পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় – ভাব-সম্প্রসারণের একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আগ্রহীরা এখন থেকে ধারণা নিয়ে নিজের ভাষায় নিজস্ব ভাষণ তৈরি করবেন। কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় অনেক সময় ভাব-সংহত বাক্য বা চরণ থাকে, যার মিত-অবয়বে লুক্কায়িত থাকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত গূঢ় কথা, নিহিত থাকে ভূয়োদর্শনের শক্তি। ইতিময়, রূপকাশ্রয়ী স্বল্প-বাক উক্তিগুলো বিশ্লেষণে বের হয়ে আসে গত জীবন সম্পর্কে বৃহৎ ভাব, জীবনের অদ্ভুদর্শন। এই ধরনের ভাবগূঢ় বাক্যগুলোর ব্যাখ্যা-বিশেষণই হলো ভাবসম্প্রসারণ।
পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়
তীর্থ হল পুণ্যক্ষেত্র; মানুষের কল্পনায় সৃষ্টিকর্তা সেখানে অধিষ্ঠিত। পুণ্যার্থী মানুষ পবিত্র তীর্থকেই জীবনের পরম লক্ষ্য বলে মনে করেন; তাঁদের ধারণা এখানেই পরম কারুণিক স্রষ্টার সান্নিধ্যলাভ সম্ভব। তীর্থবাসে পুণ্যপ্রত্যাশী মানুষের জীবন চরিতার্থ হয়। পথের প্রান্তে লোকালয় থেকে কোনো দূরতর নির্জনতায় মন্দিরের শুচিশুভ্র প্রাঙ্গণে ভক্তহৃদয় আপ্লুত হয়ে ওঠে। মনে হয়, বুঝি ভক্ত-ভগবানের মিলনের এই হল উপযুক্ত পুণ্যক্ষেত্র।
কিন্তু বস্তুত তা নয়। দেবতার আবাস যে শুধু মন্দিরে বা তীর্থে একথা ঠিক নয়। তিনি সর্বত্র বিরাজমান বলেই পথের দুপাশে যেমন তাঁকে পাওয়া যায়, লোকালয়ের অভ্যন্তরে, কলরব-মুখর সংসারযাত্রায়, সর্বত্রই তিনি বিরাজ করছেন। দুঃখে-সুখে গড়া সাধারণ মানব-সংসারেই ঈশ্বর বহুরূপে বিরাজমান।
মানুষকে যিনি ভালোবাসতে পেরেছেন তাঁর কাছে সমস্ত চরাচরই দেবালয়ে পরিণত হয়েছে। মানুষকে ভালোবেসেই মানব সংসারকে পুণ্যতীর্থক্ষেত্র করে গড়ে তুলতে হবে। পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার আদর্শ ও উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের মধ্যেই নিহিত থাকে। মনুষ্যত্বের গুণে মানুষ নিজের স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে পরার্থে, দীনদুঃখীদের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের সন্ধান খুঁজে পান। প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতা, পরোপকার, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি গুণাবলির মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিরাজমান।

ঈশ্বরকে পেতে হলে প্রথমেই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে, তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই তিনি বিরাজমান, কোনো দেবালয়ে গেলেই যে তাঁর সন্ধান পাওয়া যাবে এমন ধারণা ভ্রান্ত। তবে উপাসনার জন্য যে দেবালয়ে যেতে হবে না এমনও নয়, বস্তুত তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসাই হলো উপাসনা। এই উপাসনা আমরা প্রতি মুহূর্তেই, যে কোনো জায়গায়, যে কোনো স্থানে করতে পারি বলে দেবালয় সেখানে গৌণ। বস্তুত মানুষের সেবাই প্রকৃত উপাসনা। মানুষই শ্রেষ্ঠ দেবালয় ।
আরও দেখুন: