এ-কাজটি কিছুতেই করা যাবে না।

একদম খাঁটি কথা, পিরেন সায় দিলেন। ইনসাইক্লোপীডিয়া আগে, সব সময়।

সশব্দে একটা শ্বাস ছাড়লেন হার্ডিন। বোর্ডের মাথায় দেখছি ইনসাইক্লোপীডিয়ার পোকা ছাড়া আর কিছু নেই, ভাবলেন তিনি।

বরফ-শীতল কণ্ঠে তিনি বললেন, বোর্ড-এর কি কখনো ভুলেও মনে হয়েছে যে, ইনসাইক্লোপীডিয়া ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে টার্মিনাসের সামান্যতম মাথাব্যথা থাকলেও থাকতে পারে?

উত্তর এল পিরেন-এর তরফ থেকে। হার্ডিন, আমার মনে হয়, ইনসাইক্লোপীডিয়া ছাড়া আর কোনো মাথাব্যথা ফাউণ্ডেশনের নেই।

আমি কিন্তু ফাউণ্ডেশন বলিনি, বলেছি টার্মিনাস। আমার ধারণা, তুমি পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছ না। টার্মিনাসে আমরা লাখ দশেক লোক আছি আর এদের মধ্যে সরাসরি ইনসাইক্লোপীডিয়ার সঙ্গে জড়িত লোকের সংখ্যা দেড় লাখের বেশি হবে না। বাকি সবার কাছে এটা-ই বাড়ি। এখানেই জন্মেছি আমরা। এখানেই বাস করছি। আমাদের ফার্ম, বাড়ি-ঘর আর কল-কারখানার তুলনায় ফাউণ্ডেশনের গুরুত্ব খুবই কম আমাদের কাছে। আমরা এগুলোকে সুরক্ষিত

ইনসাইক্লোপীডিয়া আগে। ক্রাস্টের গর্জনে হার্ডিনের গলা চাপা পড়ে গেল। আমাদেরকে একটা মিশন শেষ করতে হবে।

মিশন না ছাই, চেঁচিয়ে উঠলেন হার্ডিন। পঞ্চাশ বছর আগে হয়ত ছিল। কিন্তু এটা একটা নতুন জেনারেশন।

তাতে কী হয়েছে? পিরেন বলে উঠলেন। উই আর সায়েন্টিস্টস্।

যেন শিকার বাগে পেয়েছেন, এই ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হার্ডিন। তাই নাকি? অলীক কল্পনা হিসেবে কিন্তু ব্যাপারটা খুব চমৎকার, কি বলো? হাজার হাজার বছর ধরে গ্যালাক্সিতে গলদটা কোথায় হচ্ছে তা তোমাদের দেখলেই বোঝা যায়। বসে বসে শুধু গত সহস্রাব্দের বিজ্ঞানীদের কাজগুলো শ্রেণীবিভাগ করাটা কোন ধরনের বিজ্ঞান শুনি? তোমরা কি কখনো তাদের জ্ঞান আর বিদ্যার উন্নতি ঘটিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছ? করোনি। একটা জায়গায় আটকে থেকেই সন্তুষ্ট তোমরা। সন্তুষ্ট গোটা গ্যালাক্সি-ই। স্পেস জানে, কদ্দিন থেকে চলছে এই অবস্থা। তবে এ-জন্যেই পেরিফেরিতে বিদ্রোহ ঘটছে, এ-জন্যেই যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এ-জন্যেই ছোটখাটো যুদ্ধ চলছে অনন্তকাল ধরে, এ-জন্যই গোটা সিস্টেমটা অ্যাটমিক পাওয়ার হারাচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে রাসায়নিক শক্তির বর্বর যুগে।

আমাকে যদি মন্তব্য করতে বলল, গলা চড়িয়ে দিলেন হার্ডিন, তাহলে বলব, গ্যালাক্সিটা গোল্লায় যাচ্ছে!

থামলেন মেয়র। শ্বাস নেবার জন্যে চেয়ারের পিঠে হেলান দিলেন। দু তিন জন এক সঙ্গে ওঁর কথার উত্তর দেবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠলেন। তাদের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করলেন না তিনি। ফ্লোর পেলেন ক্রাস্ট। জনাব মেয়র, আমি বুঝতে পারছি না, আপনি আপনার এই পাগলের প্রলাপ দিয়ে কী বোঝাতে চাইছেন? তবে আলোচনায় আপনি যে গঠনমূলক কিছুই যোগ করছেন না, সেটা পরিষ্কার। মি. চেয়ারম্যান, আমি দাবি জানাচ্ছি, মেয়র হার্ডিনের মন্তব্যগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করে আলোচনা যেখানে ব্যাহত হয়েছিল, সেখান থেকে শুরু করা হোক।

এই প্রথমবারের মতো নড়েচড়ে উঠলেন জর্ড ফারা। এতক্ষণ চরম উত্তপ্ত অবস্থাতেও কোনোরকম মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন তিনি। কিন্তু এবার তাঁর গলা গম গম করে উঠল। আমরা কি একটা কথা ভুলে যাচ্ছি না?

কী কথা? পিরেন বিরক্তিভরা গলায় শুধোলেন।

এক মাসের মধ্যে আমরা আমাদের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি। মামুলি কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বলার একটা অভ্যাস আছে ফারার।

তাতে কী?

সেই বার্ষিকীতে, নিরুত্তাপ কণ্ঠ ফারার, হ্যারি সেলডন-এর ভল্ট খুলবে। কেউ কি ভেবেছেন, ভল্টে কী থাকতে পারে?

জানি না। রুটিন ম্যাটার্স। গাধা কিছু শুভেচ্ছাবাণী থাকবে খুব সম্ভব। আমার মনে হয়, ভল্টটাকে অতো গুরুত্ব না দিলেও চলবে- যদিও জার্নাল হার্ডিনের দিকে তাকালেন পিরেন, সেঁতো এক হাসি উপহার দিলেন তাঁকে মেয়র- এটাকে একটা ইস্যু বানাবার চেষ্টা করেছিল। আমিই তাতে বাদ সাধি।

কিন্তু আপনি সম্ভবত ভুল করছেন, ফারা বললেন। আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে- থেমে ছোট্ট গোল নাকটা এক আঙুলে চুলকে নিলেন তিনি- ভল্টটা একটা খুব সুবিধাজনক সময়ে খুলছে?

অর্থাৎ আপনি বোঝাতে চাইছেন যে খুব অসুবিধাজনক সময়ে খুলছে, বিড়বিড়িয়ে বললেন ফুলহ্যাম। মাথা ঘামানোর অন্য বিষয় আছে আমাদের হাতে।

হ্যারি সেলডনের মেসেজের চেয়েও জরুরি? আমার মনে হয় না। ক্রমেই আরো পণ্ডিতসুলভ হয়ে উঠছে ফারার আচরণ। গম্ভীর মুখে তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন হার্ডিন। কী বোঝাতে চাইছে লোকটা?

আসলে আপনারা বোধহয় ভুলেই গেছেন যে, সন্তুষ্টিমাখা গলায় ফারা বললেন, সেলডন ছিলেন আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় সাইকোলজিস্ট এবং ফাউণ্ডেশনের জনক। এটা ধরে নেয়া যুক্তিসঙ্গত যে, নিকট ভবিষ্যতের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাবার জন্য তিনি তাঁর সায়েন্স ব্যবহার করেছেন। আর তা যদি তিনি করে থাকেন, সেক্ষেত্রে আমি আবারো বলছি, তিনি অবশ্যই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করারও ব্যবস্থা রেখেছেন। এমনকি হয়ত একটা সমাধানও করে রেখেছেন। ইনসাইক্লোপীডিয়ার ওপর তার অসীম দরদ ছিল, সেকথা তো আপনারা ভাল করেই জানেন।

কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল সবাইকে। কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নেমে এল কামরায়। পিরেনই প্রথম কথা বললেন। দেখুন, সাইকোলজি বিজ্ঞানের এক বিশাল শাখা ঠিকই, কিন্তু এ মুহূর্তে আমাদের মধ্যে কোনো সাইকোলজিস্ট নেই। আমার মনে হচ্ছে আমরা একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছি।

হার্ডিনের দিকে তাকিয়ে ফারা বললেন, আপনি না অ্যালুরিনের কাছে সাইকোলজি পড়েছেন?

অনেকটা স্মৃতিচারণের সুরে হার্ডিন জবাব দিলেন, তা পড়েছিলাম, তবে মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলাম। থিওরি পড়তে পড়তে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। আমি আসলে হতে চেয়েছিলাম সাইকোলজিক্যাল এঞ্জিনিয়ার। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ছিল না আমাদের। কাজেই আমি বেছে নিলাম এরপর সবচেয়ে ভাল যে-বিষয় আছে সেটা, পলিটিক্স। প্র্যাকটিক্যালি, দুটো একই জিনিস।

তা, ভল্ট সম্পর্কে কী ভাবছেন আপনি?

আমি জানি না, সাবধানে উত্তর দিলেন হার্ডিন। মিটিং-এর বাকি সময়টা একেবারে চুপ করে রইলেন তিনি। এমনকি আলোচনাটা সম্রাটের চ্যান্সেলরের প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়ার পরও মুখ খুললেন না তিনি।

সত্যি বলতে, এ-সময়টায় কারো কথাই কানে যায়নি তার। নতুন একটা পথে চালিত করা হয়েছে তাঁকে। ছোট কয়েকটি জিনিস খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। দু তিনটে প্রান্ত একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

এবং মূল সূত্রটা যে সাইকোলজি সে-ব্যাপারে তিনি নিঃসন্দেহ। একসময় শেখা একটা সাইকোলজিক্যাল থিওরি মনে করার প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন তিনি- এবং সেটাই তাকে পথ দেখিয়ে দিল।

সন্দেহ নেই, সেলডনের মতো বড় মাপের একজন সাইকোলজিস্ট মানবিক অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়াগুলোর জটিল রহস্য উদঘাটন করে ভবিষ্যতের গতি সম্পর্কে মোটামুটিভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন।

আর তার অর্থ হচ্ছে- হুম্‌-ম্‌-ম্‌!

.

চার

লর্ড ডরউইন নস্যি নেন। মাথায় তাঁর ভীষণ কোঁকড়া লম্বা চুল। দিব্যি বোঝা যায় কৃত্রিমভাবে কোঁকড়া করা। ঠোঁটের ডগায় তুলোর ফেঁসের মতো লালচে এক জোড়া মিনি সাইজের গোঁফ। পরম যত্নে সেই গোঁফে অনবরত তা দিয়ে চলেন তিনি। কথা বলেন যার-পর-নাই মেপে আর সব র বাদ দিয়ে।

মহান চ্যান্সেলর আর কোন কোন কারণে প্রথম দর্শনেই তাঁর চরম বিরক্তির কারণ হয়েছেন এখন আর তা ভাববার অবকাশ নেই হার্ডিনের। ও, হ্যাঁ, তার প্রত্যেকটা মন্তব্যের সঙ্গেই রাজকীয় ভঙ্গীতে একটা হাত নাড়েন তিনি, আর এমনকি একটা মামুলি সম্মতিসূচক কথাতেও ভান করেন বিনয়ে গলে যাওয়ার।

কিন্তু সে যাই হোক, এ-মুহূর্তে তাকে খুঁজে পাওয়াটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধ ঘণ্টা আগে পিরেনের সঙ্গে উধাও হয়ে গেছেন তিনি- যাকে বলে একেবারে বেমালুম গায়েব।

হার্ডিন ঠিক জানেন, চ্যান্সেলরের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপের সময় তাঁর এই অনুপস্থিতিতে পিরেন স্বস্তি বোধ করবেন।

কিন্তু পিরেনকে এই উইং-এ দেখা গেছে, এবং এই ফ্লোরেই। প্রত্যেকটা রুমে গিয়ে ঢু মারো এখন। নামতে গিয়ে মাঝপথে হঠাৎ বলে উঠলেন, এই তো! তারপর ঢুকে পড়লেন আঁধার-করে-রাখা কামরাটায়। আলোকিত স্ক্রীনের বিপরীতে লর্ড ডারউইনের বিচিত্র কেশবিন্যাস দেখে নির্ভুলভাবে চেনা গেল তাঁকে।

কাছে গিয়ে দাঁড়াতে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। এই যে হাহডিন, নিশ্চয়ই আমাদের খুঁজছিলে? নস্যির কৌটোটা এগিয়ে দিলেন তিনি মেয়রের দিকে। হার্ডিন লক্ষ্য করলেন, বাক্সে যে কারুকাজ করা হয়েছে, সেটা বেশ জটিল এবং নিম্নমানের। বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। ডরউইন অতএব নিজেই এক চিমটি তুলে নাকে পুরলেন। হাসলেন অমায়িক হাসি।

 

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ভ্রূকুটি করলেন পিরেন। হার্ডিন নির্লিপ্ত।

সংক্ষিপ্ত নীরবতা ভঙ্গ হলো লর্ড ডরউইনের নস্যির কৌটো বন্ধ করার শব্দে। সেটা সরিয়ে রেখে চ্যান্সেলর বলে উঠলেন, সত্যি, তোমাদেহ এই ইনসাইক্লোপীডিয়া একটা সাফল্য, হাহডিন। সব্বকালেহ সবচেয়ে বহ কীহতিগুলোহ সঙ্গে এক কাতাহে বসাহ যোগ্য।

আমরা প্রায় সবাই তাই মনে করি মিলর্ড। তবে কাজটা এখনো শেষ হয়নি পুরোপুরি।

কিন্তু তোমাদেহ ফাউণ্ডেশনেহ সামান্য যেটুকু নৈপুণ্য আমি দেখেছি তাতে এটাহ সাফল্য সম্পহকে আমাহ সব সন্দেহ দূহ হয়ে গেছে। পিরেনের উদ্দেশে মাথা কঁকালেন চ্যান্সেলর কথা শেষ করে। খুশিতে একটা বাউ করে ফেললেন ভদ্রলোক ডরউইনকে।

বাহ্ চমৎকার! ভাবলেন হার্ডিন। আমি কিন্তু নৈপুণ্যের অভাবের কথা বলিনি, মিলর্ড, বলছিলাম অ্যানাক্রিয়নিয়ানদের অতিরিক্ত নৈপুণ্যের কথা- যদিও সেটা আরেকটা ব্যাপারে এবং বেশ ধ্বংসাত্মক দিকেই।

ও, হ্যাঁ, অ্যানাহকিয়ন, বলে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে একটা হাত নাড়লেন চ্যান্সেলর। আমি ওখান থেকেই এলাম। চহম বহবহ গহ একটা। পেহিফেহিতে যে লোক বাস কহতে পাহে তা ভাবাই যায় না। কাহও কোনো হুচিহ বালাই নেই, আহাম-আয়েশেহ ন্যূনতম বন্দোবস্ত নেই, নেই কোনো-

মাঝপথে বাগড়া দিলেন হার্ডিন। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে, যুদ্ধবিগ্রহ আর ধ্বংসযজ্ঞের জন্য মূলত যা যা দরকার তার সবকিছুই আছে ওদের।

তা ঠিক, তা ঠিক, বিরক্ত দেখাল লর্ড ডরউইনকে, সম্ভবত হার্ডিন কথার মধ্যে বাধা দেয়ার কারণে। তবে কিনা এমুহূর্তে আমহা ঠিক কাজেহ আলাপ কহতে আসিনি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি একেবাহে অন্য কথা ভাবছি এ মুহূর্তে। ড. পিহেন, সেকেণ্ড ভলিউমটা দেখান না, প্লীজ!

ক্লিক শব্দে আলো নিভে গেল। পরবর্তী আধ ঘণ্টা ডরউইন এবং পিরেন ফিরেও তাকালেন না হার্ডিনের দিকে। এই আধ ঘণ্টা অ্যানাক্ৰিয়নে কাটিয়ে এলেও ক্ষতি হত না কোনো, ভাবলেন হার্ডিন। স্ক্রীনে যে বইটা ফুটে উঠছে তার খুব সামান্যই মাথায় যাচ্ছে হার্ডিনের, বোঝার যে খুব একটা চেষ্টা করছিলেন তিনি তা-ও নয়, তবে একটু পর পরই ভয়ানক রকম উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন লর্ড ডরউইন। হার্ডিন খেয়াল করলেন, উত্তেজনার সেই মুহূর্তগুলোয় চ্যান্সেলর র গুলো উচ্চারণ করছেন।

আলো জ্বলে উঠল আবার। চ্যান্সেলর বলে উঠলেন, অসাধাহণ! সত্যিই অসাধাহণ! আহকিওলজিহ ব্যাপাহে বোধহয় তোমাহ কোনো উৎসাহ নেই, তাই না, হাহডিন?

তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল মেয়রের। না, মিলর্ড। নেই। হতে চেয়েছিলাম সাইকোলজিস্ট, হয়েছি রাজনীতিবিদ।

অথচ জান, ভীষণ ইন্টাহেস্টিং সাবজেক্ট এই আহকিওলজি। আমি নিজেও জান- এক চিমটি নস্যি নাকে চালান করার জন্যে থামতে হলো ভদ্রলোককে-শখ কহে মাঝে মধ্যেই আহকিওলজি নিয়ে ঘাটাঘাটি কহি।

তাই?

হিজ লর্ডশিপ-এর খুব ভাল দখল আছে বিষয়টার ওপর, পিরেন জানালেন মাঝখান থেকে।

তা বলতে পাহ, তা বলতে পাহ, আত্মপ্রসাদের সুর হিজ লর্ডশিপের গলায়। মেলা কাজ কহেছি আমি বিষয়টাহ ওপহ। সত্যি বলতে কী, পচুহ পহাশোনা কহেছি। জডান, ওবিজাসি, কোমিল- সবাহ লেখা পহা আমাহ।

ওদের নাম শুনেছি ঠিকই, কিন্তু কারো লেখাই পড়িনি কখনো, হার্ডিন অকপটে জানালেন।

সময় পেলে পহে নিও, হে। কাজে আসবে অনেক। টাহমিনাসে আসা আমাহ সাহথক হয়েছে ল্যামেথ- এহ এই কপিটা দেখতে পেয়ে। ভাল কথা, ড. পিহেন, যাবাহ আগে আমাকে এক কপি টান্সডেভলপ কহে দেবেন বলেছিলেন, ভোলেননি নিশ্চয়ই?

সানন্দে করে দেব।

ল্যামেথ, বুঝেছ, ছাত্র পড়াবার সুরে বলে চললেন লর্ড ডরউইন, অহিজিন কোশ্চেন-এহ ব্যাপাহে আমাহ ধাহণাহ সম্পূণ্য নতুন আহ ইন্টাহেস্টিং এক মাত্রা যোগ কহেছেন।

কী কোশ্চেন? হার্ডিন ভুরু কুঁচকে শুধোলেন।

অহিজিন কোশ্চেন। মানব জাতিহ উৎসস্থল সংকান্ত ব্যাপাহ, বুঝলে। এটা নিশ্চয়ই জানো যে, ধাহণা কহা হয়, অহিজিন্যালি মানব জাতি একটা মাত্র প্ল্যানেটাহি সিস্টেমে আবদ্ধ ছিল?

হ্যাঁ, তা জানি।

অবশ্যি ঠিক কোন সিস্টেমে সেটা কেউ বলতে পাহে না। অতীতেহ কুহেলিকায় তা হাহিয়ে গেছে। একেক জন একেক কথা বলেন। কেউ বলেন সাইহিয়াস, আবাহ কাহও মতে আলফা সেনটাউহি। সোল আহ সিক্সটি ওয়ান সিঙ্গি-হ কথাও বলে কেউ কেউ। সবগুলোই কিন্তু সাইহিয়াস সেক্টহে।

তা, ল্যামেথ কী বলেন এ ব্যাপারে?

উনি কিন্তু একেবাহে ভিন্ন কথা বলেন। উনি দেখাতে চেয়েছেন যে, আকাহিয়ান সিস্টেম-এর তিতীয় গহেহ প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ সাক্ষ্য দেয়, ভমনেহ সূচনা হবাহ অনেক আগে থেকেই সেখানে মানুষ বাস কহত।

তার মানে মানব জাতির জন্ম ঐ গ্রহে?

সম্ভবত। ভাল কহে পহে পমাণ-টমান বেহ কহে, তবেই বলতে পাহব নিশ্চিত কহে।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন হার্ডিন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ল্যামেথ কবে লিখেছিল বইটা?

তা পায় আটশো বছহ আগে। অবশ্যি তাহও আগে লেখা গ্লেন-এহ বইপত্তহেহ ওপহ ভিত্তি কহেই তিনি বইটা লিখেছেন মূলত।

তাহলে আর তার ওপর ভরসা করছেন কেন? সোজা আর্কটারাসে গিয়ে ধ্বংসাবশেষগুলো নিজে দেখে এলেই তো পারেন।

ভুরু ধনুক হয়ে গেল লড ডারউইনের। কৌটো খুলে দ্রুত এক চিমটি নস্যি নিলেন তিনি। কেন? তা কহতে যাব কেন?

কেন আবার? একেবারে নতুন টাটকা তথ্য পাবার জন্যে!

কিন্তু তাহ দহকাহটা কোথায়? এটা তো সিদ্ধান্ত অজ্জনেহ হীতিমত একটা আজব, ঘোহানো, আহ বিহক্তিজনক পদ্ধতি বলে মনে হচ্ছে আমাহ কাছে। তুমি দেখ, আমাহ কাছে পাচীন সব পণ্ডিত মানুষদেহ বইপত্তহ আছে-সবাই সেই আমলেহ বাঘা বাঘা আহকিওলজিস্ট। তাদেহ সবাহ লেখা পহে আমি একটাহ সঙ্গে আহেকটা তুলনা কহি- মতবিভেদগুলোহ মধ্যে একটা ভাহসাম্য আনি- পহস্পহবিহোধী মন্ত ব্যগুলো বিশ্লেষণ কহি- সম্ভাব্য সঠিক তথ্যটি বেছে নিই এবং তাহপহ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। এটাই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, সায়েন্টিফিক মেথড। অন্তত আমাহ দৃষ্টিতে। পাচীন যুগেহ বিজ্ঞানীহা যেখানে আমহা যতটা ভালভাবে কহতে পাহব বলে আশা কহি, তাহচেয়ে অনেক সুন্দহভাবে এ কাজ সেহে গেছেন, সেখানে তোমাহ ঐ আকটাহাস বা ধহহা ঐ সোলে গিয়ে খামোকা ঘুহে বেহানো কতোটা মূহখতা ভেবে দেখেছ!

বিনীত কণ্ঠে হার্ডিন বিড় বিড় করে বললেন, তা অবশ্যি ঠিক।

এর নাম নাকি সায়েন্টিফিক মেথড; যত্তসব! গ্যালাক্সি যে গোল্লায় যাবে তাতে আর আকাশ থেকে পড়ার কী আছে?

চলুন, মিলর্ড, পিরেন বলে উঠলেন। ফেরা যাক।

হ্যাঁ, তাই ভাল।

সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হার্ডিন আচমকা বলে উঠলেন, মিলড, একটা। কথা জিগ্যেস করব?

অমায়িক এক হাসি উপহার দিলেন হার্ডিনকে লর্ড ডরউইন। দরাজ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, অবশ্যই। তোমাদেহ কাজে আসতে পাহলেই তো আমাহ আনন্দ। আমাহ ক্ষুদ্দ জ্ঞান-ভাণ্ডাহ থেকে যদি কোনোভাবে তোমাহ সামান্য উপকাহও হতে পাহি-

মিলর্ড, প্রশ্নটা ঠিক আর্কিওলজি সংক্রান্ত নয়।

নয়?

না। ব্যাপারটা হচ্ছে, গত বছর আমরা গামা অ্যাণ্ড্রেমিডা প্ল্যানেট ফাইভ-এ একটা পাওয়ার-প্ল্যান্ট বিস্ফোরণের খবর শুনেছিলাম। কিন্তু বিস্ফোরণ যে হয়েছে, স্রেফ ঐ পর্যন্তই; আর কোনো কিছু জানতে পারিনি এ-ব্যাপারে। ঠিক কী ঘটেছিল যদি বলতেন।

বিরক্তিতে মুখ বেঁকে গেল পিরেনের। একেবারে অপ্রাসঙ্গিক একটা ব্যাপারে প্রশ্ন করে খামোকাই তুমি হিজ লর্ডশিপকে বিরক্ত করছ।

মোটেই না, ড. পিহেন, চ্যান্সেলর মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করলেন। কোনো অসুবিধা নেই। ঠিক আছে। তবে কথা হচ্ছে, ঘটনাটা সম্পর্কে তেমন কিছুই বলাহ নেই। পাওয়াহ প্ল্যান্টে সত্যিই একটা বিস্ফোহণ ঘটেছিল। মর্মান্তিক এক দুঘঘটনা ছিল সেটা। আমাহ ধাহণা, কয়েক মিলয়ন লোক মাহা গিয়েছিল ওই ঘটনায়। তাছাহা, গহটিহ অন্তত অদ্ধেক একেবাহে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এ জন্যই সহকাহ অ্যাটমিক-পাওয়াহেহ যথেচ্ছ ব্যবহাহ সম্পর্কে কহাকহি আহোপেহ কথা খুব গুহুত্বেহ সঙ্গে ভেবে দেখছেন। ব্যাপাহটা গোপনীয়, বুঝতেই পাহছ।

পারছি, হার্ডিন জবাব দিলেন। কিন্তু গণ্ডগোলটা ঠিক কী হয়েছিল?

লর্ড ডরউইন নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, কে জানে! বছহ কয়েক আগে একবাহ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্ল্যান্টটা। অনেকেই মনে কহেছেন, হিপ্লেসমেন্ট আহ মেহামতেই কাজে ভয়ঙ্কহ হকমেহ কোনো দোষ ছিল। আমাদেহ পাওয়াহ সিস্টেম সম্পর্কে ভাল জ্ঞান আছে এ-হকম লোকজন পাওয়া খুব মুশকিল হয়ে উঠেছে ইদানীং। কথা শেষ করে অতি ক্ষুদ্র এক চিমটি নস্যি নিলেন তিনি।

আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, হার্ডিন বললেন, পেরিফেরির স্বাধীন রাজ্যগুলো একসঙ্গে অ্যাটমিক পাওয়ার খুইয়ে বসেছে?

তাই নাকি? অবাক হচ্ছি না তেমন। বব্বহ যত গহ সব। ভাল কথা, স্বাধীন বলো না ওগুলোকে। গহগুলো স্বাধীন নয়, তুমি জান। ওদেহ সঙ্গে আমহা যে চুক্তি কহেছি সেটাই তাহ পমাণ। ওহা এম্পায়াহকে সাব্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন বলে স্বীকাহ কহে। কহতেই হত ওদেহ। নইলে আমহা ওদেহ সঙ্গে চুক্তি কহতাম না।

তা হতে পারে। তবে ওদের কিন্তু যথেষ্ট ফ্রিডম অভ অ্যাকশন রয়েছে।

হ্যাঁ, আমিও তাই মনে কহি। যথেষ্ট ফিডম অভ অ্যাকশন ওদেহ আছে। কিন্তু তাতে তেমন কিছু এসে যায় না। নিজেহ হিসোস-এহ ওপহ ঝাঁপিয়ে পহা পেহিফিহি নিয়ে এম্পায়াহ ওদেহ চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাদেহ কাছে গহগুলোহ তেমন কোনো মূল্য নেই, বুঝলে। হীতিমত বব্বহ গহসব। সভ্য বলা যায় না ওদেহ।

অতীতে কিন্তু সভ্য ছিল গ্রহগুলো। দূরবর্তী গ্রহগুলোর মধ্যে অ্যানাক্রিয়ন ছিল সবচেয়ে ধনী গ্রহের একটা। খোদ ভেগার সঙ্গে পাল্লা দিত।

আহ্ হা, হাহডিন, সেটা তো কয়েকশো বছহ আগেহ কথা। তাই ওপহ নিভ্যহ কহে সিদ্ধান্ত নিতে পাই না তুমি। আমহা আগে যে অবস্থায় ছিলাম এখন আহ সে অবস্থায় নেই, তুমি ভাল কহেই জান। ভীষণ নাছোহবান্দা লোক হে তুমি, হাহডিন। কিন্তু আগেই বলে দিয়েছি, আজ আমি কোনো কাজেহ কথা বলব না। ড. পিহেন আমাকে আগেই সাবধান কহে দিয়েছেন তোমাহ সম্পর্কে। তুমি যে আমাকে জ্বালাবে সে কথা তিনি আগেই বলে হেখেছিলেন। তবে আমি হলাম, যাকে বলে, বুহো বক। এত সহজে আমাকে বিহক্ত কহতে পাহবে না তুমি। কাল এসব নিয়ে আলাপ হবে, কেমন?

 

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পাঁচ

এই দ্বিতীয়বারে মতো বোর্ড মিটিং-এ যোগ দিলেন হার্ডিন। অবশ্যি বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে লর্ড ডারউইনের খোশালাপটা ধরলে আলাদা কথা। কাজ শেষ করে হপ্তাখানেক আগেই চলে গেছেন ভদ্রলোক।

হার্ডিন নিশ্চিত, দুতিনটা, অন্ততপক্ষে একটা মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে এর মধ্যে এবং তাকে সেগুলোয় আমন্ত্রণ জানান হয়নি। তিনি আরো জানেন, চরমপত্রটা না পেলে এই মিটিং-এর কথাও জানান হতো না তাঁকে।

চরমপত্রই বলা চলে ওটাকে। তেমন মন দিয়ে না পড়লে অবশ্যি ভিসিগ্রাফ করা ডকুমেন্টটাকে সেরকম কিছু মনে হবে না। বরং, দুই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময়কারী একটা নির্দোষ চিঠিই মনে হবে সেটাকে।

নিঃশব্দে চিঠিটা নাড়াচাড়া করছেন হার্ডিন। অ্যানাক্ৰিয়নের প্রবল প্রতাপশালী রাজা চিঠির শুরুতে বন্ধু এবং ভাই বলে সম্বোধন করেছেন প্রথম ইনসাইক্লোপীডিয়া

ফাউণ্ডেশনের বোর্ড অভ ট্রাস্টিজ-এর চেয়ারম্যান ড. লুইস পিরেনকে। তারপর বর্ষিত হয়েছে একরাশ অলঙ্কারবহুল শুভেচ্ছা। শেষ হয়েছে আরো দরাজভাবে এবং জটিল সিম্বলিজমের একটা প্রকাণ্ড, বহুবর্ণ সীল-এর সাহায্যে।

কিন্তু এত কিছুর পরেও ওটা যে একটা চরমপত্র, সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

হার্ডিন বলে উঠলেন, শেষ পর্যন্ত তাহলে দেখা গেল, সময় আমরা তেমন বেশি পেলাম না। মাত্র তিন মাস। কিন্তু এই স্বল্প সময়টুকুও একদমই কাজে লাগাইনি আমরা। হেলাফেলা করে নষ্ট করেছি। আর এবার এই চরমপত্রটা আমাদের জন্যে এক সপ্তাহ সময় বরাদ্দ করেছে। কী করবো আমরা এখন?

পিরেনের কপালে চিন্তার রেখা ফুটল। পরিত্রাণের একটা উপায় না থেকেই পারে না। সম্রাট আর গোটা এম্পায়ার-এর দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে লর্ড ডারউইন আমাদের আশ্বস্ত করে যাবার পরেও ওরা পরিস্থিতিকে এভাবে চরম অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে, ভাবাই যায় না।

হার্ডিন আরো আগ্রহ নিয়ে বলে উঠলেন, আচ্ছা! তুমি তাহলে অ্যানার্জিয়নের রাজাকে সম্রাটের দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়েছ।

জানিয়েছি- ভোটাভুটির জন্য প্রস্তাবটা বোর্ডের সামনে হাজির করে সবার। সম্মতি পেয়ে তবেই জানিয়েছি।

তা, ভোটটা কখন হলো?

মর্যাদাবোধে ঘা লাগল পিরেনের। আমার ধারণা, আমি তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই, মেয়র হার্ডিন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। উত্তরটা আমার না জানলেও চলবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে লর্ড ডরউইনের মূল্যবান ভূমিকাটুকুর কথা কূটনৈতিকভাবে জানিয়েছে বলেই,–এখানে এসে ঠোঁটের কোনা দিয়ে তিক্ত হাসি হাসলেন হার্ডিন, সৌহার্দ্যপূর্ণ এই ছোট্ট চিরকুটটি উড়ে এসেছে বলে আমার ধারণা। নইলে ওরা হয়ত আরো দেরি করত। অবশ্যি এ-ব্যাপারে বোর্ডের যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখছি তাতে বাড়তি ঐ সময়টুকু টার্মিনাসের কোনো উপকারে আসত বলে আমার মনে হয় না।

ইয়েট ফুলহ্যাম কিঞ্চিত ব্যঙ্গভাবে শুধোলেন, তা আপনার এই চমৎকার সিদ্ধান্তে আপনি পৌঁছুলেন কী করে, মাননীয় মেয়র?

খুব সহজে; বহু উপেক্ষিত সেই বস্তু- কমন সেন্স ব্যবহার করে। দেখুন, সিম্বলিক লজিক বলে মানবজ্ঞানের একটি শাখা আছে। যে-সমস্ত মরা ডালপালা মানুষের ভাষাকে নোংরা আর দুর্বোধ্য করে তোলে, সে-সমস্ত ডালপালা ঘেঁটে ফেলা যায় এই সিম্বলিক লজিকের সাহায্যে।

তাতে কী হলো? শুধোলেন ফুলহ্যাম।

এই বিশেষ লজিকটি আমি এই ডকুমেন্টটার ওপর প্রয়োগ করেছিলাম। আমার নিজের জন্যে অবশ্যি প্রয়োগ করার দরকার ছিল না, তার কারণ, এতে কী আছে আমি জানতাম। তবে আমি মনে করি, পাঁচ জন ফিজিক্যাল সায়েন্টিস্ট-এর কাছে কথার চেয়ে সিম্বলের সাহায্যেই চিঠিটা ব্যাখ্যা করা সহজ হবে আমার পক্ষে।

বাহুর নিচে থেকে কয়েকটা কাগজ সরিয়ে সবার সামনে মেলে ধরলেন হার্ডিন। ভাল কথা, কাজটা আমি নিজে করিনি। দেখতেই পাচ্ছেন, ডিভিশন অভ লজিক এর মুলার হলকের সাইন রয়েছে অ্যানালাইসিসটার নিচে।

কাগজটা আরো ভাল করে দেখার জন্যে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন পিরেন। হার্ডিন বলে চলেছেন, অ্যানাক্রিয়ন থেকে আসা মেসেজটা তেমন জটিল ছিল। তার কারণ, যাঁরা ওটা লিখেছেন, তাঁরা কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাসী। কোনোরকম ভণিতা না করে সরাসরি কাজের কথায় চলে এসেছেন তারা। আর সেটারই প্রতীকী চেহারাটা দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। অনুবাদ করলে এর মানেটা যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, আমরা যা চাই এক সপ্তাহের মধ্যে তা দিচ্ছ তোমরা। নইলে আঙুল বাকা করে আমরা সেটা আদায় করে নেব।

বোর্ডের পাঁচ সদস্য হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সিম্বলগুলোর ওপর। নিঃশব্দে কেটে গেল খানিকটা সময়। অবশেষে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন পিরেন। খুক খুক করে কাশলেন একটু, অস্বস্তিসূচক কাশি।

হার্ডিন বললেন, পরিত্রাণের পথ নেই। নাকি আছে ড. পিরেন?

মনে তো হচ্ছে না।

বেশ, কাগজগুলো যথাস্থানে রেখে দিলেন হার্ডিন। এবার আপনারা দেখতে পাচ্ছেন এম্পায়ার আর অ্যানাক্ৰিয়নের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির একটি কপি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, গত সপ্তাহে যিনি এখানে ছিলেন, সেই লর্ড ডরউইনই ম্রাটের হয়ে স্বাক্ষর করেছেন চুক্তিটায়। চুক্তির কপির সঙ্গে একটা সিম্বলিক অ্যানালাইসিসও দেখতে পাচ্ছেন আপনারা।

চুক্তিপত্রটার জন্য খরচ হয়েছে ফাইন প্রিন্টের পাঁচ পৃষ্ঠা আর অ্যানালাইসিসটার জন্যে দরকার হয়েছে মাত্র আধা পৃষ্ঠা।

দেখতেই পাচ্ছেন, অর্থহীন বলে চুক্তিপত্রের প্রায় নব্বই শতাংশই বাদ পড়ে গেছে। অ্যানালাইসিস থেকে। বাকি অংশটুকু খুব চমৎকার করে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?

এম্পায়ার-এর প্রতি অ্যানাক্ৰিয়নের নৈতিক বা আইনগত বাধ্যবাধকতা: শূন্য!

অ্যানাক্ৰিয়নের ওপর এম্পায়ার-এর কর্তৃত্ব: শূন্য!

আবারো উদ্বিগ্ন মুখে যৌক্তিক বিশ্লেষণটা খুঁটিয়ে দেখলেন বোর্ডের পাঁচ সদস্য। মাঝে মাঝে তা মিলিয়ে নিলেন চুক্তিপত্রের সঙ্গে। কাজটা শেষ হতে পিরেন কেমন এক দিশেহারা কণ্ঠে বলে উঠলেন, তোমার কথাই তো সত্যি বলে মনে হচ্ছে।

তাহলে তুমি স্বীকার করছ, চুক্তিপত্রটা আর কিছুই না- স্রেফ অ্যানাক্ৰিয়নের পূর্ণ স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র, আর এব্যাপারে এম্পায়ারের একটা অনুমোদনপত্রও বটে?

তাই তো দেখছি।

আর তোমার কি মনে হয়, অ্যানাক্রিয়ন এটার গুরুত্ব উপলব্ধি করে না? তুমি কি ভাব যে, এম্পায়ার-এর তরফ থেকে কোনোরকম ভীতি প্রদর্শনকে ওরা যাতে স্বাভাবিকভাবেই অপমানজনক মনে করে প্রতিবাদ করার শক্তি অর্জন করতে পারে সেজন্য এই স্বাধীন অবস্থাটা আরো জোরদার করার ব্যাপারে ওরা উৎসুক নয়? বিশেষ করে যখন এটা খুবই পরিষ্কার যে, এম্পায়ার এ-ধরনের কোনো হুমকি কার্যকর করতে অক্ষম; অক্ষমই যদি না হবে তাহলে কি আর স্বাধীনতা দেয়?

কিন্তু সেক্ষেত্রে, বাধা দিলেন সাট, মেয়র হার্ডিন, এম্পায়ার-এর সমর্থনের ব্যাপারে লর্ড ডারউইনের নিশ্চয়তাটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? শুনে তো মনে হল- শ্রাগ করলেন তিনি। শুনে তো বেশ সন্তোষজনকই মনে হলো তার কথাবার্তা।

চেয়ারের পিঠে পিঠ ঠেস দিয়ে হার্ডিন জবাব দিলেন, সেটাই তো সবচেয়ে মজার ব্যাপার। স্বীকার করছি, প্রথম দেখায় হিজ লর্ডশিপকে একটা গো-গর্দভ বলে মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু পরে দেখলাম, লোকটা ঝানু কৃটনীতিক আর মহা ধুরন্ধর। তার সব স্টেটমেন্ট রেকর্ড করে রেখেছি আমি।

বোমা ফাটলো যেন ঘরের মধ্যে। আতঙ্কে হাঁ হয়ে গেল পিরেনের মুখটা।

আহা, তাতে এমন কী হলো? হার্ডিন বললেন। বুঝতে পারছি, এতে আতিথেয়তার রীতি-নীতি চরমভাবে লজ্জিত হয়েছে, আর তথাকথিত একজন ভদ্রলোক কখনোই এ-ধরনের কাজ করবে না। হিজ লর্ডশিপ ব্যাপারটা টের পেলে তার পরিণতি খারাপ হতে পারতো, সেকথাও স্বীকার করছি। কিন্তু মোদ্দাকথা হচ্ছে, তিনি টের পাননি, আর আমার কাছে রেকর্ড রয়ে গেছে। রেকর্ডটা কপি করিয়ে হলকের কাছে আমি পাঠিয়েও দিয়েছিলাম বিশ্লেষণের জন্য।

লানডিন ক্রাস্ট জিগ্যেস করলেন, তা সেই অ্যানালাইসিসটা কোথায়?

দ্যাট ইজ দি ইন্টারেস্টিং থিং। তিনটের মধ্যে ঐ অ্যানালাইসিসটা ছিল সবচেয়ে জটিল। দুদিন টানা কাজ করার পর হলক যখন ডারউইনের বিবৃতির ভেতর থেকে অর্থহীন বক্তব্য, বকবকানি আর অকেজো শর্তগুলো- এককথায়, ঘেঁদো কথাগুলো বাদ দিতে সমর্থ হলো, সে অবাক হয়ে দেখল, বিশ্লেষণ করার মতো আর কিছুই বাকি নেই তার হাতে। সবই বাদ পড়ে গেছে।

পাঁচদিনের ঐ আলাপ আলোচনায় লর্ড ডারউইন কাজের কথা বলেননি একটাও। আর হেঁদো কথাগুলো এমনই কায়দা করে বলেছিলেন যে, কেউ তা ধরতে পারেনি। তো, এই হচ্ছে আপনাদের নমস্য এম্পায়ার-এর দেয়া নিশ্চয়তা।

হার্ডিন তার শেষ কথাগুলো বলার পর ঘরের বাকি সবার মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হলো, ঠিক ঐ একই প্রতিক্রিয়া হতো টেবিলের ওপর তিনি শুধু একটা তাজা দুর্গন্ধ বোমা আস্তে করে রেখে দিলে। ক্লান্তিকর ধৈর্য নিয়ে প্রতিক্রিয়াটা মিইয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তিনি।

সুতরাং, উপসংহার টানলেন তিনি, অ্যানাক্রিয়ন আপনাদের গায়ে টোকা দিলে এম্পায়ার তার প্রতিশোধ নেবে- এই মর্মে হুমকি দেবার ফলে আপনারা এমন এক রাজাকে চটিয়ে দিলেন, যিনি ভেতরের খবর জানেন। খুবই সঙ্গত কারণে তার অহমে ঘা লেগেছে এবং তিনি ত্বরিত অ্যাকশন নিতে মাঠে নেমে পড়েছেন। চরমপত্রটা তারই ফলশ্রুতি। আর সে কারণেই আমি প্রথমেই ঐ কথাটা বলেছিলাম- এক সপ্তাহ সময় আছে আমাদের হাতে; আমরা কী করবো এখন?

দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে, সাট বললেন, অ্যানাক্রিয়নকে টার্মিনাসে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

এ-ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে একমত, হার্ডিন বললেন। কিন্তু কথা হচ্ছে প্রথম সুযোগেই ওদেরকে লাথি মেরে তাড়ানোর ব্যাপারে কী করতে যাচ্ছি আমরা?

ইয়েট ফুলহ্যামের গোঁফজোড়া বেঁকে গেল। মনে হচ্ছে, আপনি ওদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছেন?

সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো, ভায়োলেন্স ইজ দ্য লাস্ট রিফিউজ অভ দি ইনকম্পিটেন্ট। সহিংসতা অক্ষমের শেষ অবলম্বন। কিন্তু তাই বলে অবশ্যই আমি ওদেরকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিতে চাই না, বা সর্বশক্তি দিয়ে অতিথি সেবায় লেগে পড়তে চাই না।

কিন্তু তারপরেও আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা পছন্দ হচ্ছে না আমার, ফুল্যহ্যাম বললেন। যে-দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি ব্যাপারটাকে দেখছেন সেটা বিপজ্জনক। আরো বিপজ্জনক এই কারণে যে, আমরা কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, জনসাধারণের একটা বেশ বড়সড় অংশ আপনাদের এধরনের কিছু পরামর্শে সাড়া দিয়েছে। এই সঙ্গে আমি আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই, মেয়র হার্ডিন। আপনার সাম্প্রতিক কার্যকলাপের বিষয় বোর্ড কিন্তু মোটেই অজ্ঞ নয়।

বিরতি দিলেন ফুলহ্যাম। মাথা নেড়ে সবাই একমত প্রকাশ করলেন তার সঙ্গে। হার্ডিন শ্রাগ করলেন।

 

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ফের শুরু করলেন ফুলহ্যাম, লোকজনকে আপনি সহিংস কাজে খোঁপয়ে তুললে সেটা একটা ব্যাপক ধরনের আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই হবে না, আর আমরা সেটা হতে দিতে পারি না। আমাদের কূটনীতির মূলনীতি একটাই, আর তা হচ্ছে ইনসাইক্লোপীডিয়া। কোনো কিছু করার বা না করার ব্যাপারে আমরা যে সিদ্ধান্তই নেই না কেন, সেটা নেবো ইনসাইক্লোপীডিয়াকে নিরাপদ রাখার জন্য।

তাহলে, হার্ডিনের গলায় হালকা ব্যঙ্গের প্রলেপ, আপনারা আমাদের কিছুই না করার ব্যাপক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন?

তিক্ত কণ্ঠে পিরেন বললেন, তুমি নিজেই তো দেখিয়ে দিলে যে, এম্পায়ার আমাদের সাহায্য করতে পারছে না; যদিও, কেন, কীভাবে তা সম্ভব, সেকথা আমার মাথায় আসছে না। যদি আপোস করার প্রয়োজন হয়

প্রাণপণে দৌড়েও এক কদমও এগোচ্ছেন না– এরকম একটা দুঃস্বপ্নময় অনুভূতি হলো হার্ডিনের। দেয়ার ইজ নো কম্প্রোমাইজ! তুমি কি বুঝতে পারছ তা যে সামরিক ঘাঁটির এই ফালতু ব্যাপারটা আসলে একটা অতি নিম্ন শ্রেণীর ছেঁদো প্যাঁচাল ছাড়া আর কিছুই নয়? হট রডরিক তো আমাদের জানিয়েই দিয়েছে, অ্যানাক্রিয়ন আসলে কী চায়। চায়, আমাদের রাজ্যটা বেমালুম গিলে নিতে, আর ওদের সামন্তপ্রজা আর কৃষক-অভিজাততন্ত্রের অর্থনীতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে। অ্যাটমিক পাওয়া সম্পর্কে আমরা বে ধাক্কা দিয়েছি, তার আর যতটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটার কারণে ওরা হয়ত একটু ধীরে এগোবে। তবে এগোবে যে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কথা শেষ করে ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। জর্ড করা ছাড়া বাকি সবাই তার সঙ্গে উঠে পড়লেন।

জর্ড ফারা বললেন, প্লীজ বসুন আপনারা। এতো রাগার কোনো কারণ নেই মেয়র হার্ডিন। আমাদের মধ্যে কেউ-ই বিশ্বাসঘাতকতা করছে না।

এ-ব্যাপারে আমাকে নিশ্চিত করতে হবে আপনাকে।

শান্তভাবে হাসলেন ফারা। আপনি জানেন এটা আপনার মনের কথা নয়। আমাকে বলতে দিন।

ফারার ধূর্ত চোখ জোড়া আধখোলা; চিবুকে চিক চিক করছে ঘাম। আমার মনে হয় কাটা গোপন করে কোনো লাভ নেই- বোর্ড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, অ্যানাত্রিয়ন সমস্যার সঠিক সমাধান রয়েছে ভল্টের মধ্যে এবং আজ থেকে মাত্র ছদিন পরই খুলেছে সেটা।

এ-ব্যাপারে তাহলে আপনাদের অবদান এটুকুই?

হ্যাঁ।

অর্থাৎ প্রাচীন আমলের নাটকে কোনো কোনো নাট্যকার তাদের নাটকের শেষে চরিত্র আর প্রটের জটিল সমস্যা মেটাবার জন্যে যেভাবে যন্ত্রের সাহায্যে মঞ্চের ওপর একজন নেতাকে হাজির করতেন, ঠিক সেভাবে ভল্ট নামক যন্ত্র থেকে একজন দেবতা বেরিয়ে এসে সমাধান বাতলে না দেয়া পর্যন্ত আমরা সবাই অটল বিশ্বাসে চুপচাপ, শান্তভাবে বসে থাকব। ঠিক কি না?

আপনার কথার ঐ আবেগঘন অংশটুকু বাদ দিলে ব্যাপারটা তাই-ই দাঁড়ায়।

নির্জলা, পলায়নপর মনোবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই না এটা। সত্যিই, ড. ফারা, এ রকম মূর্খতা না দেখালে কি আর প্রতিভাবান বলে লোকে! সাধারণ একজন লোকের পক্ষে কিন্তু এ-কাজ অসম্ভব ছিল।

প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন ফারা। এপিগ্রাম, আই মীন, শ্লেষাত্মক বাক্য ব্যবহারে আপনার জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে আপনার রুচির প্রশংসা করতে হয়। তবে হার্ডিন, স্থান নির্বাচনে ভুল করেছেন আপনি। ভাল কথা, হপ্তা তিনেক আগে ভল্ট সম্পর্কে আমি যেসব যুক্তি দেখিয়েছিলাম, সেগুলো নিশ্চয়ই খেয়াল আছে আপনার?

হ্যাঁ আছে। অস্বীকার করবো না, শুধুমাত্র ডিডাক্টিভ লজিক-এর দিক থেকে সেগুলো আর যাই হোক কোনো স্টুপিড আইডিয়া ছিল না। আপনি বলেছিলেন ভুল হলে থামিয়ে দেবেন- তাবৎ গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে হ্যারি সেলডনই হলেন সবচেয়ে বড় মনস্তত্ত্ববিদ। সুতরাং আমরা বর্তমানে যে অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি সেটা তিনি অনেক আগেই ঠিক ঠিক দেখতে পেয়েছিলেন এবং সেহেতু তিনি আমাদেরকে মুক্তির উপায় বাতলানোর একটা উপকরণ হিসেবে ভল্ট স্থাপিত করে গেছেন।

আমার কথার মূল ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন আপনি।

শুনে কি অবাক হবেন যে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেছি?

খুব তৃপ্তি অনুভব করছি। তা চিন্তা করে কী বের করলেন?

বের করলাম যে, শুধু নিখুঁত ডিডাকশনে কাজ হয় না। সেই সঙ্গে পুরনো সেই কমন সেন্সের জল ছিটানোরও দরকার হয় খানিকটা।

যেমন?

যেমন, অ্যানার্জিয়ন সম্পর্কিত এই জটিলতা যদি সেলডন আগেভাবেই দেখে থাকবেন তাহলে তিনি কেন আমাদেরকে গ্যালাকটিক সেন্টার-এর নিকটবর্তী কোনো গ্রহে রাখার ব্যবস্থা করলেন না? এটা সবাই জানে যে, টার্মিনাসে ফাউণ্ডেশন স্থাপন করার ব্যাপারে ট্রানটরের কমিশনারদের তিনি প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু কেন তিনি তা করবেন? যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়া, গ্যালাক্সি থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতা, প্রতিবেশীদের হুমকি, আর টার্মিনাসে ধাতুর অভাবজনিত করণে আমাদের অসহায়ত্ব এতো কিছু তিনি যদি আগে থেকেই দেখতে পেয়ে থাকেন তাহলে কেন তিনি এখানে পাঠালেন আমাদের? অথবা তিনি যদি এসব আগেই দেখে থাকবেন তাহলে প্রথমে বসতি স্থাপনকারীদেরকে তিনি গোড়াতেই সতর্ক করে দিলেন না কেন, যাতে তারা এই বিপদগুলো মোকাবেলা করার জন্যে আগে থেকেই তৈরি হতে পারে?

আরো একটা কথা ভুলে যাবেন না। তিনি তখন সমস্যাগুলো দেখে থাকলেও থাকতে পারেন। কিন্তু এ-মুহূর্তে আমরাও সেগুলো পরিষ্কার দেখতে পাচিছ। যতো যাই হোক, সেলডন জাদুকর ছিলেন না। একটা সংকট এড়ানোর এমন কোনো কূটবুদ্ধি নেই যা তিনি দেখতে পান, অথচ আমরা পাই না।

কিন্তু হার্ডিন, ফারা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন, আমরা কিন্তু সত্যিই দেখতে পাচ্ছি না।

কারণ আপনারা চেষ্টা করেননি, একবারের জন্যও চেষ্টা করেননি। প্রথমে তো আপনারা স্বীকারই করতে চাইলেন না যে ভয়ংকর কোনো বিপদ আদৌ আছে। এরপর আপনারা সম্রাটের ওপর পুরোপুরি একটা অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করে বসে রইলেন। এখন সেটা সম্রাটের ওপর থেকে সরিয়ে হ্যারি সেলডনের কাঁধের ওপর বসিয়েছেন। আগাগোড়াই আপনারা হয় কর্তৃপক্ষ, নয় অতীতের ওপর ভরসা করে ছিলেন; কখনোই নিজেদের ওপর নয়।

উত্তেজনায় হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল তার। এটা একটা অসুস্থ মানসিকতা একটা কণ্ডিশনাল রিফ্লেক্স। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচারণের প্রশ্ন এলেই আপনাদের মানসিক স্বাধীনতাকে ভুল পথে চালিত করে এই রিফ্লেক্স।

সম্রাট যে আপনাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান- এ-ব্যাপারটা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন আপনারা, মেনে নিয়েছেন যে, হ্যারি সেলডন অনেক বেশি জ্ঞানী। কিন্তু এটা যে ভুল তা কি আপনারা বুঝতে পারছেন না?

যে-কারণেই হোক, কেউ এ-প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না।

হার্ডিন বলে চললেন, শুধু আপনাদের নয়, গোটা গ্যালাক্সিরই এই দশা। সায়েন্টিফিক রিসার্চ বলতে লর্ড ডরউইন কী বোঝেন সেটা পিরেন শুনেছেন। লর্ড ডরউইন মনে করেন ভালো একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ হওয়ার উপায় হচ্ছে, এ-বিষয়ের ওপর লেখা সমস্ত বইপত্তর পড়ে ফেলা- যে বইগুলো লিখেছেন কয়েকশো বছর আগে মারা গেছেন এমন সব লেখক। উনি ভাবেন, স্রেফ পরস্পরবিরোধী মতামতগুলো যাচাই করেই প্রত্নতাত্ত্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। আর পিরেন চুপচাপ শুনে গেছেন কথাগুলো, কোনো প্রতিবাদ করেননি। আপনাদের কি মনে হয় না একাজটা ঠিক নয়?

আবার তার কণ্ঠে প্রায় আর্তি ঝরে পড়লো। এবারো সবাই নিরুত্তর রইলেন। কিন্তু হার্ডিন বলে চললেন, আপনাদের এবং টার্মিনাসের অর্ধেক লোকের এই একই দুর্দশা। ইনসাইক্লোপীডিয়াকে সর্বেসর্বা ধরে নিয়ে আমরা সব ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছি। এখনো আমরা মনে করছি অতীতের সব ডাটার শ্রেণীবিভাজন করার মধ্যেই বিজ্ঞানের চরমোৎকর্ষ নিহিত। কাজটা গুরুত্বপূর্ণ, স্বীকার করছি। কিন্তু তারপর কি আর কিছুই করার নেই? পিছিয়ে যাচ্ছি আর ভুলে যাচ্ছি আমরা, বুঝতে পারছেন না কেউ? এই পেরিফেরিতে সবাই অ্যাটমিক-পাওয়ার খুইয়ে বসেছে। গামা অ্যান্ড্রোমিডায় ত্রুটিপূর্ণ মেরামতির জন্য একটা পাওয়ার প্ল্যান্ট উড়ে গেছে। সম্রাটের চ্যান্সেলর আক্ষেপ করছেন এই বলে যে, অ্যাটমিক টেকনিশিয়ানের সংখ্যা নেহাতই অপ্রতুল। কোথায় নতুন নতুন লোককে ট্রেনিং দেবেন তা না, উল্টো তারা অ্যাটমিক-পাওয়ারের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করছেন!

তৃতীয়বারের মতো অনুনয় ঝরে পড়লো তার কণ্ঠ থেকে, আপনারা কি এসব বুঝতে পারছেন না? সারা গ্যালাক্সি জুড়ে এই দশা! এটা একধরনের অতীতপূজা। এটা একটা অধঃপতন- একটা বন্ধাত্ম!

এক এক করে প্রত্যেকের দিকে তাকালেন তিনি। সবাই স্থির দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছেন তাঁর দিকে।

ফারা-ই প্রথম ঘোর কাটিয়ে উঠলেন। দেখুন, রহস্যময় দর্শন কোনো কাজে আসবে না আমাদের। লেট আস বি কংক্রিট। আপনি কি অস্বীকার করবেন, সাধারণ কিছু সাইকোলজিক্যাল টেকনিকের সাহায্যে হ্যারি সেলডন খুব সহজেই ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক প্রবণতা বের করতে পারতেন?

না, অবশ্যই অস্বীকার করি না, চেঁচিয়ে উঠলেন হার্ডিন। কিন্তু তাই বলে সমাধানের আশায় আমরা তার ওপর ভরসা করে বসে থাকতে পারি না। বড়জোর তিনি সমস্যাটা দেখিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সমাধান? সেটা আমদেরই বের করতে হবে। আমাদের হয়ে এ-কাজটি তিনি করে দিতে পারেন না।

ফুলহ্যাম হঠাৎ বলে উঠলেন, সমস্যাটা দেখিয়ে দিতে পারেন বলতে কী বোঝাতে চান আপনি? আমাদের সমস্যা কী আমরা তা জানি।

বিদ্যুদ্বেগে তাঁর দিকে ফিরলেন হার্ডিন। আপনার ধারণা আপনি জানেন! আপনি মনে করেন, হ্যারি সেডন শুধু অ্যানাক্রিয়ন নিয়েই চিন্তিত। আমি ভিন্নমত পোষণ করি। আমি আপনাদের বলছি, আসলে যে কী ঘটতে চলেছে, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আপনাদের কারো।

তোমার আছে? প্রায় দাঁত মুখ খিঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন পিরেন।

আই থিংক সো! ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে এক ধাক্কায় পেছনে সরিয়ে দিলেন হার্ডিন চেয়ারটাকে। চোখের দৃষ্টি তার আশ্চর্য রকমের তীক্ষ্ণ এবং স্থির। অন্তত এই একটা ব্যাপার নিশ্চিত করে বলা যায় যে, গোটা পরিস্থিতিটার মধ্যে রহস্যময় একটা ব্যাপার লুকিয়ে আছে। এমন একটা কিছু যা আমরা এতক্ষণ যেসব বিষয় নিয়ে কথা বললাম, তার চেয়ে বড়। নিজেকে শুধু এই প্রশ্নটা জিগ্যেস কর: ফাউণ্ডেশনের একেবারে প্রথমদিককার লোকজনের মধ্যে বোর আলুরিন ছাড়া আর একজনও প্রথম শ্রেণীর সাইকোলজিস্ট অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কেন? আর তিনিও তার ছাত্রদের প্রাথমিক বিষয়গুলো ছাড়া বাড়তি কোনো কিছু শেখানো থেকে সাবধানে বিরত রেখেছেন নিজেকে।

খানিক নীরবতা। তারপর ফারা জিগ্যেস করলেন, ঠিক আছে, কেন?

সম্ভবত এই কারণে যে, একজন সাইকোলজিস্ট হয়ত এই রহস্যটা বের করে ফেলতে পারতেন আর সেটা হ্যারি সেলডনের উদ্দেশ্য সফল হবার আগেই। আমরা যে এই হোঁচট খেয়ে মরছি, অন্ধকারে পথ হাতড়াচ্ছি, কুহেলিকা ঢাকা সত্যের ঈষৎ বিচ্ছুরণ ছাড়া বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছি না- এটাই চেয়েছিলেন হ্যারি সেলডন।

কর্কশ শব্দে হেসে উঠলেন হার্ডিন। গুড ডে, জেন্টেলমেন!

দৃপ্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি কামরা থেকে।

 

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ছয়

চুরুটের গোড়াটা দাঁত দিয়ে কামড়াচ্ছেন মেয়র হার্ডিন। নিভে গেছে ওটা। কিন্তু সেটা খেয়াল করার মতো অবস্থায় তিনি নেই। গত রাতে ঘুমোননি তিনি। ভাল করেই জানেন, আজ রাতেও ঘুমোতে পারবেন না। তার চোখ দেখলেই সেটা বোঝা যায়।

মনে হয় হবে, ইয়োহান লী নিজের চিবুকে হাত দিলেন। কেমন মনে হচ্ছে?

খুব একটা খারাপ না। বুঝতেই পারছে, খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে সারতে হবে কাজটা। তার মানে, কোনোরকম ইতস্তত করা চলবে না। পরিস্থিতি বুঝে ওঠার কোনো সুযোগই দেয়া যাবে না ওদেরকে। আমরা যখন হুকুম দেয়ার মতো অবস্থায় চলে যাবো, তখন এমনভাবে হুকুম দিতে হবে যেন জন্মগতভাবেই এ-অধিকার পেয়েছি আমরা। আর তখন ওরাও অভ্যস্তভাবেই হুকুম তামিল করবে। এটাই হচ্ছে কু-র আসল কথা।

বোর্ড যতি তারপরও না মচকায়–

বোর্ড? হিসেবের বাইরে রাখো ওদের। আগামীকালের পর থেকে টার্মিনাসের কোনো ব্যাপারেই কানাকড়ি গুরুত্ব থাকবে না ওদের।

ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন লী। এত সময় পেয়েও ওরা আমাদের থামানোর চেষ্টা করেনি দেখে অবাক হয়ে গেছি আমি। আর তোমার কথা অনুযায়ী, ওরা তো একেবারে অন্ধকারের মধ্যেও ছিল না।

ফারা ব্যাপারটা টের পেতে গিয়েও পায়নি। মাঝে মাঝে আমাকে বেশ নার্ভাস করে দেয় লোকটা। আর পিরেন তো আমাকে সন্দেহ করে আসছে আমি নির্বাচিত হবার পর থেকেই। কিন্তু কী ঘটতে চলেছে সেটা বুঝে ওঠার ক্ষমতা ছিল না ওদের কারোরই। ওদেরকে বরাবর এমনভাবে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে যাতে ওরা ব্যক্তি স্বাধীনতার চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে নতজানু হয়ে থাকাকেই শ্রেয় মনে করে। অথরিটেরিয়ান ট্রেনিং যাকে বলে। ওদের বদ্ধমূল ধারণা, সম্রাট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী- স্রেফ তিনি সম্রাট শুধু এই কারণেই। ওরা আরো মনে করে, বোর্ড অভ ট্রাস্টিজ- স্রেফ ওটা সম্রাটের পক্ষে কর্মরত বোর্ড অভ ট্রাস্টিজ বলেই- কখনো এমন অবস্থানে নেমে যেতে পারে না যেখান থেকে সেটা সবার ওপর আর কর্তৃত্ব ফলাতে পারবে না। বিদ্রোহের যে কোনোরকম সম্ভাবনা আছে এটা উপলব্ধি করার ওদের এই অক্ষমতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়।

চেয়ার ছেড়ে উঠে ওয়াটার কুলারটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।

যতক্ষণ ওরা ঐ ইনসাইক্লোপীডিয়া নিয়ে আছে, ততক্ষণ ওরা মন্দ না, বুঝেছ, লী। আর আমাদের কাজ হবে, ভবিষ্যতেও ওরা যাতে ঐ জিনিসটা নিয়েই থাকে সেটা দেখা। টার্মিনাস শাসন করার ব্যাপারে নেহাতই অযোগ্য ওরা। এখন যাও, কাজ শুরু করে দাও। আমি একটু একা থাকতে চাই।

ডেস্কের এক কোনায় বসে পড়লেন তিনি। চেয়ে রইলেন কাপভর্তি পানির দিকে।

যতটা ভান করছেন আসলেই যদি ততটা আত্মবিশ্বাসী হতেন তিনি। অ্যানাক্ৰিয়ানবাসীরা দুদিনের মধ্যেই ল্যাণ্ড করবে। অথচ হ্যারি সেলডনের উদ্দেশ্যে যে কী, সে-ব্যাপারে কিছু অনুমান আর আবছা ধারণা ছাড়া কী-ইবা আছে তাঁর যার ওপর ভরসা করে সামনে এগোনো যায়? তিনি নিজে এমনকি একজন সত্যিকারের সাইকোলজিস্টও নন। স্রেফ সামান্য ট্রেনিং পাওয়া এক হাতুড়ে তিনি, অথচ চাইছেন সর্বকালের সর্বসেরা মনীষীকে টেক্কা দিতে!

ফারার কথাই যদি ঠিক হয়, যদি এমন হয় যে শুধু অ্যানাক্রিয়নের সমস্যাটাই হ্যারি সেলডন আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছেন, যদি সত্যি সত্যিই শুধু ইনসাইক্লোপীডিয়া সংরক্ষণ করাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আর এই কু-র অর্থ কী?

শ্রাগ করলেন হার্ডিন। কাপের পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে চালান করে দিলেন পেটে।

.

সাত

ছটার অনেক বেশি চেয়ার রাখা হয়েছে ভল্টে। যেন ছজনের চেয়ে বেশি লোক আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। গম্ভীরভাবে ব্যাপারটা লক্ষ করলেন হার্ডিন। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এলেন। পাঁচজনের কাছ থেকে যতটা দূরে সম্ভব, এক কোনায় গিয়ে বসে পড়লেন।

বোর্ডের সদস্যরা এতো কিছু খেয়াল করেছেন বলে মনে হলো না। ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন তারা। আস্তে আস্তে এক সময় সেটা বন্ধ হয়ে গেল। ছজনের মধ্যে একমাত্র জর্ড ফারাকেই বেশ শান্ত দেখাচ্ছে। একটা ঘড়ি বের করে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছেন তিনি সেটার দিকে।

হার্ডিন তাঁর নিজের ঘড়ি দেখলেন। তারপর কামরার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে থাকা একদম ফাঁকা গ্লাস কিউবিকলটার দিকে তাকালেন। এটাই ঘরটার একমাত্র অস্বভাবিক জিনিস, কারণ, এ-ছাড়া আর কোনো কিছু দেখে বুঝবার উপায় নেই যে কোথাও রেডিয়ামের একটা ফুটকি ক্ষয়ে ক্ষয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তটির দিকে যখন একটা টাম্বলার পড়বে, একটা সংযোগ স্থাপিত হবে, আর

হঠাৎ নিভু নিভু হয়ে এলো ঘরের আলো!

পুরোপুরি নিভে গেল না। শুধু হঠাৎ হলুদ রঙ ধারণ করে এত কমে এল যে হার্ডিন সচকিত হয়ে উঠলেন। চমকে সিলিং-এর আলোর দিকে তাকালেন তিনি। চোখ নামাতেই দেখতে পেলেন গ্লাস কিউবিকলটা আর ফাঁকা নেই।

একজন লোককে দেখা যাচ্ছে সেখানে হুইল চেয়ারে বসা এক লোক।

মিনিট খানেক কোনো কথা বলল না লোকটা। তবে কোলের ওপর রাখা খোেলা বইটা বন্ধ করে অলসভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগল, তারপর নিঃশব্দে একটা হাসি উপহার দিল। সারা মুখটা জীবন্ত হয়ে উঠল তার।

কোমল এবং বার্ধক্যপীড়িত কণ্ঠে লোকটি বলে উঠল, আমি হ্যারি সেলডন।

ভদ্রতাবশত উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন হার্ডিন আরেকটু হলে। থেমে গেলেন।

খোশালাপের সুরে হ্যারি সেলডন বলে চললেন, দেখতেই পাচ্ছেন, আমি এই চেয়ারেই বন্দি। উঠে দাঁড়িয়ে আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে পারছি না বলে দুঃখিত। আমার সময়ের হিসেব অনুযায়ী কয়েক মাস আগে আপনাদের পিতামহ-পিতামহীরা টার্মিনাসের উদ্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। আর তখন থেকেই মারাত্মকভাবে প্যারালইসিসে আক্রান্ত হয়েছি আমি। আপনারা জানেন, আমি আপনাদের দেখতে পাচ্ছি না। ফলে, আমি আপনাদের ঠিকমত শুভেচ্ছাও জানাতে পারছি না। আমি এমনকি এটাও জানি না আপনারা ক জন এখানে বসে আছেন। সুতরাং গোটা ব্যাপারটা অনানুষ্ঠানিকভাবেই চলুক। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে প্লীজ বসুন। কেউ ধূমপান করতে চাইলে আমার কোনো আপত্তি নেই। মৃদু হাসলেন তিনি। কেনই বা আপত্তি করবো? আমি তো সত্যি সত্যি এখানে নেই।

প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিগারের জন্যে পকেটে হাত চলে গেল হার্ডিনের। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টালেন।

হ্যারি সেলডন সরিয়ে রাখলেন বইটা- যেন রেখে দিলেন পাশের ডেস্কে বই থেকে আঙুল সরে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল সেটা।

তিনি বললেন, ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছরপূর্তি হলো আজ। তারা কী উদ্দেশ্যে কাজ করছেন, সে-ব্যাপারে ফাউণ্ডেশনের সদস্যরা এই পঞ্চাশ বছর যাবৎ একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন। তাদের এই অজ্ঞ থাকাটা দরকার ছিল। এখন সে দরকার ফুরিয়েছে।

শুরুতে বলে রাখছি, ইনসাইক্লোপীডিয়া ফাউণ্ডেশন একটা ধাপ্পা ছাড়া কিছু নয়। প্রথম থেকেই একটা ধাপ্পা ছিল এটা?

হার্ডিনের পেছনে কিছু বিস্মিত চাপা কণ্ঠ শোনা গেল। কিন্তু তিনি ঘাড় ফেরালেন না।

আর হ্যারি সেলডনের তো কোনোরকম বিরক্তি বোধ করার প্রশ্নই আসে না। তিনি নির্বিকারভাবে বলে চলেছেন, ধাপ্পা এই অর্থে যে, ইনসাইক্লোপীডিয়ার একটা খণ্ডও প্রকাশিত হলো কি না হলে তা নিয়ে আমার কোনো সহকর্মীর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তবে ইনসাইক্লোপীডিয়ার সাহায্যে যে কাজগুলো করতে চেয়েছিলাম, সেগুলো সফল হয়েছে- সম্রাটের কাছ থেকে একটা রাজকীয় সনদ লাভ করা গেছে, আমাদের পরিকল্পনার জন্যে প্রয়োজনীয় লাখখানেক লোককে আকৃষ্ট করতে পেরেছি আর এই ইনসাইক্লোপীডিয়ার সাহায্যে তাদের এমন একটা মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যস্ত রাখা গেছে যে, এখন আর তাদের কারো পক্ষেই পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় কোনোমতে। আর, এর মধ্যে ঘটনা তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে গিয়ে একটা বিশেষ আকার নিয়েছে।

যে-পঞ্চাশ বছর ধরে আপনারা এই মিথ্যে প্রকল্পের জন্যে কাজ করে গেছেন মিথ্যে শব্দটার বদলে মিষ্টি কোনো শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই- সেই সময়ের মধ্যে আপনাদের পিছু হঠার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর আমাদের যে মূল পরিকল্পনা ছিল বা এখনো আছে, আরো গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রকল্পের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই আপনাদের হাতে।

তো, সেই লক্ষ্যে আপনাদের বিশেষ এক গ্রহে, বিশেষ এক সময়ে রেখে আর পঞ্চাশ বছর ধরে পরিচালিত করে এমন এক অবস্থানে নিয়ে আসা হয়েছে যে, এখন থেকে ফ্রীডম অভ অ্যাকশন বা কাজের স্বাধীনতা বলে কিছু রইল না আপনাদের। এখন থেকে সামনের বছরগুলোতে আপনারা যে পথে চলবেন সেটা হবে অবশ্যম্ভাবী; অর্থাৎ কিনা, শুধু ঐ পথেই চলতে হবে আপনাদের। ধারাবাহিক সংকটগুলোরই প্রথমটি আপনাদের সামনে। এবারের মতো প্রতিবারই আপনাদের ফ্রীডম অভ অ্যাকশন এমনভাবে সংকুচিত হয়ে আসবে যে, আপনারা একটি এবং একমাত্র পথটির দিকে তাড়িত হবেন।

সেই বিশেষ পথটি আমাদের সাইকোলজি হিসেব করে বের করে রেখেছে এবং রেখেছে বিশেষ একটি কারণে।

যদিও অল্প সংখ্যক লোকই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, কিন্তু এ-কথা সত্য যে, গত কয়েক শতাব্দী ধরে গ্যালাকটিক সভ্যতা একটি বদ্ধ দশার মধ্যে পড়ে আছে আর ক্রমেই এর অবনতি ঘটছে। কিন্তু এখন পেরিফেরি শেষ পর্যন্ত ভেঙে যাচ্ছে আর তার ফলে এম্পায়ার-এর রাজনৈতিক সংহতি টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের ধারেকাছের কোনো একটা সময় বরাবর আগামী দিনের ঐতিহাসিকরা একটা আবছা রেখা টেনে বলবেন: এখান থেকে শুরু হয়েছে গ্যালাকটিক এম্পায়ার-এর পতন।

ঠিকই বলবেন তাঁরা, যদিও পতন-পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে কেউ সেই পতনকে পতন বলে চিনতে পারবে কিনা, সেন্দহ।

আর পতনের পরেই শুরু হবে এক অনিবার্য বর্বর যুগ। আমাদের সাইকোহিস্ট্রি বলছে, সাধারণ পরিস্থিতিতে এই বর্বর যুগ তিরিশ হাজার বছর স্থায়ী হবে। পতনটাকে রোধ করতে পারবো না আমরা, করতে চাই-ও না। কারণ এম্পায়ার-সংস্কৃতির যে প্রাণ প্রাচুর্য আর উৎকর্ষ একসময় ছিল, এখন আর তা নেই। কিন্তু অবশ্যম্ভাবী সেই বর্বর যুগের মেয়াদ কমিয়ে আমরা এক হাজার বছরে নিয়ে আসতে পারি।

পঞ্চাশ বছর আগে যেমন ফাউণ্ডেশন সম্পর্কিত সত্যি কথাটি আমরা আপনাদের জানাতে পারিনি, সে-রকম, এই বর্বর যুগের মেয়াদ সংক্ষিপ্তকরণ প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি বিষয়ও এ-মুহূর্তে জানাতে পারছি না। এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আপনারা জেনে গেলে পরিকল্পনাটা হয়ত ভেস্তে যাবে। ইনসাইক্লোপীডিয়া সংক্রান্ত প্রতারণার ব্যাপার আগেভাগে জেনে ফেললেও গোটা ব্যাপারটা কেচে যেতে পারতো, তার কারণ, অবহিত থাকার কারণে আপনাদের ফ্রীডম অভ অ্যাকশন বেড়ে যেত আর তাতে করে ব্যবহৃত অ্যাডিশনাল ভ্যারিয়েবল-এর সংখ্যা এতো বেড়ে যেত যে তা আমাদের সাইকোলজির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত।

 

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

কিন্তু আপনারা অবহিত হতে পারবেন না তার কারণ টার্মিনাসে কোনো সাইকোলজিস্ট নেই। অ্যালুরিন ছাড়া কেউ ছিলেনও না কখনো- আর তিনি ছিলেন আমাদেরই লোক।

তবে আপনাদের আমি এটুকু বলতে পারি, টার্মিনাসে এবং গ্যালাক্সির অপর প্রান্তে টার্মিনাসের সহযোগী ফাউণ্ডেশনই হচ্ছে নবজাগরণের বীজ এবং সেকেণ্ড গ্যালাকটিক এম্পায়ার-এর দুই ভাবী প্রতিষ্ঠাতা। আর এই বর্তমান সংকটটিকে দিয়েই টার্মিনাসের যাত্রা শুরু হলো সেই চরম পরিণতির দিকে।

এবারের সংকটটা অবশ্য নেহাতই সহজ সরল। সামনে যেসব আছে সেগুলোর চেয়ে অনেক সাদামাঠা। সংক্ষেপে বলতে গেলে সমস্যাটা এই: আপনারা এমন একটা গ্রহে বাস করছেন যে-গ্রহটা হঠাৎ করে এখন-পর্যন্ত-সভ্য গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিবেশীরা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আপনাদের জন্যে। বিজ্ঞানীদের নিয়ে তৈরি এমন একটি ছোট বিশ্বের বাসিন্দা আপনারা যে-বিশ্বের চারদিকে বিশাল আর ক্রমবর্ধমান বর্বতার রাজতু। আপনারা অ্যাটমিক পাওয়ার-সম্পন্ন একটি দ্বীপ, কিন্তু দ্বীপটি এমন এক সাগরে অবস্থিত, যে-সাগরে আদ্দিকালের এনার্জিই বেড়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। কিন্তু তারপরেও ধাতব সম্পদের অভাবে আপনারা নিতান্তই অসহায়।

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কঠিন এক প্রয়োজনের মুখোমুখি আপনারা এখন। বাধ্য হয়ে পড়েছেন আপনারা অ্যাকশন নিতে। সে অ্যাকশনের প্রকৃতি- অর্থাৎ আপনাদের সংকটের সমাধান- নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

খোলা জায়গায় চলে এল হ্যারি সেলডনের মূর্তিটা। বইটা আবার দেখা গেল তাঁর হাতে। সেটা খুলে তিনি বললেন, তবে আপনাদের ভবিষ্যৎ ইতিহাস যে সর্পিল পথই নিক না কেন উত্তরপুরুষদের সবসময় আপনারা এধারণাই দিয়ে যাবেন যে, পথটা পূর্ব নির্ধারিত এবং এপথের শেষে অপেক্ষা করছে এক নতুন ও বৃহত্তর এম্পায়ার!

তার চোখ বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ হতেই শূন্যে মিলিয়ে গেলেন তিনি। ঘরের বাতি উজ্জ্বল হয়ে উঠল আবার।

হার্ডিন মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলেন, করুণ দৃষ্টি মেলে, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে, তার দিকেই চেয়ে আছেন পিরেন।

দৃঢ় তবে নীরস কণ্ঠে বলে উঠলেন চেয়ারম্যান, তোমার কথাই ঠিক মনে হচ্ছে। তুমি যদি আজ রাত ছটায় আমাদের সঙ্গে দেখা কর তাহলে ভাল হয়। পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করার ব্যাপারে বোর্ড তোমার সঙ্গে আলাপ করতে পারে তাহলে।

একে একে সবাই হার্ডিনের সঙ্গে করমর্দন করে বেরিয়ে গেলেন। সবার সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে আপন মনে হাসলেন তিনি। শত হলেও, নিজেদের ভুল স্বীকার করার মতো সৎ-সাহস সম্পন্ন বিজ্ঞানী এঁরা সবাই। তবে তাঁরা তাঁদের নিজেদের ব্যাপারে বড্ড দেরি করে ফেলেছেন।

নিজের ঘড়ির দিকে তাকালেন তিনি। এতক্ষণে সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে লী-র লোকজন। বোর্ডের হাতে আর হুকুম দেবার ক্ষমতা নেই।

অ্যানাক্রিয়নবাসীরা তাদের প্রথম স্পেস-শিপ টার্মিনাসের মাটিতে নামাচ্ছে আগামীকাল। তাতে কোনো অসুবিধা নেই, ছমাস মাত্র, তারপর ওরাও হুকুম করবে না আর।

আসলে ঠিকই বলেছেন হ্যারি সেলডন; ঠিকই অনুমান করেছিলেন স্যালভর হার্ডিন অ্যানসেল্ম হট রডরিক অ্যানাক্ৰিয়নের পারমাণবিক শক্তিহীনতার কথা ফাঁস করে দেবার পর থেকে এই সংকটের সমাধান অতি সরল।

জলবৎ তরলং!

বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]
বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

cropped Bangla Gurukul Logo বিশ্বকোষ রচয়িতাদের কথা -ফাউণ্ডেশন (১৯৫১) আইজাক আসিমভ [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment