বাবুরের মহত্ত্ব । কালিদাস রায়

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ বাবুরের মহত্ত্ব । যা সাহিত্য কণিকার অন্তর্গত। এটি কালিদাস রায় রচিত কবিতা।’বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতাটি কালিদাস রায়ের ‘পর্ণপুট’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। এ কবিতায় মুঘলসম্রাট বাবুরের মহানুভবতা বর্ণিত হয়েছে। এতে তাঁর মহৎ আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ তুলে ধরা হয়েছে।

 

বাবুরের মহত্ত্ব । কালিদাস রায়

 

বাবুরের মহত্ত্ব । কালিদাস রায়

পাঠান-বাদশা লোদি

পানিপথে হত। দখল করিয়া দিল্লির শাহিগদি,

দেখিল বাবুর এ-জয় তাঁহার ফাঁকি,

ভারত যাদের তাদেরি জিনিতে এখনো রয়েছে বাকি ।

গর্জিয়া উঠিল সংগ্রাম সিং, “জিনেছ মুসলমান

জয়ী বলিব না এ দেহে রহিতে প্রাণ ।

লয়ে লুণ্ঠিত ধন

দেশে ফিরে যাও, নতুবা মুঘল, রাজপুতে দাও রণ।

খানুয়ার প্রান্তরে

সেই সিংহেরো পতন হইল বীর বাবুরের করে।

এ বিজয় তার স্বপ্ন-অতীত, যেন বা দৈব বলে

সারা উত্তর ভারত আসিল বিজয়ীর করতলে।

কবরে শায়িত কৃতঘ্ন দৌলত,

বাবুরের আর নাই কোনো প্রতিরোধ ।

দস্যুর মতো তুষ্ট না হয়ে লুণ্ঠিত সম্পদে,

জাকিয়া বসেছে মুঘল সিংহ দিল্লির মসনদে।

মাটির দখলই খাঁটি জয় নয় বুঝেছে বিজয়ী বীর,

বিজিতের হৃদি দখল করিবে এখন করেছে স্থির।

প্রজারঞ্জনে বাবুর দিয়াছে মন,

হিন্দুর-হৃদি জিনিবার লাগি করিতেছে সুশাসন,

ধরিয়া ছদ্মবেশ

ঘুরি পথে পথে খুঁজিয়ে প্রজার কোথায় দুঃখ ক্লেশ ।

চিতোরের এক তরুণ যোদ্ধা রণবীর চৌহান

করিতেছে আজি বাবুরের সন্ধান,

দাঁড়ায়ে যুবক দিল্লির পথ-পাশে

কুর্তার তলে কৃপাণ লুকায়ে ঘুরিছে সে পথে পথে

দেখা যদি তার পায় আজি কোনো মতে

লইবে তাহার প্রাণ,

শোণিতে তাহার ক্ষালিত করিবে চিতোরের অপমান ।

দাঁড়ায়ে যুবক দিল্লির পথ-পাশে

লক্ষ করিছে জনতার মাঝে কেবা যায় কেবা আসে ।

হেন কালে এক মত্ত হস্তী ছুটিল পথের পরে

পথ ছাড়ি সবে পলাইয়া গেল ডরে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সকলেই গেল সরি

কেবল একটি শিশু রাজপথে রহিল ধুলায় পড়ি।

হাতির পায়ের চাপে

‘গেল গেল’ বলি হায় হায় করি পথিকেরা ভয়ে কাঁপে।

‘কুড়াইয়া আন ওরে’

সকলেই বলে অথচ কেহ না আগায় সাহস করে।

সহসা একটি বিদেশি পুরুষ ভিড় ঠেলে যায় ছুটে,

‘কর কী কর কী’ বলিয়া জনতা চিৎকার করি উঠে

করি-শুণ্ডের ঘর্ষণ দেহে সহি

পথের শিশুরে কুড়ায়ে বক্ষে বহি

ফিরিয়া আসিল বীর ।

চারি পাশে তার জমিল লোকের ভিড়।

বলিয়া উঠিল এক জন, ‘আরে এ যে মেথরের ছেলে,

ইহার জন্য বে-আকুফ তুমি তাজা প্রাণ দিতে গেলে?
খুদার দয়ায় পেয়েছ নিজের জান,

ফেলে দিয়ে ওরে এখন করগে স্নান।’

শিশুর জননী ছেলে ফিরে পেয়ে বুকে

বক্ষে চাপিয়া চুমু দেয় তার মুখে ।
বিদেশি পুরুষে রাজপুত বীর চিনিল নিকটে এসে,

এ যে বাদশাহ স্বয়ং বাবুর পর্যটকের বেশে।

ভাবিতে লাগিল, ‘হরিতে ইহারই প্রাণ

পথে পথে আমি করিতেছি সন্ধান?

বাবুরের পায়ে পড়ি সে তখন লুটে

কহিল সঁপিয়া গুপ্ত কৃপাণ বাবুরের করপুটে,”

‘জাঁহাপনা, এই ছুরিখানা দিয়ে আপনার প্রাণবধ

করিতে আসিয়া একি দেখিলাম! ভারতের রাজপদ

সাজে আপনারে, অন্য কারেও নয় ।

বীরভোগ্যা এ বসুধা এ কথা সবাই কয়,

ভারত-ভূমির যোগ্য পালক যেবা,

তাহারে ছাড়িয়া, এ ভূমি অন্য কাহারে করিবে সেবা ?

কেটেছে আমার প্রতিহিংসার অন্ধ মোহের ঘোর,

সঁপিনু জীবন, করুন এখন দণ্ডবিধান মোর।’

রাজপথ হতে উঠায়ে যুবকটিরে

কহিল বাবুর ধীরে,

‘বড়ই কঠিন জীবন দেওয়া যে জীবন নেওয়ার চেয়ে

জান না কি ভাই? ধন্য হলাম আজিকে তোমারে পেয়ে

আজি হতে মোর শরীর রক্ষী হও;

প্রাণ-রক্ষকই হইলে আমার, প্রাণের ঘাতক নও।’

 

বাবুরের মহত্ত্ব । কালিদাস রায়

 

শব্দার্থ ও টীকা

হত – নিহত

শাহিদি – বাদশার গদি, সিংহাসন ।

জিনিতে – জয় করতে।

রণ – যুদ্ধ।

প্রান্তর –  বিস্তৃত মাঠ, ময়দান ৷

স্বপ্ন-অতীত – স্বপ্নের অতীত, যা স্বপ্নেও দেখা যায় না, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়।

করতল – হাতের তালু।

প্রতিরোধ – বাধা।

তুষ্ট – তৃপ্ত , আনন্দিত, খুশি।

মসনদ –  সিংহাসন, রাজাসন ।

করি-শুভ – হাতির শুঁড়।

বে-আকুফ –  নির্বোধ ।

পর্যটক – ভ্রমণকারী।

কৃপাণ – ছোট তরবারি, খড়্গগ

বসুধা – পৃথিবী ।

ঘাতক – হত্যাকারী।

দন্ডবিধান  – শাস্তি প্রদান ।

বাবুর – ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। তাঁর আসল নাম জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ। তবে তিনি ‘বাবুর’ বা ‘সিংহ’ নামেই সমধিক পরিচিত । তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে মধ্য-এশিয়ার সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহন করেন এবং অল্প বয়সেই দু’বার সিংহাসন হারান। তারপর তিনি নিজ দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানের সিংহাসন অধিকার করেন এবং পরে ভারতের ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করেন। মেবারের রাজা সংগ্রাম সিংহকে তিনি পরাজিত করেন। এভাবে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন বাবুর।

পাঠান বাদশা লোদি – ভারতের লোদি বংশীয় শেষ পাঠান-সম্রাট সুলতান ইব্রাহিম লোদি ।

পানিপথ – দিল্লীর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে তিনটি প্রসিদ্ধ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।

সংগ্রাম সিংহ – রাজপুতানার অন্তর্গত মেবার রাজ্যের অধিপতি রাজা সংগ্রাম সিংহ। তিনি খানুয়ার প্রান্তরে বাবুরের কাছে পরাজিত হন।

খানুয়ার প্রান্তর — আগ্রার পশ্চিমে অবস্থিত যুদ্ধক্ষেত্র।

কৃতঘ্ন দৌলত – বাবুরের ভারত আক্রমণকালে দৌলত খাঁ লোদি পাঞ্জাবের শাসক ছিলেন। তিনি নিজের দুশমন ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাবুরকে ভারত আক্রমণের জন্য আহ্বান করেন। পরে তিনি বাবুরের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেন।

চিতোর — রাজপুতানার মেবার রাজ্যের রাজধানী।

রণবীর চৌহান –  রাজপুত জাতির একটি প্রাচীন শাখার নাম চৌহান। যে স্বদেশপ্রেমিক রাজপুত যুবক বাবুরকে হত্যা করতে চেয়েছিল তাকে বলা হয়েছে ‘রণবীর চৌহান’।

 

বাবুরের মহত্ত্ব । কালিদাস রায়

 

পাঠের উদ্দেশ্য

কবিতাটি পাঠ করার মাধ্যমে সম্রাট বাবুরের মহানুভবতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা অবহিত হবে। তারা মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হবে।

পাঠ-পরিচিতি

‘বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতাটি কালিদাস রায়ের ‘পর্ণপুট’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। এ কবিতায় মুঘলসম্রাট বাবুরের মহানুভবতা বর্ণিত হয়েছে। এতে তাঁর মহৎ আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ তুলে ধরা হয়েছে। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবুর। রাজ্য বিজয়ের পর তিনি প্রজা সাধারণের হৃদয় জয়ে মনোযোগী হলেন । রাজপুতগণ তাঁকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

রাজপুত-বীর তরুণ রণবীর চৌহান বাবুরকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে দিল্লির রাজপথে ঘুরছিল। এমন সময় বাবুর নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে মত্ত হাতির কবল থেকে রাজপথে পড়ে-থাকা একটি মেথর শিশুকে উদ্ধার করেন। রাজপুত যুবক বাবুরের মহত্ত্বে বিস্মিত হয়। সে বাবুরের পায়ে পড়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে। মহৎপ্রাণ বাবুর তাকে ক্ষমা করেন এবং তাকে নিজের দেহরক্ষী নিয়োগ করেন।

কবি-পরিচিতি

কালিদাস রায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে তিনি আদর্শ পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন। তিনি বিচিত্র বিষয়ের ওপর কবিতা লিখেছেন। তিনি বেশ কিছুসংখ্যক কাহিনি-কবিতা রচনা করেন। তিনি তাঁর কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক প্রয়োগ করেছেন। কবি হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘কবিশেখর’ উপাধিতে ভূষিত হন। কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করে ৷

কালিদাস রায়ের উল্লেখযোগ্য কাব্য : ‘কিশলয়’, ‘পর্ণপুট’, ‘বল্লরী’, ‘ঋতুমঙ্গল’, ‘রসকদম্ব’ ইত্যাদি । তিনি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

নমুনা প্রশ্ন

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতাটি কালিদাস রায়ের কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে?

ক. কিশলয়

খ. পর্ণপুট

গ. ঋতুমঙ্গল

ঘ. বৈকালী

২. ‘জয়ী বলিব না এ দেহে রহিতে প্রান।’ কে এই প্রতিজ্ঞা করেছিল?

ক. চৌহান

খ. সংগ্রাম সিং

গ. দৌলত খাঁ

ঘ. ইব্রাহিম লোদি

৩. ‘বীরভোগ্যা এ সুবিধা’- এ কথার অর্থ কী?

ক. বীরপুরুষেরাই এ পৃথিবীতে মর্যাদা পেয়ে থাকেন

খ. বীরপুরুষগণই পৃথিবীতে কীর্তি স্থাপন করে থাকেন

গ. বীরগণ পৃথিবীকে বেশি ভোগ করেন

ঘ. এ পৃথিবীতে বীরের অধিকারই স্বীকৃত

৪. বাবুরের মহত্ত্ব কবিতায় ফুটে উঠেছে বাবুরের-

i. ক্ষমাশীলতা

ii. বীরত্ব

iii. মহানুভবতা

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i

খ. i ও ii

গ. iii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের চরণ দুটো পড় এবং ৫ ও ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও । কেটেছে আমার প্রতিহিংসার অন্ধ মোহের ঘোর, সঁপিনু জীবন, করুন এখন দণ্ডবিধান মোর।’

৫. কেটেছে আমার প্রতিহিংসার অন্ধ মোহের ঘোর, কার প্রতিহিংসার ঘোর কেটেছে?

ক. চৌহানের

খ. সংগ্রাম সিং-এর

গ. দৌলত খাঁ-এর

ঘ. ইব্রাহিম লোদির

৫. ‘করুন এখন দন্ডবিধান মোর’- কিসের দন্ডবিধানের কথা এখানে বলা হয়েছে?

i. প্রতিহিংসার

ii. অন্ধ মোহের

iii. অপরাধের

নিচের কোনটি সঠিক?

ক. i

খ. i ও ii

গ. iii

ঘ. i, ii ও iii

সৃজনশীল প্রশ্ন

প্রচণ্ড বন্যায় ডুবে যায় টাঙ্গাইলের ব্যাপক অঞ্চল। অনেকেরই ঘর-বাড়ি ডুবে যায়। নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে অগণিত মানুষ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এমনি একটা পরিবার নৌকায় চড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে। তীব্র স্রোতের টানে নৌকাটি উল্টে গেলে সবাই সাঁতার কেটে উঠে এলেও জলে ডুবে যায় একটি শিশু। বড় মিয়া নামের এক যুবক এ দৃশ্য দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করেন শিশুটিকে। কূলে উঠে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ডাক্তার এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন বড় মিয়া আর বেঁচে নেই।

ক. রনবীর চৌহান কে ছিলেন?

খ. ‘বড়ই কঠিন জীবন দেওয়া যে জীবন নেওয়ার চেয়ে।’ কেন?

গ. উদ্দীপকে বর্ণিত বড় মিয়া আচরণে ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতায় ফুটে ওঠা দিকটি ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. উদ্দীপকটিতে ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতার একটা বিশেষ দিকের প্রতিফলন ঘটলেও সমভাব ধারণ করে না – যুক্তিসহ বুঝিয়ে লেখ । –

২. “বাঁচিতে চাই না আর

জীবন আমার সঁপিলাম, পীর, পূত পদে আপনার।

ইব্রাহীমের গুপ্তঘাতক আমি ছাড়া কেউ নয়,

ঐ অসিখানা এ বুকে হানুন সত্যের হোক জয়।”

ক. বাবুর এর আসল নাম কী ?

খ. সঁপিনু জীবন, করুন এখন দণ্ডবিধান মোর’। — উক্তিটি কার, কেন?

গ. উদ্দীপকে উল্লিখিত ইব্রাহীমের গুপ্তঘাতকের সাথে ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতায় বর্ণিত রাজপুত বীরের সাদৃশ্যপূর্ণ দিকটি ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. উদ্দীপকটি ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ কবিতার সমগ্র ভাব প্রকাশে কতটুকু সক্ষম তা যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে বল ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment