Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

পড়ে পাওয়া । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ পড়ে পাওয়া । যা সাহিত্য কণিকার অন্তর্গত। এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত গদ্য।এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কিশোর গল্প। এটি ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব গ্রন্থ থেকে সংকলিত।

 

 

পড়ে পাওয়া । বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কালবৈশাখীর সময়টা। আমাদের ছেলেবেলার কথা ।

বিধু, সিধু, নিধু, তিনু, বাদল এবং আরও অনেকে দুপুরের বিকট গরমের পর নদীর ঘাটে নাইতে গিয়েছি। বেলা বেশি নেই।

বিধু আমাদের দলের মধ্যে বয়সে বড়। সে হঠাৎ কান খাড়া করে বললে – ঐ শোন –

আমরা কান খাড়া করে শুনবার চেষ্টা করলাম। কিছু শুনতে বা বুঝতে না পেরে বললাম – কী রে?

বিধু আমদের কথার উত্তর দিলে না। তখনো কান খাড়া করে রয়েছে।

হঠাৎ আবার সে বলে উঠল – ঐ ঐ শোন –

আমরও এবার শুনতে পেয়েছি—দূর পশ্চিম-আকাশে ক্ষীণ গুড়গুড় মেঘের আওয়াজ।

নিধু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললে—ও কিছু না—

বিধু ধমক দিয়ে বলে উঠল—কিছু না মানে? তুই সব বুঝিস কিনা? বৈশাখ মাসে পশ্চিম দিকে ওরকম মেঘ ডাকার মানে তুই কিছু জানিস? ঝড় উঠবে। এখন জলে নামব না। কালবৈশাখী।

আমরা সকলে ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি ও কী বলছে। কালবৈশাখীর ঝড় মানেই আম কুড়ানো! বাড়ুয্যেদের মাঠের বাগানে চাঁপাতলীর আম এ অঞ্চলে বিখ্যাত। মিষ্টি কী! এই সময়ে পাকে। ঝড় উঠলে তার তলায় ভিড়ও তেমনি। যে আগে গিয়ে পৌঁছতে পারে তারই জয়। সবাই বললাম— তবে থাক ।

কিন্তু তখনো রোদ গাছপালার মাথার দিব্যি রয়েছে। আমাদের অনেকের মনের সন্দেহ তখনো দূর হয় নি। ঝড়-বৃষ্টির লক্ষণ তো কিছু দেখা যাচ্ছে না; তবে বহু দূরাগত ক্ষীণ মেঘের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওরই ক্ষীণ সূত্র ধরে বোকার মতো চাপাতলীর তলায় যাওয়া কি ঠিক হবে?

বিধু আমাদের সকল সংশয় দূর করে দিলে। যেমন সে চিরকাল আমাদের সকল সংশয় দূর করে এসেছে। সে জানিয়ে দিলে যে, সে নিজে এখুনি চাঁপাতলীর আমতলায় যাচ্ছে, যার ইচ্ছে হবে সে ওর সঙ্গে যেতে পারে।

এরপর আর আমাদের সন্দেহ রইল না। আমরা সবাই ওর সঙ্গে চললাম ।

অল্পক্ষণ পরেই প্রমাণ হলো, ও আমাদের চেয়ে কত বিজ্ঞ। ভীষণ ঝড় উঠল, কালো মেঘের রাশি উড়ে আসতে লাগল পশ্চিম থেকে । বড় বড় গাছের মাথা ঝড়ের বেগে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল, ধুলোতে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল, একটু পরেই ঠান্ডা হাওয়া বইল, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে পড়তে বড় বড় করে ভীষণ বাদলের বর্ষা নামল ।

বড় বড় আমবাগানের তলাগুলি ততক্ষণে ছেলেমেয়েতে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। আম ঝরছে শিলাবৃষ্টির মতো; প্রত্যেক ছেলের হাতে এক এক বোঝা আম। আমরাও যথেষ্ট আম কুড়ুলাম, আমের ভারে নুয়ে পড়লাম এক একজন। ভিজতে ভিজতে কেউ অন্য তলায় চলে গেল, কেউ বাড়ি চলে গেল আমের বোঝা নামিয়ে রেখে আসতে। আমি আর বাদল সন্ধ্যার অন্ধকারে নদীর ধারের পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছি। পথে কেউ কোথাও নেই, ছোট-বড় ডালপালা পড়ে পথ ঢেকে গিয়েছে; পাকা নোনাসুদ্ধ নোনাগাছের ডাল কোথা থেকে উড়ে এসে পড়েছে, কাঁটাওয়ালা সাঁইবাবলার ডালে পথ ভর্তি, কাঁটা ফুটবার ভয়ে আমরা ডিঙিয়ে পথ চলছি আধ-অন্ধকারের মধ্যে ।

এমন সময় বাদল কী একটা পায়ে বেধে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আমায় বললে— দ্যাখ তো রে জিনিসটা কী?

আমি হাতে তুলে দেখলাম একটি টিনের বাক্স, চাবি বন্ধ। এ ধরনের টিনের বাক্সকে পাড়াগাঁ অঞ্চলে বলে, ডবল টিনের ক্যাশ বাক্স। টাকাকড়ি রাখে পাড়াগাঁয়ে। এ আমরা জানি ।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বাদল হঠাৎ বড় উত্তেজিত হয়ে পড়ল। বললে—দেখি জিনিসটা?

– দ্যাখ তো, চিনিস?

– চিনি, ডবল টিনের ক্যাশ বাক্স ।

— টাকাকড়ি থাকে।

তাও জানি ।

এখন কী করবি?

– সোনার গহনাও থাকতে পারে। ভারী দেখেছিস কেমন?

তা তো থাকেই। টাকা গহনা আছেই এতে।

টিনের ক্যাশ বাক্স হাতে আমরা দুজনে সেই অন্ধকারে তেঁতুলতলায় বসে পড়লাম। দুজনে এখন কী করা যায় তাই ঠিক করতে হবে এখানে বসে। আম যে প্রিয় বস্তু, এত কষ্ট করে জল ঝড় অগ্রাহ্য করে যা কুড়িয়ে এনেছি, তাও একপাশে অনাদৃত অবস্থায় পড়েই রইল, থলেতে বা দড়ির বোনা গেঁজেতে।
বাদল বললে—কেউ জানে না যে আমরা পেয়েছি—

– তা তো বটেই। কে জানবে আর ।

– এখন কী করা যায় বল ।

– বাক্স তো তালাবন্ধ

– এখুনি ইট দিয়ে ভাঙি যদি বলিস তো—ওঃ না জানি কত কী আছে রে এর মধ্যে। তুই আর আমি দুজনে – নেব, আর কেউ না। খুব সন্দেশ খাব ।

ঝড়ের ঝাপটা আবার এলো। আমরা তেঁতুলগাছের গুঁড়িটার আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। তেঁতুলগাছে ভূত আছে সবাই জানে। কিন্তু ভূতের ভয় আমাদের মন থেকে চলে গিয়েছে। অন্য দিনে আমাদের দুজনের সাধ্য ছিল না এ সময় এ গাছতলায় বসে থাকি ।
বাদল বলল—শীতে কেঁপে মরছি। কী করা যাবে বল। বাড়ি কিন্তু নিয়ে যাওয়া হবে না। তাহলে সবাইকে ভাগ দিতে হবে, সবাই জেনে যাবে। কী করবি?

– আমার মাথায় কিছু আসছে না রে।

– ভাঙি তালা। ইট নিয়ে আসি, তুই থাক এখানে।

না। তালা ভাঙিসনে। ভাঙলেই তো গেল। অন্যায় কাজ হয় তালা ভাঙলে, ভেবে দ্যাখ। কোনো গরিব লোকের হয়তো। আজ তার কী কষ্ট হচ্ছে, রাতে ঘুম হচ্ছে না। তাকে ফিরিয়ে দেব বাক্সটা।

বাদল ভেবে বললে—ফেরত দিবি?

দেব ভাবছি।

– কী করে জানবি কার বাক্স?

— চল, সে মতলব বার করতে হবে। অধর্ম করা হবে না।

এক মুহূর্তে দুজনের মনই বদলে গেল। দুজনেই হঠাৎ ধার্মিক হয়ে উঠলাম। বাক্স ফেরত দেয়ার কথা মনে আসতেই আমাদের অদ্ভুত পরিবর্তন হলো। বাক্স নিয়ে জল ঝড়ে ভিজে সন্ধ্যার পর অন্ধকারে বাড়ি চলে এলাম। বাদলদের বাড়ির বিচুলিগাদায় লুকিয়ে রাখা হলো বাক্সটা।

তারপর আমাদের দলের এক গুপ্ত মিটিং বসল বাদলদের ভাঙা নাটমন্দিরের কোণে। বর্ষার দিন—আকাশ মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম। সেই কালবৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টির পরই বাদলা নেমে গিয়েছে। একটা চাঁপাগাছের ফোটা চাঁপাফুল থেকে বর্ষার হাওয়ার সঙ্গে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। ব্যাঙ ডাকছে নরহরি বোষ্টমের ডোবায় । আমাদের দলের সর্দার বিধুর নির্দেশমতো এ মিটিং বসেছিল। বাক্স ফেরত দিতেই হবে— এ আমাদের প্রথম ও শেষ প্রস্তাব।

মিটিং-এ সে প্রস্তাব পেশ করার আগেই মনে মনে আমরা সবাই সেটি মেনেই নিয়েছিলাম। বিধুকে বলা হলো বাক্স ফেরত দেয়া সম্বন্ধে আমরা সকলেই একমত, অতএব এখন উপায় ঠাওরাতে হবে বাক্সের মালিককে খুঁজে বের করার। কারও মাথায় কিছু আসে না। এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হলো। যে কেউ এসে বলতে পারে বাক্স আমার। কী করে আমরা প্রকৃত মালিককে খুঁজে বার করব? মস্ত বড় কথা। কোনো মীমাংসাই হয় না ।

অবশেষে বিধু ভেবে ভেবে বললে—মতলব বার করিছি। ঘুড়ির মাপে কাগজ কেটে নিয়ে আয় দিকি । বলেছি—বিধুর হুকুম অমান্য করার সাধ্য আমাদের নেই। দু-তিনখানা কাগজ ঐ মাপে কেটে ওর সামনে হাজির করা হলো।

বিধু বললে—লেখ—বাদল লিখুক। ওর হাতের লেখা ভালো ।

বাদল বলল—কী লিখব বলো

লেখ বড় বড় করে। বড় হাতের লেখার মতো। বুঝলি? আমি বলে দিচ্ছি—

– বলো

– আমরা একটা বাক্স কুড়িয়ে পেয়েছি। যার বাক্স তিনি রায়বাড়িতে খোঁজ করুন । ইতি – বিধু, সিধু, নিধু, তিনু । আমি আর বাদল আপত্তি করে বললাম—বারে, আমরা কুড়িয়ে পেলাম, আর আমাদের নাম থাকবে না বুঝি ?

আমাদের ভালো নাম লেখ ।

বিধু বললে—লিখে দাও । ভালোই তো। ভালো নাম সবারই লেখ ।

তিনখানা কাগজ লিখে নদীর ধারের রাস্তায় ভিন্ন ভিন্ন গাছে বেলের আঠা দিয়ে মেরে দেওয়া হলো।

দু-তিন দিন কেটে গেল ।

কেউ এল না ।

 

 

তিন দিন পরে একজন কালোমতো রোগা লোক আমাদের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে এসে দাঁড়াল। আমি তখন সেখানে বসে পড়ছি।

বললাম—কী চাও?

বাবু, ইদিরভীষণ কার নাম?

আমার নাম। কেন? কী চাই?

– একটা বাক্স আপনারা কুড়িয়ে পেয়েছেন?

আমার নামের বিকৃত উচ্চারণ করাতে আমি চটে গিয়েছি তখন। বিরক্তিভাবে বললাম—কী রকম বাক্স?

কাঠের বাক্স ।

– না। যাও ।

বাবু, , কাঠের নয়, টিনের বাক্স।

কী রঙের টিন?

কালো ।

– না। যাও— –

– বাবু দাঁড়ান, বলছি। মোর ঠিক মনে হচ্ছে না। এই রাঙা মতো—

– না, তুমি যাও ।

লোকটা অপ্রতিভভাবে চলে গেল। বিধুকে খবরটা দিতে সে বললে—ওর নয় রে। লোভে পড়ে এসেছে। ওর মতো কত লোক আসবে ।

আবার তিন-চার দিন কেটে গেল ।

বিধুর কাছে একজন লোক এলো তারপরে । তারও বর্ণনা মিলল না; বিধু তাকে বিদায় দিলে পত্রপাঠ। যাবার সময় সে নাকি শাসিয়ে গেল, চৌকিদারকে বলবে, দেখে নেবে আমাদের ইত্যাদি। বিধু তাচ্ছিল্যের সুরে বললে— যাও যাও, যা পার করো গিয়ে। বাক্স আমরা কুড়িয়ে পাইনি। যাও।

আর কোনো লোক আসে না ।

বর্ষা পড়ে গেল ভীষণ ।

সেবার আমাদের নদীতে এলো ভীষণ বন্যা ।

বড় বড় গাছ ভেসে যেতে দেখা গেল নদীর স্রোতে। দু-একটা গরুও আমরা দেখলাম ভেসে যেতে। অম্বরপুর চরের কাপালিরা নিরাশ্রয় হয়ে গেল। নদীর চরে ওদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি সেবারেও দেখে এসেছি—কী চমৎকার পটলের আবাদ, কুমড়োর খেত, লাউ-কুমড়োর মাচা ওদের চরে! দু পয়সা আয়ও পেত তরকারি বেচে। কোথায় রইল তাদের পটল কুমড়োর আবাদ, কোথায় গেল তাদের বাড়িঘর। আমাদের ঘাটের সামনে দিয়ে কত খড়ের চালাঘর ভেসে যেতে দেখলাম।

সবাই বলতে লাগল অম্বরপুর চরের কাপালিরা সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে। একদিন বিকেলে আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে একটা লোক এলো। বাবা বসে হাত-বাক্স সামনে নিয়ে জমাজমির হিসেব দেখছেন। গ্রামের ভাদুই কুমোর কুয়ো কাটানোর মজুরি চাইতে এসেছে । আরও দু-একজন প্রজা এসেছে খাজনা পত্তর দিতে। আমরা দু ভাই বাবার কড়া শাসনে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছি । এমন সময় একটা লোক এসে বললে- দণ্ডবৎ হই, ঠাকুরমশায়।

বাবা বললেন—এসো। কল্যাণ হোক । কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

– আজ্ঞে অম্বরপুর থেকে। আমরা কাপালি।

– বোসো। কী মনে করে? তামাক খাও। সাজো।

লোকটা তামাক সেজে খেতে লাগল। সে এসেছে এ গাঁয়ে চাকরির খোঁজে। বন্যায় নিরাশ্রয় হয়ে নির্বিষখোলার গোয়ালাদের চালাঘরে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছে। এই বর্ষায় না আছে কাপড়, না আছে ভাত। দু আড়ি ধান ধার দিয়েছিল গোয়ালারা দয়া করে, সেও এবার ফুরিয়ে এলো। চাকরি না করলে স্ত্রী- পুত্র না খেয়ে মরবে।

বাবা বললেন—আজ এখানে দুটি ডাল-ভাত খেও।

লোকটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—তা খাব। খাচ্ছিই তো আপনাদের। দুরবস্থা যখন শুরু হয় ঠাকুরমশাই, এই গত জষ্টি মাসে নির্বিষখোলার হাট থেকে পটল বেচে ফিরছি; ছোট মেয়েটার বিয়ে দেব বলে গহনা গড়িয়ে আনছিলাম । প্রায় আড়াই শো টাকার গহনা আর পটল-বেচা নগদ টাকা পঞ্চাশটি – একটা টিনের বাক্সের ভেতর ছিল। সেটা যে হাটের থেকে ফিরবার পথে গরুর গাড়ি থেকে কোথায় পড়ে গেল, তার আর খোঁজই হলো না। সেই হলো শুরু—আর তারপর এলো এই বন্যে-

বাবা বললেন—বল কী? অতগুলো টাকা-গহনা হারালে ?

—অদেষ্ট, একেই বলে বাবু অদেষ্ট। আজ সেগুলো হাতে থাকলে—

আমি কান খাড়া করে শুনছিলাম। বলে উঠলাম—কী রঙের বাক্স?

সবুজ টিনের।

বাবা আমাদের বাক্সের ব্যাপার কিছুই জানেন না। আমায় ধমক দিলেন— তুমি পড়ো না, তোমার সে খোঁজে কী দরকার? কিন্তু আমি ততক্ষণে বইপত্তর ফেলে উঠে পড়েছি। একেবারে এক ছুটে বিধুর বাড়ি গিয়ে হাজির। বিধু আমার কথা শুনে বললে—দাঁড়া, সিধু আর তিনুকেও নিয়ে আসি। ওরা সাক্ষী থাকবে কি না ?

বিধুর খুব বুদ্ধি আমাদের মধ্যে। ও বড় হলে উকিল হবে, সবাই বলত।

আধঘণ্টার মধ্যে আমাদের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বেশ একটি ছোটখাটো ভিড় জমে গেল। বাক্স ফেরত পেয়ে সে লোকটা যেন কেমন হকচকিয়ে গেল। চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। কেবল আমাদের মুখের দিকে চায় আর বলে— ঠাকুরমশাই, আপনারা মানুষ না দেবতা? গরিবের ওপর এত দয়া আপনাদের?

বিধু অত সহজে ভুলবার পাত্র নয়। সে বললে—দেখে নাও মাল সব ঠিক আছে কি না আর এই কাকাবাবুর সামনে আমাদের একটা রসিদ লিখে দাও, বুঝলে? কাকাবাবু আপনি একটু কাগজ দিন না ওকে–লিখতে জান তো?

না, ও উকিলই হবে বটে!

আমার বাবা এমন অবাক হয়ে গেলেন ব্যাপার দেখে যে, তাঁর মুখ দিয়ে একটি কথাও বেরুল না ।

 

 

শব্দার্থ ও টীকা

দিব্যি – চমৎকার। আশাতীতভাবে ।

সংশয় – সন্দেহ। দ্বিধা ।

গহনা – অলংকার।

অনাদৃত – অবহেলিত। উপেক্ষিত। গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এমন ।

বিচুলি গাদা – ধানের খড়ের স্তূপ।

নাটমন্দির – দেবমন্দিরে সামনের ঘর যেখানে নাচ-গান হয় ।

বোষ্টম – হরিনাম সংকীর্তন করে জীবিকা অর্জন করে এমন বৈষ্ণব।

অপ্রতিভভাবে – বিব্রত বা লজ্জিতভাবে।

পত্রপাঠ বিদায় – তৎক্ষণাৎ বিদায়।

চৌকিদার – প্রহরী।

কাপালি – তান্ত্রিক হিন্দু সম্প্রদায় ।

চণ্ডীমণ্ডপ – যে মণ্ডপে বা ছাদযুক্ত চত্বরে দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেবীর পূজা হয় ।

দণ্ডবৎ‍ – মাটিতে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম ।

আড়ি – ধান, গম ইত্যাদির পরিমাপবিশেষ। ধান মাপার বেতের ঝুড়ি বা পাত্ৰ ।

পাঠের উদ্দেশ্য

এই গল্প পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে কর্তব্যপরায়ণতা ও নৈতিক চেতনার সৃষ্টি হবে। একইসঙ্গে নিজের জীবনেও এর প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবে ।

পাঠ-পরিচিতি

এটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত কিশোর গল্প। এটি ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব গ্রন্থ থেকে সংকলিত। এ গল্পের কিশোররা কুড়িয়ে পাওয়া অর্থ সম্পদ নিয়ে লোভের পরিচয় দেয়নি। বরং তারা তাদের বয়সের চেয়েও অনেক বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। লেখক দেখিয়েছেন, বয়সে ছোট হলে কী হবে তাদের নৈতিক অবস্থানও বেশ দৃঢ়।

এই গল্পে কিশোরদের ঐক্য চেতনার যেমন পরিচয় পাওয়া যায় তেমনি তাদের উন্নত মানবিক বোধেরও প্রকাশ ঘটেছে। তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তার পাশাপাশি তীক্ষ্ণ বিবেচনাবোধও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিশোরদের এমন সততা, নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধে বয়োজ্যেষ্ঠরাও বিস্মিত, অভিভূত। কিশোররা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন তারা তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ও বিবেচক তাকে মান্য করে তার ওপর আস্থা স্থাপন করে। এটি গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। দরিদ্র অসহায় মানুষের প্রতি ভালোবাসার চিত্রও ফুটে উঠেছে এ গল্পে।

লেখক-পরিচিতি

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে চব্বিশ পরগনা জেলার মুরাতিপুর গ্রামে, মাতুলালয়ে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুর গ্রামে। তাঁর বাল্য ও কৈশোরকাল কেটেছে দারিদ্র্যের মধ্যে। মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেশা ছিল কথকতা ও পৌরোহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়াকালে (১৯১৮) তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু ঘটলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অসমাপ্ত থাকে।

অতঃপর স্কুল শিক্ষকতাসহ নানা পেশায় তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়। এর বাইশ বছর পরে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন (১৯৪০)। ছোটগল্প, উপন্যাস, দিনলিপি ও ভ্রমণ- কাহিনি রচনার মধ্যেই তিনি জীবনের আনন্দ খুঁজে পান। তাঁর রচিত সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানবজীবন এক অখণ্ড অবিচ্ছিন্ন সত্তায় সমন্বিত হয়েছে। তাঁর সাহিত্যে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য ও গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচরণের সজীব ও নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ উপন্যাস যেমন তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি তেমনি বাংলা সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ।

তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘আরণ্যক’, ‘ইছামতী’; গল্পগ্রন্থ : ‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরীফুল’; ভ্রমণ-দিনলিপি : ‘তৃণাঙ্কুর’, ‘স্মৃতির রেখা’; কিশোর উপন্যাস : ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘মিসমিদের কবচ’, ‘হীরামানিক জ্বলে’। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

 

 

কর্ম-অনুশীলন

ক. ভালো কাজ করলে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার পক্ষে তোমার অনুভূতি ব্যক্ত কর (একক কাজ)।

খ. ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পের চরিত্রগুলো অবলম্বন করে একটি নাটিকা উপস্থাপন কর (দলগত কাজ) ।

নমুনা প্রশ্ন

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

১. কাদের বাগানে আম কুড়াতে কালবৈশাখী উপেক্ষা করে সবাই ছুটছিল?

ক. চাটুয্যেদের

খ. মুখুয্যেদের

গ. বাড়ুয্যেদের

ঘ. গাঙ্গুলিদের

২. চাঁপাতলীর আমের ব্যাপারে এত আগ্রহের কারণ তা-

i. প্রচুর পাওয়া যায়।

ii. খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু

iii. নির্বিঘ্নে কুড়ানো যায়

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i

খ. ii

গ. iii

ঘ. iii

৩. লেখকের চমৎকার অর্থে ব্যবহৃত ‘দিব্যি’ শব্দটি আমরা আর কোন অর্থে ব্যবহার করে থাকি ?

ক. শপথ

খ. বিশ্বাস

গ. সংশয়

ঘ. অনবরত

নিচের উদ্দীপকের আলোকে ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :

স্কুলের ঝাড়ুদার শচী। পরীক্ষা শেষে কক্ষ পরিষ্কার করতে গিয়ে সে একটি মূল্যবান ঘড়ি পেল। তার লোভ হলো। ভাবল, ঘড়িটা মেয়ের জামাইকে উপহার দেবে। মেয়ে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। কিন্তু রাতে ঘুমুতে গিয়ে মনে হলো—এ অন্যায়, অনুচিত। যার ঘড়ি তার মনঃকষ্টের কারণে মেয়ের চরম অকল্যাণ হতে পারে। ঘড়িটা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া তার কর্তব্য। সে পরদিন তা-ই করল।

8. শচী ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পের কোন চরিত্রের প্রতিভূ ?

ক. বাদল

খ. বিধু

গ. কথক

ঘ. সিধু

৫. উল্লিখিত তুলনাটা কোন মানদণ্ডে বিচার্য ? উভয়েই—

i. ন্যায় ও কর্তব্যবোধে উদ্বুদ্ধ

ii. লোকলজ্জার ভয়ে ভীত

iii. অকল্যাণ চিন্তায় তাড়িত

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i

খ. ii

গ. i ও ii

ঘ. ii ও iii

 

 

সৃজনশীল প্রশ্ন

১. আরিফ টেক্সি ক্যাব চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। একবার একজন আরোহীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে সে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সহসা গাড়ির ভিতরে দৃষ্টি পড়তে সে দেখতে পেল একটি মানিব্যাগ সিটের ওপর পড়ে আছে। ব্যাগে অনেকগুলো ডলার। কিন্তু ব্যাগে কেনো ঠিকানা পাওয়া গেল না। সে সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করল। নিরুপায় হয়ে সে পত্রিকা অফিসে গিয়ে সম্পাদককে একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে দেবার অনুরোধ জানায়।

ক. ‘পড়ে পাওয়া’ কী ধরনের রচনা ?

খ. ‘ওর মতো কত লোক আসবে’–বিধুর এ কথাটির অর্থ বুঝিয়ে লেখ ।

গ. উদ্দীপকের আরিফকে কোন যুক্তিতে বিধুদের সঙ্গে তুলনা করা যায় ? – বুঝিয়ে লেখ ৷

ঘ. কলেবরে ক্ষুদ্র হলেও আরিফ চরিত্রটি ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পের মূল সুরকেই ধারণ করে আছে।—মূল্যায়ন কর।

২. সন্ধ্যায় দেখা গেল, নিজেদের ছাগলের সাথে অতিরিক্ত একটি ছাগলও আথালে ঢুকছে। এশার নামাজ পার হয়ে গেল, কিন্তু কেউ খোঁজ নিতে এল না। দাদু বললেন, না, না, চুপ করে থাকা ঠিক হবে না। এক কাজ কর, রফিক-শফিক বেরিয়ে পড়। প্রতিবেশী নাবিল আর তালিমকে সাথে নিয়ে দুজন দুদিকে যেও। মসজিদ থেকে চোঙ্গা নিয়ে গাঁয়ে ঘোষণা দিয়ে আস। কিছুক্ষণের মধ্যে দু-ভাই দাদুর পরামর্শ মতো বলতে লাগল, ভাইসব, একটি ছাগল পাওয়া গেছে। যাদের ছাগল তারা দয়া করে মতিন শিকদারের বাড়ি থেকে নিয়ে যান ।

ক. লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোন ধরনের লেখক হিসেবে সমধিক পরিচিত ?

খ. — দুজনই হঠাৎ ধার্মিক হয়ে উঠলাম।’ কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে ?

গ. রফিক-শফিকের চোঙ্গা ফোঁকার ঘটনাটি ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পের কোন ঘটনার সাথে সংগতিপূর্ণ ? ব্যাখ্যা কর।

ঘ. উদ্দীপকের দাদু যেন ‘পড়ে পাওয়া’ গল্পের মূল চেতনারই প্রতিভূ। বিশ্লেষণ কর ।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version