বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা: আমরা গল্প শুনে বা পড়ে আনন্দ পাই। যে কোনো গল্পেই আমরা আকৃষ্ট হই ঘটনার ঘনঘটায়। গল্পে রয়েছে কাহিনী। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানা কাহিনীর সূত্র ধরে মানব জাতির নানা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। আর এ কাহিনী ও চরিত্রের মধ্যেই ফুটে ওঠে গল্পের মর্মবাণী। এভাবে একজন গল্পকার জীবন ও জগত সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটান এবং মানব ভাগ্যের সম্পর্ক নির্ণয় করেন । তাই গল্প হয়ে ওঠে সুখপাঠ্য, সুশ্রাব্য এবং আনন্দঘন। গল্প এ কারণেই সাহিত্যের একটি রসময়, বৈচিত্র্যময় উপাদান।

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প

ছোটগল্প কি? : ছোটগল্প একদিকে যেমন নতুন, অপরদিকে তেমনি পুরাতন। ইতালীয় সাহিত্যে Gesta Romanorum, ইংরেজি সাহিত্যে বাইবেল, সংস্কৃতে বিষ্ণুশর্মার ‘হিতোপদেশ’ ও ‘পঞ্চতন্ত্র’, বৌদ্ধসাহিত্যের ‘জাতকের গল্প’ ইত্যাদি গল্পসাহিত্যে ছোট’গল্পের চিরন্তন আবেদনেরই সাক্ষ্য বহন করে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, আধুনিক ছোট’গল্প একপ্রকার নতুন সৃষ্টি । প্রাচীনকালের গল্পের মতো এরা যথেচ্ছবিহারী, প্রগলভ ও নিরুদ্দেশপন্থী নয়। আধুনিক গল্পলেখক বিষয়বস্তু, চরিত্র সৃষ্টি, কথোপকথন, পরিবেশ সৃষ্টি, বাণীভঙ্গি প্রভৃতি প্রত্যেকটি বিষয় সম্বন্ধে একান্তভাবে আত্মসচেতন। 

 

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

 

ছোটগল্প বা গল্প আকৃতিতে ছোট হলেই ছোটগল্প হয় না। আকৃতিগত ব্যতীত প্রকৃতিগত এবং মর্মগত অনেক বিভিন্নতা একে উপন্যাস থেকে পৃথক শ্রেণীভুক্ত করেছে। 

  1. A. Poe (১৮০৯-৪৯) বলেন, যে গল্প অর্থ থেকে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায় তাকে ছোটগল্প বলে।
  2. G. Wells বলেন যে, ছোটগল্প ১০ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আসল কথা হলো, ছোটগল্প আকারে ছোট বলে এতে জীবনের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা থাকতে পারে না; জীবনের খণ্ডাংশকে লেখক যখন রসনিবিড় করে ফোটাতে পারেন তখনই এর সার্থকতা। জীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত কোনো বিশেষ পরিবেশের মধ্যে কেমনভাবে লেখকের কাছে প্রত্যক্ষ হয়েছে এটা তারই রূপায়ণ। এতে অনাবশ্যক কথা, অনাবশ্যক ভাষা, অনাবশ্যক চরিত্র ও ঘটনা প্রভৃতিকে বর্জন করে লেখক শুধু একটি রসঘন নিবিড় মুহূর্তের পরিস্ফুটন ঘটান। ছোটগল্পের আরম্ভ ও উপসংহার নাটকীয় হয়ে থাকে। কোথায় আরম্ভ হবে এবং কোথায় সমাপ্তির রেখা টানতে হবে এ শিল্পদৃষ্টি যার নেই তার পক্ষে ছোট’গল্প লেখা অসম্ভব।

উপন্যাস বা নাটকে পরিতৃপ্তি আছে, ছোটগল্পে ইঙ্গিত-মধুরতা আছে। অথচ এ ক্ষুদ্র কলেবরের মধ্যে নিগূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনাই এর সার্থকতা। ছোট’গল্পের প্রকৃতি ও গঠনরীতি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজের মনের অজান্তে বলে ফেলেছেন—

ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা

নিতান্তই সহজ-সরল

সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা

তারি দুচারিটি অশ্রুজল।

নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ

অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে

শেষ হয়ে ও হইল না শেষ।

 

“শেষ হয়ে হইল না শেষ’ একেই আমরা ব্যঞ্জনার মাধুর্য বলে থাকি। ছোটগল্প লেখকের আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করে। এতে বিশেষ প্রকারের গঠনরীতি, বিষয়বস্তু চয়ন, চরিত্র সৃষ্টি, কথোপকথন, পরিবেশ সৃষ্টি, বাণীভঙ্গি প্রভৃতির প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। এতে লেখক পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তি, অনুভূতি অথবা অন্তরতম প্রদেশ পর্যন্ত আলোড়িত করতে পারেন।

ছোটগল্প মানবজীবনের গভীরতর রহস্য ভেদ করতে চায় না, জীবনের অবিরাম স্রোতে মনপ্রাণ ও বিলীয়মান যে তরঙ্গ উঠছে, পড়ছে, ভাঙ্গছে তাকেই লেখক স্থিরদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেন। এতে নাটক, উপন্যাস বা মহাকাব্যের বিস্তৃতি নেই। জীবনের খরূপ এখানে বিশেষরূপে ধরা দেয়। এ রূপসৃষ্টিকে সার্থক করার জন্য লেখক গল্পের উপাদান ও ভাববিন্যাসে একটিমাত্র রসপরিণামমুখী করে তুলতে চেষ্টা করেন। শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের আদর্শ এই।

ছোটগল্পের শ্রেণীবিভাগ: সংজ্ঞা নির্মাণ যেমন সুকঠিন, শ্রেণীবিভাগ ততোধিক কঠিন। তথাপি ছোটগল্পকে বিষয়বস্তুর দিক থেকে কতিপয় শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ছোটগল্প অশেষ বৈচিত্র্য লাভ করেছে। নিচে ছোটগল্পের শ্রেণীবিভাগ দেখানো হলো:

১. প্রেম বিষয়ক: এ শ্রেণীর গল্পে প্রেমের বিচিত্র লীলা বিচিত্র পরিবেশে বিচিত্র অবস্থায় এমনভাবে অঙ্কিত হয় যে, প্রেমের একটি মাত্র রসপরিণাম গল্পে মুখ্য হয়ে ওঠে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানী’, রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’, ‘শেষ রাত্রি’, ‘নষ্টনীড়’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ভষ্মশেষ’, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘সর্পিল’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

২. সামাজিক: এ জাতীয় গল্পে বিশেষ কোনো সামাজিক পরিবেশ-রসই মুখ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের, ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘পোস্টমাস্টার’, শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’, তারাশঙ্করের ‘পিতাপুত্র’, নরেন্দ্র মিত্রের ‘রস’ উল্লেখযোগ্য।

৩. প্রকৃতি ও মানুষ: এ শ্রেণীর গল্পে প্রকৃতির পটভূমিতে চরিত্রাঙ্কন করা হয় এবং প্রকৃতি মানুষের সুখ-দুঃখের পশ্চাৎপদরূপে ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘তারাপদ’, ‘অতিথি’, মনোজ বসুর ‘বনমর্মর’ উল্লেখযোগ্য।

৪. হাস্যরসাত্মক: এ শ্রেণীর গল্পে আখ্যানভাগ বা চরিত্রচিত্র অপেক্ষা হাস্যরস মধুরতার স্পর্শই প্রাধান্য পায়। রবীন্দ্রনাথের ‘অধ্যাপক’, প্রভাতকুমারের ‘রসময়ীর রসিকতা’ উল্লেখযোগ্য।

৫. সাংকেতিক বা প্রতিকী: যে শ্রেণীর পরে পাত্র-পাত্রী বা পরিবেশকে না বুঝিয়ে অন্য কোনো অর্থকে ব্যঞ্জনা করে এবং তা-ই তোর মুখ্য আবেদন হয়ে ওঠে সেগুলোকে প্রতিক গল্প বলে। রবীন্দ্রনাথের “তাসের দেশ’, ‘গুপ্তধন’ উল্লেখযোগ্য। 

৬. মনস্তাত্ত্বিক: যে গল্পে নর-নারীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয় রসঘন হয়ে ফুটে ওঠে সেগুলোকে মনস্ত গল্প বলা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’, শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ উল্লেখযোগ্য। 

৭. বাস্তবনিষ্ঠ: যে গল্পে জীবনের কোনো অধ্যায় বা কাহিনী অকুণ্ঠ বাস্তবতামণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পায়, যাতে বিষয়বস্তু কোনো আদর্শ বা ভাবজ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না, সে শ্রেণীর গল্পকে বাস্তবনিষ্ঠ গল্প বলা যায়। প্রবোধ সাম্রালের ‘অঙ্গার’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক অচিন্ত্য সেনের ‘বস্তু’ উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও আরো কতিপয় শ্রেণীর ছোট’গল্প লিখিত হয়ে থাকে; যেমন— উদ্ভট, অতিপ্রাকৃত, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, গার্হস্থ্য, ডিটেকটিভ এবং বিদেশী পটভূমিকাযুক্ত গল্প ইত্যাদি।

ছোটগল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ একপ্রকার শিল্পসমষ্টি। এর পৌর্বাপর্ব নেই, এটি জীবনের খণ্ডাংশের মহিমাজ্জ্বল কান্তি। তবে উপন্যাসের মতো এখানেও বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা হতে পারে, কিন্তু সংযত ও ছোট পরিধির মধ্যে। উপন্যাস যেখানে পাঠককে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়, ছোটগল্প সেখানে তাকে বোঝার অবকাশ দেয়। এ কারণে যারা আত্মভাবপরায়ণ তাদের ছোট’গল্প রসনিবিড় হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে জনৈক সমালোচকের উক্তিটি বিশেষভাবে স্মরণীয় –

“No man ought to embark upon a career of short story writing who is not aware that he himself lives a hundred short stories a day, and that he is not unlike anybody else in the world in this.”

কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, লেখক ছোটগল্পের আঙ্গিক কৌশল অগ্রাহ্য করে তাকে গল্প পরম্পরায় উপস্থাপিত করতে প্রয়াসী হন। এতে গ্রন্থকার ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত ও সংযত রস-গাঢ়তার সাথে উপন্যাসের লক্ষণ সংযোজিত করে আখ্যানবস্তু বা চরিত্রের বিকাশ সাধন করেন।

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প: আমাদের দেশের সংকীর্ণ পরিসর, বৈচিত্রহীন জীবনযাত্রার সাথে ছোট”গল্পের একটি স্বাভাবিক সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রয়েছে। এছাড়াও এখানকার জীবনের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে গল্পের বিষয়েও বৈচিত্র্য এসেছে। যেমন, আধুনিক যুগের মানুষের জীবনে অবসর কম, কাজ বেশি। সুতরাং এর মধ্যেই আনন্দ পেতে হলে তাকে সুবৃহৎ উপন্যাসের আশ্রয় গ্রহণ করা সম্ভব। নয়। ইংরেজি, ফরাসি, রুশীয় এবং আমেরিকান সাহিত্যে অতুলনীয় ছোট’গল্প আছে। ইংরেজিতে স্টিভেনসন, হেনরি জেমস্, ওয়েলস, ডি. এইচ. লরেন্স, ফরাসিতে আনাতোলে ফ্রাঁ, মোপাসা; রাশিয়ার গেসিগল, টলস্টয়, আমেরিকার এডগার এলান পো, ব্রেটহার্ট হেনরি প্রভৃতি খ্যাতনামা লেখক।

বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

 

বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তার গল্প আধুনিক ছোটগল্প বলতে যে শিল্পসমষ্টি বোঝায়, তা হয়নি। রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের পথপ্রদর্শক ও শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা। আমাদের বাহ্যত তুই অকিঞ্চিৎকর জীবনের তলদেশে যে একটি অশ্রুসজল ভাবন গোপন প্রবাহ আছে, রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য স্বচ্ছ অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ অন্তদৃষ্টির সাহায্যে সেগুলোকে আবিষ্কার করে পাঠকের বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে মেলে ধরেছেন। তার কোনো কোনো গল্পে হাস্যরস বা কৌতুকপ্রিয়তা, কোথাও জীবনের গভীরতা, ক্ষুদ্র ভুলভ্রান্তি, অসামান্য কবিত্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।

একটিমাত্র ভাবের সুর যেন তার গল্পকে কাব্যিক অনুভূতির মৃদু প্রলেপে আচ্ছন্ন করে তাকে গীতিকবিতার মাধুর্য দান করেছে। ফলে তার অধিকাংশ গল্পই গীতিকাব্যধর্মী হয়ে উঠেছে। জীবনের কুশ্রীতা, নগণ্যতা রবীন্দ্র কাব্যদৃষ্টিতে বিধৌত হয়ে যে নির্মল রসচেতনায় একাকার হয়ে উঠেছে, সে শ্রেণীর রসচেতনা পরবর্তী বাংলা গল্প সাহিত্যে দেখা যায় না।

একমাত্র শরত্চন্দ্রের ছোটগল্পে বাংলার বঞ্চিত বেদনা ভাষা পেয়েছে এবং গল্পগুলো যেন হৃদয়াবেগের প্রেরণায় মর্মস্পর্শী হয়ে মানবতা বা মনুষ্যত্বের স্তুতিরূপে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সাধনার মধ্যবর্তী সময়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তার গল্পে জীবনের ছোটখাটো ঘটনা হাস্যোজ্বল কৌতুক রসিকতায় সংযত অথচ লঘু কোমল স্পর্শে বিচিত্র রূপ লাভ করেছে। তিনি তার ছোটগল্পে একটি সহজ অথচ বিস্ময়কর এবং অভ্রান্ত পরিণতির অর্থ ব্যঞ্জনা ও রূপকথাসুলভ ভাবমণ্ডল সৃষ্টি করে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার সূক্ষ্ম সংযম জ্ঞান ও স্বাভাবিকতাবোধই তাকে শ্রেষ্ঠ শিল্পীর পর্যায়ে উন্নীত করেছে।

ছোটগল্পে বিশিষ্ট দৃষ্টি ও বাণীভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন প্রমথ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “গল্প সাহিত্যে তিনি ঐশ্বর্য দান করেছেন। অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যে মিলেছে তার অভিজাত মনের অনন্যতা, গাঁথা হয়েছে ভাষার শিল্পে।” পরবর্তীকালে ভাবদৃষ্টি নয়, বাস্তবদৃষ্টিই গল্পের ভূষণরূপে পরিগণিত হয়েছে এবং মানুষ অপেক্ষা মানুষের সমাজই গল্প লেখকের কাছে বড় হয়ে উঠেছে।

এরপর শৈলজানন্দ তার গল্পে বাস্তবদৃষ্টি ও বস্তুতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। তারাশঙ্করের গৌরবও এতে কম নয়। তিনি আধুনিক বাস্তবতামূলক সমস্যাকে গ্রহণ করে এর মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের গভীর রহস্যকে স্পর্শ করেছেন। তার ‘জলসাঘর’ ও ‘রসকালী’ সার্থক গল্পের নিদর্শনরূপে গৃহীত হয়েছে। তাঁর অধিকাংশ ছোট’গল্পের অন্যতম বিষয় বিলীয়মান মধ্যযুগীয় জমিদার বংশ। ছোটগল্প সাহিত্যে ‘বনফুল’ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। মানব জীবনের “বিন্দু বিসর্গ’ অবলম্বনে তিনি যে শ্রেণীর নাতিদীর্ঘ ব্যঞ্জনাদীপ্ত গল্প রচনা করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তা অভিনব ।

রোমান্টিক কল্পনাষিদ্ধ সুকুমার গল্প রচনায় মনীন্দ্র লাল বসু, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনোজ বসু দক্ষতা দেখিয়েছেন। বাংলার প্রকৃতিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করার নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অকুণ্ঠ বাস্তবনিষ্ঠ গল্পলেখকদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্য সেন ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য।

এদের মধ্যে বুদ্ধদেবের আদর্শ ডি. এইচ. লরেন্স ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ বালজাক। হাস্যরসাত্মক গল্প রচনায় রাজশেখর বসু, বিভূতি মুখোপাধ্যায় ও অমূল্য দাশগুপ্ত অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’ ও ‘পরশুরামের কুঠার’ বাংলা গল্পসাহিত্যে বাস্তবনিষ্ঠতার একটি বিশেষ স্তর সূচনা করেছে। মানুষের মনোবৃত্তি বিশ্লেষণে তিনি কঠোর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্মম সততার পরিচয় দিয়েছেন ।

বাংলাদেশের ছোটগল্প: বাংলাদেশের ছোট’গল্পের ইতিহাস স্বল্প সময়ের। এ সংক্ষিপ্ত সময়ের পরিক্রমায় ছোটগল্প ধীর ধীরে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গিয়েছে। কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল ছোট’গল্পকারের আবির্ভাব এখানকার গল্পসাহিত্যকে সমৃদ্ধি দান করেছে। বর্তমান ছোটগল্পের ইতিহাস বিভাগ- পূর্বকালের ঐতিহ্যের অনুসারী।

অবশ্য দেশবিভাগের পরবর্তী পর্যায়ে ছোটগল্পের ইতিহাস দ্রুত এবং বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে নিজস্ব সাহিত্যের স্বতন্ত্র পরিসরে বহুসংখ্যক গল্পকারের আবির্ভাব লক্ষণীয়। তাছাড়া এখানকার জীবনযাত্রা ও জীবনবোধের পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে গল্পের বিষয়ে যথেষ্ট বৈচিত্র্য এসেছে। বাংলার সবুজ শ্যামল পল্লীপ্রকৃতি নদ-নদী কিংবা গ্রামের মেঠোপথ প্রভৃতি প্রাকৃতিক নৈসর্গ বাংলাদেশের গল্পে স্থান পাচ্ছে। আবার অন্যদিকে নগরকেন্দ্রিক মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাও উপজীব্য হচ্ছে বর্তমান ছোট’গল্পে।

আধুনিক জীবনের নানা সমস্যাও ফুটে উঠেছে বর্তমান ছোট’গল্প সাহিত্যে। শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র বর্তমান ছোট’গল্পে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম প্রভৃতিও বর্তমান ছোট’গল্পে স্থান পেয়েছে। এছাড়া অশ্লীলতাও স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের কিছু কিছু গল্পে। এভাবে বাংলাদেশের গল্পসাহিত্য নানাদিক থেকে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে।

আবুল মনসুর আহমদ, মবিনউদ্দিন আহমেদ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, শাহেদ আলী, ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, শহীদ সাবের, রাহাত খান, শহীদ আখন্দ, হুমায়ুন কাদির, লায়লা সামাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সুব্রত বড়ুয়া প্রমুখ গল্পকার এমনকি নব্য গল্প লেখকগণ তাদের বৈচিত্র্যময় লেখনীর দ্বারা বর্তমান গল্পসাহিত্যে নবযুগের সূচনা করছেন।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার: বাংলা গল্পসাহিত্য যথেষ্ট সম্প্রসারণশীল। বর্তমান সাহিত্যজগতের নতুন ধারায় ছোট’গল্প অপূর্ব বৈচিত্র্যময়তা নিয়ে হাজির হচ্ছে। আধুনিক গল্পকাররা নতুন আঙ্গিকে তাদের গল্প সাহিত্যকে পুষ্ট। করছেন। পাশ্চাত্যের ছোট’গল্পের অনেক অনুবাদ বর্তমানে প্রকাশিত হচ্ছে এবং বর্তমান গল্পকারগণ বাইরের উন্নত গল্পসাহিত্য সম্ভারের সাথে পরিচিত হচ্ছেন। চলছে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সুতরাং বলা যায়, বাংলা ও বাংলাদেশের ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট সম্ভাবনাময় ।

 

ছোট গল্প লেখার নিয়ম ঃ

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment