বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার শীর্ষক আলোচনা সভায় ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার শীর্ষক আলোচনা সভায় ভাষণ | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার শীর্ষক আলোচনা সভায় ভাষণ

‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার’ শীর্ষক আলোচনা সভার সম্মানিত সভাপতি, আমন্ত্রিত আলোচকবৃন্দ ও সুধীবৃন্দ— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা। আজকের এই আলোচনা আমাদের নাগরিক সচেতনতারই নিদর্শন। আজ সময়োপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তৃতাদানের সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এজন্য সভার আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য। সুধীবৃন্দ, আপনারা অবগত যে, জনসংখ্যার তুলনায় এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই সীমিত।

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার শীর্ষক আলোচনা সভায় ভাষণ

 

আবার যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে তারও সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া কোনো দেশের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তার যথাযথ আহরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহারের গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই আমাদের জাতীয় অগ্রগতি অনেকাংশে নিশ্চিত হতে পারে। সুধী, প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্ট সম্পদই হল প্রাকৃতিক সম্পদ, এটা আপনাদের জানা। এ সম্পদ মানুষ সৃষ্টি করতে না পারলেও আহরণ ও ব্যবহার করতে পারে। আগেই বলেছি, এই সম্পদ ব্যবহার করে দেশের উন্নতি ও মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখা যায়।

যে কোনো দেশের উন্নতি বা জাতীয় সমৃদ্ধি নির্ভর করে সে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথার্থ ব্যবহারের ওপর। ভূমি ও খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক গ্যাস, মৎস্য, জল, সৌরশক্তি প্রভৃতি একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদের আবার দুটি ভাগ রয়েছে। একটি স্থায়িত্বকাল সীমিত, এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। যেমন-খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক গ্যাস, বনজ সম্পদ ইত্যাদি। আবার অন্যটির স্থায়িত্বকাল অনির্দিষ্ট। তা ব্যবহারের ফলে ক্ষয় হয়, কিন্তু নিঃশেষ হয়ে যায় না। যেমন- ভূমিসম্পদ। সুধী, ভূমি একটি দেশের স্থায়ী এবং মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। এই সম্পদের মধ্য দিয়ে একটি দেশের সমৃদ্ধি নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ।

এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। কিন্তু আমাদের ভূমি সম্পদের পরিমাণ মাত্র ১ লক্ষ ৪৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যার তুলনায় এ সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত কম। আবার এ কথাও ঠিক যে, ভূমির পরিমাণ কম হলেও বাংলাদেশকে ভূমি সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ বলা যায়। কারণ বাংলাদেশের ভূমি অত্যন্ত উর্বর, নরম তথা ফসল ফলানোর উপযোগী। তাই এই সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের উপরই আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধি নীর্ভর করছে। আবার, যে দেশে যত বেশি খনিজ সম্পদ থাকে সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ হতে পারে।

বাংলাদেশে খনিজ সম্পদ পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান উল্লেখযোগ্য খনিজ দ্রব্যগুলো হল- ১। কয়লা ২। খনিজ তেল ৩। চুনাপাথর ৪। চিনামাটি ৫। তামা ৬। কঠিন শিলা ৭। সিলিকা বালি ৮। পারমাণবিক খনিজ পদার্থ ৯। গন্ধক ১০। প্রাকৃতিক গ্যাস। সুধীবৃন্দ, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাচুর্য রয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০০০ পর্যন্ত দেশের আবিষ্কৃত মোট গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা ২২টি। বর্তমানে ১২টি ক্ষেত্রের ৪৪টি কূপ তাকে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এছাড়া, মৎস্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ।

এ দেশের অসংখ্য নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওড় ও জলাভূমিতে প্রচুর পরিমাণে নানা ধরনের মাছ পাওয়া যায়। আপনারা অবগত যে, প্রতি বছর মৎস্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ কম হওয়ায় (মাত্র ১৬ ভাগ) বনজ সম্পদে আমাদের সমৃদ্ধি সম্ভব হয়ে ওঠে নি। যদিও একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বনজ সম্পদের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। ঝড়-তুফান, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলেও দেশকে বনায়নের দিক থেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা দরকার।

আরো একটি প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে- বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদী অঞ্চলের কাপ্তাই থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বর্তমান বিদ্যুৎ সঙ্কটের মোকাবেলায় আমরা সৌরশক্তি, তাপশক্তি, বায়ুশক্তির মতো প্রাকৃতিক শক্তি বা সম্পদকে কাজে লাগাতে পারি। সুধী, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করেই মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতার ইমারত। ‘পাথর, লোহা, তামা ইত্যাদি ব্যবহার করে সভ্যতার পথে আদি মানুষের যাত্রা শুরু। মানুষ ক্রমে কৃষিসম্পদ, অরণ্যসম্পদ, খনিজসম্পদ, জলজসম্পদ, সূর্যালোকসম্পদ— সবই কাজে লাগিয়েছে সভ্যতার বিকাশে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের চরম উৎকর্ষ দেখিয়ে মানুষ মহাকাশ জয় করেছে, পৌঁছে গেছে কম্পিউটার প্রযুক্তির বিস্ময়কর যুগে।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের মূলে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের বহুমুখী ব্যবহারের সাধনা। সুধীমণ্ডলী, আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রাকৃতিক সম্পদের রত্নভাণ্ডার অফুরন্ত নয়। এর যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। আমাদের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা দিন দিনই বেড়ে চলেছে। আকাঙ্ক্ষা হয়েছে অপরিমিত। অতৃপ্ত কামনা নিয়ে আমরা ছুটে চলেছি দিকে দিগন্তরে। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার আজ মানুষকে করে তুলেছে শঙ্কিত। আজ অনেক চিন্তাবিদই বলেছেন, একদিন খনিজ সম্পদ ফুরিয়ে যাবে, নিঃশেষ হবে বনজ সম্পদ। আর তার পরিণাম হবে ভয়াবহ। প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাবে। মানুষের উদার আকাশ আজ বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন। পরিবেশ দূষণ আজ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। মানুষের সামনে তাই আজ এক মহাসংকটের নিদারুণ চিত্র।

সুধী, সম্প্রতি কোপেনহেগেন সম্মেলনে সে কথাই আমাদের জানিয়ে দিয়েছে— ইতোমধ্যে পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে ১৩০ কোটি মানুষ। আমাদের দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর, আইলা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আমাদেরকে সজাগ করে দিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফল কী হতে পারে। আজ শহরে শহরে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক সম্পদের তীব্র সঙ্কট পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্পদের অকল্যাণকর ও অশুভ ব্যবহারে আমরা কত দ্রুত বিপদ ডেকে আনছি! মাত্র একটা দেয়াশলাইর কাঠি বাঁচাতে অপরিণামদর্শী জনগণ গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, গ্যাসের চুলায় কাপড় শুকানো হয়।

কী বিবেকহীন কাজ আমরা দিনের পর দিন করে যাচ্ছি। নির্বিচারে গাছপালা কেটে বনজ সম্পদ উজাড় করে দিচ্ছি, ভূমি বৃদ্ধির লিপ্সায় পুকুর, নদীনালা-হাওড়-বিল ভরাট করছি, নির্দয়ভাবে সকল জলজ প্রাণীকে হত্যা করছি, নদীতে বর্জ্য ঢেলে দিয়ে পরিবেশকে করছি বিষাক্ত। হায়! বিবেকবান মানুষের এই কী কর্ম? হে সচেতন সুধীসমাজ, আসুন আমরা আরো একবার সচেতন ও বিবেকবান হই, প্রাকৃতিক সম্পদের অমানবিক ও অবিবেচনাপ্রসূত ব্যবহার থেকে নিরস্ত হই।

সুধী, প্রাকৃতিক সম্পদকে মানবিক ব্যবহারে রূপান্তরিত করে মানুষ সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, মহিমাময় করেছে। অগ্রগতির ইতিহাসে সে রেখেছে বুদ্ধিবৃত্তির শ্রেষ্ঠত্বের অক্লান্ত নজির। অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রয়োজনেই প্রাকৃতিক সম্পদের নতুন নতুন প্রয়োগ। এই প্রয়োগ-উন্মাদনাই তাকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে গেছে। আবার এটাই তার জীবনে ফেলেছে দীর্ঘবিস্তারী আতঙ্ক-পান্ডুর ছায়া। প্রাকৃতিক সম্পদের অকল্যাণকর ও অশুভ ব্যবহার মানব-সভ্যতার জন্যে বিপদ ডেকে আনছে। তাই প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও এর সর্বোত্তম ব্যবহার।

এই প্রত্যাশা রেখে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন— আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার শীর্ষক আলোচনা সভায় ভাষণ

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment