পরিভাষার সংজ্ঞার্থ | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

পরিভাষার সংজ্ঞার্থ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিভাগের “ছন্দ ও অলঙ্কার” বিষয়ের একটি পাঠ। অক্ষর বা দল বা ধ্বনি (Syllable) বাগ্যন্ত্রের স্বল্পতম প্রচেষ্টায় যে ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ উচ্চারিত হয় তাকে অক্ষর বলে। উচ্চারণসাধ্য হ্রসতম ধ্বনি, বা ধ্বনিগুচ্ছ অক্ষর হিসেবে পরিচিত; অর্থাৎ স্বরধ্বনি অথবা স্বরধ্বনির সাহায্যে উচ্চারিত ক্ষুদ্রতম শব্দাংশকেই অক্ষর বলে।

পরিভাষার সংজ্ঞার্থ | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

যেমন : অকম্পন — অ-কম্‌পন তিনটি অক্ষর। অক্ষর দু’রকম : অকাতর, বউ = মুক্তাক্ষর বা মুক্ত দল বা অযুগ্ম ধ্বনি (Open syllable) যে সকল অক্ষর স্বরধ্বনিজাত অথবা অক্ষরের শেষে একটি স্বরধ্বনি থাকে তাকে স্বরান্ত অক্ষর বা বিবৃত অক্ষর বা. মুক্তাক্ষর (Open syllable) বলে।

ভাষা ও শিক্ষা 5 পরিভাষার সংজ্ঞার্থ | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

মুক্তাক্ষর উচ্চারণের শেষে মুখ খোলা থাকে, ফলে অক্ষর উচ্চারণ করে ও তাকে প্রয়োজনমতো প্রলম্বিত করা চলে । . বদ্ধাক্ষর বা বদ্ধদল বা যুগ্মধ্বনি (Closed syllable) ব্যঞ্জনধ্বনি বা অর্ধস্বরধ্বনির মাধ্যমে যে সব অক্ষরের সমাপ্তি ঘটে তাকে সংবৃত অক্ষর বা বদ্ধাক্ষর (Closed syllable) বলে।

বদ্ধাক্ষর উচ্চারণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ হয়ে যায়। অক্ষর উচ্চারণের শেষে মুখ খোলা থাকে না বন্ধ হয়ে যায়—তা লক্ষ করেই মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর চিহ্নিত করা যায়। তর্, য়। তর্, বড়। চিহ্ন = মাত্রা (Mora) অক্ষর উচ্চারণের কালপরিমাণকে মাত্রা বলে। একটি অক্ষর উচ্চারণের জন্য যে সময় বা Duration প্রয়োজন, সেই সময় অনুসারেই প্রতিটি অক্ষরের মাত্রা নির্ধারণ করা চলে। যেমন-

Capture 97 পরিভাষার সংজ্ঞার্থ | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

 

যতি ও ছেদ যতি বা ছেদ বলতে উচ্চারণের বিরতি বোঝায়। কেবল কিছু পাঠ করবার সময় সমস্ত কথাকে অনর্গল উচ্চারণ করে -যাওয়া যায় না; বক্তব্যের অর্থকে সুবোধ্য ও সুচারুরূপে প্রকাশ করবার জন্য মাঝে মাঝে থামতে হয়। এই ধরনের উচ্চারণ বিরতিকে ছেদ বলে। ছেদ বলতে অর্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উচ্চারণের বিরতি বোঝায়। ছেদ দু’ রকম

উপচ্ছেদ :

কবিতার চরণে যেখানে বিশিষ্ট অর্থবাচক শব্দ সমষ্টি অর্থাৎ বাক্যাংশের শেষ হয়, সেখানে স্বল্পক্ষণের জন্য উচ্চারণের বিরতি ঘটে এরূপ বিরাম স্থলকে উপচ্ছেদ বলে। পূর্ণচ্ছেদ : বাক্য যেখানে শেষ হয়ে যায় সেখানে পূর্ণচ্ছেদ বসে। ** যেমন- এই কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে পা দুখানি ।

যতি

নিশ্বাস প্রশ্বাসের প্রয়োজনার্থে মাঝে মাঝে থামতে হয়। এক ঝোঁকে কতকগুলো ধ্বনি উচ্চারণ করলে যেখানে সেই ঝোঁকের সমাপ্তি ঘটে এবং জিহ্বা স্বল্পকালের জন্য বিরাম গ্রহণ করে, সেই বিরামকে যতি বলে। অর্থ প্রকাশের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। কবিতা আবৃত্তিকালে নিশ্বাসের যে বিরতি ঘটে তা-ই যতি। যতি দুরকম: অর্ধযতি ও পূর্ণযতি । অর্ধযতি : চরণের কতকগুলো ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণের পর ঝোঁকের অবসানহেতু চরণের মধ্যে জিহ্বার যে বিরাম স্থান তার নাম অর্ধযতি।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অর্ধতির স্থানে জিহ্বার সামান্য বিরতি ঘটে। পূর্ণযতি : প্রতিটি চরণের শেষে জিহ্বার যে পূর্ণবিরতি ঘটে তার নামই পূর্ণযতি। পূর্ণযতির স্থানে বিরতি দীর্ঘতর। [u] মহাভারতের কথা। অমৃত সমান। কাশীরাম দাস ভনে। শুনে পুণ্যবান৷ ছেদে অর্থ, যতিতে অর্থ নেই। পর্ব ও পর্বাঙ্গ কবিতার চরণে অর্ধযতি বা হ্রস্বযতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ধ্বনি সমষ্টির নাম পর্ব; অর্থাৎ যতি দ্বারা কবিতার চরণ কতকগুলো ধ্বনি সমষ্টিতে বিভক্ত হয়ে যায়। এই খণ্ডিত ধ্বনি প্রবাহই পর্ব। পর্বের অন্তর্গত ক্ষুদ্রতম অংশ বা পর্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগই পর্বাঙ্গ।

কবিতা আবৃত্তিকালে এক এক বারের ঝোঁকে অর্থাৎ এক নিশ্বাসে চরণের যতটুকু অংশ উচ্চারিত হয়, তাই পর্ব। পর্ব [I], পৰ্বাঙ্গ [:]। ও গাছের । তলে এইখানে : তোর । দাদির : কবর । ডালিম : গাছের মধ্যখণ্ডন পর্ব বিন্যাসের স্বার্থে কখনও কখনও শব্দের মধ্যবর্তী স্থানে খণ্ডিত করতে হয়। ছন্দো বিজ্ঞানে একে মধ্যখণ্ডন বলে। কান্ডারী তত । সম্মুখে ঐ । পলাশীর প্রান্ । তর অপূর্ণ পর্ব যদি সমপর্বিক ছন্দের মধ্যে শেষ পর্বটি অপেক্ষাকৃত ছোট হয়, তবে সেই ছোট পর্বটিকে অপূর্ণ পর্ব বলে। আর কত দূরে । নিয়ে যাবে মোরে ।

হে সুন্দরী ৬ + ৬ + ৪ অতিপূৰ্ণ পৰ্ব P সমপর্বিক ছন্দে পংক্তি বা চরণের শেষের পর্বটি অন্য পর্বের চেয়ে বড় হলে তাকে অতিপূর্ণ পর্ব বলে। এক্ষেত্রে মাত্রা সংখ্যা অন্যান্য পর্বের চেয়ে বেশি। কৈলাশ ভূধর । অতি মনোহর । কোটি শশী ৬ পরকাশ। অতি পর্ব অনেক সময় ছন্দের প্রারম্ভে অতিরিক্ত একটি ছোট পর্ব থাকে ; এর সঙ্গে অন্যান্য পর্বের কোন সমতা থাকে না। একে অতিপর্ব বলে । (আজ) সঙ্কেত। শঙ্কিতা। বনবীথি। কায় (কত) কুল বধূ। ছিঁড়ে শাড়ি। কুলের কাঁ। টায়।

চরণ ও পংক্তি কবিতায় পূর্ণচ্ছেদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পূর্ণ ধ্বনি প্রবাহের বা ছন্দো বিভাগের নাম চরণ। একটি সম্পূর্ণ বাক্যই কবিতার চরণ হিসেবে বিবেচ্য। ছন্দের পূর্ণরূপ প্রকাশের অন্য যতগুলো পর্বের প্রয়োজন ততগুলো পর্ব নিয়ে একটি চরণ গঠিত হয়।

অপ্রবহমান পূর্ণযতি বিভাগের নাম পংক্তি। সোজা কথায় এক সারিতে সাজানো শব্দ সমষ্টিই পংক্তি। চরণ ও পংক্তি একার্থবোধক নয়। একটি পংক্তিতেও চরণ হতে পারে, আবার একটি চরণকে ভেঙে বিভিন্ন পংক্তিতেও সাজানো যেতে পারে চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে? এক চরণ / চার পংক্তি সমচরণ ছন্দ বিভিন্ন পংক্তিতে পর্ব সংখ্যা সমান হলে সমচরণ ছন্দ বলে। মরিতে চাহিনা আমি। সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি। বাঁচিবারে চাই। মিশ্রচরণ ছন্দ কবিতার চরণগুলোতে পর্ব সংখ্যা সমান না হলে তাকে মিশ্রচরণ ছন্দ বলে ।

আমি । পরাণের সাথে । খেলিব আজিকে । মরণ খেলা । নিশীথ বেলা ॥ ৫ যখন বরষা । গগন আঁধার ॥ ২ পদ পদ বলতে পারিভাষিক অর্থে অর্ধযতি নির্দিষ্ট এবং অপারিভাষিক অর্থে পূর্ণযতি নির্দিষ্ট ছন্দোবিভাগ বোঝায়। দ্বিপদী, ত্রিপদী, চৌপদী প্রভৃতি শব্দে পারিভাষিক অর্থে পদ কথাটি ব্যবহৃত হয় : কিন্তু চতুর্দশপদী কবিতা বলতে প্রতিটি পংক্তিকে পদ ধরা হয়।

 

ভাষা ও শিক্ষা 5 পরিভাষার সংজ্ঞার্থ | ছন্দ ও অলঙ্কার | ভাষা ও শিক্ষা

 

মরিতে চাহিনা আমি। সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি। বাঁচিবারে চাই। ৪/সনেট-২ শ্লোক অন্ত্যানুপ্রাস দ্বারা সংযুক্ত দুটি চরণ মিলে একটি শ্লোক গঠিত হয়। প্রাচীরের ছিদ্রে এক। নাম গোত্রহীন৷ ফুটিয়াছে ফুল এক। অতিশয় দীন৷ স্তবক সুশৃঙ্খলভাবে একত্র সন্নিবিষ্ট দুই বা ততোধিক পংক্তিকে অর্থাৎ পংক্তি সমষ্টিকে স্তবক বলে। হৃদয় আজি মোর । কেমনে গেল খুলি জগৎ আসি সেথা । করিছে কোলাকুলি প্রভাত হল । কাশ না যেই কী জানি হল একি আকাশ পানে চাই ।

কী জানি কারে দেখি। ৪/১ বল বা প্রস্বর কবিতা আবৃত্তিকালে কখনো কখনো কোনো কোনো অক্ষরে যে বিশেষ ঝোঁক পড়ে তাকে বল, প্রস্বর, স্বরাঘাত বা শ্বাসাঘাত (Accent বা, Stress) বলে। বাক্য উচ্চারণ করার সময় মাঝে মাঝে শব্দের বিশেষ বিশেষ ধ্বনির ওপর বিশেষ জোর পড়ে।

এটাই বল বা প্রস্বর। পর্বের প্রথমে [ ] রেফ চিহ্ন দিয়ে শ্বাসাঘাত বোঝানো হয়। “বিষ্টি পড়ে । টাপুর টুপুর । নদে এল । বোন ॥ “শিব ঠাকুরের । বিয়ে হল । তিন কন্যে । দান ॥ মিত্রাক্ষর কবিতার পংক্তির শেষে মিলযুক্ত ছন্দকে মিত্রাক্ষর ছন্দ বলে। একে অন্ত্যানুপ্রাস বা শেষ মিলও বলে। দুটি চরণের বা পংক্তির অথবা পংক্তিবিভাগের শেষাংশে (শেষ অক্ষরে) ধ্বনির মিল দেখা যায়। এ সমধ্বনি যুক্ত অক্ষরযুগলকে মিত্রাক্ষর বলে। ১. পর্যায় সম-মিল : ১ম, ৩য় / ২য়, ৪র্থ। ২. মধ্য সম-মিল : ১ম, ৪র্থ / ২য়, ৩য় ।

অমিত্রাক্ষর কবিতার পংক্তির শেষে মিলহীন ছন্দকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলা হয়। অর্থাৎ কবিতার দুটি পংক্তির শেষ অক্ষরের ধ্বনির সাম্য, না থাকলে তাকে অমিত্রাক্ষর বলা চলে। যেমন : সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে।

ছন্দ সন্ধি ছন্দ পতন থেকে রক্ষা করার জন্য পাশাপাশি দুটি ভিন্ন শব্দকে এক শব্দের মতো উচ্চারণ করে পড়তে হয়। এর নাম ছন্দ সন্ধি। এতে শব্দের দুটি ধ্বনির সংযোগ ঘটে। যেমন : হত্যা নয় আজ । সত্যা গ্রহ। শক্তির উদ্বো। ধন নয়+আজ= নয়াজ; শক্তির+উদ্বোধন = শক্তিরুদ্বোধন পড়লে ছন্দ রক্ষিত হয়। ছন্দ সমাস ছন্দের সুবিধার জন্য পাশাপাশি দুটি শব্দকে কখনও কখনও সমাসবদ্ধ করে উচ্চারণ করতে হয়। এই ধরনের শব্দের মিলনকে ছন্দ সমাস বলে। গুরু গুরু গুরু । নাচের ডমরু ।

বাজিল ক্ষণে ক্ষণে ‘ক্ষণেক্ ক্ষণে’ উচ্চারিত হবে। ছন্দের লয়, গতি বা চাল কবিতা আবৃত্তির বেলায় কখনো দ্রুত, কখনো বিলম্বিত বা টেনে টেনে, আবার কখনো ধীরে ধীরে পড়তে হয়। বিশেষ বিশেষ কবিতা পড়ার বিশেষ এই গতিবেগকে ছন্দের লয়, গতি বা চাল বলে। লয় অনুসারে কবিতা আবৃত্তি না না করলে ছন্দের যথার্থ বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে না।

লয় বা গতির ধরন কানে শুনলেই ছন্দের জাতি নির্ণয় করা চলে। প্রবহমানতা পয়ারের ন্যায় একটি শ্লোকেই একটি ভাবকে আবদ্ধ না রেখে দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা ততোধিক পংক্তিতে টেনে নিয়ে যাওয়াকে ছন্দঃশাস্ত্রে বলে প্রবহমানতা। অর্থাৎ প্রবহমানতা হল এক পংক্তিতে বক্তব্য শেষ না হয়ে অন্য পংক্তি বা পংক্তিসমূহে গড়িয়ে যাওয়া। যেমন: সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর চূড়ামণি বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে।

আরও দেখুন:

Leave a Comment