নৈতিক মূল্যবোধ রচনার একটা নমুনা তৈরি করবো আজ। এই রচনাটি আমাদের “নীতি চরিত্র মূল্যবোধ” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।
Table of Contents
নৈতিক মূল্যবোধ রচনা
ভূমিকা :
নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণবিধি, যা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতিকে করে তোলে সুন্দর, নির্মল ও রুচিস্নিগ্ধ। এর সাথে জড়িত আছে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠ, শ্রম, উত্তম চরিত্র, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়া ইত্যাদি বিশেষ কতগুলো গুণ।
নৈতিক মূল্যবোধ মানবচরিত্রকে করে তোলে সুষমামণ্ডিত। তাই মানুষের আত্মিক সামাজিক উৎকর্ষের জন্য এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই কারণে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধের উৎসারণ এবং তার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা ।
নৈতিকতার সংজ্ঞা :
ইংরেজি ‘Ethics’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো নীতিশাস্ত্র বা নীতিবিদ্যা এটি রীতিনীতি বা অভ্যাস সংক্রান্ত জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে। মানবের রীতি, বিশ্বাস, ও আচার-আচরণের কোনটি ভালো কোনটি মন্দ তা নীতিশাস্ত্র নির্ধারণ করে। তাই মানুষের নৈতিকতার স্বরূপ কি হওয়া উচিত নীতিশাস্ত্র তা নির্ধারণ ও বর্ণনা করে। উইলিয়াম লিলি বলেন, দৈনন্দিন কথাবার্তায় ‘ভালো’, ‘ঠিক’, ‘উচিত’ প্রভৃতি যেসব শব্দ অহরহ ব্যবহৃত হয়ে থাকে তার যথার্থ অর্থ কী এ জাতীয় প্রশ্ন নিয়েই নীতিবিদ্যা আলোচনা করে’।
সাধারণভাবে বলতে গেলে যে সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণ করে মানুষ তার দৈনন্দিন ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে নৈতিকতা বলে। এটি ন্যায়নীতি, ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনগত অনুশাসন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। নৈতিকতা মানুষের রীতিনীতি, আচার-আচরণ, কার্যক্রম ইত্যাদির মধ্যে কোনটি ভালো এবং কোনটি মন্দ তা নির্ধারণ করে। নৈতিকতার কারণেই আমাদের মনে মন্দ কাজ না করে ভালো কাজ করার তাগিদ দেখা দেয়। অধ্যাপক নিউনার ও কিলিং-এর মতে, ‘Ethics is the systematic act of that part of science and philosophy which deals with normal conduct. duty and judgment অর্থাৎ নৈতিকতা হচ্ছে বিজ্ঞান ও দর্শনের ঐ সকল কাজ যা মানুষের নৈতিক আচরণ, কর্তব্য এবং বিচার বিবেচনা নিয়ে বিশ্লেষণ করে।
নৈতিকতা সম্পর্কে এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, নৈতিকতা হচ্ছে দর্শনের এমন একটি শাখা যার মাধ্যমে মানুষ নির্দিষ্ট নৈতিক কার্যক্রম বা আচরণের সূত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেষ্ট হয় । মোটকথা দৈনন্দিন ও সামাজিক কার্যক্রমগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে মানুষ যে ন্যায় নীতি; সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগত অনুশাসন অনুসরণ করে তাকেই নৈতিকতা বলে। এটি মানুষের একটি অন্যতম আদর্শ বা মানবীয় গুণ হিসেবে বিবেচিত হয় নৈতিকতা মানুষকে সৎ ও ন্যায়ের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে এবং মানুষের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে।
মূল্যবোধের ধারণা :
মূল্যবোধ হচ্ছে একটি প্রত্যয়। এই প্রত্যয় সমাজের সদস্যদের আচরণগত ধারণাকে নিয়ন্ত্রিত করে, সামাজিক শৃঙ্খলা, অখণ্ডতা ও সংহতি বজায় রেখে উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে । এই প্রত্যয়ের উপাদান হচ্ছে নীতি, মান ও বিশ্বাস। এসব উপাদান স্পষ্ট করে দেয় ব্যক্তি, সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান; ভালোমন্দ, দোষগুণ, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা বিচার করে এবং নৈতিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে কাজের দিক নির্দেশনা। মূল্যবোধ শুধু পর্যবেক্ষণ বা সত্যের উক্তি নয়, এটি হচ্ছে অকৃত্রিম ও আপসহীন নীতি যা সৈনদ্দিন আচরণে প্রতিফলিত হয়। সামাজিক আচরণের দিক দিয়ে কামা মূল্যবোধ হচ্ছে সুনাগরিকতা, দলগত বিশ্বস্ততা, সহযোগিতা, স্বার্থত্যাগ, দেশপ্রেম ইত্যাদি।
ব্যক্তির নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবনের দিক দিয়েও ব্যক্তিগত মূল্যবোধ আহরণ করা প্রয়োজন। সত্যবাদিতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, বন্ধুত্ব, কর্তব্যপরায়ণতা। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ব্যক্তির জীবনকে উন্নতমানে নিয়ে যায়। কোনো সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি ধারণাগুলোর মুখ্য ও বৃহৎ অংশ হচ্ছে মূল্যবোধের সংগঠন। সামাজিক বিভিন্ন আচরণের ওপর ভিত্তি করে নানা স্তরের মূল্যবোধ তৈরি হয়। সমাজতত্ত্ব ও শিক্ষাতত্ত্বের দিক দিয়ে শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ আহরণ গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার ও বিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে সমাজ অনুমোদিত মূল্যবোধ কাঠামো আহরণ ও আয়ত্ত করতে সহায়তা করে।
নৈতিক মূল্যবোধের স্বরূপ ও গুরুত্ব :
নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের জীবনে অনুসরণযোগ্য এমন কিছু আচরণ বিধি, যা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতিকে করে তোলে সুন্দর, নির্মল ও রুচিস্নিগ্ধ। নৈতিকতা মানুষকে অন্যায়ের পতন, বন্ধুর পথের বিপদ থেকে বাঁচায়। স্বার্থপরতার প্রলুব্ধকর আকর্ষণ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আত্মত্যাগের মহামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষকে দেয় প্রবল ও দৃঢ় মানসিক শক্তি, যার বলে মানুষ যাবতীয় দুর্নীতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে শেখে, অন্যায় ও অবৈধ পন্থা অবলম্বন সচেতনভাবে পরিহার করতে শেখে।
নৈতিক মূল্যবোধ মানবচরিত্রকে করে তোলে সুষমামণ্ডিত। ধর্মের কল্যাণধর্মী মর্মবাণী অনুসরণ করা, মিথ্যাকে কায়মনোবাক্যে পরিহার করা, সত্য ও ন্যায়ের আদর্শে পরিচালিত হওয়া, সজ্ঞানে অন্যের ক্ষতি না করা, পরহিতব্রতে যথাসম্ভব নিজেকে সমর্পণ করা—এসবের মাধ্যমেই মানুষের জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটে।
নৈতিক মূল্যবোধে আলোকিত মানুষ সমাজে যতই বাড়ে ততই সমাজজীবন হয়ে ওঠে নিষ্কলুষ ও সৌন্দর্যবিভামণ্ডিত। তাই মানুষের আত্মিক সামাজিক উৎকর্ষের জন্য এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এ কারণে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্যই হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধের উৎসারণ এবং তার মাধ্যমে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা ।
নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় :
দুঃখের বিষয় মানবসভ্যতা যখন একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে তখন মানুষ মূল্যবোধের সংকটে পীড়িত। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য-লালসা ও পরিভোগ- প্রবণতা মানুষকে লোভী ও স্বার্থানেষী করে তুলছে। মানবধ্বংসী মারণাস্ত্রের বিস্তার বিজ্ঞানের অনৈতিক ব্যবহারেরই মারাত্মক ফল। দুনিয়াজোড়া মাদক ব্যবসায়, গণমাধ্যম করায়ত্ত করে স্কুল ভোগবাদী অপসংস্কৃতির প্রচারণা, হলুদ সাংবাদিকতা ইত্যাদি নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ ।
আমাদের দেশেও নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবক্ষয়ের লক্ষণ আজ প্রকট। সীমাহীন দুর্নীতি সর্বস্তরে গ্রাস করেছে সমাজজীবনকে। নীতিহীন, বিবেকহীন মানুষ সদম্ভে সমাজে বিচরণ করছে এবং ন্যায়নীতির কণ্ঠরোধ করার জন্য তারা উঠে-পড়ে লেগেছে। অন্যায় ও অবৈধ পন্থায় বিত্তের পাহাড় গড়ছে লুটেরা ধনীরা। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। এখন সমাজে অবৈধ পন্থায় ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ, প্রতিপত্তি, ভোট আদায়ের এক অনভিপ্রেত অস্থির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
এর জন্য বল প্রয়োগও হয়ে গেছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ফলে নৈতিক অবক্ষয় সংক্রামক ভাইরাসের মতো সমাজজীবনের সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। এমন কি শিক্ষাঙ্গনে, চিকিৎসাসেবায়, বিচারব্যবস্থায় পর্যন্ত দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্র ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ঘটেছে ব্যাপক বিস্তার। মূল্যবোধের এ অবক্ষয়া এখন বিবেকবান সব লোককেই গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
মূল্যবোধের অবক্ষয় ও এর কারণসমূহ :
দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে স্বাধীনতা-উত্তরকালে একাধিক কারণে বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধের পূর্ণ অবক্ষয় ঘটেছে –এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় । সাম্প্রতিককালে এর ক্রমবর্ধমান ব্যাপকতা জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারাকে ব্যাহত করছে। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী মহল সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রকৃত কারণ উদঘাটনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। নিচে তাদের মতবাদের আলোকে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. দারিদ্র্য:
দারিদ্র্যের দিক থেকে শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী বিশ্বের ১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট ২০০৫-এ ১৭৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯তম। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৫৭% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ফলে জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে এবং পরিবারের ভরণ-পোষণ যোগাতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সমাজবিরোধী কাজকর্ম করতেও দ্বিধাবোধ করে না ।
২. জনসংখ্যার আধিক্য :
১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯৬০ জন লোক বাস করে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম এবং এশিয়ার পঞ্চম জনাধিক্য দেশ। মাথাপিছু জমির পরিমাণ মাত্র ০.২৫ একর। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়েও এ দেশ ততটা সমৃদ্ধ নয়। তাই সীমিত আয়তন ও সম্পদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ মানুষের মৌল চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে কর্মসংস্থান ও সুযোগের অভাবে মানুষ বিকল্প রাস্তা হিসেবে অন্ধকার জগতে পা বাড়ায় তথা অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে।
৩. বেকারত্ব :
দেশে প্রায় আড়াই কোটি লোক বেকারত্বের বোঝা বহন করে চলেছে। বেকারত্ব গোটা জাতিকে এক মহা সংকটে ফেলেছে। কর্মক্ষম মানুষ কর্মের অভাবে নিশ্চুপ বসে থাকতে থাকতে জীবিকার তাগিদে যে কোনো কাজের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। বিশেষ করে পরিবারের প্রতি অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে চোরাচালান, রাহাজানি, ছিনতাই, মাদকদ্রব্যের ব্যবস ইত্যাদি গর্হিত কাজ করে থাকে। এ অন্ধকার জগতে এসে অল্প পরিশ্রমে বেশি মুনাফা দেখে ধীরে ধীরে আসক্তির পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং পরবর্তীতে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কেউ ঐ রাস্তা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। এভাবেই বাড়তে থাকে মূল্যবোধের অবক্ষয়।
৪. মাদকাসক্তি :
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাস শব্দ দুটো সমার্থকরূপে বিবেচিত হয়। দেখা যায়, যে মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে সে কমবেশি সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি করে । মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তাকে ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির আশ্রয় নিতে হয়, আর এভাবেই কলুষিত হচ্ছে আজকের সমাজ।
৫. অশিক্ষা :
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষিত তথা মূর্খ। মূর্খরা উন্নত জীবন ও জগতের প্রতি সাধারণত উদাসীন, এদের মধ্যে পশুবৃত্তির প্রবণতাটাই বেশি পরিমাণে প্রকট। তাই সমাজবিরোধী কার্যকলাপ করতে এদের বিবেকে বাঁধে না। এ কারণে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য অশিক্ষাকেই প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয় ।
৬. রাজনৈতিক কারণ:
স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষত ‘৭৫-এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাজনীতি ক্রমান্বয়ে পেশীশক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার পরিবর্তে পেশীশক্তি দ্বারা ঘায়েল করার এক আত্মমাতী প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজকের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। আর এ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কিছু বিপথগামী তরুণ- যুবক । এরা জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রশ্রয় ও আনুকূল্য পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে সমাজ জীবন এদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জনো দুর্বল রাজনৈতিক অঙ্গীকার দায়ী বলে সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত ব্যক্ত করেন।
![নৈতিক মূল্যবোধ রচনা [ ২৫০০ শব্দ ] 3 আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2023/01/google-news-300x225.jpg)
৭. অসম বণ্টন ব্যবস্থা :
বাংলাদেশে সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। এ দেশের মুষ্টিমেয় লোকের কাছে বিশাল সম্পত্তি ও টাকা-পয়সা জমা রয়েছে এবং এর ফলে সমাজের অধিকাংশ লোক সহায়-সম্পদহীন। এক হিসাবে দেখা গেছে, এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগ সম্পদ ১০ ভাগ লোক ভোগ করছে এবং মাত্র ১০ ভাগ সম্পদ ভোগ করছে ৯০ ভাগ লোক। যেহেতু আমাদের সম্পদ সীমিত, কাজেই একজন বেশি ভোগ করলে স্বভাবতই আরেকজনের ভাগে কম পড়বে।
একদিকে সীমিত সংখ্যক শিশু প্রচুর সম্পদ আর প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হচ্ছে, অপরদিকে অধিকাংশ শিশু বেড়ে উঠছে চরম দারিদ্র্য আর অবহেলার মধ্যে। এতে উভয়ের মধ্যেই অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। প্রাচুর্যের আধিক্যে লালিত সন্তান সম্পদের অহংকার ও টাকার গরমে যেমন অসামাজিক কার্যকলাপ তথা মদ, গাঁজা, হেরোইন ও কোকেন সেবন করে, তেমনি অভাব আর তাচ্ছিল্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তান সন্ত্রাস, মাস্তানি, চাঁদাবাজি আর রাহাজানিতে সুদক্ষ হয়ে ওঠে।
৮. সামাজিক কারণ :
কিছু কিছু সামাজিক কারণেও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়তে থাকে, সেগুলো হচ্ছে :
ক. পারিবারিক :
যেসব পিতা-মাতা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে এবং সন্তানের পেছনে সময় দিতে পারে না তাদের সন্তান পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে গড়ে ওঠে। তাদের অনুপস্থিতিতে সন্তান অনেক সময় অবাঞ্ছিত অভ্যাস ও আচরণ রপ্ত করে। তাছাড়া বহুদিন যাবৎ যদি পিতা-মাতার মধ্যে মনোমালিন্য বা ব্যক্তিত্বের সংঘাত চলে আসে তাহলে সন্তান-সন্ততির মধ্যে হতাশা ও উদ্দেশ্যহীনতা সৃষ্টি হয় । এর ফলে সন্তান মাদকাসক্তিসহ সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে থাকে।
খ. প্রেমে ব্যর্থতা :
প্রেমে ব্যর্থতার কারণে কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে অনেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং অভিমানে মাদকদ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ প্রতিশোধ হিসেবে খুন, এসিড নিক্ষেপ ও ধর্ষণ করতেও দ্বিধা করে না ।
গ. সঙ্গদোষ :
মানুষ সামাজিক জীব। সবাই মিলেমিশে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়। ফলে পরিবারের বাইরে মিশতে গিয়ে খারাপ সঙ্গে মিশে অনেকেই খারাপ হয়ে যায়।
ঘ. অনুকরণ :
মানুষ অনুকরণপ্রিয়। কেউ কোনো কিছু করলে অন্যদের সেটা করার ইচ্ছা প্রবণতা জাগে । বিশেষ করে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের অনেকেই অশ্লীল পত্রিকা, সিনেমা দেখে বা গল্প শুনে অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে। অনেকে মাদকদ্রব্য সেবন একটি বাহাদুরিমূলক ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করে অবাধে তার ব্যবহার করছে।
৯. চলচ্চিত্র ও স্যাটেলাইট চ্যানেল :
চলচ্চিত্রের অশ্লীল নাচ, গান, সংলাপ আর অতি নিম্নমানের কাহিনীতে এ দেশের যুবসমাজ ক্রমান্বয়ে বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ডিশ এন্টেনার প্রভাবে বিদেশী সংস্কৃতির নামে যে অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে ভূতের মতো চেপে বসেছে তার কুফল ইতোমধ্যেই অনুমান করা যাচ্ছে ।
১০. সেশনজট :
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পেছনে পরোক্ষভাবে যে কারণটি চিহ্নিত করা যায় তা হলো সেশনজট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের শিকার আজ হাজার হাজার ছাত্র। নির্দিষ্ট সময়ের কোর্স শেষ করতে দ্বিগুণ সময় লাগায় অনেকেই দুশ্চিন্তা আর বিষণ্নতায় ভোগে এবং অনেক দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এই দীর্ঘ সময়ের শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে অপারগ হয়ে পড়ে। একদিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অন্যদিকে আর্থিক দুশ্চিন্তা দুয়ে মিলে তারা বিষণ্নতার চরম সীমায় পৌঁছে যায় এবং এর ফলে এক পর্যায়ে তারা বিভিন্ন সমাজবিরোধী কার্যকলাপে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জড়িয়ে পড়ে।
১১. ভৌগোলিক কারণ :
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্থানগত ও আবহাওয়াগত বিষয়, খাদ্যাভাস ইত্যাদি কারণও মানুষের মধ্যে বিরাট প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে মানুষ সামাজিক মূল্যবোধগর্হিত কাজ করে থাকে। অবক্ষয় রোধে পদক্ষেপ : আমাদের জাতীয় জীবনে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় জাতীয় সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে এ সমস্যার প্রতিকার খুবই জরুরি। নিচে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কিছু প্রতিকার সম্পর্কে আলোচিত হলো :
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিকার:
১. দারিদ্র্য বিমোচন:
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর যথেষ্ট নজর দিতে হবে। সহায়-সম্বলহীন লোকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বেকারদের বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ঋণ দিয়ে উৎপাদনমুখী কাজে নিয়োগ করতে হবে।
২. গ্রাম উন্নয়ন :
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে গ্রামই প্রাণ। গ্রামই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করছে। তাই সরকারকে গ্রাম উন্নয়ন তথা কৃষি সেক্টরের দিকে অধিক নজর দিতে হবে। কৃষি কাজে জড়িত ব্যক্তিদের যারা ইতিমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন বিবেকবর্জিত কাজে জড়িত হয়ে পড়েছে তাদেরকে স্বাবলম্বী করতে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে।
৩. জনসংখ্যা হ্রাস :
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধকল্পে সরকারকে আরো সজাগ ও কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে। জনসংখ্যা যদি বর্তমান হারে বাড়তেই থাকে, তবে সামাজিক অবক্ষয়ও বাড়তে থাকবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে দেশের জন্য প্রণীত পরিকল্পনাও ব্যর্থ হবে। তাই মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ অতি জরুরি।
৪. বেকারত্ব হ্রাস :
যেহেতু অধিকাংশ অপরাধ বেকাররাই ঘটিয়ে থাকে, তাই এদের কর্মের সুযোগ-সুবিধ সৃষ্টি করলে সামাজিক অবক্ষয়ও বহুলাংশে হ্রাস পাবে। বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানে প্রেরণা যোগাতে হবে। তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থান ব্যাংকের শাখা ও মূলধন বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি ঋণ গ্রহণের শর্ত আরো শিথিল করতে হবে।
৫. রাজনৈতিক অঙ্গীকার :
যে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা স্থানীয় নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যুবশক্তিকে পেশীশক্তির কাজে ব্যবহার করবে না এই মর্মে আন্তরিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে । প্রয়োজনে নেতৃবৃন্দের আলোচনায় বসে বিষয়টি সুরাহা করতে হবে।
৬. শিক্ষার প্রসার:
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষিত জাতি একটা দেশের শক্তি। আধুনিক জীবন যাপনের অন্যতম শর্ত হলো শিক্ষা। অশিক্ষা অন্ধকারের শামিল। তাই মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কেননা সামাজিক, রাজনৈতিক, নাগরিক ও ধর্মীয় কর্তব্যবোধ সম্পর্কে যতই উপদেশ বা বাণী শোনানো হোক না কেন তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলা হবে।
৭. সম্পদের সুষম বণ্টন :
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় সম্পদ বণ্টনে যে বিশাল বৈষম্য রয়েছে তা দূর করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে নতুন নীতি প্রণয়ন করতে হবে। সবার সম্পদের হিসাব নিতে হবে এবং আয়ের উৎসের সাথে সম্পদ বৃদ্ধির সামঞ্জস্য কতটুকু তার একটা জরিপ চালিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮. সংস্কৃতির অবাধ প্রসার রোধ :
বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। সংস্কৃতি তথা বিনোদনের নামে স্যাটেলাইটের কিছু চ্যানেল আমাদের যুবসমাজ থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত সবার মধ্যে যৌন উদ্দীপনা তথা বিকৃতির সৃষ্টি করছে, যার ফলে বেড়ে যাচ্ছে ধর্ষণসহ মারাত্মক সামাজিক অপরাধসমূহ। এক হিসাবে জানা গেছে, ডিশ এন্টেনা আমদানির পর ধর্ষণের পরিমাণ আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে গেছে। তাই নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষামূলক এবং সপরিবারে দেখার মতো চ্যানেল রেখে বাকি চ্যানেল বন্ধের ব্যাপারে সরকারকে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।
৯. পারিবারিক কর্তব্যবোধ :
পিতা-মাতাকে সন্তান-সন্ততির ব্যাপারে আরো বেশি খেয়াল রাখতে হবে। সন্তান-সন্ততি যেন পাড়া বা মহল্লার বখাটে ছেলেমেয়েদের সাথে না মেশে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অর্থাৎ সন্তানদের গতিবিধির ওপর পিতা-মাতার কড়া নজর রাখতে হবে।
১০. সেশনজট নিরসন :
শিক্ষা ক্ষেত্রে সেশনজট নিরসন করতে হবে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সকল পরীক্ষা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রেজাল্ট দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের বাধ্য করতে হবে।
১১. ধর্মীয় বোধ জাগ্রত :
মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বোধ জাগ্রত করতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে । কেননা ধর্মীয় অনুভূতি মানুষের বিবেকের রক্ষাকবচ ।
উপসংহার :
আমাদের সামনে আজ একুশ শতকের পথচলা। নতুন শতকে আমাদের জীবন যেন সুন্দর ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সেজন্য সবার আগে নজর দিতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। শিক্ষার্থীদের সামনে রাখা চাই নৈতিক মূল্যবোধের আদর্শ। সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতি জাগাতে হবে তাদের ভালোবাসা। নৈতিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এখন আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন, উদ্যোগী ও সক্রিয়। এর জন্য প্রয়োজনে গড়ে তুলতে হবে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন । তা না হলে নৈতিক অধোগতির যে পিছুটান আমাদের জাপটে ধরেছে তার হাত থেকে আমরা নিস্তার পাব না ।
আরও দেখুন: