প্রমিত ভাষা ও সাধু ভাষা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা , প্রমিত ভাষা:প্রত্যেক ভাষায়ই উপভাষা বৈচিত্রা এবং বিভিন্ন উপভাষীদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম রূপে প্রমিত ভাষা বা ‘লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা থাকে। বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়।
প্রমিত ভাষা ও সাধু ভাষা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা
একই ভাষার উপভাষাগুলো অনেক সময় বোধগম্য হয় না। ফলে কোনো ভাষাভাষী অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষাগুলোর উপরে সর্বজনমান্য একটি আদর্শ ভাষা গড়ে ওঠে। দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় এই আদর্শ ভাষাতেই ভাব- ব-বিনিময় করে। থাকেন। বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষার উপাদানের সমন্বয়ে শিষ্টজনের ব্যবহৃত এ ভাষাই প্রমিত ভাষা (Standard Language)। শিক্ষিত বাঙালি সমাজে সর্বজনমান্য যে মুখের ভাষা প্রচলিত তাকে আমরা বলি প্রমিত চলিত ভাষা (Standard colloquial Language) |
আনুষ্ঠানিক বা আচরিক ভাষায়, যেমন শিক্ষায়, মৌখিক সংবাদ মাধ্যমে, বক্তৃতায়, সাংস্কৃতিক আলোচনায় ও বার্তালাপে প্রমিত বাংলা ব্যবহৃত হয়। প্রচার মাধ্যমে, সাময়িকপত্রে, পাঠ্যগ্রন্থে, সাহিত্যকর্মের বর্ণনাভাগেও প্রমিত বাংলাই মূলত লিখিত হয়। সরকারি নথিপত্রে এবং সর্বস্তরের প্রশাসনিক কাজে এ রীতির প্রয়োগ দিন দিন বাড়ছে। প্রথিত চলিত ভাষার কথা এবং লেখা উভয় রূপেই ব্যবহৃত হয়।
উপভাষা ও প্রমিত ভাষার পার্থক্য সুস্পষ্ট। নিচে উপভাষা ও প্রমিত ভাষার পার্থক্য উপস্থাপন করা হল :
সাধু ভাষা বা সাধু রীতি (Standard literary style)
উনিশ শতকে বাংলার যে লিখিত রূপ গড়ে ওঠে, তার নাম দেওয়া হয় ‘সাধু ভাষা (Standard literary style)| সংকৃত ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন মানুষের ভাষাকে সাধু ভাষা’ বলে প্রথম অভিহিত করেন রাজা রামমোহন রায়। পরে রামমোহন, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ গদ্যশিল্পীগণ এই সাধু ভাষার মাধ্যমেই তাঁদের সাহিত্যকীর্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
প্রখ্যাত বৈয়াকরণ ও ভাষাতত্ত্ববিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সাধারণ গদ্য সাহিত্যে ব্যবহৃত বাঙ্গালা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।”
সাধুভাষাশ্রয়ী গদ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধান থেকে ধার করা অলংকারে সাজিয়ে তোলা।” কারণ বাংলা গদা সৃষ্টির প্রাথমিক পর্বে গদ্য রচনার দায়িত্ব বর্তেছিল সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের ওপর। স্বাভাবিকভাবে সংস্কৃত বাক্যরীতিকে আদর্শ করে সাধু গদ্য রীতির বুনিয়াদ গড়ে ওঠে, বাংলা গদ্যের বিবর্তন ও বিকাশ আলোচনা প্রসঙ্গে তা আমরা দেখেছি। তাহলেও একথা ঠিক যে, সাধুভাষা প্রতিষ্ঠার একেবারে গোড়ায় চলিত ভাষার কিছু কিছু পদ ও বাকারীতি গৃহীত হয়েছিল, অর্থাৎ সাধু-চলিতের মিশ্রণ ঘটেছিল প্রধানত ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের ব্যবহারে। পরে সাধু ভাষা লেখ্য বা সাহিত্য-ভাষার আদর্শ হয়ে নিজেকে শক্ত ভিতের ওপর পাকাপোক্তভাবে যত দৃঢ় করে দাঁড় করাতে লাগল, ততই গ্রাম্যতা দোষ ও প্রাদেশিকতা বর্জনের তাগিদে সংস্কৃত শব্দের অধিক প্রয়োগে ও সংস্কৃত বাক্যরীতির অনুসরণে ভাষা নিয়মবন্ধ ও কৃত্রিম হয়ে পড়ল।
বক্তৃতা, নাটক ও আলাপচারিতার অনুপযোগী বলে এই ভাষা কৃত্রিম, এবং শুধু লেখা ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন। ‘যাহাকে তাহাকে মারিতে যাওয়া তোমার উচিত হয় নাই। এখানে ‘যাহাকে’, ‘তাহাকে সর্বনাম পদ, ‘মারিতে’— ক্রিয়া পদ এবং ‘নাই’- নঞর্থক অব্যয় (যোজক) পদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়েছে। সাধুভাষা কঠোর ব্যাকরণের রীতিতে নিয়ন্ত্রিত।
উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন পদ— বিশেষত ক্রিয়া, সর্বনাম ও নঞর্থক অব্যয় পদের পূর্ণরূপ বজায় রেখে— সহজ, সরল, তদ্ভব ও দেশি-বিদেশি শব্দের সমাবেশে হালকা রীতিতেও সাধু ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সুতরাং, বাংলা গদ্যসাহিত্যে ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দবহুল সুষ্ঠু, মার্জিত, সর্বজনবোধ্য, অথচ নিয়ম ও কৃত্রিম ভাষারূপ হল সাধুভাষা (standard literary or written form) |
সাধু ভাষা প্রসকো রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
“রূপকথায় বলে, এক যে ছিল রাজা, তার দুই ছিল রানি সুয়োরানি আর সুয়োরানি। তেমনি বাংলা বাক্যাধিপেরও আছে দুই রানি— একটিকে আদর করে নাম দেওয়া হয়েছে সাধু ভাষা আর-একটাকে কয়াভাষা, কেউ বলে চলিত বা চলতি ভাষা। সাধু ভাষা মাজাঘষা, সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিযান থেকে ধার করা অলংকারে সাজিয়ে তোলা। চলতি ভাষার আটপৌরে সাজ নিজের চরকায় কাটা সুতো দিয়ে বোনা। . কিন্তু আমার বিশ্বাস, সুয়োরানি নেবেন বিদায় আর একলা দুয়োরানি বসবেন রাজাসনে।”
সাহিত্যিক সাধু ভাষার নিদর্শন
[ক] “তাহার ঘরে গেলাম। সে আমাকে ক্ষুধাতুরা দেখিয়া গাইটি দুহিয়া একটু দুধ খাইতে দিল। সে মহেষপুর চিনিত। তাহাকে আমি বলিলাম যে, ‘তোমাকে টাকা দেওয়াইব- তুমি আমাকে সেখানে রাখিয়া আইস। তাহাতে সে কহিল যে, “আমার ঘর-সংসার ফেলিয়া যাইব কি প্রকারে। তখন সে যে পথ বলিয়া দিল, আমি সেই পথে গেলাম। স পর্যন্ত ইাটিলাম, তাহাতে অত্যন্ত শ্রান্তি বোধ হইল। একজন পথিককে জিজ্ঞাসা করিলাম, হা গা মহেষপুর এখান হইতে কত দূরে?” … পরিক কহিল যে, তুমি পথ ভুলিয়াছ, বরাবর উলটা আসিয়াছ। ” [বঙ্কিমচন্দ্র]
[খ] “বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি, তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া মনে পড়ে তখনকার বর্ষার দিনগুলি। বাতাসের বেগে জলের ছাটে বারালা একেবারে ভাসিয়া যাইতেছে, সারি সারি ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ হইয়াছে, প্যারি বুড়ি কক্ষে একটা বড়ো ঝুড়িতে তরি-তরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জল কাদা ভাঙ্গিয়া আসিতেছে। আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় প্রবল আনন্দে ছুটিয়া বেড়াইতেছি। আর মনে পড়ে। ইস্কুলে গিয়াছি, নরমায় ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাস বসিয়াছে…।” [রবীন্দ্রনাথ]
সাহিত্যিক এই সাধু ভাষার নিদর্শনে দেখা যাচ্ছে, সংস্কৃত শব্দের পাশাপাশি অ-সংস্কৃত শব্দও অনেক ব্যবহৃতহয়েছে। সংস্কৃত শব্দগুলোও কঠিন বা দুর্বোধ্য নয়, কিন্তু এতে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হচ্ছে অসমাপিকা, সমাপিকা ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের রূপ; যেমন :
[ক] তাহারা দেখিয়া, লুহিয়া খাইতে চিনিতে বলিলাম আইস, তাহাতে, বলিয়া ইত্যাদি।
[খ] তাকাইয়া, ভাসিয়া, যাইতেছে, হইয়াছে ইত্যাদি।
এগুলো একান্তভাবে সাধু ভাষার বিশিষ্ট রূপ, চলিত ভাষার রূপ ভিন্ন। ”

আরও দেখুন: