পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পাহাড়ের মাথায় উঠে

Table of Contents

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

 

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

পোয়ারো পাহাড়ের মাথায় উঠে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মনে হল পায়ে আর যন্ত্রণা নেই। একটা বিপদের আঁচ পাচ্ছে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে, সুতরাং যাতে বিপদ না আসতে পারে সে চেষ্টা করা দরকার।

এলস্পেথ দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। পোয়ারোর কাছে এসে তার হাতে একটা চিঠি দিল খামের উপর বিদেশী ডাক টিকিট মারা।

ভাঁজ খুলে চিঠিটা পড়তে লাগলো পোয়ারো।

ইংল্যাণ্ডে মিঃ গোবির উপর খবর সংগ্রহের যে দায়িত্ব পোয়ারো দিয়েছিল তার উত্তরে সে এই চিঠি লিখেছে। সে ভাবতেই পারেনি এতো অল্প সময়ে খবর পাঠাতে পারবে।

ওলগা সেমিনোস নিজের বাড়িতে ফিরে যায়নি। তার পরিবারের কেউ জীবিত নেই। ওলগার এক সুধীজন বৃদ্ধা মহিলা আছে। এর কাছে সে মাঝে মাঝে চিঠিপত্র লিখতো। চিঠির বিষয়বস্তু থাকতো ইংল্যাণ্ডের জীবনযাত্রা নিয়ে। মনিবের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল না। তবু ওলগা তার কাছে টাকা পয়সা চাইলে উনি দিতেন। একেবারে খারাপ লোক ছিলেন না।

ওলগা শেষ চিঠি লিখেছিল বছর দেড়েক আগে। সেই চিঠিতে একজন যুবকের কথা লেখা আছে।

ওলগা তাহলে মাঝে মাঝে টাকা পয়সা চাইতো মনিবের কাছে। পোয়ারো ভাবলো সে টাকা কেন চাইতো কার জন্য চাইতো? তবে কি লেসলিকে মাঝে মাঝে টাকা দিত? এই টাকা কি উইল জাল করবার পারিশ্রমিক?

পোয়ারো এলস্পেথ-এর সঙ্গে ওলগা আর লেসলির অংশীদারীর কথা নিয়ে অলোচনা করল। তারপর চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখলো। পোয়ারো নিজের আস্তানায় ফিরে চললো। বাড়ি ফিরে দেখলো মিসেস ড্রেক তার জন্য অপেক্ষা করছে। পোয়ারো বললো আপনাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে মেসেস ড্রেক।

আপনি খবরটা শোনেননি, সেই ভয়ঙ্কর খবর?

কি খবর?

লিওপোল্ড রেনল্ড মারা গেছে, কেউ ওকে খুন করেছে। স্কুল থেকে ফিরছিল কেউ ওকে নদীতে নিয়ে গিয়ে জলের মধ্যে মাথা চেপে ধরে খুন করেছে।

জয়েসার জীবনে যা ঘটেছে ওর জীবনেও তাই ঘটল। নিশ্চয়ই কোনো পাগলের কাজ। আপনাকে আগেই বলা উচিত ছিল। আপনি প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু আমি বলিনি। নিজেকে ভীষণ ভাবে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। মঁসিয়ে পোয়ারো– কান্নায় ভেঙে পড়লো রোয়েনা।

পোয়ারো বলল, আমাকে সব খুলে বলুন মাদাম।

হাঁ, আপনাকে সব খুলে বলার জন্যই এখানে এসেছি।

এলিজাবেথ আপনাকে বলেছিল আমি কিছু দেখে চমকে উঠেছিলাম।, সত্যি দেখেছিলাম, কিন্তু অস্বীকার করেছিলাম আপনার কাছে। কি দেখেছিলেন?

লাইব্রেরী ঘরের দরজা খুলে গিয়েছিল– খুব সাবধানে ভোলা হয়েছিল, তারপরেই সে বেরিয়ে এসেছিল। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসেনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তারপর ক্ষিপ্র হাতে দরজা ঠেলে খুলে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।

লোকটা কে?

লিওপোল্ড–এ ছেলেটাই তো খুন হয়েছে।

ভাবলাম লিওপোল্ট তার দিদিকে খুন করেছে তার চোখে মুখে একটা বিচিত্র অভিব্যক্তির ছাপ। ভাবলাম ছেলেটা স্ন্যাপড্রাগন অনুষ্ঠানের ঘর থেকে না বেরিয়ে কেন লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এল?

আপনি ভেবেছিলেন, একাজ লিওপোল্ডের?

হ্যাঁ, চেহারা দেখে তাই মনে হয়।

তবে ছেলেটা নিজে খুন হয়ে যাওয়ায় বুঝলাম আমার অনুমান একেবারে ভুল। ও লাইব্রেরীতে ঢুকে দিদিকে মৃত অবস্থায় দেখে মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে।

বাইরে বেরিয়ে এসে আমার মুখোমুখি পড়ে যায়। তারপর হল ঘর নির্জন না হওয়া পর্যন্ত ভেতরেই অপেক্ষা করে।

তবুও আপনি মুখ খোলেননি?

না। আমি –ওঃ, আমি পারিনি।

পোয়ারোর মনে হল, কথাগুলো এই দুঃখভরা পৃথিবীতে যত দুঃখ আছে এগুলো তাদের অন্যতম।

রোয়েনা বলল, আমি ভালো চেয়েছিলাম, হয়তো ছেলেটার ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কারণ সে খুনীকে চেনা যাবে। কোনো কারণে খুনীর মনে হয়েছিল সে গাড্ডায় পড়ে গেছে, তাই ছেলেটাকে কবে নির্জনে পাবে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তারপর একা পাওয়ার পরই –মিসেস ড্রেক ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

শুনেছিলাম লিওপোল্ড টাকা পয়সা যথেষ্ট খরচ করতো, কোথায় পেত? নিশ্চয়ই কেউ তার মুখ বন্ধ করবার জন্য টাকা পয়সা দিত।

কিন্তু কে, কে সেই লোক?

খুঁজে বের করতে হবে –পোয়ারো জানালো আর বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না।

.

২২.

এরকুল পোয়ারো তার নিজের মতামতের ওপরই বেশি আস্থা রাখে। পোয়ারো আর স্পেনস কিছু সময় কথাবার্তা বলবার পর, গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় এমন এক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারপর বন্ধুর সঙ্গে তার ইনসপেক্টর র‍্যাগলানের সঙ্গে সামান্য সময় আলোচনা করার পর গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। কথা বলে ঠিক করে নেওয়া হয়েছে যে এ পথে যাওয়ার সময় এক জায়গায় কিছু সময়ের জন্য নামবে তারপর তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে লণ্ডনে। গাড়ি করে এল এলমস এ। ড্রাইভারকে জানাল ঘন্টাখানেকের মত দেরী হতে পারে তারপর দেখা করল মিস এমলি এর সঙ্গে।

পোয়ারো বললো, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। যা বলতে চাই খুলেই বলি, আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে চাই।

জয়েসা রেনল্ড-এর আততায়ী কে আমি জেনেছি– পোয়ারো বললো, আমার বিশ্বাস আপনিও জানেন। আপনার কোনো মতামত থাকলে জানান।

স্বীকার করছি আমার মতামত আছে তার অর্থ এই নয় যে আমাকে পুনরাবৃত্তি করতে হবে।

পোয়ারো বললো, শুনুন একটা ছেলে জলে ডুবে মারা গেছে।

শুনেছেন?

হ্যাঁ একজন ফোন করে জানিয়েছে। জয়েসার ভাই। কি করে ছেলেটা এর মধ্যে এল?

পোয়ারো বললো– অর্থ দাবী করে ছিল। ওকে নিয়মিত পয়সা দিতে হতো। খুনী সুযোগের সন্ধানে ছিল, সুযোগ পেয়েই জলে ডুবিয়ে মেরেছে। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে এ ধরনের কেসে আমি প্রথমে কি করি?

এমলিন বললো –প্রথমে বিচার চাইবেন। করুণার প্রশ্ন আসবে পরে।

ঠিক বলেছেন। শুনুন আমি লণ্ডনে যাচ্ছি। পথে কয়েকজন লোকের সঙ্গে দেখা করে কেসটা নিয়ে আলোচনা করব। তাদেরকে আমার নিজের মতামত বোঝাতে চাই।

যাওয়ার আগে কয়েকটা বিষয়ে আপনার মতামত জেনে নিতে চাই। নিকোলাস র‍্যানসাম আর ডেসমণ্ড হল্যাণ্ড সম্পর্কে আপনার মত কি? ওদের উপর আস্থা রাখতে পারি?

অবশ্যই আস্থা রাখা যায়। পোয়ারো বিদায় নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠলো।

.

২৩.

কোয়ারী উডে কি ঘটেছে শুনেছ?–

মিসেস বাটরাইট বাজারের ব্যাগে জিনিস ভরতে ভরতে বললো।

এলস্পেথ বললো, কোয়ারী উডে? কই আমি তো কিছু শুনিনি। দুজন মহিলা নতুন তৈরি সুপার মার্কেটে সকালের বাজার করতে বেরিয়েছে।

লোকে বলাবলি করছে ওখানকার গাছগুলো পাহাড়ের গায়ে খুবই বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। কয়েকজন পুলিশ এসেছে ওরা কাউকে ধারে কাছে যেতে দিচ্ছে না।

এলস্পেথ বিস্ময় প্রকাশ করে বলল –ওমা তাই বুঝি?

অরিয়াদে অলিভার একটা টেলিগ্রাম পেল। তাতে লেখা আছে: দয়া করে মিসেস বাটলার আর মিরান্দাকে তোমার ফ্ল্যাটে নিয়ে এস। একটুও বিলম্ব করবে না।

ডাক্তারের সঙ্গে অপারেশনের জন্য দেখা কর।

মিসেস অলিভার রান্নাঘরে এল, জুডিথ বাটলার কুইন্স ফল দিয়ে জেলি তৈরি করতে ব্যস্ত। জুডিথ –মিসেস অলিভার বললো, যাও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও গে। আমি লণ্ডনে ফিরে যাচ্ছি, তুমি আর মিরান্দা আমার সঙ্গে যাবে। আজই যেতে হবে নাকি?

হাঁ, আমাকে তাই বলা হয়েছে।

কে বলেছে তোমার বাড়িওয়ালা?

না অন্য একজন যার কথা আমি ফেলতে পারি না। যে টেলিগ্রামটা পেয়েছি তাতে লিখিত নির্দেশ মতো কাজ করছি।

তুমি কি পাগল হয়ে গেছ অরিয়াঁদে?

খুব সম্ভব একেবারে বন্ধ পাগল। যাও প্রস্তুত হয়ে নাও। জুডিথ আর মিসেস অলিভার সুটকেস গুছিয়ে গাড়িতে তুলল। মিরান্দাও এসে গেল।

এরকুল পোয়ারো লন্ডনে চারজন লোকের সঙ্গে বসে আছে। একজন ইনসপেক্টর টিমোথি র‍্যাগলান, দ্বিতীয়জন সুপিরিন্টেন্টে স্পেনস, তৃতীয়জন চীফ কনস্টেবল আলফ্রেড রিচমণ্ড আর চতুর্থজন পাবলিক প্রসিকিউটার অফিসের একজন প্রতিনিধি। তারা সবাই পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তি।

আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একেবারে নিশ্চিন্ত মঁসিয়ে পোয়ারো।

পোয়ারো বললো, আমি সত্যি নিশ্চিন্ত।

আমার মতে উদ্দেশ্য খুবই জটিল। না, প্রকৃতপক্ষে জটিল মোটেই নয়। এতো সরল যে সহজে ধরা যায় না।

পাবলিক প্রসিকিউটার অফিস থেকে আসা লোকটি অবিশ্বাস ভরা চোখে তার দিকে তাকাল। আমরা প্রমাণ শীঘ্র পাব।

ইনসপেক্টর র‍্যাগলান বলল, অবশ্য যদি এ ব্যাপারে ভুল না হয়ে থাকে….

এর স্বপক্ষে প্রমাণ আছে। কোনো মেয়ে যখন অদৃশ্য হয় তার পেছনে বেশি কারণ থাকে না। প্রথম কারণ, কোনো পুরুষের সঙ্গে পালান। দ্বিতীয় কারণ মারা যাওয়া। এছাড়া অন্য কারণ থাকতে দেখা যায় না।

পোয়ারো বললো, সম্ভবতঃ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আপনাদের সামনে এমন কিছু উপস্থিত করতে পারব যা ঘটনাগুলো অনেকখানি পরিষ্কার করে দিতে পারবে।

 

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

সেটা কি?

স্বচক্ষে দেখা একজন সাক্ষী। আইনের লোকটি প্রচণ্ড অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকাল। সেই স্বচক্ষ দেখা সাক্ষী এখন কোথায়?

আমার বিশ্বাস লণ্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।

আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আপনার মন বিক্ষিপ্ত।

কথাটা সত্যি যতটা সম্ভব, সাবধানতা অবলম্বন করেছি, তবু স্বীকার করতেই হবে আমি ভীত হয়ে পড়েছি।

এরকুল পোয়ারো উঠে দাঁড়াল। সে বলল, এখন আমায় যেতে হবে। যা জানতাম সব বলেছি এখন যা ভালো বুঝবেন করবেন। আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলব।– সকলের সঙ্গে করমর্দন করে সে চলে গেল।

চীফ কনস্টেবল বলল, স্পেনস তোমাকে অনেক বছর ধরে জানি, তুমি মঁসিয়ে পোয়ারোর বন্ধু। তোমার কি মনে হয় ওর ভীমরতি হয়েছে?

আমার তা মনে হয় না। স্পেনস বলল, তোমার মতামত কি র‍্যাগলান?

ওর সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের নয় স্যার। প্রথম দিকে আমার মনে হয়েছিল ওর কথাবার্তা আইডিয়া সব অদ্ভুত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে মত পরিবর্তন করতে হয়েছে। আমার ধারণা উনি অবশ্যই প্রমাণ করবেন।

.

২৪.

মিসেস অলিভার দি ব্ল্যাক বয় হোটেলের ডাইনিং হলের খোলা জানালার ধারে পাতা টেবিলের সামনে চেয়ারে বসল। জুডিথ এসে বসলো, তারপর মেনু খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।

মিরান্দার কোনো খাবার পছন্দ? –মিসেস অলিভার জানতে চাইল ওর পছন্দমতো খাবার দিতে বলব। মিনিট খানেকের মধ্যে এসে পড়বে।

চিকেন রোস্ট ওর খুব পছন্দ, তাহলে তো ঝামেলাই থাকলো না।

তোমার কি পছন্দ?

আমার তো তাই।

তিনটে চিকেন রোস্ট –মিসেস অলিভার অর্ডার দিল। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে জুডিথের দিকে তাকিয়ে রইল।

তুমি ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন?

ভাবছি –মিসেস অলিভার বলল।

কি ভাবছো?

ভাবছি তোমার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না।

প্রত্যেকের সম্বন্ধে প্রায় একথা বলা যায়।

তার মানে বলতে চাইছো কারো সম্পর্কে জানা যায় না?

এরকম ভাবা উচিত নয়।

দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। একজন পরিচারিকা ট্রের উপর খাবার সাজিয়ে নিয়ে এসে পরিবেশন করে গেল।

মিরান্দার আসতে দেরী হচ্ছে বলে জুডিথ অধৈর্য হয়ে পড়ল। একটু পরে উঠে গেলো। তারপর কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলো গম্ভীর মুখে। ওকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। লেডিস টয়লেটেও নেই।

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল, আমি সার্জেন্ট গুডবডি কথা বলছি। একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো। আপনার দাদা আছেন?

না, আজ লণ্ডনে আছেন। ওখানে ফোন করেছিলাম, শুনলাম ওখানে থেকে রওনা হয়েছে। উনি ফিরলে বলে দেবেন আমরা পজিটিভ রেজাল্ট পেয়েছি।

তার মানে কুয়োর মধ্যে মৃতদেহ পেয়েছেন? পাঁচকান করবেন না। ইতিমধ্যে খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

মৃতদেহ কি সেই কাজের মেয়ে ওলগা সেলিলোফের?

হ্যাঁ তাই মনে হচ্ছে।

ব্যাপারটা মনে হচ্ছে খুন, ওকে ছুরি মারা হয়েছিল।

মেয়েদের টয়লেট থেকে মা চলে যাওয়ার পর মিরান্দা মিনিট খানেক কি মিনিট দুই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে পিছনের দরজা খুলে সাবধানে বাইরে উঁকি দিল। বাইরে বাগান। সে দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে দৌড়াতে লাগল। একটা গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

পাশের রাস্তা ধরে যেতে গিয়ে দেখলো রাস্তার উপর একটা মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোক চালকের আসনে বসে খবরের কাগজ পড়েছে। মিরান্দা দরজা খুলে চালকের আসনের পাশে বসে হাসতে লাগলো। গাড়ী ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। পাশের দাড়িওয়ালা লোকটা বলল, এখন আমরা ঠিক সময়ে ঠিক জায়ায় এসে পড়ছি। হঠাৎ পাশ ঘেঁষে একটা গাড়ি সামনের দিকে এমনভাবে বেরিয়ে গেল যে তাদের গাড়ি প্রায় ঝোঁপের মধ্যে এসে পড়ল। বেরিয়ে যাওয়া গাড়ির মধ্যে দুটি যুবক বসে। একজনের চুল কাধ পর্যন্ত লম্বা। তার চোখে প্যাঁচার চোখের মতো দেখতে চশমা। অন্য যুবকটি দেখতে স্পেনদেশীয় আর মুখের একটা পাশে বিশ্রী পোড়া দাগ।

মিরান্দা জিজ্ঞাসা করল– তোমার কি মনে হয়, মা আমার জন্য খুব চিন্তা করবে?

তোমার মায়ের চিন্তা করার সময় কোথায়? যখন চিন্তা করবে তার আগেই তুমি যথাস্থানে পৌঁছে যাবে।

লণ্ডনে এরকুল পোয়ারো ফোন কানের পাশে তুলে ধরতেই মিসেস অলিভারের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

মিরান্দা হারিয়ে গেছে। বলছ কি! কি ভাবে হারাল? আমরা দি ব্ল্যাক বয় হোটেলের লাঞ্চ খাচ্ছিলাম। মিরান্দা মেয়েদের টয়লেটে ঢুকেছিল, কিন্তু আর ফেরেনি। কেউ কেউ বলছে একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে গাড়ীতে চেপে কোথায় যেন গেছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, অন্য মেয়েও হতে পারে।

তোমাদের উচিত হয়নি চোখের আড়াল করা। আমি তো আগেই তোমাকে বিপদের আভাস দিয়েছিলাম। মিসেস বাটলারের কি অবস্থা? তিনি কি ভেঙে পড়েছেন?

হ্যাঁ তিনি খুবই ভেঙে পড়েছেন কান্নাকাটি করছেন। তিনি চাইছেন পুলিসে খবর দিতে। তিনি আর দেরী করতে চাইছেন না। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।

পোয়ারো বললো, আর দেরী না করে পুলিসে খবর দেওয়াটাই উচিত হবে।

আমিও ওদের সঙ্গে ফোনে যোগযোগ করছি। দেখছি কি করা যায়।

কিন্তু মিরান্দা কেন বিপদে পড়ল? তুমি জান না? তুমি জান না? জানা উচিত ছিল। — পোয়ারো বলল, মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এইমাত্র খবর পাওয়া গেল।

কার মৃতদেহের কথা বলছ?

কুয়ো থেকে একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

মিসেস অলিভারের মুখে আর কোনো কথা সরল না। সে টেলিফোনের রিসিভার হাতে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।

.

২৫.

কিলটারবারি রিং। মিরান্দা দুচোখ মেলে তাকিয়ে বললো, বাঃ কি সুন্দর! কিলটারবারি রিং হল স্থানীয় অতীব সৌন্দর্যপূর্ণ অংশ, কিন্তু বাকি অংশ তেমন বিখ্যাত নয়। এই সৌন্দর্যপূর্ণ জায়গাটা কয়েক শ বছর আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। ইতস্ততঃ উঁচু পাথর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। পুরাকালে নানা শাস্ত্রীয় পূজা অর্চনার কথা মনে করিয়ে দেয়।

মিরান্দা নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো।

এইসব পাথর এখানে ছড়িয়ে রেখেছ কেন?

শাস্ত্রীয় প্রয়োজনে। শাস্ত্রীয় ত্যাগ স্বীকারের জন্য।

মিরান্দা তোমাকেও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে বুঝলে?

তোমার কি মনে হয় না এ এক ধরনের শাস্তি? না অন্য কিছু?

হ্যাঁ অন্য কিছু, অন্যরা যাতে বাঁচতে পারে সেই কারণে তোমাকে মরতে হবে। তুমি মরবে যাতে সৌন্দর্য বেঁচে থাকে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে এই হল আসল উদ্দেশ্য।

সম্ভবতঃ বুঝতে পেরেছি– বল মিরান্দা, থামলে কেন? বুঝেছি তোমাকে মরতে হবে কারণ তোমার কৃতকর্মের জন্য একজন খুন হয়েছে।

বুঝলে কি করে?

জয়েসার কথা মনে পড়ে। যদি কিছু না বলতাম তাহলে ওকে মরতে হত না বোধ হয়।

সম্ভবতঃ নয়।

জয়েসা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। ওকে কথাটা বলা উচিত হয়নি, কি বল? ওকে বলেছিলাম দামী কিছু পাওয়ার আশায়। জয়েসা ভারত ভ্রমণের গল্প করতো, বলতো সোনায় মুড়ে হাতাঁকে কিভাবে সাজানো হয় আর তাদের ধরা হয়। হঠাৎ আমারও মনে হল ওকে কিছু শোনাতে কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ওকে বলব আগে কখনও ভাবিনি। আচ্ছা একি ধরনের আত্মত্যাগ?

মিরান্দা কিছু সময় গভীরভাবে চিন্তা করল। তারপর বলল, সূর্য এখনও ঠিক জায়গায় পৌঁছায়নি। আর মিনিট পাঁচেক পরে সূর্যকিরণ সোজাসুজি পাথরের উপর পড়বে। তখনি হবে আমাদের ত্যাগস্বীকার উপযুক্ত সময়।

মনে হচ্ছে সেই বিস্ময়কর মুহূর্ত উপস্থিত। মিরান্দার সঙ্গী আকাশের দিকে তাকাল।

তোমাকে প্রথম দেখাব পাহাড়ের গায়ে একজোড়া কুঠার। কয়েকশো বছর আগে সিসিলি ক্রীট থেকে লোক এসে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে। দেখ, মিরান্দা কেমন চমৎকার তাই না?

একটা উঁচু পাথরের মাথায় তারা উঠল। এই পাথরের পাশে আর একটা পাথর পড়ে আছে, সমান্য দূরে পাথরের ঢালে কোণাকুণি অবস্থায় পড়ে আছে আর একটা পাথর।

তুমি খুশী হয়েছ মিরান্দা? হ্যাঁ খুব খুশী হয়েছি। দেখ, চিহ্নটা ফুটে উঠেছে। মিরান্দা সাগ্রহে দেখতে লাগল। জিজ্ঞাসা করল, সত্যি কি জোড়া কুঠার?

হ্যাঁ সময়ের আবর্তে ক্ষয়ে গেছে কুঠারের প্রতীক। এর উপর হাত রাখ। এখন আমরা পান করব অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ আর সৌন্দর্য।

আঃ কি সুন্দর –মিরান্দা অস্ফুট কণ্ঠে বলল।

 

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

একটা সোনালী পানপাত্র মিরান্দার হাতে ঢেলে দিল লোকটি। ফ্লাস্ক থেকে সেই কাপে সোনালী তরল পদার্থ ঢেলে পূর্ণ করল।

পাঁচ ফলের স্বাদ পার। পান কর মিরান্দা। দেখবে সুখ তোমার মনকে ভরিয়ে তুলবে। কাপ তুলে ধরে চুমুক দাও।

বাধ্য মেয়ের মতো মিরান্দা কাপটা তুলে ধরল। তার একটা হাত সেই পাথরের গায়ে রয়েছে ফলে কুঠারের চিহ্ন সামান্য মুছে গেছে। তার সঙ্গী ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে। কাৎ হয়ে থাকা পাথরটার তলা থেকে দুটি লোক বেরিয়ে এল, পাথরের উপরের লোকটি পিছন ফিরতেই তাদের দেখতে পেল না। তারা ক্ষিপ্র পদে চুপিসারে পাহাড়ের উপরে উঠে এল।

সৌন্দর্য পান কর মিরান্দা। যা বলছে মেয়েটা তাই করছে –পিছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

একটা লাল কোট এসে পড়ল লোকটার মাথার উপর, তার হাতের উদ্যত ছুরিটা ছিটকে নিচে পড়ে গেল। নিকোলাস র‍্যানসান মিরান্দার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। বাকি লোক দুটি হাতাহাতি করতে লাগলো।

অসভ্য মেয়ে। –নিকোলাস ধমকের সুরে বলল, একটা খুনীর সঙ্গে এখানে এসেছ? কিছু করার আগে ভাবা উচিত ছিল।

মিরান্দা বলল –ঠিকই করেছি। ভাবছিলাম আত্মাহুতি দিচ্ছি। সমস্ত দোষ আমারই, আমার জন্যই জয়েসা খুন হয়েছে। সেই কারণে আমার উচিত আত্মাহুতি দেওয়া। আমার মৃত্যু হতো শাস্ত্রসম্মত।

বোকার মতো তুমি কথা বলো না মিরান্দা, মেয়েটাকে ওরা খুঁজে পেয়েছে। ব্যাপারটা তুমিও তো জানো, সেই যে কাজের মেয়েটাকে অনেক দিন যাবৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই ভেবেছে উইল জাল করার অপরাধে ভয় পেয়ে পালিয়েছে, আসলে মেয়েটি পালিয়ে যায়নি। ও নিষ্ঠুর ভাবে খুন হয়েছিল। ওর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে কুয়োর মধ্যে।

হঠাৎ মিরান্দা আর্তনাদ করে উঠলো, মনোবাসনা পূরণের কুয়োতে নয় তো? এই কুয়োটা আমি কুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম। কে– ওখানে কে ওকে ফেলেছে?

মিরান্দা আত্মবিস্মৃতের মতো চীৎকার করে উঠলো –আহ!

.

২৬.

চারজন তারা তাকিয়ে আছে পোয়ারোর দিকে। টিমোটি র‍্যাগলান সুপারিন্টেন্টে স্পেনস আর চীফ কনস্টেবল এর চোখে মুখে আনন্দের ছায়া। চতুর্থজনের চোখ এখনও সন্দেহের ছায়া দুলছে।

ইনসপেক্টর র‍্যাগলান ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে ফিরে এল বছর ত্রিশেক বয়সের একজন ভদ্রমহিলা, একটি বাচ্চা মেয়ে আর দুজন যুবককে সঙ্গে নিয়ে। সে চীফ কনস্টেবলের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল, মিসেস বাটলার, মিস মিরান্দা বাটলার, মিঃ নিকোলাস র‍্যানসান আর মিঃ ডেসম হল্যাণ্ড।

পোয়ারো উঠে মিরান্দার হাত ধরে বলল, মায়ের পাশে বস মিরান্দা –চীফ কনস্টেবল, মিঃ রিচম তোমায় কয়েকটা প্রশ্ন করবেন। তুমি উত্তর দেবে।

মিরান্দা মাথা নাড়ল।

মিরান্দাকে জিজ্ঞাসা করা হল এক কিম্বা দুবছর আগে জয়েসাকে সে কিছু বলেছিল কিনা। মিরান্দা বললে হ্যাঁ জয়েসাকে সে একটা খুন হওয়ার কথা বলেছিল। সে কথাটি লিওপোল্ট দরজার আড়াল থেকে শুনেছিল। ও মানুষের গোপন খবর শুনতে ভালোবাসতো।

জয়েসা রেনল্ড হ্যালুইন পার্টিতে বলেছিল সে নিজে একটা খুন হতে দেখেছে। কথাটা সত্যি?

না আমি যা বলেছিলাম ও তাই পুনরাবৃত্তি করেছিল মাত্র।

প্রথমে বুঝতে পারিনি ওটা খুন। ভেবেছিলাম দুর্ঘটনা। মেয়েটা হয়তো উপর থেকে পড়ে গেছে।

কোথায় ঘটেছিল?

কোয়ারী গার্ডেনে, যেখানে জলের ধার উপর থেকে নিচে এসে পড়ছে। একজন লোক আর একজন মেয়েছেলে একটা মেয়েকে তুলে আনল রাস্তায়, ভেবেছিলাম ওরা ওকে হাসপাতালে কিম্বা কোয়ারী হাউসে বুঝি নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, কেউ আমাদের উপর লক্ষ্য রাখছে। লোকটা বললো, বোকামি কর না। ওরা চলে গেল।

আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমার চোখে পড়ল স্কার্ফে জড়িয়ে থাকা রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়েছিল কেউ মেয়েটাকে খুন করবার চেষ্টা করেছে।

পরের দিন ঠিক ঐ জায়গায় একটা ঝোঁপের আড়ালে বসে আমি লক্ষ্য রাখছিলাম। সেই ঝোঁপের ওপাশে সেই লোকটা আর মেয়েটা বসে একটা দ্বীপের কথা– মানে গ্রীস দ্বীপের কথা আলোচনা করছিল। মেয়েটা বলছিল, সইসাবুদ হয়ে গেছে দ্বীপটা আমাদের, দ্বীপের যে কোনো জায়গায় আমরা যেতে আসতে পারি। তবে যা করবার ধীরে ধীরে করতে হবে তাড়াহুড়ো করা চলবে না।

ঠিক তখনি আমার মনে হল সেদিন যা দেখেছি সেটা খুন ছাড়া আর কিছু নয়, মৃতদেহ কোথাও লুকিয়ে রাখার জন্য ওরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মিরান্দা তুমি বলতে পারবে ওরা কারা?

নিশ্চয়ই পারবো। ওরা হল মিসেস ড্রেক আর মাইকেল….

তুমি কাউকে বলনি কেন? আমার মনে হয়েছিল, ঘটনাটা আত্মাহুতি। মাইকেল আমায় বলেছিল আত্মাহুতি দেওয়ার দরকার ছিল।

পোয়ারো মৃদু হেসে বলল, তুমি মাইকেলকে ভালোবাস।

হ্যাঁ, ভীষণ ভালোবাসি।

.

২৭.

পোয়ারোকে দেখে মিসেস অলিভার বললো– যাক শেষ পর্যন্ত তোমায় এখানে পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি ফিরলে না কেন?

মাপ করে দাও মাদাম।– পোয়ারো বলল, পুলিসকে তাদের তদন্তে সাহায্য করতে ব্যস্ত ছিলাম।

আসল সূত্রটা কি?

জল। এমন একজন মানুষের খোঁজ করি যে পার্টিতে ছিল এবং পোশাক ছিল জলে ভেজা, কিন্তু তার পোশাক জলে ভেজার কোনো কারণ ছিল না। যে জয়েসাকে খুন করেছে তার পোশাক জলে ভিজে যাওয়ার কথা। তুমি একটা শক্ত সামর্থ মেয়ের মাথা যদি জলভর্তি গামলার মধ্যে চেপে ধর তাহলে মেয়েটা ছাড়া পাওয়ার জন্য ঝাঁপটি করবে আর চারিদিক জল ছিটোবে। সুতরাং খুনীকে পোশাক ভিজার একটা অজুহাত দেখাতে হবে, নাহলে অন্যদের চোখে ধূলো দেওয়া যাবে না।

 

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

সবাই যখন স্ন্যাপড্রাগন উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য ডাইনিং হলে গেল, মিসেস ড্রেক জয়েসাকে ডেকে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরীতে। জয়েসা কিন্তু মিসেস ড্রেককে কোনো রকম সন্দেহ করেনি। মিরান্দা শুধু বলেছিল একটা খুন হতে সে দেখেছে। তাই জয়েসাকে মিসেস ড্রেক খুন করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তার পোশাক ছিটিয়ে পড়া জলে ভিজে গেল।

ভিজে যাওয়ার কারণ তৈরি করতে হল তাকে এবং একজন সাক্ষী রাখার দরকার হল কি করে ভিজেছে দেখানোর জন্য।

তিনি সিঁড়ির ল্যাণ্ডিংয়ের উপর অপেক্ষা করতে লাগলেন জল ভর্তি ফুলদানি হাতে নিয়ে। একসময় মিস উইটেকার ডাইনিংরুম থেকে বেরিয়ে হলে আসতেই মিসেস ড্রেক এমন ভাব করলেন যেন কিছু দেখে ফুলদানিটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।

মিসেস উইটেকারের মনে এমন একটা ধারণা জন্মিয়ে দিলেন যেন কাউকে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে আসতে এবং ঢুকে যেতে দেখেছেন, কারণ এই ঘরেই জয়েসাকে খুন করা হয়েছিল।

প্রথমে মিস উইটেকার কোনো গুরুত্ব দেননি, কিন্তু মিস এমলিন ব্যাপরটার স্বরূপ এবং গুরুত্ব বুঝতে পেরে আমায় সব খুলে বলেলেন।

কিছুসময় চুপ করে থেকে পোয়ারো বলল, আর তারপরেই আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল জয়েসার খুনী কে।

মিসেস অলিভার বললো– তাহলে বোঝা যাচ্ছে জয়েসা কখনো কাউকে খুন হতে মোটেই দেখেনি।

কখন তুমি জানলে খুন হতে দেখেনি, খুন হতে দেখেনি, খুন হতে দেখেছে মিরান্দা।

যখন বুঝতে পারলাম সে জয়েসা সত্যিই মিথ্যাবাদী, তাছাড়া মিরান্দার কথাবার্তার মধ্যেও এ সম্পর্কে যথেষ্ট ইঙ্গিত ছিল। ঠিক তখনই আমার ওই ধারণা হয়।

শেষ পর্যন্ত রোয়েনা ড্রেক!– অস্ফুট কণ্ঠে মিসেস অলিভার বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।

জালিয়াতি সম্পর্কে তোমার মত কি? অলিভার জানতে চাইলো। আমার ধারণা মাইকেল আর রোয়েনা ড্রেকের অবৈধ সম্পর্কের কথা মিসেস স্মিথ জানতে পেরেছিলেন। খুব সম্ভব তিনি বিধবা হওয়ার আগেই সেই কারণে রেগে গিয়ে উইল পাল্টে সবকিছু ওলগাকে দিয়ে যান।

সম্ভবতঃ ওলগা এ কথা মাইকেলকে জানায়– কারণ তার আশা ছিল একদিন মাইকেলের সঙ্গে তার বিয়ে হবে।

আমি ভেবেছিলাম লোকটা লেসলি ফেরিয়ার। মাইকেল সেই রকমই একটা গল্প আমায় শুনিয়েছিল বটে কিন্তু সেই গল্পের উপর কারো সমর্থন পাইনি। গল্পটা শুনিয়ে আমাকে ভ্রান্ত পথে চালাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যদি সে আসল উইলের কথা জানতই তাহলে ওলগাকে কেন বিয়ে করে সব হাতিয়ে নিল না?

কারণ মাইকেলের তখনও সন্দেহ ছিল সত্যিই ওলগা সব পাবে কিনা।

আর রোয়েনা ড্রেক?

মিসেস ড্রেক মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অনেক বছর ধরে স্বামী খোঁড়া হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন মধ্যবয়সী এবং আবেগপ্রবণা নারী। তাঁর জীবন পরিক্রমায় ঢুকে পড়ল একজন সুদর্শন চেহারার যুবক নাম মাইকেল। অবশ্য মেয়েদের রূপের দিকে মাইকেলের নজর ছিল না- ছিল রূপের দিকে। লোকটা কেবল ভালোবাসতো নিজেকে– যাকে বলে একজন নার্সিসাস।

গ্রীস দ্বিপে শুধু একটা বাগান করবার জন্য খুন করা — আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছি না –মিসেস অলিভার বললো।

বাগান করতে গেলে তো অর্থের প্রয়োজন। মাইকেল সেই অর্থের অন্বেষণে উঠে পড়ে লেগে পড়ল। উপোসী রোয়েনা ড্রেককে সে হাতের কাছে পেল যার অর্থ আছে, সেই অর্থের উপর নির্ভর করে সৌন্দর্যময় এক জগৎ সৃষ্টি করতে পারবে।

কিন্তু রোয়েনার মত মেয়ের সঙ্গে বনিবনা করতে পারত?

না পারলে আর একটা দুর্ঘটনা ঘটত।

তার মানে আর একটা খুন?

হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অলিভার জানতে চাইল, মাইকেলকে পোয়ারো কিভাবে সন্দেহ করলো?

শেষ যে বার মাইকেলের সঙ্গে কথা বলি, তখন থেকেই সন্দেহ হয়। ও আমাকে হেসে বলেছিল, আমার কাছ থেকে দূরে থাক শয়তান। পুলিস বন্ধুর কাছে যাও। আমি মনে মনে বলেছিলাম তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি শয়তান।

পোয়ারো আরো বললো, মাইকেল ভালোবাসতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হয়ত সেই কারণে মিরান্দাকে ভালোবাসতো। কিন্তু নিজেকে বাঁচাবার জন্য মিরান্দাকে হারাতে প্রস্তুত ছিল। মেয়েটাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল সুন্দর ভাবে।

মাদাম, আপনার মেয়ে এখন নিরাপদ। পোয়ারো বলল, কিন্তু আমি একটা কথা জানতে চাই। সত্যি উত্তর দেবেন?

জুডিথ বললো, নিশ্চয়ই উত্তর দেব।

মিরান্দা আপনার মেয়ে ও কি মাইকেলেরও মেয়ে?

জুডিথ স্তব্ধ হয়ে গেল, কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, হ্যাঁ।

মিরান্দা জানতো?

না, ওর সঙ্গে আমার পরিচয় যৌবনে। ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু তারপরেই একটা ভয় মনে বাসা বাঁধে।

ভয়?

হা, ওর আচার-আচরণ আমাকে ভীত করে তুলতো। ভদ্র, কিন্তু অন্তরে ছিল একটা পাকা। শয়তান। ওকে কোনোদিন জানাইনি যে আমি মা হতে চলেছি। একদিন ওকে ছেড়ে চলে গেলাম, আমার সন্তান জন্ম নিল। জানতে পারলাম একটা প্লেন দুর্ঘটনায় একজন পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। রটিয়ে দিলাম আমার পাইলট স্বামী প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

তারপর অস্থির মনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে উডলিফ কমন্সে এসে পড়লাম।

একদিন মাইকেল এই কোয়ারী উড়ে এল চাকরী পেয়ে।

মিরান্দার সঙ্গে মাইকেলের এক প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠলো। পোয়ারো একটা কাগজ নিয়ে জুডিথের সামনে মেলে ধরলো– নিচে সই করা আছে: মাইকেল গারফিল্ড।

ছবিটা এঁকেছিল কোয়ারী উড়ে নদীর ধারে বসে। সে চেয়েছিল মিরান্দাকে ভুলে যেতে। মাইকেল তার মেয়েকে আহুতি দিতে চেয়েছিল যাতে সে ইডেনের মত নতুন একটা বাগানের প্রতিষ্ঠা করতে পারে।, যা করবার মাইকেল সজ্ঞানেই করেছে। জুডিথ বলল, জানিনা, দুঃখপ্রকাশ করবে কিনা।

পোয়ারো কিছু সময় চুপ করে রইলো। একটা ছবি তার মনের পর্দায় ক্রমশঃ আকার নিচ্ছে। একজন সুদর্শন যুবকের মৃতদেহ নিচে পাথরের পাশে পড়ে আছে হাতে ধরা একটা পান পাত্র। মাইকেল গারফিল্ড মারা গেছে। আর কোনোদিন সমুদ্রঘেরা গ্রীসের কোনো দ্বীপে ফুল ফোঁটাবার স্বপ্ন সে দেখবে না। তবে মাইকেল নেই বটে কিন্তু রয়ে গেছে মিরান্দা–জীবিত প্রস্ফুটিত আর সৌন্দর্যের আকর।

জুডিথের একটা হাত তুলে নিয়ে চুম্বন করল পোয়ারো। সে বলল, বিদায় মাদাম। আপনার মেয়ের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাই। পোয়ারো মিসেস অলিভারের কাছে এসে বলল, বিদায় সুন্দরী মাদাম, লেডি ম্যাকবেথ আর নার্সিসাস।

সব মিলিয়ে ব্যাপারটা বেশ মজার। মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে আসার জন্য তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ। আশা করি লণ্ডনে আমাদের আবার দেখা হবে। বিদায়!

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

Bangla Gurukul Logo পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিসেস আরিয়াদে অলিভার -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

কোয়ারী হাউসের দিকে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

পাহাড়ের মাথায় উঠে -হ্যালুইন পার্টি ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

ভ্রুকুটি করলো পোয়ারো -হিকরি ডিকরি ডক (১৯৫৫) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিস লেমনকে নোট দিতে -হিকরি ডিকরি ডক (১৯৫৫) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment