পদ্মা সেতু, স্বপ্নের পদ্মা সেতু [ Essay on Padma Bridge ] অথবা, দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু – নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনার নমুনা দেয়া হল।
Table of Contents
পদ্মা সেতু রচনার সূচনা :
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম দুটি নদী- ব্ৰহ্মপুত্র ও গঙ্গা যেখানে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে সেখানেই কালের পরিক্রমায় গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম এই ব-দ্বীপ। ভৌগােলিক গঠনগত কারণেই এদেশে জালের মতাে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। কিছু কিছু নদী আছে যেগুলাে দীর্ঘতর ও প্রশস্ততর। এজন্য বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চল বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার যােগাযােগ ব্যবস্থা তেমন ভালাে নয়। এমনই একটি নদী পদ্মা, যার ওপর সেতু নির্মিত হলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলের ১৯টি জেলার যােগাযােগ নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের জনগণের বহু বছরের, বহু যুগের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প :
১৯৯৮-৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে । ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মাসেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় প্রথম পদ্মাসেতু প্রকল্প অনুমােদন করেছিল।
২০১১ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশােধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পাঁচটি ভৌত ও দুটি তদারক প্যাকেজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। নদীর তীর রক্ষা, ফেরিঘাট সরানাে ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রক্ষার ব্যয় ধরলে তা ২৯ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছাবে।
প্রকল্প নিয়ে জটিলতা নিরসন :
পদ্মাসেতু প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থে । নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল।
কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযােগে দাতারা সরে যাওয়ার ঘােষণা দিলে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় ডলার জোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ :
বাংলাদেশ সরকার পদ্মাসেতু প্রকল্পটিকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। এর পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পদ্মাসেতু প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে সরকারের তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই সরকার এ প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকেও তুলে ধরতে চায় সরকার।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০০৮ সালে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সরকারের প্রতি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের আস্থা বহুগুণ বেড়ে যাবে।
পদ্মাসেতুর অবকাঠামাে :
পদ্মাসেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলােমিটার। সেতুটি হবে দ্বিতলবিশিষ্ট। সেতুটি নির্মিত হবে কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে। সেতুর ওপরের তলা দিয়ে চলবে বাস, ট্রাক ইত্যাদি যানবাহন আর নিচতলা দিয়ে চলবে ট্রেন। পদ্মাসেতুর পিলারের সংখ্যা ৬৬টি। এর মধ্যে ৪২টি পিলার পদ্মাবক্ষে বসানাে হবে আর বাকি ২৪টি পিলার উভয় পাড়ে দেড় কিলােমিটার করে তিন কিলােমিটার সংযােগ সেতুর জন্য করা হবে। পদ্মাবক্ষে বসানাে ৪২টি পিলারে ৬টি করে পাইল থাকছে। তবে দুই পাড়ের পিলার দুটিতে আরও ৬টি করে বেশি পাইলসহ মােট ১২টি পাইল বসানাে হবে। মােট পাইলের সংখ্যা ২৬৪টি (৪২ X ৬ + ১২)। সেতুর পিলারগুলাে ১৫০ মিটার পরপর বসানাে হচ্ছে। প্রতিটি পিলার কম-বেশি ৭০ ফুট মাটির গভীরে প্রােথিত থাকবে।
পদ্মাসেতুর মূল কাজের উদ্বোধন :
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাজিরা পাড়ে নদীশাসনের কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর মাওয়া পাড়ে সুইচ টিপে পাইলিং কাজের আনুষ্ঠানিক পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল সেতুর নির্মাণযজ্ঞ। স্বপ্নের এ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে।
প্রধানমন্ত্রী সুইচ অন করার পর মুহুর্মুহু করতালির আওয়াজের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোলিক গ্যামারে নদীর তলদেশে গভীর থেকে গভীরে প্রােথিত হতে থাকে পদ্মাসেতুর মূল পাইল। এর মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া হয় নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু।
এটি আর স্বপ্ন নয়; বাস্তবদৃশ্য। ৬.১৫ কিলােমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০১৮ সালের মধ্যেই। সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধনী দিনে সাক্ষী হতে ঢল নামে হাজারাে মানুষের। তারা ছুটে আসেন শ্রীনগর, লৌহজং, কেরানীগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে। এছাড়া পদ্মার ওপারের জাজিরা এবং মেঘনার ওপারের গজারিয়া থেকেও এসেছেন অনেকে। উপস্থিত জনগণের চোখে-মুখে ছিল স্বপ্ন ।
নির্মাতা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান :
পদ্মাসেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে শিফট অনুসারে কাজ চলছে এবং ড্রেজিংসহ নদীশাসনের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নদীশাসনের কাজের দায়িত্বে রয়েছে চীনের ‘সিনােহাইড্রো কর্পোরেশন।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ সেতুর মূল নির্মাণ কাজের জন্য চীনের ‘চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দুই পাড়ে সংযােগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামাে নির্মাণের জন্য যৌথভাবে বাংলাদেশি ‘আবদুল মােনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার ‘হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট কাজ করে চলছে।
এছাড়া পদ্মাসেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে।
ভূমি অধিগ্রহণ :
মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর- তিনটি জেলায় প্রস্তাবিত ১৪২২.৭৫ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজও প্রায় শেষের দিকে। ইতােমধ্যে ৮০ শতাংশ পুনর্বাসনের কাজ শেষ হয়েছে। শহরের আদলে নির্মিত পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলাে এখানকার মানুষের মাঝে নগরজীবনের ছোঁয়া এনে দেয়।
৭টি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২৭০০ পরিবারের জন্য পুট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অধিকাংশ পরিবারের কাছে ইতােমধ্যে প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে। পদ্মাসেতু প্রকল্পে ৫ হাজার পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলাে ঘুরে দেখা যায়, পরিকল্পিতভাবে দৃষ্টিনন্দিত করে সাজানাে হয়েছে। কেন্দ্রগুলােতে স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মার্কেট শেড, পানির ট্যাংক, বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, পাকা রাস্তা, পাকা ড্রেন, সুয়ারেজ লাইন ও পুকুর রয়েছে।
পদ্মাসেতু ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা :
পদ্মাসেতু এশিয়ান হাইওয়ের পথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পদ্মাসেতু চালু হলে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর ঢাকা শহর থেকে মাওয়া মহাসড়ক পর্যন্ত ১৩ কিলােমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক স্থাপিত হবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে হংকং-এর আদলে নগর গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। মাওয়া থেকে পােস্তগােলা পর্যন্ত চার লেনের সড়ক হবে।
উপসংহার :
বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। বহু চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে অবশেষে ২০১৫ সালে পদ্মসেতুর কাজ শুরু হয়েছে। দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযােগে বিশ্বব্যাংক ও দাতাগােষ্ঠী সরে গেলেও বাংলাদেশ সরকার পিছু হটেনি।
সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এ সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় আর সে অনুযায়ী কাজও এগিয়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজের অগ্রগতি তদারকি করছেন, নিয়মিত খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতি মাসে তিনচার বার করে পদ্মার পাড়ে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন সেতুর কাজ পর্যবেক্ষণ করতে। পদ্মা সেতুর কাজ স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবাই আশা করছেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হবে।
আরও দেখুনঃ
- বাংলা প্রতিবেদন রচনা সূচি | বিরচন
- স্কুলের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা রচনা । Essay on Experience of my first School day । প্রতিবেদন রচনা
- মুজিবনগর সরকার রচনা । Essay on Mujibnagar Government । প্রতিবেদন রচনা
- বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রচনা । Essay on Natural disaster of Bangladesh । প্রতিবেদন রচনা
- See the English Version of The Padma Bridge Essay