ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম | কৃষি-কৃষক ও পল্লী উন্নয়ন | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : নাগরিক সভ্যতার বিপুল প্রসার, শিল্পবিপ্লবোত্তর যান্ত্রিক যুগ আজ গ্রামকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। সভ্যতার কেন্দ্রস্থল থেকে গ্রাম আজ নির্বাসিত প্রায়। কিন্তু গ্রাম বর্জন করলে দেশ বাঁচবে না। ৮৫ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে এ সত্যের কোনো বিকল্প নেই। তাই তো আজ আওয়াজ উঠেছে— ‘Back to the village back to your home’. নিজ বাসভূমে প্রত্যাবর্তনের এই যে আহ্বান- এ আহ্বানে আজ সবাইকে সাড়া দিতে হবে। গ্রামগুলোকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার পূর্বতন শ্রী ও সৌন্দর্য। নাগরিক জীবনের চাকচিক্য যতই পিছু ডাকুক- শ্যামল ছায়া মেলে হাতছানি দিয়ে যে গ্রাম ডাকছে আমাদের, এবারে তারই দিকে শুরু হোক যাত্রা ।
ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম | কৃষি-কৃষক ও পল্লী উন্নয়ন | বাংলা রচনা সম্ভার
ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম
‘তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয় ?
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়
উদাসী বনের বায়
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি।’
কবির এ উদাত্ত নিমন্ত্রণ চিরন্তন সত্য। ইংরেজিতে একটি কথা আছে— ‘Man made the town and God made the Country’। কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টি এ গ্রামগুলো আজ এক করুণ পরিণামের শিকার হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। গ্রাম আজ অবহেলিত, তার ছায়া সুনিবিড় শান্তিকুঞ্জ নিশ্চিন্তে বসবাসের দিনগুলো আজ আর নেই।
বাংলার গ্রামের রূপ সুষমা : বাংলাদেশ মানেই গ্রামবাংলা, আর গ্রাম বাংলা মানেই বাংলাদেশ । প্রকৃত প্রদত্ত অকৃপণ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের এ গ্রামগুলো। গ্রামের এ রূপ সুষমার কারণেই আমাদের দেশের অপর নাম ‘সোনার বাংলা’। নদীর কুলকুল রবে, পাখির কুজনে, মৃদুমন্ধ বাতাসে, আম-কাঁঠালের সুনিবিড় ছায়ায় যেন গ্রাম বাংলা ঘুমিয়ে আছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গ্রামগুলো থেকে আমাদের গ্রাম বাংলার স্বাতন্ত্র্য এখানেই। ফসলের সবুজ সমতল মাঠ, বিস্তীর্ণ জলাশয়, আঁকাবাঁকা নদ নদী, পুকুর-দিঘি, বিল-ঝিল ও বন-বনানীর সমন্বয়ে গঠিত বাংলার গ্রাম।
সবুজের এত সমারোহ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাংলার নীল আকাশ কখনো গাঢ় মেঘে আচ্ছন্ন, কখনো রৌদ্র করোজ্জ্বল, কখনো ঝড়-বাদলের ঝাপটা, আবার কখনোবা প্রবল বর্ষণে বিজলী রোষায়িত। ষড়ঋতুর বাংলায় গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত আসে পর্যায়ক্রমে ঋতুবৈচিত্র্যের সাথে মিল রেখে ফোটে নানা বর্ণের ফুল, জন্মায় নানাবিধ ফল আর নানাবিধ ফসল ! আঁকাবাঁকা পথের ধারে ঝোপেড় আড়ালে উকি দেয় গ্রাম বাংলার অগণিত স্বর্ণ কুটির। গোয়াল ঘরের গাভী, উঠানের ধান, আর দোষাড়ের হাস-মুরগি নিয়ে ব্যস্ত কিষাণ বৌ।
চাষের বলদ, মাঠের ফসল, পুকুর ও খালবিলের মাছ ধরার মধ্য দিয়েই দিন কাটে সরল সুবোধ বাংলার অগণিত কৃষকের। ঈদে, উৎসবে, পূজায়-পার্বণে, মেলায়-খেলায়, গান-বাজনা মুখরিত হয় বাংলার গ্রাম। থৈ, চিড়া, মিঠাই-মণ্ডা ও পিঠার ঘ্রানে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। ইস্টি কুটুম্ব, মেহমান-মেজবানের হৃদয় বিগলিত হয় পারস্পরিক আদান-প্রদানে। প্রবাসে চাকরিরত শিক্ষিত স্বামী, উপার্জনক্ষম যুবক, শহরের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত সন্তান-সন্তুতি সকলের মন বাঁধা পড়ে রূপসী বাংলা মায়ের সবুজ আঁচলে। কখন অফিস-আদালত বন্ধ হবে, স্কুল-কলেজ ছুটি হবে তারই প্রতীক্ষায় দিন গোনে প্রবাসী সন্তানের মা এবং বন্ধুরা। সুযোগ পেলেই ছুটে এসে মুখ লুকায় মায়ের নিভৃত আঁচলে।
অবহেলিত গ্রাম : একদিন ছিল- যখন বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু- আজ এ চিত্রটিকে যতই কিংবদন্তি বলে মনে হোক, একদিন এটাই ছিল বাস্তবতা। সেদিন মাঠে মাঠে শস্য ফলত, কিষাণের মুখে হাঁসি ফুটত, তাঁতী বসে তাঁত বুনত, জেলে ফেলত জাল, রূপালী রঙের মাছে তার জাল ভরে যেত- সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের গ্রামগুলো স্বচ্ছলতা ও আড়ম্বরের কেন্দ্রস্থল। স্বয়ং সম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি, লোকসংস্কৃতির চর্চা, সুখ- শান্তিপূর্ণ সুন্দর জীবন—এ ছিল সেকালের গ্রাম বাংলার পরিচয়।
কিন্তু আজ সে কেবলি ধূসর অতীতের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস মাত্র। গ্রামীণ জীবনে আজ এক মেরুদূর বিচ্ছিন্নতা। গ্রামের কৃষি অর্থনীতি ভেঙে গেছে। কুটিরশিল্প বিলুপ্ত প্রায়, লোকসংস্কৃতি এখন বিস্মৃতির সীমানায়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎস এই যে মানবজীবনের পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজন তা থেকে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আজ বঞ্চিত । রুগ্ন, জীর্ণশীর্ণ মানুষ এখন গ্রামের ভগ্নপ্রায় বাড়ি-ঘরের বাসিন্দা। শুধু দিনযাপনের, শুধু প্রাণ ধারণের গ্লানিতেই তারা আজ বিপর্যন্ত। দেশের শিক্ষিত মানুষরা শহরবাসী, নাগরিক জীবনের বৈভবে তারা তাদের উৎসের কথা ভুলে গেছে। এ এক সর্বনাশা আত্মবিধ্বংসী নীতি। দেশের প্রাণ যে গ্রাম- তাকে শোষণ করে শহর বেঁচে থাকতে পারে না। একদিন না একদিন শিকড়ে টান পড়বেই।
শহরের বৈশিষ্ট্য : শহরে জীবনের বড় ত্রুটি সহৃদয়তার অভাব। গ্রামের জীবন অনেকখানি যৌথ । সেখানে পরস্পরের যে নির্ভরশীলতা তা কেবল কর্মক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। শহরে পরস্পরের নির্ভরশীলতা বোধ আরও বেশি, আরও স্পষ্ট। প্রাতাহিক জীবনযাত্রায় আমরা এখানে একে অন্যের মুখাপেক্ষী। কিন্তু এ নির্ভরশীলতার মূলে মুদ্রার সচলতা ছাড়া আর কোনো হৃদয়িক সম্পর্ক এখানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মর্যদা গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি প্রতিষ্ঠিত। অনেকটা সে কারণে এবং অনাবশ্যক ও অকারণ সম্পর্ক স্থাপনে শহরবাসীর একটা স্বাভাবিক পৃষ্ঠা আছে।এখানে তাকেই আদর্শ নাগরিক বলে গণ্য করা হবে যিনি নিজের অস্তিত্ব অন্যের ওপরে আরোপ করে না এবং অন্যের সম্পর্কে কৌতূহলও ভদ্রতার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখে।
তুলনা : সাধারণভাবে বলা যেতে পারে, শহরের জীবন পরী জীবনের চেয়ে বেশি দ্রুত ও কৃত্রিম এবং হয়তো সে কারণে অনেক বেশি আধুনিক, যাকে আরও স্থলভাবে বলা যেতে পারে সত্য। গ্রাম্য জীবন একটু ঢিমে তালে চলে, সে জীবন অনেকখানিই অকৃত্রিম এবং সেজন্যই তা অনাধুনিক, পশ্চাৎপ্রবণ। আমরা জানি যে, সভ্যতার সাথে কৃত্রিমতার যোগ আনেকখানি প্রবল। আদিম মানুষ যেভাবে নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, প্রেম-হিংসা, ক্রোধ-উল্লাস প্রকাশ করতো আজ তেমন করে নিজের মনোভাব আর কেউ প্রকাশ করে না। কাজেই কৃত্রিমতা কথাটা শুনতে যতই খারাপ হোক না কেন সভ্যতার অঙ্গ বলে আমরা যখন তা গ্রহণ করেছি, তখন এটাকে শহুরে জীবনের দোষ বলে গ্রহণ করা মুশকিল ।
সুবিধা-অসুবিধা : শহরের একটি অসম্পূর্ণতার কথা সকলেই স্বীকার করবেন। তা হচ্ছে প্রাকৃতিক আবেষ্টনী থেকে এর বিচ্ছিন্নতা। ইট-কাঠের বাড়ি শহরের সবটুকু সবুজকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং ক্রমেই তা আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে কৃত্রিম হ্রদ বা সরকারি বাগান গড়ে ওঠে মাঝে মাঝে, কিন্তু জনসংখ্যার তুলনায় তার সংখ্যা ও আয়তন এতই অপ্রতুল যে, এ কৃত্রিম সৌন্দর্যের পরিবেশ ও লোকের ভিড়ে এবং অন্যান্য কারণে তার জৌলুস হারাতে বসেছে।
শহরবাসীকে তাই পয়সা দিয়ে প্রেক্ষাগৃহে বসে কিছুটা মেকি আনন্দ ও বৈচিত্র্য খুঁজতে হয়। এক্ষেত্রেই গ্রামের জিত। প্রকৃতির দান সেখানে অফুরন্ত উদার বাতাস, উন্মুক্ত প্রান্তর, ধীরস্রোতা তটিনী আর সীমাহীন আকাশ এখানে মানুষের কল্পনাকে গতি দেয়, তার মনকে দেয় উড়ার শক্তি। আর গ্রামের শস্যক্ষেত আমাদের বাঁচার যে শক্তি দেয়, তাকে কেবল প্রেরণা বললে চলে না, তার দান আরও প্রত্যক্ষ।
গ্রাম যে শহরের ব্যবসায় ও শিল্পের পশ্চাৎভূমি এ কথাও আমরা ভুলতে পারি না। গ্রামের কাছে শহরের ঋণ তাই অনেক। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে গ্রামের সেই শ্রী আজ আর নেই। ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলো দারিদ্র্য আর নিরক্ষরতা, অস্বাস্থ্যের আক্রমণে পর্যুদস্ত। আর তার ফলেই নানারকম সংকীর্ণতার আবেষ্টনীতে সেখানকার মানসিক জীবন পঙ্গু হয়ে উঠেছে।
যান্ত্রিক সভ্যতার ফল : যন্ত্র বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির সাথে সাথেই আধুনিক কলকারখানা ও ব্যবসায়- বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটেছে। এর ফলে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্রগুলো যথেষ্ট আর্থিক উন্নতি সাধন করেছে। তাদের সমাজব্যবস্থাতেও একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে এর প্রতিফলন হয়েছে তাদের সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে ও চিন্তাধারাতে। তাদের গ্রাম আর গ্রাম নেই- যান্ত্রিক সভ্যতার প্রায় সব সুযোগসুবিধা বিস্তার লাভ করে সেখানেও শহরের পরিবেশ বিস্তার লাভ করেছে। সেসব দেশে অফিস-আদালত, কলকারখানা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো শহরে, কিন্তু বাসস্থানগুলো শহর থেকে দূরে গ্রামের অভ্যন্তরে।
মানুষ অর্থনৈতিক কার্য উপলক্ষে শহরে এসে জড়ো হয়, কিন্তু দৈনন্দিন কার্যানি সমাপন করে গ্রামাঞ্চলে ফিরে গিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে। যান্ত্রিক সভ্যতা দ্বারা পৃথিবীর সকল দেশ সমভাবে উপকৃত হয়নি। বিশেষত বাংলাদেশের পল্লীসমূহের কুটিরশিল্প নষ্ট হওয়ায় ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর মতো যন্ত্রশিল্পের প্রসার না ঘটায় দেশের পক্ষে যান্ত্রিক সভ্যতার উপকার অপেক্ষা অপকার বেশি করেছে। যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতিক্রিয়া রূপে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ আমাদের গ্রামে যেতে উপদেশ দিচ্ছেন। ব্যাপারটি আমাদের বিশেষভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন ।
প্রথমেই আমাদের একটি কথা বিনা বিতর্কে মেনে নেয়া উচিত যে, যান্ত্রিক সভ্যতা আমাদের যতই অপকার সাধন করুক না কেন বর্তমান সময়ে আমরা যন্ত্রকে উপেক্ষা করে এক পাও অগ্রসর হতে পারি না। তবে আমাদের প্রকৃতি ও মন যেন যান্ত্রিক না হয়ে পড়ে, মনের গভীরে যাতে একটি সরল স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজমান থাকে সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মানুষ যে যন্ত্রের চেয়ে বড় এ কথাটি যেন আমরা ভুলে না যাই। শহরের বিলাস ব্যসনের দিকে প্রলুব্ধ না হওয়াই মঙ্গলকর, কিন্তু পরী জীবনকেও যে এখন শুধু কুটিরশিল্প আর কৃষিকাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা সম্ভব হবে না একথা মানতে হবে । কেননা এখনন গ্রামীণ জীনবযাত্রা ও ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে।

গ্রামোন্নয়নের আবশ্যকতা : আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে দেশের গ্রামকে রক্ষা করতে সর্বাগ্রে গ্রামোন্নয়ন দরকার । গ্রামের উন্নতি ব্যতীত দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। গ্রাম ব্যতীত কেবল শহরের ওপর নির্ভর করে আমাদের বেঁচে থাকার উপায় নেই। শুধু শহরের ওপর নির্ভর করে গোটা জাতি চলতে পারে না। তাই গ্রামকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার প্রয়োজন। আত্মনির্ভরশীল হতে যেসব উপকরণ প্রয়োজন সেগুলো এখানে আছে । অভাব হচ্ছে কেবল সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা, শিক্ষা ও আদর্শের। দেশের অন্ন সমস্যার সমাধান, মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হলে গ্রাম জননীর দিকে নজর দেয়া উচিত।
সৌন্দর্য্য ফিরে পাওয়ার উপায় : সোনার বাংলার এ রিক্ততা আমাদের জন্য কিছুতেই গৌরবের নয় । এত রিক্ততার মাঝে এখনো শতকরা ৮৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। এদের মাঝে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও জীবনের স্বাদ ফিরিয়ে আনতে হলে পরিকল্পিত ও আধুনিক উপায়ে গ্রাম বাংলার সংস্কার ও উন্নতির প্রয়োজন। আর তা করতে হলে সর্বপ্রথমেই প্রয়োজন নিরক্ষর গ্রামবাসীদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণ, কুটির শিল্পের উন্নান, বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ ও খালবিল, পুকুর-দিঘি ও নদনদীর সংস্কার। আর প্রয়োজন পরিবার পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক কৃষি খামার স্থাপন, পশুপাখি পালন ও নিরাপত্তা বিধান, গাছ-গাছালী ও বন-বাদাড়ের উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ ত্বরান্বিতকরণ এবং সহজলভ্য চিকিৎসার ব্যবস্থাকরণ আর তা হলেই রিক্ত বাংলা আবার ফিরে পাবে তার হারানো যৌবন সুষমা।
কৃষি উন্নয়ন : সর্বাগ্রে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার করতে হবে। ক্রামগত শোষণ এবং সীমাহীন দারিদ্র্যের ফলে কৃষককুল আজ দিশেহারা। ভূমিহীন হওয়ার এবং নিস্বকরণ প্রক্রিয়ায় মানুষ ক্রমশই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। শতকরা ৬০ ভাগ ভূমিহীন কৃষক নিয়ে কোনো দেশের কৃষি অর্থনীতি উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে না ।
ভূমি সংস্কার আইন কার্যকর করে প্রকৃত চাষী এবং প্রান্তিক চাষীর হাতে জমি ছেড়ে দিতে হবে- দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করতে হবে। বর্গাদারী প্রথার অবিচার, মহাজনী শোষণের নিষ্ঠুরতা থেকে তাকে মুক্তি দিতে হবে। এ মৌলিক প্রশ্নমালার মীমাংসা ছাড়া গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির ধ্বংসকে ঠেকানো যাবে না। তারপর আসবে উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির প্রবর্তন। কৃষি যন্ত্রপাতি এবং উপকরণসমূহকে চাষীর নিকট সুলভ করে তুলতে হবে। সেচ যন্ত্র, সার, তেল, কীটনাশক যাতে চাষীর কাছে অবাধে পৌঁছে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সমবায় চেতনা : সমবায় চেতনা কৃষকদের দিতে পারে নতুন জীবনের দিক-নির্দেশনা। কৃষি সমবায়কে সফল করে তোলা ছাড়া আমাদের দেশে আর কোনো গত্যন্তর নেই। চাষীর কাছে এ শিক্ষা পৌঁছে দিতে হবে যে, একাকী বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ বাঁচতে পারে না। আমরা ঐক্যবদ্ধ জীবনের মধ্যেই আমাদের সমস্যার সমাধান পেতে পারি। অধিক জনসংখ্যা আর সীমিত সম্পদ এ দুই বিপরীত দিককে মিলাতে গেলেই প্রয়োজন হবে ঐক্যবদ্ধ সম্মিলিত সমবায়ভুক্ত প্রয়াস ।
নিরক্ষরতা দূরীকরণ : নিরক্ষরতার অন্ধকার গ্রামীণ জীবনকে আজও আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে আছে। দেশের ৫০ ভাগ লোকও সাক্ষর নয়। নিরক্ষরতার এই জগদ্দল পাথর সমগ্র জাতির ঘাড়ে চেপে বসে আছে। – অর্থনৈতিক সমস্যায় পীড়িত মানুষ শিক্ষার দিকে আগ্রহী হয় না হতেও পারে না, কিন্তু শিক্ষাই আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের পূর্বশর্ত। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি তাদের মৌলিক সমস্যা সমাধান করতে পারে না।
এজন্য চাই ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম। জাতীয় পর্যায়ে এ কার্যক্রমকে সমন্বিত করে সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে। বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম, নৈশ বিদ্যালয় চালু, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করে নিরক্ষর মানুষের জন্য ধারাবাহিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কর্মকেন্দ্রিক এ শিক্ষা সাক্ষরতার সাথে সাথে দেবে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বার্তা, দেবে সামাজিক সচেতনতার ধারণা। জীবনকে উন্নয়নের স্রোতধারায় প্রবাহিত করার তাগিদ সৃষ্টি করতে পারলেই এক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ সম্ভব।
চিকিৎসা সুবিধা : সুন্দর শরীর, স্বাস্থ্যবান মানুষ, উজ্জ্বল জীবন গড়তে হলে চাই চিকিৎসা সুবিধার সম্প্রসারণ। নানাবিধ কুসংস্কারে গ্রামীণ মানুষের অসুখ বিসুখ সংক্রান্ত ধারণাগুলো লাভ করেছে বিকৃত রূপ। তাদেরকে কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে ন্যূনতম চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ লোক মৃত্যুর পূর্বে চিকিৎসার সুযোগ পায় না। এতেই বলা যায় কি ভয়াবহ পরিস্থিতি এখানে বিরাজমান। রোগে জর্জরিত, জীর্ণশীর্ণ এক কংাল শিশু, ভগ্নস্বাস্থ্য কৃষক এবং মেহনতি মানুষ- গ্রামীণ জীবনের এ যে সাধারণ চিত্র একে অবশ্যই বদলে দিতে হবে। কি করে কম খরচে পুষ্টিকর খাবার লাভ করা যায়, সে বিষয়ে উপযুক্ত সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
বহুমুখী কর্মধারা : গ্রামীণ জীবন আজ স্পন্দনহীন, সবকিছুই সেখানে আজ নিরব নিস্তব্ধ প্রয়াস আর উদ্যম সেখানে অনুপস্থিত। নতুন থানা প্রশাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে চেষ্টা হয়েছে উন্নয়নের গতিধারায় মানুষের কর্ম প্রয়াসকে প্রবাহিত করার জন্য। কিন্তু সে উদ্যোগ সার্বিকভাবে দিক-নির্দেশনা দিতে পেরেছে এমন বলা যাবে না। মূল কথা গ্রামকে জাগাতে হলে চাই নানা মুখী কর্মধারা। কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য সব বিষয়ে চাই ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রয়াস। গ্রামের কুটির শিল্পের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। কৃষি কাজের পরেই ছিল কুটিরশিল্পের স্থান।
কিন্তু শিল্পবিপ্লবোত্তর যান্ত্রিক প্রযুক্তির বিপুল প্রসার আমাদের কুটিরশিল্পের মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিয়েছে । আমাদের যাবতীয় আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, পরিধেয় বস্ত্র এর সবকিছুই এক সময়ে আমরা কুটিরশিল্পের কাছ থেকে পেতাম । কিন্তু সে কুটিরশিল্প আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। বংশানুক্রমিক কুটিরশিল্পীরা এখন বেকার জীবনের গ্লানি বহন করছে। কামার-কুমার, তাঁতী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষরা এখন তাদের পরিবারিক ঐতিহ্য ছেড়ে অন্য পেশার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কুটিরশিল্পের এ গ্লানিময় অবস্থার অবসান সম্ভব।
যান্ত্রিক প্রযুক্তির বিপুল বিকাশের ক্ষেত্রে শিল্পকে রক্ষা করা যতই দুরূহ মনে হোক না কেন, উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে এক্ষেত্রে সাফল্য লাভ নিশ্চিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কুটিরশিল্প ও হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে হবে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়েও আমাদের কুটিরশিল্পের বেঁচে থাকা সম্ভব। এজন্য এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। কুটিরশিল্পে নিয়োজিত লোকদের নবতর চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে নতুন দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। কৃষির পাশাপাশি কুটিরশিল্পের উজ্জীবন গ্রামীণ অর্থনীতিতে সামগ্রিক অবয়বে নতুন তরঙ্গ সঞ্চার করবে।
উপসংহার : গ্রামই বাংলাদেশের প্রাণ- ধমনীতে প্রবাহিত রক্ত ধারা। গ্রামকে দূরে রেখে, অবহেলা করে বাংলাদেশ বাঁচতে পারে না। নাগরিক জীবনের যে ঐশ্বর্য আজ আমাদের মোহিত করে, তা তো গ্রামকে শোষণ করেই গড়ে তোলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শরীরের সমস্ত রক্ত শোষণ করে মুখে জমা করলেই তার নাম স্বাস্থ্য নয়। গ্রাম শোষণ করে নগর গড়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু মূলকে কর্তন করে কোনো বৃক্ষ বেশিদিন বাঁচতে পারে না। কাজেই আর বিলম্ব নয় ফিরে যেতে হবে গ্রামে-প্রত্যাবর্তন করতে হবে উৎস ধারায়। তাহলেই দেশ হিসেবে, জাতি হিসেবে আমরা বেঁচে থাকতে পারব, বিশ্ব সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব ।
আরও দেখুন: